Mom is everything for life

0 6
Avatar for Nipa1234
3 years ago

তিতলি? তিতলি?

মায়ের গলার স্বর শুনতে পাই আমি আমার ঘর হতে । দুর্বল কন্ঠে চিৎকার করে ডাকছেন মা তিতলিকে । মায়ের জ্বর। জ্বর হলে মায়ের মাথাব্যথা করে। মা তখন বিছানায় শুয়ে কাতর স্বরে বকেন।

তিতলি? আবার ডাকেন মা। আমি বের হই ঘর হতে। তিতলিটা যে কই গেছে! দৌড়ে মায়ের ঘরের দরজায় যাই।

মা, ডাকছেন কেন? তিতলি বাড়িতে নেই।

কই গেছে নবাবজাদী? সারাদিন টো টো করে ঘুড়ে বেড়ায়। বিয়ে দিলে দু বাচ্চার মা হতো! আসুক আজ।

মা, আপনি ওকে এত বকেন কেন? ছোট মানুষ।

ছোট মানুষ! আসতে দে।

কি আম্মা? কোথা হতে যেন দৌড়ে এলো তিতলি। ডাকেন কেন?

কই গেসলি?

নিসুদের বাড়িতে। দুটো আলু নিতে। ভাতে দিয়ে সিদ্ধ করে ভর্তা করবো।

ভাত পরে রান্না করিস। জাউভাত রান্না করে তোর ভাইকে দে। পাতলা পায়খানা, জাউভাত খেলে আরাম হবে একটু।

না মা লাগবে না। ওষুধ খেয়েছি তো। ঠিক হয়ে যাবো।

মায়ের জ্বর , তা নিয়ে কোন চিন্তা মায়ের নেই। আমার খাওয়ার একটু কম বেশি হলেই পেটে সমস্যা হয়। ঘন ঘন বাইরে ছুটতে হয় তখন। আজ বেশ কবার যেতে হয়েছে । এটা আমার জন্য স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে এসেছে, তবু মা চিন্তা করছেন আমাকে নিয়ে । অদ্ভুতুড়ে হন মায়েরা। সত্যিই অদ্ভুত!

তিতলি রান্নাঘরে। জাউভাত রান্না করছে। আমি মায়ের কপালে হাত দিয়ে বসে থাকি। মা ছেলে দুজনেই নিরব থাকি বেশ কিছু সময় । নিরবতা ভাঙেন মা।

আসু?

হ্যা মা বলেন।

তিতলিটা বড় হলো । বিয়ে দিতে হয়। সেদিন নাদিয়ার মা বললো একটা ভালো ছেলে আছে। তুই কি বলিস?

মা, তিতলি এখনো এসএসসি দেয় নাই। এসএসসি টা দিক। আর এর আগে কি ঘটেছিল মনে নেই আপনার?

মা আর কথা বলেন না। নিরব হয়ে শুয়ে থাকেন। মেয়ে একটু বড় হলেই মায়েদের মেয়েকে নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। বাবা বেঁচে নেই। আমিও বেকার। তাই তিতলিকে নিয়ে মাকে বেশিই ভাবতে হয়। মা এখন সেদিনের ঘটনা নিয়ে ভাবছেন। মা হয়তো ক্ষনিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন, আমি মনে করিয়ে দিয়েছি। মাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে।

নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে যা হয়! তিতলিকে দেখতে এসেছিল এক ছেলে, তার বাবা মা সহ। ছেলের বয়স সাতাশ- ত্রিশ এর মধ্যে হবে। তিতলির তের। এদেশের স্বপ্নবাজ ত্রিশ বছরের অবিবাহিত পুরুষরা স্বপ্ন দেখে তের হতে আঠারো বছর বয়েসী মেয়ে বিয়ে করার! তিতলি দেখতে পরীর মতো। পরীর মতো মেয়ে, বয়স একেবারে অল্প, ছেলে পছন্দ করে ফেলেছে দেখেই। বিয়ে সে এখানেই করবে।

আমি মায়ের সাথে রাগারাগি করে তখন বন্ধুর বাড়িতে। তিতলির বিয়েতে মত নেই। অতটুকু মেয়ের বিয়ে দিতে দিবো না । ওকে পড়ানোর ইচ্ছে আমার।আর মা চাচ্ছে ছেলে ভালো! এ পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হইবে না!

