মায়া_জাল

0 1
Avatar for Nipa1234
3 years ago

আমার ছমাস ধরে জমানো পাক্কা আট হাজার টাকায় কেনা স্টিলের আলমারীটা এই মাত্র পিক আপে পুরানো মালামালের সাথে তুলে দেওয়া হল। বিয়েতে আমার বর শশুর বাড়ী থেকে কিছু নেবেনা বলে যখন বাঁকিয়ে রইল তখন গা ভর্তি শাড়ী গহনা পরে শূন্য হাতে শশুর বাড়ীতে এলাম। গ্রামের চাচী,ফুফু খালারা যখন বৌ দেখতে এসে জানতে চাইতেন বৌ বাবার বাড়ী থেকে কি আনল তখন আমার শাশুড়ী মা সহাস্য মুখে বলতেন তার বাবার সবচাইতে মূল্যবান সম্পদটাইতো নিয়ে আসলাম আর কি আনার কথা বলছ বলতো?

যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শহরে আমাদের দু রুমের বাসায় প্রথম যেদিন আমি সায়ানের সাথে এলাম সে রাতে মাদুর পেতে শুয়েছিলাম। মনে পড়ে লাইট, ফ্যান লাগিয়ে শুতে শুতে রাত আড়াইটা বেজেছিল। সারাদিনের জার্নি তারওপর এত ধকল শেষে কি নির্বিঘ্নে সেই খাট হীন তোশকহীন বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। পরদিন শনিবার থাকায় সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। সকালে একটা হোটেলে চা পরাটা,সাথে সব্জি দিয়ে নাস্তা সেরে ছুটলাম চুলা,থালা বাসন,নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। ফেরার পথে তোশক আর পর্দা কিনতে গেলাম। আমার পছন্দ নীল রং সায়ানের সবুজ। বিছানার চাদরটাও আমার ম্যাচিং হওয়া চাই। বেশ কিছুক্ষন দোমনা শেষে সায়ান হাল ছেড়ে দিল। স্কাই ব্লু পর্দা আর চাদর কিনে শেষ বেলায় আমার মনটা যে প্রশান্তিতে ছেয়ে গিয়েছিল আজ ঘর ভর্তি লাখ টাকার পর্দা আর শরীর ডেবে যাওয়া নরম বিছানাও আমাকে সে প্রশান্তি দিতে পারেনি।

বড় বড় চারটা বেড,বিশাল ড্রইং ডাইনিং তিনটা বেলকুনির এ ঝকঝকে বাসাটা জুড়ে যেন শুধুই শূন্যতা। এঘর থেকে ডাকলে ছেলে মেয়েদের কান অব্দি আমার গলাটা ঠিক সহজে পৌঁছয়না। অথচ আমার সেই ছোট দুরুমের বাসাটায় হোক ঝগড়া অথবা লুকোনো আলাপ সবটাই যেন বেশ সাবধানে উচ্চারণ করতে হত পাছে ছেলে মেয়েদের কানে চলে যায়। তখন বার বার মনে হত কবে যে নিজের একটা খোলামেলা খানিকটা বিস্তৃত বাসা হবে আমার। কিন্তু আজ যেন এই ১৬০০ স্কয়ার ফিটের বাসায় আমরা একেকজন দূর দেশের বাসিন্দা। তখন বাড়ীতে কেউ এলে গাদাগাদি করে থাকতে হত অথচ আজ যেন থাকার মতই তেমন কেউ নেই। শুধু মনে হয় এ শেষ বেলা বড্ড একলার, পুরোনো কেউ যদি একটু বেড়াতে আসত!

কাজের চাপে সময় দিতে না পারায় সায়ানের সাথে সপ্তাহে সপ্তাহে কথা বন্ধ করে রাখা সেই আমিই যেন আজ সায়ানের অফুরন্ত অবসরে বিরক্ত। বুড়ো বয়সে রাত দিন গল্প করার মত সেই গল্পেরা যেন বাজারের তালিকা আর ডাক্তারের পথ্যির হিসেবে আটকে আছে। ব্যাংক ভর্তি টাকা আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে যেন চাইলেও কোথায় বেরিয়ে পড়তে মন চায়না। অথচ কত দিন আবদার করে দু ঈদের বোনাসের টাকা বাঁচিয়ে আমি আর সায়ান তিনদিনের ছুটিতে আমাদের চার বছরের ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সে কি আনন্দ, কি উচ্ছাস। স্বপ্নের মত ছিল সেই তিনটা দিন যেন। আজও ভাবলে মনের কোণে আনন্দেরা ঢেউ খেলে যায়। এর পর আরো দু একবার বেড়িয়েছি বটে তবে সময়ের সাথে সেই সুখের অনুভূতিরা ফিকে হয়ে এসেছে যেন। একটা সময় শখ ছিল সাধ্য ছিলনা আজ সয়ংসম্পূর্ণ সায়ান - অদিতির শখটাই যেন মরে গিয়েছে অথবা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে।

একটু একটু করে দু জনে মিলে সংসারটা গুছিয়েছিলাম, আজ ডাইনিং তো কাল টিভি। আমার আবার খুব ঘর সাজানের সখ ছিল বের হলেই কিছুনা কিছু কিনতাম,শাড়ী গহনার চাইতেও ঘরটাকে অলংকৃত করতেই যেন শান্তি খুঁজে পেতাম। সায়ান যখনই বলত কি চাই? কিছু না ভেবেই সংসারের জন্য কিছু একটা চেয়ে বসতাম। একবার ব্লিন্ডার তো আরেকবার ওভেন। আহা! সেই এক একটা জিনিস কেনায় যে তৃপ্তি ছিল তা যেন আজ আমার সাজানো সংসারের নতুন অগনিত আসবাবেও নেই। এখন আমার ইজি চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সৌখিন চায়ের কাপ হাতে আকাশ পানে চেয়ে থাকার চাইতেও যেন ঘাম মুছতে মুছতে সায়ান অফিসে যাওয়ার আগে হাজারটা কাজের ফাঁকে একসাথে দু চুমুক চা পান করাটায় কি এক অজানা সুখ লুকিয়ে ছিল।

সায়ান আমাদের পুরোনো সব মালামাল একটা পিকআপে তুলে দিচ্ছে। ওসব এবাড়িতে মানানসই না। আমার ছেলে সৈকত তার বাবাকে সাহায্য করছে, মেয়েটা মনের সুখে গুনগুনিয়ে তার ঘর গোছাচ্ছে। নতুন ফ্লাট নতুন আসবাব নতুন এলাকা কিন্তু কেন যেন আমার ভেতরে ভেতরে কান্নারা দলা পাঁকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার মেয়ের পড়ার টেবিলটা ওটা বানিয়েছিলাম অরিন যখন ক্লাস থ্রিতে,সেই থেকে ইন্টার পর্যন্ত ঐ টেবিলটায় ও পড়ত,কি যে এলোমেলো করে রাখত আমি রোজ বকতে বকতে টেবিল গোছাতাম। তার পাশেই রাখা মিটসেল্ফটা, মিস্ত্রীকে নিজে বলে বুঝিয়ে বানিয়েছিলাম খাবার গুলা রাখতে বেশ সুবিধা হত তাতে। আর তার পাশেই আমার ছমাসের জমানো আট হাজার টাকায় কেনা স্টিলের আলমারীটা। কেনার পর আমার সে কি আনন্দ, বেশ করে শাড়ীগুলা এক তাকে,সায়ানের স্যুট গুলা আরেক তাকে হ্যাংগারে,ছেলে মেয়েদের বাহিরে পরা কাপড় গুলা ভিন্ন ভিন্ন তাকে গুছিয়ে রেখে ছিলাম। ওটাই ছিল আমার সকল সম্পদের রক্ষক। অলংকার গুলা, জমানো টাকা যা কিছু মূল্যবান কি যত্ন করে আগলে রেখেছিল এ কুড়িটা বছর। মনে হয় এই তো সেদিন ঠিক আমার সন্তানের মত ঘর আলো করে ওরা এল, কত আনন্দ। অথচ আজ কত অবহেলায় ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের কত সুখী সংগ্রামী জীবনের সাক্ষী হয়ে।

প্রথম জীবনের সব কিছুই বুঝি সুন্দর হয়। সংসার জীবনের প্রথম দিকে দোকান ঘুরে ঘুরে আমাদের ছোট ছোট নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, পছন্দ না হলে ফিরে আসা,অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে বড় শখ করে কেনা অতি সাধারণ প্রাপ্তীগুলাতে সুখ গুলা ছিল বাঁধন হারা। এখন আর শখ বলে কিছু নেই সবই যেন বিলাসীতা। যা কিছু চাওয়া মাত্রই আমার, তাকে পাওয়াতে যেন আমার ব্যাকুলতা নেই,নেই সীমাহীন সুখ। তাই বুঝি আমাদের কোয়াটারের সেই ছোট্ট বাসাটায় আমাদের ফেলে আসা টুকরো টুকরো স্মৃতিরা অশরীরির মত ঘুরে বেড়ায়। আমার এই ঝকমকে জীবন থেকে আমাকে হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতিরা টেনে নিয়ে যায় সায়ানের সাথে ভালবাসা মান অভিমানের অলিতে গলিতে,সন্তানদের ছেলেবেলার বেসামাল দুষ্টুমিতে আর আমার পরিপাটি করে সাজানো অতি সাধারন সেই সংসারে।

সংসার আসলে একটা মায়ার ভান্ডার,এর সবটুকুই যেন মায়া। দেওয়ালে ঝুলানো ওয়াল ম্যাটটায়, চায়ের ছোট্ট পাতিলটায়, ড্রয়িং রুমের ফুলদানিটায়, জানালায় রাখা লতানো পাতাবাহারটায় যেন ভালবাসা আর মায়ার প্রতিচ্ছবি। নিজ হাতে পালা সন্তান, অথবা নিজ হাতে কেনা শো পিস হয়তবা নিজ হাতে পাক করা খাবার এর কোনটাই ভালবাসার উর্ধ্বেনা। সবটা মিলেমিশে এক অদ্ভূুত মায়াজাল তৈরী করে আমাদেরকে আঁকড়ে ধরে রাখে একে ওপরের সাথে তাই বুঝি যতই এগোতে চাইনা কেন কোথায় যেন পুরোনো একটা সুতার টান রয়েই যায় তা চাইলেও উপেক্ষা করা যায়না।

1
$ 0.06
$ 0.06 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments