মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে আপনি যে জাদুর চর্চা করেন তা অনেকটা ভালো আর খারাপের মাঝামাঝি? তাইতো?
মামা বললেন, হ্যাঁ, তবে যেহেতু ভালো কাজ করার নিয়তে জাদু চর্চা করে থাকি, নিজের স্বার্থ মেটানোর উদ্দেশ্যে না, তাই আমার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা আমার ওপর নাখোশ হবেন না। যদিও সেটা একান্তই তার মর্জি!
– মামা, আপনি কি করে ও কেন এই জগতে পা রেখেছিলেন?
– তোর মামীকে এক দরবেশ জাদু করে পাগল বানিয়ে দেয়, সে এক লম্বা কাহিনী, তারপর থেকেই আমার এই জাদু শেখা ও কবিরাজি জীবন। থাক সেসব, আমরা আসল কথায় আসি।
তিনি এরপরে মিশকাতকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি বুঝতে পারবি যে কখন শয়তান জাদুকরটা ঘুমোতে যাবে?
মিশকাত বললো,
হ্যাঁ, ঠিক সূর্য উঠে যাবার পরপরই।
মামার বউ মানে মামীর কথা চিন্তা করে খুব খারাপ লাগছিল। তবে ঠিকই সময় করে মামার কাছ থেকে মামীর ঘটনা জেনে নেবো ভেবে আর কথা আগালাম না।
(তোমরা যদি গল্পে কবিরাজ রহিম মন্ডলের স্ত্রীর ঘটনাটুকু জানতে আগ্রহী থাকো, কিভাবে দরবেশ জাদু করে ও পাগল বানিয়ে দেয় – তবে কমেন্টে আগ্রহের কথা জানাও, জানানোর চেষ্টা থাকবে আমার পক্ষ থেকে)
–
সূর্য উঠতে শুরু করেছে কেবল, এমন সময় মিশকাত তার পাশে বসা সেহেলকে বললো, সেহেল তুই জাদুকরকে স্বপ্ন দেখাতে পারিস এখন। সেহেল উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, ও চলে গেল কেন? ও কি তবে জাদুকরের কাছে গিয়ে স্বপ্ন দেখাবে?
মামা বললেন, না রে পাগলী, তা নয়। স্বপ্ন দেখানোর ব্যাপারটা অনেকটা ধ্যানের মতন। এর সাথে জাদুও জড়িত, এর জন্য সে নির্জন স্থানে গিয়েছে যেখানে গেলে সে দূর থেকে ধ্যানের মাধ্যমেই স্বপ্ন দেখাতে পারবে।
প্রায় মিনিট বিশেক পরে সেহেল ফিরে এসে জানায়, যা করবার তা করা হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায়। এই কষ্টিপাথরই ওকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে বাধ্য করবে।
রহিম মামা সেহেল ও মিশকাত দুজনকেই চলে যেতে বললেন। ওরা মানুষ রূপে যেভাবে এসেছিল, অমনি আবার চলে গেল। আমি ওদের চলে যাবার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম, আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি, সারাজীবন যে জ্বীনের গল্প শুনে এলাম, সেই জ্বীন আজ আমার সামনে কথা বললো, আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেল!
– এই সুমা, কিরে কি ভাবছিস? চল ঘুমোতে যাই এখন। মামা আর সাইফুল মিলে ব্যাপারটাকে দেখবে।
রত্নার কথায় ঘোর ভাঙলে বললাম, তুই আমাকে বাড়িতে দিয়ে আই, যদি জাদুকরের সন্ধান মেলে তবে আমাকে আবার নিয়ে আসিস দয়া করে।
ও বললো, আরে থেকে যা, গিয়ে কি হবে। মেয়েদেরকে নিয়ে ভয় নেই, একটা ফোন দিয়ে দেখ সব ঠিক আছে কিনা।
রত্নার কথায় আমি বাড়িতে ফোন দিলাম। সব ঠিকঠাক আছে জেনে রত্নার সাথে ঘুমোতে গেলাম, রত্নাই মূলত আমাকে ওর সাথে ঘুমোতে বললো, কারণ, এই সময় যখন তখন আমার ওপর শয়তানি আক্রমণ আসতে পারে নাকি, যদিও বাড়ি বন্ধ করা আছে, তারপরেও একা থাকাটা উচিত নয়।
–
এক ঘুমে দুপুর দুইটা, রত্না আমাকে ডাকছে। দুপুরের খাবার খেতে। ওর ডাকে আমি হুড়মুড় করে জেগে উঠি।
– কিরে খারাপ স্বপ্ন দেখছিলি নাকি?