ছেলে প্রার্থমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলের বয়স, ছেলেটা কেমন এসব কোনো বিষয় না, ছেলে সরকারী চাকরি করে এটাই হলো বড় কথা!

শেষ পর্যন্ত আমি ছাড়াও বাধ সাধলো ছেলের বাবা। ছেলের বাবার কথা ছেলেকে পাড়ালেখা শিখিয়েছেন, অনেক টাকা খরচা করে । মেয়ে বাড়ি হতে তিনি এর কিছুটা উশুল করবেন।

কথাটা নিজ মুখে না বললেও, বললেন ঘটকের মাধ্যমে । আলাপে ঘটক মায়ের কাছে কথাটা বললো, ছেলের বাপের দাবি দাওয়া তেমন কিছু নাই। তাদের শুধু একটা দাবি, ছেলেকে কষ্ট করে পড়িয়েছেন। অনকে খরচ করেছেন। আপনার মেয়েরই তো সব হবে। আপনাদের শুধু লাখ সাতেক টাকা দিতে হবে।

সাত লাখ টাকা? এতটাকা?

আরো মেয়েপক্ষ আছে । যারা দশ বারো লাখ টাকা দিতে রেডি হয়ে আছে। কিন্তু তারা তেমাদের মেয়েকে পছন্দ করেছে । তাই একটু কমিয়েই চাচ্ছে তারা । আর মেয়ে জন্ম দিছেন , টাকা তো দিতেই হবে!

মা আর কথা বাড়ান নি। অতোটাকা দেবার সাধ্য মায়ের নেই। মেয়ে জন্ম দিয়েই টাকার গাছ লাগাতে হতো, মা সম্ভবত তিতলিকে জন্ম দেবার সময় উপলব্ধি করেন নি। যদি হতো, তাহলে জন্ম হওয়া মাত্রই তিতলির গলা চেপে মেরে ফেলতেন! বিয়েটা না হওয়ায় কেন যেন মা, আমার মৃর্ত বাবার প্রতি ভীষন ক্ষুব্ধ হলেন। আর সেই ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করলেন তিতলির উপর।

ঘটককে যেদিন মা বললেন, অতো টাকা দেবার সাধ্য তার নেই, তার দুদিন পর মা কোনো কারনে তিতলির প্রতি ভিষন ক্ষিপ্ত হয়ে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। বললেন,

কত মেয়েই তো প্রেম করি ভাগি যায়, তুই যেতে পারিস না? তোর বাপে মরে গিয়ে আমাকে আযাবের মধ্যে রাখি গেইছে!

তিতলি চুপ করে গিয়েছিল কথাটা শোনার পর। আমি শুধু বলেছি, ছিঃ মা, কি সব বলেন!

এর পরের ঘটনা ভয়াবহ।

গোয়ালঘরে ধস্তাধস্তি'র শব্দ। সেই সাথে তিতলির চিৎকার, ভাইয়া, মা গলায় দড়ি দিচ্ছে... ভাইয়া, ওয় ভাইয়া!

ছুটে গোয়ালঘরে যাই। একটা গরুর দড়ি উপরে লটকানো। মা দড়িটা ফাঁসের মতো করে গলায় দিতে চেষ্টা করছেন। তিতলি জোর করে মাকে নিবৃত করার চেষ্টা করছে । কিন্তু পারছে না।

ছাড় বলছি। ছেড়ে দে। মা মেয়ে মরে যাই এক সাথে।

মা, মা...! মাকে ঝাপটে ধরে কেঁদে উঠলো তিতলি।

আমি ছুটে যাই। মায়ের হাত হতে দড়িটা জোর করে কেড়ে নেই। তার পর হাত ধরে টেনে ঘর হতে বের করে নিয়ে আসি । মা চুপ করে থাকেন। তিতলির কাঁন্না বেড়ে যায়। সে চোখ মুখ চোখের জলে ভিজিয়ে ফেলে।

এসব কি শুরু করলেন মা? মাকে জিজ্ঞেস করি ।

কি করেছি?

গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিলেন কেন?

আমি না, তোর বোন গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল । ভাগ্যিস দেখেছি । তো মরলে ও একা মরবে কেন? আমিও মরি । মরলে তোদের আযাব হতে বেঁচে যাই।

কি হয়েছে তিতলি?

তিতলি চুপ করে থাকে । কথা বলে না । আমি বিরক্ত হই। চিৎকার করে উঠি, কি হলো, কথা বলিস না কেন?

আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরতে চেয়েছিলাম। তিতলি বললো ।

কেন মরবি কেন?

তোমাদের সাত লাখ টাকা বাঁচানোর জন্য।

ঠাস করে একটা শব্দ হলো, দেখলাম আমার পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ ওর গালে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে । বললাম, আর কখনো যদি বলিস এমন কথা, আমিই তোকে মেরে ফেলবো!

ঘটনা বলতে, তিতলি মায়ের উপর রাগ করে গলায় দড়ি দিতে চেয়েছিল। এজন্য দড়ি বেধে যে মহুর্তে ফাঁস দিবে, মা দেখে ফেলেন। মা ছুটে যান। কিন্তু ওকে কিছু না বলে আর একটা দড়ি বেধে নিজের ফাঁস দেয়ার বন্দবস্ত করেন। তিতলি নিজের গলায় দড়ি দিবে কি, বিষ্মিত হতবুদ্ধি হয়ে মায়ের কার্যকলাপ যখন বুঝতে পারলো, মা কি করতে চাচ্ছেন, তখনই মাকে জাপটে ধরে আমাকে ডাকা শুরু করেছিল।

সেদিন সন্ধায় সেই তিতলি আমার ঘরে এসেছিল। আমি ঘরে থাকলে সে সচারচর আমার ঘরে আসে না । কিন্তু যতক্ষন বাইরে থাকি, আমার ঘর ওর দখলে।

কিছু বলবি?

ভাইয়া পাঁচশ টাকা দিবি?

কি করবি?

ঢাকা যাবো। গার্মেন্টস এ চাকরি করবো।

শুয়ে ছিলাম। চমকে উঠে বসলাম। তিতলির চোখে জল। ওকে টেনে নিয়ে জরিয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম অবুঝ শিশুর মতো।

পাগলি কি বলিস এসব?

দেখিস না ভাইয়া, আমাদের কত কষ্ট যাচ্ছে । টাকা থাকলে এসব হতো না!

তোকে গার্মেন্টস এ চাকরির বুদ্ধিটা কে দিল?

কে দিবে আর? দেখো না নার্গিসদের অবস্থা। নার্গিস ঢাকায় গিয়ে মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে, ওরা দিব্যি খেয়ে পরে বেঁচে আছে। আমিও পাঠাবো। তখন আমাদের এত কষ্ট থাকবে না।

শোন এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই পড়ালেখা কর ভালো করে।

এসব বছর দুই আগের কথা । এর পর আর মা তিতলির বিবাহ নিয়ে কোনো কথা বলেন নি । হঠাৎ উপলব্ধি হলো আমার, মায়ের শরীর তাপে পুড়ে যাচ্ছে । প্রচন্ড জ্বর এসেছে ।

তিতলি? ডাক দেই আমি।

কি ভাই? ছুটে আসে তিতলি ।

পানি আর গামছা নিয়ে আয় তো। ভিজিয়ে মায়ের শরীরটা মুছে দে । জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

মা আবোল তাবোল বকতেছেন। তিতলি মায়ের শরীর মুছে দিচ্ছেন। অল্প সময়ের মধ্যে মায়ের জ্বর কমে এলো ।

মা ডাক্তার ডাকি? জানতে চাই আমি।

না, লাগবে না। এমনিতেই সেড়ে যাবে । জাউভাত হয়েছে?

