কয়েকটি খুন ও কালো মুখোশ

0 3
Avatar for Nipa1234
4 years ago

-মারুফ হুসাইন

৯.

আলিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক চাকরী ছেড়ে চলে গেছেন। স্কুলে নতুন শিক্ষকের প্রয়োজন। কমিটি মিটিংয়ে মতিন মেম্বার শামসুদ্দিনকে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব উঠালেন৷ শামসুদ্দিন ইয়ং জেনারেশনের ছেলে৷ তার পড়াশুনা শুধু আরবির উপরই নয়৷ জেনারাল লাইনেও পড়াশুনা আছে। তাই নতুন শিক্ষক আসা পর্যন্ত তার থেকে ভালো অপশন আর নেই৷ স্কুল কমিটির সদস্যারাও তার সাথে একাগ্রতা প্রকাশ করলেন। সবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে শামসুদ্দিনকেই আপাদত ধর্ম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে।

আসরের নামাজ শেষে মতিন মেম্বারসহ মাসজিদ কমিটির আরো দুয়েকজন সদস্য মিলে শামসুদ্দিনকে প্রস্তাব দিলেন৷ সে এই প্রস্তাবে রাজি হতে না চাইলেও মাসজিদ কমিটির সদস্যদের অনুরোধে রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না৷ তাই সে রাজি হয়ে গেলো৷ আগামিকাল থেকেই তার জয়েন করতে হবে৷

কলিং বেলের আওয়াজে তায়েফের ঘুম ভাংলো। চোখ ঢলতে ঢলতে গেট খুলে দিয়েই সে অবাক হয়ে যায়। সামনে অপর্ণা দাঁড়িয়ে আছে৷ সে চোখ ঢলতে লাগলো৷ 'ঠিকই দেখতেসেন৷' বলে অপর্ণা ভিতরে ঢুকে যায়৷ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সে ঘর দেখতে থাকে। তায়েফ গেট লক করে তার পিছু পিছু এসে বলল, 'আপনি আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কোথায়?'

'কাল এক পিচ্চিকে দিয়ে আপনাকে ফলো করিয়েছিলাম।'

'ঠিকানা চেয়ে রাখলেই পারতেন। এতো কষ্ট করানোর কি দরকার ছিলো৷ যদি আমি সরাসরি বাসায় না আসতাম তাহলে তো বেচারা বিপদে পরে যেতো।'

'আচ্ছা বাদ দিন ও কথা।' বলে অপর্ণা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো, 'এই নিন! এই নিউজটা দেখেন। আপনার শোয়ের জন্য নতুন কেস খোঁজ করছিলেন। আমার মনে হয়, এটা বেস্ট হবে।'

তায়েফ মোবাইলটা নিয়ে নিউজটা পড়লো। একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে আলিপুরের খুনগুলো নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে৷

'খুনি এখনো ধরা পড়েনি। ইন্টারেস্টিং একটা কেস। পরবর্তী শো'টা এই কেস দ্বারা সাজাতে পারলে অমায়িক একটা কাজ হবে।' অপর্ণা ততক্ষণে একটা চেয়ারে টেনে বসে পরেছে। তার সামনেই তায়েফ দাঁড়িয়ে আছে। সে মোবাইলটা অপর্ণার দিকে এগিয়ে দিলো, 'গুড আইডিয়া। আমি স্যারের সাথে কথা বলে দেখি৷ স্যার কি বলে।'

'আমি কথা বলে নিয়েছি। আপনি কাজ শুরু করতে পারেন। আর এই নিউজটা আলিপুর স্কুলের এক শিক্ষিকা করেছে। তার সাথেও যোগাযোগ করেছি। সে সব ধরণের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।'

তায়েফ অবাক হয়ে যায়। না বলতেই মেয়েটা তার জন্য এতো কিছু করে দিচ্ছে। মেয়েটা ভুল করছে না তো৷ তার এহেন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় না৷ সে স্বাভাবিকভাবে বলে, 'এতো কিছু যে আগ বাড়িয়ে করে নিলেন। আমি যদি কাজটা করতে আগ্রহী না হই?'

'আগ্রহী না হলেও সমস্যা নেই৷ তবে আমার মনে হয়েছে আপনি আগ্রহী হবেন। তাই আমি কাজগুলো এগিয়ে রেখেছি।'

তায়েফ কথার কোনো উত্তর পায় না। চুপ করে থাকে। অপর্ণা তায়েফের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে মুখ ভেংচে বলে, 'আপনার লজ্জা করছে না একটা অবলা মেয়ের সামনে কতক্ষণ ধরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন?'