– মনে হয়, সেরকম কিছুই, তুই এখুনি আমার বাড়িতে একটা ফোন লাগা না?
– আরে ভয় পাস নে, রহিম মামা তোদের বাড়িতেই গিয়েছেন একবার দেখে আসতে।
– তাহলে কি আমরা দুজন বাড়িতে একা?
– আরে না পাগলী, সাইফুল আছে না?
হুইলচেয়ারে উঠে বসলাম, রত্না আমাকে সাহায্য করলো। হাত মুখ ধুঁতেও সাহায্য করলো।
ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি সাইফুল ভাই এরই মধ্যে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন। রত্না বললো, তোরা দুজন খেয়ে নে, আমি রহিম মামা এলেই খাবো।
গতকাল থেকে একবারের জন্যও সাইফুল ভাইয়ের সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। খাবার খেতে খেতে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি সাইফুল ভাই, জাদুবিদ্যায় হাত পাকাচ্ছেন মনে হচ্ছে?
– হ্যাঁ, সেরকমই, আসলে জাদুবিদ্যার প্রতি আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই বেশ আগ্রহ। আর মামা যেহেতু কবিরাজি করেন, মনে হলো কিছু জিনিস শিখে রাখা মন্দ না, যদিও জাদুবিদ্যার যত গভীরে যাওয়া হয়, শয়তানী শক্তির লোভ যেন মনের কোণে উঁকি মারতে থাকে। অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
– তো এখন পর্যন্ত কি কি শিখলেন?
– অনেক কিছুই; বলে শেষ হবেনা – বলে হাসলেন।
পাশে বসা রত্নাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে তুইও নাকি শিখবি? তো কি শেখার ইচ্ছা তোর?
রত্না হাসতে হাসতে বললো, যদি কোনোদিন সম্ভব হয় অবশ্যই শিখবো, আমার ইচ্ছের কথা শুনলে তুই হাসবি রে সুমা।
– আরে নাহ বলতো আগে।
– আমি চাইবো আমার এই সৌন্দর্য যেন চির-অটুট থাকে। জীবনে যেন কোনোদিন বুড়ি না হই।
রত্নার কথা শুনে আমি আর সাইফুল ভাই দুজনই হেসে উঠলাম, এরই মধ্যে রহিম মামা হাজির, আমি উনার দিকে তাকাতেই বললেন, তোমাদের বাড়িতে সকলেই ভালো আছেন, তোমার দুই মেয়ে আসতে চাচ্ছিলো কিন্তু আমি নিয়ে আসিনি।
বললাম, ভালোই করেছেন মামা! ওরা সবাই বাড়িতে নিরাপদ থাকলেই হলো।
মামা খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললেন, খবর তো একটা পেলাম একটু আগে। সেহেল বললো, শয়তান জাদুকরটা এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। খুব বেশি দেরী নেই যে ও আমার সামনে বসে আমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে, তারপর সবকটা কে দেখে ছাড়বো!
আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ! তাই যেন হয়। তুমি রক্ষা করো আমাকে।
– আচ্ছা মামা, জাদুকর এলে কি করা হবে? মানে আপনি কি করবেন? ওর কাছে থাকা আমার শাশুড়ির কংকাল দিয়ে ওকে উলটা বান মারার কথা বলেছিলেন?
– হ্যাঁ, কিন্তু যেহেতু ও নিজের থেকেই আমাদের কাছে আসছে বা আসবে, সেহেতু এখানে ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হতে পারে কিংবা করা হবে।
পাশ থেকে সাইফুল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, সেটা আবার কেমন মামা?
মামা বাটি থেকে মাছ ভর্তা তুলে নিতে নিতে সাইফুল ভাইকে বললেন,
– জাদুকর এলে ওকে বলবো জাদু তুলে নিতে। ও যদি জাদু তুলে নেয়, তবে আর ওকে উলটা বান মারা লাগবেনা।
– কিন্তু এই জাদু তো আরো চৌদ্দ বছরের পুরোনো জাদু। সৌর চক্র অনুযায়ী তা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে, এখন কি আর এই জাদু তুলে নেওয়া সম্ভব হবে?
– তাও ঠিক, কিন্তু এখানে এটা দেখতে হবে যে সে কোন সৌর চক্র ব্যবহার করেছে। এটাও তো হতে পারে সে চন্দ্র-চক্র ব্যবহার করেছে?
– তবে কি আমাদের গণণা ভুল হতে পারে?
– না, আমাদের গণণা ভুল হতে পারেনা, যেটা হতে পারে সেটা হলো, জাদুকর তার মায়াজাল দিয়ে জাদুর মূল উৎসকে প্রতিরক্ষা করে রেখেছে যাতে করে আমরা জাদুটাকে না ধরতে পারি। যাইহোক, তোমার তো কদিনেই বেশ উন্নতি হয়েছে – রহিম মামা সাইফুল ভাইকে বললেন।
সাইফুল ভাই মামার কথায় বেশ খুশি হলেন সেটা বোঝা গেল। কিন্তু এসব চক্র-ফক্র মাথায় ঢুকলো না বিধায় মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা এসব চক্র দ্বারা কি হয়?
– জাদুকর আসুক, তখন নিজের চোখেই সব দেখতে পারবি মা, আরেকটু অপেক্ষা কর।
–
সন্ধ্যে ৭টা বাজে।
মামা ধ্যানে বসে মিশকাত ও সেহেলের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
আমরা মামার সামনে বসে আছি। খুব নাটকীয় একটা দৃশ্য তৈরী হয় তখন। মামা হুট করে চোখ খুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও এসেছে, ও এসে পড়েছে, এক সিঁড়ি, দুই সিঁড়ি, দরজার সামনে…
অমনি দরজায় দুম দুম করে আওয়াজ। আমার ভেতরটা যেন কেঁপে উঠলো, শরীর কাপঁছে, অজানা ভয়ে। মামা নিজের থেকে উঠে গেলেন, সাইফুল ভাইও যেতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু বললেন, না, তুমি এসোনা, তুমি ওদেরকে দেখে রাখো, ও এসেই যে হামলা চালাবেনা তার কি নিশ্চয়তা?
মামা, তার হাতের মুঠোয় চাল আর দূর্বা ঘাস নিয়ে দরজা বরাবর এগোতে লাগলেন। দরজা খুলেই মামা মুঠোয় থাকা চাল আর দূর্বা ঘাস জাদুকরের শরীর বরাবর ছিটিয়ে দিলে জাদুকর হো হো করে হেসে উঠে।
জাদুকর মামার শরীর বরাবর থকথকে রক্ত জাতীয় কিছু ছুড়ে মারলে মামা মেঝেতে পড়ে যান। সাইফুল ভাই মামা বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
বুঝতে পারছিলাম খুব ভালো কিছু হচ্ছেনা, জাদুকর হয়তো মামাকে আঘাত করেছে কোনভাবে। আরো শক্তিশালী কোনো কিছুর আঘাত যা মামা সইতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গিয়েছেন।
জাদুকর আমাদের দিকে অগ্রসর হতে লাগলে সাইফুল ভাই জোরে শ্বাস নিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করেন। জাদুকর খুব কাছেই চলে এসেছে, সে আমাদের দিকেও সেই রক্ত জাতীয় পদার্থ ছুড়ে মারবে ঠিক এমন সময় সাইফুল ভাই বোতল থেকে কিছু একটা জাদুকরের মুখ বরাবর ছুড়ে মারলে সে প্রচন্ড যন্ত্রণায় মেঝেতে পড়ে যায় ও কাতরাতে থাকে।
রত্না তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, কি করলে তুমি? কোনো জবাব না দিয়ে সে রত্নাকে ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করতে বলে। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, জাদুকরের মুখ ঝলসে যাচ্ছে। সাইফুল ভাই আমাকে বললেন, আমি ওর মুখে এসিড ছুঁড়েছি, এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা আমার কাছে। তুমি মামাকে গিয়ে সাহায্য করো, আমি জাদুকর ব্যাটাকে সামলাচ্ছি!
মামার কাছে যেতেই দেখি মামা চোখ উলটে মেঝেতে পড়ে আছেন, আমি প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠি!!
--
আমার কাছে কেন জানি মনে হতে লাগলো যে রহিম মামা মরে গিয়েছেন। চোখ উলটে এভাবে পড়ে থাকাটা ভালো কিছুর সংকেত দেয়না। মূলত মানুষ মরে গেলেই এভাবে চোখ উলটে পড়ে থাকে। যদিও মনে হচ্ছিলো যে মামার শ্বাস প্রশ্বাস তখনো চলছিল।
আমার চিৎকারে রত্না আর সাইফুল ভাই দুজনই আমার দিকে ছুটে আসছিল কিন্তু সাইফুল ভাই রত্নাকে বললো, তুমি শয়তানটার যেখানে যেখানে এসিড লেগেছে সেসব স্থানে ভালো করে ঠান্ডা পানি ঢালো। সাইফুল ভাইয়ের হাতে শয়তানের হাতে থাকা বোতলটাকে দেখলাম, উনি আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন, বসেই মামার চোখ টেনে ভালো করে দেখলেন, মামার চোখের নিচের পাশটা কালো হয়ে যাওয়া দেখে বেশ অবাক হলাম। সাইফুল ভাই বললেন,
– ঠিক যেটা ভেবেছিলাম, সেটাই হয়েছে!
– কি হয়েছে সাইফুল ভাই? শুধু বলেন যে মামা মরেননি!
– না, মামা মরেননি। তুমি এক কাজ করো মামার মাথাটা সোজা করে ধরে রাখো। আমি এক দৌঁড়ে ঘর থেকে আসছি।
সাইফুল ভাইয়ের কথা শুনে আমি যেন আমার অন্তরে প্রাণ ফিরে পেলাম! উনার কথা মতন আমি মামার মাথাটাকে যতসম্ভব সোজা করে রাখলাম। মনে
সাইফুল দ্রুত ঘর থেকে ফিরে এলেন। একটা মোটা দড়ি দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরানো শয়তানের হাত দুটো বেঁধে টয়লেট পর্যন্ত দিয়ে এলেন আর রত্নাকে বললেন শাওয়ারের ঠান্ডা পানি গাল আর ঘাড় বরারবর ছেড়ে রাখতে।
সাইফুল ভাই আবার আমার পাশে এসে বসলেন, আমি বললাম,
– সাইফুল ভাই, শয়তানটাকে কি জ্বীনেরা সুস্থ করতে পারবেনা?
– মানে তুমি কি সেহেল আর মিশকাতের কথা বলছো?
– হুম!
– জানিনা ওরা শয়তানকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে কিনা, যদিও মনে হয়না সেটার দরকার আছে, ওর গালে আর ঘাড়ে এসিড লেগেছে! পানি ঢাললে ঠিক হয়ে যাবে, ব্যাটা মরবেনা – বলে তিনি একটা ছোট্ট শিশি দেখালেন আমাকে। দেখিয়ে বললেন, এটা দিয়ে যদি মামাকে কোনোভাবে সুস্থ করা যায়! দেখা যাক! এটা উনার নাকে দেয়ার কিছু সময়ের মধ্যে যদি উনার নাক দিয়ে পানি না বের হয় তবে বুঝতে হবে তিনি হয়তো মৃত্যুর দিকে ঢেলে পড়ছেন!
সাইফুল ভাইয়ের কথা শুনে আমার হার্টবিট যেন আবার বেড়ে গেল, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এমনিতেই যেন নিজের মধ্যে নেই। সাইফুল ভাই দ্রুততার সাথে একটা ছোট পিরিচে সেই শিশি থেকে তরল আঠালো জাতীয় পদার্থের এক ফোঁটা ঢাললেন, এরপরে শয়তানের হাতে থাকা বোতল থেকে এক ফোঁটা লাল (রক্ত জাতীয় কিছু একটা) তরল ঐ শিশির আঠালো পদার্থের সাথে মিশিয়ে মামার নাকের মধ্যে ঢালতেই মামা প্রচন্ড জোরে একটা হাচ্চি দিয়ে চোখ খুলে তাকালেন। তারপর তুমুল গতিতে শ্বাস নিতে লাগলেন। যেন তিনি বহুকাল পরে নতুন করে শ্বাস নিচ্ছেন – ব্যাপারটা এমন ছিল! মামাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে সাইফুল ভাই আর আমি দুজনই কেঁদে ফেললাম আনন্দে! মামা সাইফুল ভাইকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুমি একদিন আমার চাইতেও বড় জাদুকর হবে সাইফুল। আমি বলে দিচ্ছি, জাদুকর কখনো তার শেখা জাদু দিয়ে বড় জাদুকর হতে পারেনা, জাদুকরের স্বার্থকতা নিহিত তার কৌশলে। উপস্থিত বুদ্ধিই জাদুকরের মূল শক্তি!
মামা উঠে বসলেন, উঠেই বললেন, শয়তানটা কোথায়?
আমি বললাম, শয়তানটাকে সাইফুল ভাই এসিড মেরে আহত করে ফেলেছে, ও এখন বাথরুমে, রত্না ওর শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালছে।
আমার কথা শোনার সাথে সাথে মামা উঠে সোজা বাথরুম বরাবর হাঁটলেন। আমি আর সাইফুল ভাই উনার পেছন পেছন। গিয়ে দেখি জাদুকর শয়তানটার গাল, থুতনির নিচের অংশ আর গলা-ঘাড়ের কিছু অংশ ঝলসে গিয়েছে। সাইফুল ভাই মামাকে বললেন, মামা, এসিডে বেশ পরিমাণেই পানি মেশানো ছিল, সুতরাং ওর খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।
মামা বললেন, ওকে সুস্থ রাখতে হবে, নাহলে সমস্যা, একটু অপেক্ষা করো, আমি আমার ব্যাগ থেকে কচু পাতার ঐ মলম টা নিয়ে আসি। ওর ক্ষত স্থানে দিলে ও দ্রুত সেরে উঠবে।
এরপরের সময়টা পার হয় শুধু জাদুকরকে সুস্থ করানো নিয়ে। ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে যায় এরই মধ্যে, কচু পাতার মলমে জাদুকর সত্যিই যন্ত্রণামূক্ত হলেও ওর ঝলসে যাওয়া অংশ গুলো পুড়ে যায়। ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
জাদুকর কথা বলার চেষ্টা করলেও কথা বলতে পারছিল না, থুতনির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে, তবে মামা বললেন,
– চিন্তা নেই, আগামীকালের মধ্যেই সে কথা বলতে পারবে, আপাতত ওকে বেঁধে রাখা হোক, যত্ন-আত্নি করা হোক। ওকেই এখন আমাদের সবচাইতে বেশি প্রয়োজন! আমার নিজেরও বেশ বিশ্রামের প্রয়োজন। আমার ওপর যা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা আমাকে বেশ দূর্বল বানিয়ে দিয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে।
শয়তানটাকে একটা ম্যাট্রেসের ওপর শুইয়ে দেয়া হলো, যদিও হাত দুটো আর পা দুটো বেঁধে। ওকে বসার ঘরে আমাদের চোখের সামনেই রাখা হয়। এমন ধূর্ত ব্যক্তিকে এক পলকের জন্যও নজরছাড়া করা যাবেনা। মামাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– মামা, জাদুকরটা আপনার ওপর কিইবা ছুঁড়ে মারলো আর আপনাকে সুস্থ করা হলোই বা কিভাবে? ঐ তরলগুলো কি জাদুকরী কিছু?
– না সুমা, ওগুলো এক ধরণের পদার্থ। পুরোটা জাদুকরী নয়, তবে কিছুটা। ওগুলো মূলত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী, প্রাচীনকাল থেকেই জাদুকরেরা যা ব্যবহার করে আসছে। এমনকি কচু-পাতার মলমটাও!
মামার কথায় আমি নিদারুণ রহস্যের মধ্যে পতিত হলাম, আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম মামা এর ব্যাখ্যা দেন কিনা কিন্তু নিজের থেকে খুব বেশি প্রশ্ন করলাম না কারণ মামাকে তখন বেশ দূর্বল লাগছিল। উনি যোগ করলেন,
ওগুলো কি এবং কিভাবে তা কাজ করে, সেটা পরে বলছি। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে তোর মামীর পাগল হবার রহস্য। তোকে তো বলেছিলামই যে তোর মামীকে এক দরবেশ জাদু করে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনা শুনলেই সব বুঝতে পারবি।
মামা শুরু করলেন,
তোর মামীর সাথে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল তেইশ আর তোর মামীর পনেরো।
আমার বাবার বেশ সহায় সম্পত্তি ছিল। আমি সেগুলোরই দেখাশুনা করতাম। সাথে ছিল পারিবারিক ব্যবসা। একবার আরেক গ্রামের এক জমিদারের সাথে সওদা করতে যাই নদী পথ পাড়ি দিয়ে। এটা আমরা প্রায়ই যেতাম!
অন্যান্য সময় আমাদের নিজেদের গ্রামের এক মাঝিই আমাদেরকে বাণিজ্যে নিয়ে যেতেন, কিন্তু তিনি সেবার অসুস্থ থাকার দরুন গ্রামে আসা নতুন এক মাঝির শরাপন্ন হই, কারণ গ্রামের অন্য মাঝিরা আমার চাচাদের সাথে বাণিজ্যে চলে গিয়েছিল।
যখন সেই মাঝিকে প্রথম দেখি, শুকনো এক বৃদ্ধকেই আমরা আবিষ্কার করি। আমি আর আমার চাচাতো ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি যে এই বৃদ্ধ আমাদেরকে কি করে অতদূর নিয়ে যাবেন, উনার বয়স ছিল ষাটের বেশি। আমরা উনাকে জিজ্ঞেস করি, কাকা, আপনি কি আমাদেরকে হরিপুর অব্দি নিয়ে যেতে পারবেন? তাছাড়া আপনি কি পথ চিনবেন? যেতে কিন্তু দুই দিন সময় লাগবে।
মাঝি ছিলেন খুব অল্পভাষী একজন মানুষ।
তিনি বললেন, আপনারা শুধু বসুন। বাকিটা আমি দেখছি। এরপর আমি আর আমার চাচাতো ভাইয়েরা আসলেই যেন শুধু দেখে গেলাম, যে পথ দুইদিনের বেশি সময়ে কখনো আমাদের তাগড়া যুবক মাঝি পার হতে পারেনি, একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ আমাদেরকে সেই পথ একদিনের একটু বেশি সময়ে পার করে দিলেন।
যখন ভোর নাগাদ পৌছাই, বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই যেন করার ছিলনা! উনাকে জিজ্ঞেস করি, কাকা আপনি কি করে পারলেন?
স্বল্পভাষী মানুষটা শুধু একটা জবাবই দিলেন, বললেন, সর্দাররা সবই পারে!
উনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। উনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার ফেরত চলে গেলেন।
চলবে…
-
লেখকঃ Ferdous Sagar Zfs
-
“#মেকআপ_সুন্দরী”- এর সকল স্বত্ত্ব লেখক ফেরদৌস সাগরের। লেখকের অনুমতি ব্যতীত এর যে কোনো অংশ কপি করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। সকলকে শুভকামনা ও ভালোবাসা।
-
আগের পর্বের লিংকঃ https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/841817113290453/