হ্যা মা। বলে তিতলি।

তাহলে তোর ভাইকে খেতে দে।

সন্ধায় তিতলি আমার ঘরে এলো। ওর গা ভর্তি গহনা। দেখে বিষ্মিত হলাম। ভিষন খুশি লাগছে ওকে। আরো বেশি সুন্দর লাগছে। বললাম, এসব তোকে কে দিল?

মা।

মা কোথায় পেলেন।

মায়ের বিয়ের সময় নানা দিয়েছিলেন। মা আমাকে বের করে পরতে বললো । বললো, বিয়ের সময় যেন এগুলো পড়ি!

এত গহনা ছিল, অথচ একদিনও মাকে এসব পড়তে দেখি নি! আমরা কেউই দেখিনি পর্যন্ত। আজ হঠাৎ সেসব বের করে তিতলিকে পরতে দিলেন! কেন? অস্থির হয়ে উঠলো আমার মন। ঠিক কি কারনে বুঝে উঠতে পারলাম না।

রাতে খাওয়ার পর মা আমাকে ডাকলেন, বললেন, তিতলিকে পড়াস। বাক্সে যে চাল রাখার ড্রাম আছে তার নিছে লাখের মতো টাকা জমা আছে।

এসব বলছেন কেন মা।

যদি আমার কিছু হয়।

কিছু হবে না।

তাহলে ঘুমাতে যা।

আজ আপনার সাথে ঘুমাই।

না। তুই তোর ঘরে যা।

সকালে তিতলির চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। তিতলি কান্না করছে। বাড়িতে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে । আমি যখন বুঝতে পারলাম, কি ঘটেছে, তখন মনে হলো এতো বড় আঘাত কখনো পাই নি। মা আর বেঁচে নেই।

এর পর কেটে গেছে অনেক বছর। দুই ভাই বোন এসে দাড়িয়েছি মা বাবার কবরের সামনে। তিতলির চোখে পানি।

ভাইয়া , মা আমাদের খুব ভালোবাসতো তাই না রে।

হুম।

তাহলে বকতো কেন?

কি জানি।

আমরা যেন বুঝতে না পারি উনি আমাদের জন্য চিন্তা করছেন, সারাক্ষন ভাবছেন আমাদের ভবিষ্যৎ। এজন্যই বকতেন।

মায়েরা এমন কেন হন রে?

জানি না। ভাইয়া আমার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে ইট আনাবো ।

কেন?

মা বাবার কবরদুটো বেধে দিবো।

আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। যা আমার করার কথা ছিল, সেটা তিতলি করতে চাচ্ছে। কিন্তু ভালো লাগছে ভিষন। তিতলির চাকরি হয়েছে। সরকারী চাকরি।সে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।

মায়ের কবরের সামনে দাড়িয়ে মনে পড়লো অনেক বছর আগের ঘটনাটা । ছেলের বাবার দাবি ছিল, ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন অনেক টাকা খরচ করে। সেই জন্য সাত লাখ টাকা দিতে হবে!

তিতলির জন্য অনেক সমন্ধ আসছে। আমি মেয়ের ভাই। আমি কি বলবো? বোনকে পড়ালেখা করাতে অনেক খরচ করেছি! বিয়ের পর তো সে আপনাদের বাড়ির সদস্য হবে! তাই সাত লাখ টাকা দিন! বেখাপ্পা শোনাবে কথাটা । লোকে শুনলে হাঁসবে। কিন্তু উল্টো ব্যাপারটায় কেউ হাসবে না। ছেলেরা যৌতুক নিবে! আর মেয়েরা মরে যায়, তবুও তাদের দেনমোহর এর টাকাটা হাতে পায় না! অদ্ভুতুড়ে এই ঘুনে ধরা সমাজ।

তিতলি,

1
$ 0.02
$ 0.02 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments