-"একজন মেয়ে হয়ে আপনি এত ভয়ানক থ্রিলার লেখেন কী করে?"
-"একটা মেয়ে শুধু ঘরের মধ্যে বসে থেকে রোমান্টিক লিখবে সেই ধরণের কোন কথা তো কোথাও বলা নেই। সমাজে আপনারা প্রতিদিন যেই খুন, ধর্ষণ দেখে আসছেন সেগুলো কী আজো থামাতে পেরেছেন? পারেন নি তো। এত ভালোবাসা আপনারা তাদের দিচ্ছেন কিন্তু তাও অপরাধ কমার বদলে বেড়ে যাচ্ছে। আমার গল্প সমাজকে জাগ্রত করার জন্য। একটা মানুষ যখন নিজে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে তখনই সমাজ ঠিক হবে। তাই আমি ভালোবাসার বদলে মানুষকে উপহার দিচ্ছি শিক্ষা। যেই শিক্ষা তাদের জীবন পাল্টে দিবে। খুনের বদলে খুন আর রক্তের পরিবর্তে রক্ত চাই আমি।"
-"আপনার ধারণা এইরকম করে অপরাধ কমে যাবে! কিন্তু আপনার লেখা পড়ে তো মানুষের মধ্যে একটা খুনী সৃষ্টি হবে।প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা করে শয়তান সৃষ্টি হবে। যদি কেউ ভুল পথে চলে যায় তাহলে সেই দায়িত্ব কী আপনি নিবেন?"
-"আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিব। তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন? আপনি একজন মেয়ে তাইতো!"
- হু তো?
- আপনি একটা নির্জন জায়গা দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় কয়েকজন পশু মিলে আপনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ক্ষুধা নিবারণ করার পর আপনাকে সেই অবস্থাতে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে গেলো। তখন মানুষ রুপি কিছু জানোয়ার আপনার সেই অবস্থার ভিডিও করলো আবার কিছু লোক আপনাকে হাসপাতালে দিয়ে গেলো। সেই মানুষ রুপি জানোয়ার গুলো সেই ভিডিও আবার ভার্চুয়াল জগতে দিয়ে বড় বড় করে ক্যাপশন লিখে দিলো, এইরকম করেই প্রতিদিন ধর্ষণ হচ্ছে নিরীহ নারী। সরকার কিছু করছে না।
তারপর ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কয়েকদিন সেটা থেকে তারা কিছু ফলোয়ার বাড়িয়ে নিলো।
এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। এখন আপনার কাছে প্রথম প্রশ্ন,
আপনার এরপর কী হবে?
-"হাহা ম্যাডাম। হাসপাতালে যাব। পুলিশ আমার বয়ান নিবে। কিছু লোক আমার হয়ে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করবে। হয়তো পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবে।"
-"একজন সাধারণ মানুষের মত করেই ভেবেছেন আপনি।
এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, এটা বাংলাদেশ। একজন ধর্ষিতাকে সমাজ কী চোখে দেখে সেটা আপনার অবশ্যই জানা কথা।
প্রথমে আপনার চাকরি যাবে। এরপর আপনার পরিবার আপনাকে দোষারোপ করবে। আপনার চরিত্র নিয়ে কথা বলবে। আর আরেকটা কথা, সেদিন আপ্নার মাথায় হিজাব আর শরীরে কিন্তু ভালো পোশাক ছিল। তাও আপনি ধর্ষন হয়েছেন। কিন্তু তার পরেও সমাজ আপনাকে আর আপনার পরিবার কে দোষারোপ করবেই। সেই অবস্থায় আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে একটু বলবেন?"
-"প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে চাইবো।"
-"দ্যাট ওয়াস দ্যা পয়েন্ট। এটাই বলতে চাচ্ছিলাম আমি। আপনি মরে যেতে চাইবেন। সুইসাইড করতে চাইবেন তাইতো। কিন্তু আপনি কী কোন দোষ করেছেন যে আপনি সুইসাইড করেছেন? দোষ তো তাদের যারা আপনাকে এই পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ক্ষমতা তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে ফলে তারা আপনার মত আরেকজন কে ধর্ষণ করার চেষ্টা করবে। আর আপনি সমাজে বেঁচে থেকেও মরে যাবেন। তখন আপনি কী করবেন?"
-"সুইসাইড করব। কারণ যেই দেশে থাকি সেখানে যদি আমাকে নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে কিই বা করতে পারি?"
-"হাহা! আসলেই কিই বা করতে পারেন? প্রথমে আপনি সুইসাইড করবেন, তারপর আপনার দেখাদেখি আরেকজন সুইসাইড করবে। তারপর আরেকজন। এইরকম চলতেই থাকবে। তারচেয়ে একটা ভালো সমাধান আমি দেই? মৃত্যুর জন্য যখন আপনি প্রস্তুতই, যখন আপনি ঠিক করেই ফেলেছেন আপনি মারা যাবেন তাহলে সেইসব জানোয়ারদের গিয়ে শেষ করে দিন। আপনার শরীরে তাদের প্রতিটা স্পর্শের বদলা নিন। তাতে যদি আপনি তাদের হাতেই খুন হোন তাও বাকি সব মেয়েদের কাছে আপনি একজন আদর্শ হয়ে উঠবেন।
এতে বাকিরা সুইসাইড করার পরিবর্তে হাতে অস্ত্র তুলে নিবে।
লড়াই করবে তারা নিজেদের জন্য। যেই সমাজ তাদের দিকে আঙুল তুলবে সেই আঙুলটাই কেটে দিন। আপনার চেয়ে শক্তিশালী এখানে কেউ নেই। আপনি সবচেয়ে শক্তিশালী। ইসলামের কথা বলবেন? আমাদের ইসলাম নারীদের সবচেয়ে বেশি সম্মান দিয়েছে। আমাদের মহানবী (সা:) বাবা নামটা উচ্চারণ করার আগে তিনবার মা নামটা উচ্চারণ করেছে।
শুধু মেয়েদের নয়। আপনার ঘরের মেয়েদের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আপনার নিজের। একজন ভাইয়ের কাছে তার আদরের বোন সবচেয়ে প্রিয়। সেই বোনের সম্মান রক্ষা করতে তাকেও অস্ত্র তুলতে হবে। জানোয়ারদের রক্তে হাত পরিষ্কার করতে হবে।"
-" হ্যাটস অফ মিস রেখা খান। আজ আপনার থেকে অনেক কিছু শিখতে পারলাম। আমার আর কোন প্রশ্ন করার মুখ আপনি রাখেননি। আপনার পরবর্তী বইয়ের জন্য আপনাকে অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো।"
অনুষ্ঠান শেষ হতেই তালির রোল পড়ে গেলো। সবার মুখে একটাই নাম। সেটা ছিল রেখা খান। এতক্ষণ ধরে একটা লাইভ অনুষ্ঠানে এতগুলো কথা বলে গেছেন তিনি। যতো রকমের ক্রাইম থ্রিলার এবং সাইকো গল্প আছে সেগুলো লিখে থাকে সে। তার কলম দিয়ে কালো কালির পরিবর্তে যেনো রক্ত ঝড়ে।
রক্তের নেশা তার রগে রগে। রোমান্টিক বিষয়টা একেবারে দেখতে পারেনা। এত অল্প বয়সে এত তেজ খুব কম মেয়েরই আছে। তার বই বেস্টসেলারে আসার কারণেই তার এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
এতক্ষণ ধরে ফোনে সেই সাক্ষাৎকারের পুরো ভিডিও দেখলো আবরার তাসীন। সেটা দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
রাত হয়ে গেছে অনেক। এখন সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
মাথার ভিতর সেই মুহূর্তে শুধু দুটি চিন্তা। প্রথম চিন্তা হলো রাত নামের মেয়েটা। মেয়েটার নাম রাত ঠিকই। কিন্তু তার চেহারা মোটেও রাতের অন্ধকার নয়। দিনের আলোর থেকেও তীব্র সেটা। যে কারো ঘোর লেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু হাজার হলেও সে তাকে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ সে একা থাকতে চায়। সারাজীবন বই এবং পাঠক নিয়ে থাকতে চায় সে।
কিন্তু এইসবের মুখে তার সামনে আরেকটা যেই জিনিস এসে হাজির হয়েছে সেটা হলো তার নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী রেখা খান।
যদি সে শুধু এক নাম্বারে আসতো তাহলে তাসীনের কোন সমস্যা ছিলোনা। কিন্তু সে ভালোবাসা কে অপমান করেছে, ভালোবাসা কে ছোট করেছে সে। তাই তাকে উচিত জবাব দিতে হবে।
একজন লেখকের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার লেখা। একজন লেখক তার লেখার মাধ্যমেই সব কিছুর জবাব দিয়ে থাকে। তাসীনও সেইরকমই। পৃথিবীতে যদি ভালোবাসা না থাকতো তাহলে এই পৃথিবী কবেই শ্মসান হয়ে যেতো।
রেখা খানের প্রতিটা কথা তাসীন খুব মনোযোগ সহকারে শুনেছে। সে জানে তার প্রতিটা কথা সত্যি। কিন্তু এইরকম করে কিছুই হবে হবে না। শুধু খুব বেড়ে যাবে সমাজে।
তাই এখন তাকে তার লেখা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে সেটি।
বিছানায় আর থাকতে পারলো না তরুণ লেখককের মন।
উঠে চলে গেলো কম্পিউটারের কাছে।
কী বোর্ডের উপর চালাতে শুরু করে দিলো যুদ্ধ। মনের সব কথা প্রকাশ করার একটাই মাধ্যম। কী বোর্ড। সেটাই এখন তার এক মাত্র অস্ত্র।
ঘুম আসছে না রাতের। তাসীন কেমন ধরণের মানুষ সে খুব ভালো করেই জানে। তাসীন কেমন মানুষ সেটা তার থেকে রাত মনে হয় বেশি জানে। সে এও জানে তাসীন এই মুহূর্তে তার নতুন বই লেখায় ব্যাস্ত। রেখা খানের সাক্ষাৎকার সেও দেখেছে। রেখা খান যেই যুক্তি গুলো মানুষের সামনে পেশ করেছে সেগুলো চরম সত্য। আর মানুষ সেগুলো আগ্রহের সাথে গ্রহণ করছে। রেখা যেরকম করে ভালোবাসা কে ছোট করে দেখেছে সেটা রাতও মানতে পারছে না। কিন্তু সে জানে তাসীন রেখাকে একটা উচিত জবাব দিবে তার লেখার মাধ্যমেই। এই বিশ্বাস নিয়েই রাত বালিশে মাথা দিলো। কিন্তু তারও ঘুম আসলো না। একটা জরুরী কাজ যে বাকি পরে গেছে। প্রতিদিনের রুটিন মতো ডায়েরি লিখতে হবে তাকে।
সেখানে তার হাজার স্বপ্ন রয়েছে। সব স্বপ্ন গুলো সযত্নে লেখা আছে সেখানে। তাসীনকে নিয়েও অনেক কথা রয়েছে। এক কথায় রাতের পুরো জীবন রয়েছে সেই ডায়েরিতে।
যখন সব কিছু লেখা শেষ হয়ে গেলো তখন রাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,
-"স্যার! আমি জানি, আমার কথা গুলো আপনি খুব সুন্দর করে মনের ভিতর রেখে দিয়েছেন। আপনার লেখাকে সবচেয়ে শীর্ষে নিয়ে যেতে হলে আপনাকে ভালোবাসতেই হবে আমাকে। আমি কখনো আপনাকে জোর করব না। কারণ ভালোবাসা হলো একটা বিশ্বাস, একটা ভরসা। সেটার জোরেই আমি আপনার হতে চাই স্যার। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।"
এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলো টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে যায় রাত।
অত্যন্ত সাধারণ একটা মেয়ে সে। জীবনে যতো কষ্ট পেয়েছে সব নিজে শক্ত থেকে মোকাবেলা করেছে। নিজের শক্তি সে নিজেই ছিল। সেই কারণেই এখনও সে অন্য যে কোন মেয়েদের চেয়ে অনেক গুণে স্ট্রং। কিন্তু তার ভিতরেও রয়েছে একটা বাচ্চামি। যেটা সব মেয়েদের ভিতরেই থাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব শখ তার। সেগুলো বলে আবার অন্যদের বিরক্তও করে।
টেবিলের উপর ঝুলে রয়েছে অদ্ভুত সব চিত্রকর্ম। পুরো ঘর জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর ভয়ানক সব সিরিয়াল কিলারদের ছবি।
ঘরের এক পাশের আলমারি ভর্তি বই। সব গুলো বাহিরের দেশের থ্রিলার। লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া হরর গল্প সহ রয়েছে নৃশংস ভাবে খুনের বর্ননা দেওয়া সাইকো থ্রিলার বই।
দেয়ালে ঝুলছে একটা কঙ্কাল। অবশ্য সেটা প্লাস্টিকের। তাও রাতের বেলা হঠাৎ করে ঘরের ভিতর সেইরকম জিনিস দেখলে যে কারো ঘুম হারাম হতে বাধ্য।
কিন্তু দিন রাত যে খুন নিয়ে পরে থাকে তার কাছে সেটা কোন ব্যাপার নয়। রেখা খান। বয়স বাইশ থেকে চব্বিশ এর মাঝামাঝি। ছোট বেলা থেকেই সমাজের নির্মম বাস্তবতা দেখে দেখে তার মনে ক্ষোভ জন্ম নেয়। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তার লেখায়। তার পরবর্তী গল্পের প্লট হলো, ভালোবাসায় অন্ধ একটা মেয়ের কথা। যেই মেয়েটা উজাড় করে ভালোবাসতো কাউকে। কিন্তু সেই ছেলেটা শুধু তাকে ব্যবহার করে ছেড়ে দেয়। শুধু তাই নয়, সর্বনাশ করে সেই মেয়ের। সমাজ সেই মেয়েকে তাড়িয়ে দেয়। সেই মেয়েটা পরে ফিরে আসে এক নির্মম ভাবে। সমাজের প্রতিটা মানুষকে সাবধান করে দেয়। সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয় যেনো আর কেউ খারাপ কিছু করার সাহস না পায়।