তায়েফ খেয়াল করে আসলেই সে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে কোনো জামা নেই। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে পাশের রুমে চলে যায়। গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে ফিরে আসে, 'সরি আমি খেয়াল করিনি। খুব গরম লাগছিলো তাই টি-শার্ট খুলে ঘুমিয়েছিলাম।'

'এই অসময়ে আপনি ঘুমুচ্ছিলেন কেন?'

'কোনো কারণ নেই। এমনি। আচ্ছা আপনি বসুন! আমি চা করে নিয়ে আসি।' বলে তায়েফ রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।'

মিনিট পাঁচেক পর তায়েফ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফিরে আসে। একটা কাপ অপর্ণার দিকে এগিয়ে দিলো৷ আপর্ণা তায়েফের হাত থেকে কাপ নিয়ে বলল, 'আপনি কাল সকালে অফিসে গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলে দুপুরের মধ্যে আলিপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে দেন।'

'আচ্ছা' বলে তায়েফ চায়ের কাপে চুমুক দেয়৷

দুজনের মাঝে কয়েক মূহুর্তের জন্য নীরবতা নেমে আসে। অপর্ণার মন হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়৷ সে বুঝে উঠে না, দু-দিন ধরে তায়েফের সংস্পর্শে আসলে তার মন খারাপ হয়ে যায় কেনো? সে ভাবে মনের কথা বলে দিবে। কিন্তু বলতে পারে না। কিছু একটা তাকে বলতে বাঁধা দেয়৷ তার মনে হতে থাকে, তার জীবনের সাথে কাউকে জড়ানোটা উচিৎ হবে না।

'কি ভাবছেন?' তায়েফের কথায় অপর্ণার ভাবনায় ছেদ পড়ে।

সে বলে, 'না তো কিছু ভাবছি না।'

'আপনি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?'

'না তো কি লুকাবো?' অপর্ণার স্বর কাপতে থাকে। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এবার আর সামলে উঠতে পারে না। সে হাত দিয়ে চেহারা ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তার এমন আকষ্মিক কান্নায় তায়েফ ঘাবড়ে যায়৷ সে কি করবে বুঝে উঠে না৷ চায়ের কাপটা এক পাশে রেখে হাত টেনে ধরে বলে, 'আপনি কাঁদছেন কেনো?'

তায়েফের হালকা টানেই অপর্ণা তায়েফের বুকে ঢলে পরে৷ তার বুকে মাথা রেখেই ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। তায়েফের সঙ্কোচ হয়। কিন্তু কিছু বলার উপায় থাকে না৷ সে অপর্ণাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। জিজ্ঞাসা করে, 'কি হয়েছে বলুন আমাকে?'

অপর্ণা তায়েফের বুক থেকে মাথা সড়িয়ে নেয়। হন্তদন্ত করে চোখ মুছে বলে, ‘না কিছুই হয়নি।’ সে আর বসে থাকে না। খাটের উপর থেকে ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়৷ তায়েফ তার হাত ধরে টান দিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বলে, 'ভালোবাসেন?'

অপর্ণা এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পরে৷ তার অজান্তেই 'হ্যাঁ' মাথা দুলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে৷

'তাহলে কান্না না করে বলে দিলেই তো পারেন৷ শুধু শুধু চোখের পানি অপচয় করছেন কেনো?' তায়েফ অপর্ণার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অপর্ণা এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তায়েফের দিকে তাকানোর সাহস করতে পারছে না। সে নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, 'আপনি বুঝবেন না। আপনাকে আমি বুঝাতে পারবো না৷'

'আচ্ছা থাক, তা এখন আর বুঝে কি হবে। যা বলার বলেই তো দিয়েছেন।' বলে তায়েফ তার বাহু দু দিকে ছড়িয়ে দেয়৷ অপর্ণা খেয়াল করে না৷ তায়েফ হালকা করে কাশি দেয়। অপর্ণা মাথা তুলে তায়েফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তায়েফকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ রেখো৷'

জ্যাকি ফার্নান্দেজ কমিশনারের সাথে দেখা করে আসলো৷ কমিশনারই তাকে ডেকেছিলেন। কমিশনার রেগে আছেন৷ পরপর দুইটা খুন হয়ে গেছে৷ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং তার ছেলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খুনি অধরা। খুনিকে দ্রুত ধরার জন্য তাগাদা দিলেন। জ্যাকি কমিশনারকে আশ্বস্ত করলো, খুনি বেশীদিন অধরা থাকবে না৷ দ্রুতই গ্রেফতার করে ফেলবে৷ কিন্তু কমিশনার কেস রিপোর্ট শুনে খুশি হতে পারেননি। তাই সে জ্যাকিকে তার মতো করে তদন্ত চালিয়ে যেতে বললেন। এবং একজন আন্ডারগ্রাউন্ড গোয়েন্দা পাঠাবেন বললেন৷ যে আলিপুর গ্রামে থেকে মামলার তদন্ত করে যাবে৷ কিন্তু কেউ জানবে না যে সে গোয়েন্দা অফিসার। এমনকি জ্যাকিও নয়। জ্যাকি ব্যাপারটায় খুশি হতে পারলো না। কিন্তু প্রতিবাদ করার কোনো উপায় নেই। সিনিয়রদের সিদ্ধান্ত।

ভয়ংকরভাবে দুইটা খুন হওয়ায় গ্রামের মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। খুনিকে দ্রুত ধরতে না পারলে গ্রামের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে না৷ আর খুনি অবশ্যই পুলিশ থেকে খুব সাবধানে থাকবে৷ পুলিশের সংস্পর্শে আসবে না৷ তাই আন্ডারগ্রাউন্ড অফিসার নিয়োগ দেয়া। যেনো সবার সাথে মিশে গিয়ে তদন্ত করতে পারে। এতে খুনি হয়তো কোনো ভুল করে বসবে।

১০.

গ্রামে আরো একটা হত্যাকান্ড ঘটে গেছে। এবার ভিক্টিম আবুল হাসানাত। ঠিক একইভাবে তাকে মারা হয়েছে৷ হাতুড়ি পেটা করে৷ শরীরের প্রায় অধিকাংশ হাড় ভেংগে ফেলা হয়েছে। মারার পর কালো মুখোশও রেখে গিয়েছে৷ জ্যাকি ফার্নান্দেজ লাশ উদ্ধার করে পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ সে গোপণ সূত্রে জানতে পারে, এই ইউনিয়নের যত অবৈধ কারবার আছে তার অধিকাংশই তার তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে৷ সে ছিলো রাজিবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু৷ অবৈধ কাজগুলো তার পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে থাকে৷ পিছন থেকে রাজিব তাকে শেল্টার দিয়ে থাকতো৷ গ্রামের যত বখাটে ছেলে-পেলে আছে সবাই তার কথা মতোই কাজ করে থাকে৷ গ্রামের কিছু মানুষ তাকে মনে মনে ঘৃণা করলেও কারো কিছু বলার সাহস নেই। এমনকি ঘৃণা প্রকাশ করার সাহসটুকুও নেই৷

জ্যাকি ফার্নান্দেজ জিজ্ঞাসা বাদ করার জন্য মতিন মেম্বারের বাড়িতে এসেছে। বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে তারা বসেছে। মতিন মেম্বারের কপালে চিন্তার ভাজ৷ সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না৷ তার গ্রামে এভাবে খুন হচ্ছে কেনো৷ সে জানালো, এই গ্রামে তাদের কোনো শত্রু নেই৷ গ্রামের যত উন্নয়ন, মানুষের আপদে-বিপদে তারাই এগিয়ে যায়৷ তাদেরকে কেউ খুন করতে পারে এ কথা ভাবাই তো পাপ।

'মেম্বার সাব! গ্রামের কোনো সাধারণ মানুষ তাদেরক খুন করার কথা ভাবতেও পারবে না৷ কিন্তু ব্যাপারটা এমন হতে পারে না, কেউ ক্ষমতার লোভে চেয়ারম্যান ও রাজিব হাসানকে খুন করেছে। আমি যতটুকু শুনেছি আজমির হাসান গত চল্লিশ বছর ধরে চেয়ারম্যানের আসনে একক অধিপত্য বজায় রেখেছে৷ এখন তার অবসর নেয়ার সময় হয়েছিলো। আর তার জায়গায় তার ছেলে রাজিব হাসানকে বসানোর কথা৷ আর তাদের পর গ্রামের সবচেয়ে বেশী ক্ষমতার অধিকারী তো আপনিই। তারা মারা গেলে সুবিধাটা তো আপনারই বেশী হওয়ার কথা।'

'আপনি কি বলতে চাচ্ছেন অফিসার?' মতিন মেম্বার রেগে গেলো।

'রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো শুধু সম্ভাবনার কথা বললাম।'

মতিন মেম্বার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, 'না অফিসার আপনি ভুল করছেন। চেয়ারম্যান সাব আমার বাবার মতো। ছোটবেলা থেকেই তার আদরে বড় হয়েছি৷ আমাদের সব সমস্যায় তিনি বাবার মতো ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর রাজিব ভাই, আবুল হাসানাত আমার সবচেয়ে কাছের লোক। আমার আজকেই এই অবস্থান তাদের জন্যই। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, তাদেরকে এভাবে কে মারছে। আমার জানামতে তাদের কোনো শত্রুও নেই।'

জ্যাকি নিজের হাত ব্যাগ থেকে মুখোশটা বের করে দিয়ে বলল, 'খুনি খুন করে নিশানা হিসেবে মুখোশটা রেখে যাচ্ছে। এই মুখোশের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?'

মতিন মুখোশটা হাতে নিয়ে দেখলো, 'না অফিসার কিছু বলতে পারছি না৷'

'আজ উঠি। দরকার পরলে আবার আসবো।' বলে জ্যাকি উঠে দাঁড়ালো।

'অফিসার! খুনগুলোর জন্য গ্রামে আতংকে সৃষ্টি হয়েছে৷ সবাই ভয় পাচ্ছে। আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে যত দ্রুত সম্ভব খুনিকে ধরুন।'

'আমাদের কাজই এটা।' বলে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে জ্যাকি আবার ফিরে আসল, 'মেম্বার সাব! একবার ভেবে বলুন তো, আপনারা কারো এমন ক্ষতি করেছেন যার জন্য সে প্রতিশোধ নিচ্ছে?'

'না অফিসার। আমরা বরং মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে যাই। কারো ক্ষতির কথা আমরা ভাবতেও পারি না।'

'সাবধানে থাকবেন। যদি হত্যাকান্ডগুলো ক্ষমতার লোভে না হয় তাহলে হয়তো আপনিও বিপদে আছেন।' জ্যাকি মতিন মেম্বারকে সাবধান করে দেয়।

শামসুদ্দিন তার কথা অনুযায়ী স্কুলে জয়েন করে নেয়৷ সে স্কুলে আসার আগেই আবুল হাসানাতের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলো। তাতে তার কোনো ভাবান্তর হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই সে স্কুলে এসে সবার সাথে পরিচিত হয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। প্রিন্সিপালের কাছে আবুল হাসানাতের মৃত্যুর খবর আসতেই স্কুল ছুটি ঘোষণা করে দেন৷ আবুল হাসানাতও স্কুল কমিটির সদস্য। তাই তার সম্মানার্থে স্কুল ছুটি দিতেই হয়। কিন্তু শামসুদ্দিনের কাছে বিষয়টা ভালো লাগে না৷ জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে৷ কারো মৃত্যু হলেই আরো দুশো ছাত্র-ছাত্রীর পড়া নষ্ট করে ছুটি দেয়ার তো মানে হয় না৷ কিন্তু কাউকে কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই৷ তাই সে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করে স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়৷ 'শামসুদ্দিন সাব!' পিছন থেকে কারো ডাক শুনতে পায়। মেয়েলি কন্ঠ। খুবই মিষ্টি স্বর। শামসুদ্দিন অবাক হয়৷ এখানে তাকে কোন মেয়ে ডাকতে যাবে। সে পিছনে তাকিয়ে মেয়েটা চিনতে পারে৷ টিচার্স রুমে দেখেছিলো। নাম নূরে আফিয়া৷ হয়তো ইংরেজি শিক্ষক। শামসুদ্দিন নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, 'জি ম্যাম বলুন!'

'আপনি তো মাসজিদ সংলগ্নেই থাকেন?'

'হ্যাঁ।' শামসুদ্দিন এখনো মাথা উঁচু করেনি। নিচের দিকে তাকিয়েই কথা বলছে।

'আমার বাসার পথেই তো মাসজিদ। এখান থেকে দশ-পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। একা যেতে বড্ড বিরক্ত লাগে৷ এখন থেকে আপনার সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।'

'আপমি আমার বদনাম করাতে চাচ্ছেন নাকি?'

'তা কেনো চাইবো?'

'আমি এখানকার ইমাম৷ একজন বেগানা নারীর সাথে আমাকে হাঁটতে দেখলে, কথা বলতে দেখলে গ্রামবাসী আমাকে জুতাপেটা করবে।'

আফিয়া খিলখিল করে হেসে দেয়৷ 'কথা বলছেন, নিচের দিকে তাকিয়ে৷ দেখে মনে হচ্ছে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছেন। ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারেন না। কিন্তু কথাতে মনে হচ্ছে মেয়েদের সাথে উঠা-বসা কম নয়। অবশ্য ঢাকাতে আমার বন্ধু মহলেও বেশ কিছু হুজুর ছিলো। মাদ্রাসার পাশাপশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। তারা জেনারাললাইনের ছেলেদের থেকেও বেশী নির্লজ্জ ছিলো৷ কোনো রাখ-ঢাক রেখে কথা বলতো না৷ কিন্তু এখানে তো কেউ দেখছে না। ভং ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা না বললেও চলে।'

শামসুদ্দিন মুচকি হাসি দেয়, 'উহু, ভং ধরছি না।'

'আচ্ছা বাবা! আপনার বদনাম করিয়ে আমার লাভ নেই। তাই স্কুলে এসে দেখা হলেই কথা হবে৷ আজ যাই৷ বিকেলে আবার আমার মেহমান আসবে৷ তার প্রস্তুতি নিতে হবে৷'

'আচ্ছা৷' বলে শামসুদ্দিন গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো।

অপর্ণা সকাল ৯টার দিকে তায়েফের বাসায় গিয়েছিলো৷ কিন্তু বাসা বাইরে থেকে তালা দেয়া। সে ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না, সে কোথায় চলে গেলো? আজ তার আলিপুর যাওয়ার কথা। আর এখন কি না সে গায়েব। অপর্ণা তায়েফের কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোথায় গেছে না গেছে বলে গেলেই তো পারে৷ সে গেইটম্যানকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, তায়েফ রাতেও বাসায় ছিল না। গতকাল অপর্ণা যাওয়ার পর যে বের হয়েছে এরপর আর ফিরেনি৷ মোবাইলও বন্ধ। সেদিনই বলেছিলো, মোবাইল নষ্ট হয় গেছে৷ অপর্ণার তায়েফের ব্যক্তিত্ব বুঝে উঠতে পারে না৷ কেমন রহস্যজনক মনে হয়৷ সে তায়েফের বাসায় আর অপেক্ষা করে না৷

অফিসের দিকে রওনা দেয়৷ পথেই ব্যাংক থেকে কিছু টাকা উঠিয়ে মার্কেট থেকে মোবাইল কিনে নেয়। তায়েফকে উপহার দিবে।

অপর্ণা অফিসে পৌছে শাহেন আলমের রুমে চোখ পরতেই তার কলিজায় পানি ফিরে আসে। ভিতরে তায়েফকে দেখতে পায়। শাহেন আলমের সাথে কথা বলছে।

সে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে তায়েফের বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক পর তায়েফ বেরিয়ে আসতেই সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ তাদেরকে লক্ষ্য করছে কি না। সে তায়েফকে টান দিয়ে এক পাশে সড়িয়ে নিয়ে বুকে ভর দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো, 'রাতে কোথায় ছিলে? আর অফিসে এসেছো একটু জানানো যায়নি? আমি বাসা থেকে ঘুরে আসলাম৷ গেইটম্যান বলল, রাতেও বাসায় ছিলে না।'

তায়েফ অপর্ণা পাগলামি দেখে হেসে দেয়, 'আরে বাবা! ঠান্ডা হও! আমি কি আর জানতাম আপনি আমার বাসায় যাবেন। জানলে তো আর অফিসে না এসে বাসাতেই যেতাম।'

'আচ্ছে সেটা বুঝলাম। কিন্তু রাতে কোথায় ছিলে?'

তায়েফের চেহারা থেকে হাসি চলে যায়, 'অপর্ণা! আমাকে কিছুটা সময় দেও! আমি সব বলবো। আমার একটু সময় চাই।'

'আচ্ছা। ঠিক আছে৷' অপর্ণা তায়েয়ের বুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, 'আমার পাগলামিগুলোতে কিছু মনে করো না৷ প্রতিটা মেয়েই দুষ্টু-মিষ্টি পাগলামি করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। একটা বয়স পর্যন্ত সেগুলা শুধুই তার বাবা, ভাই আরেকজন পুরুষের কাছে উম্মোচিত হয়। যাকে মেয়েটা খুব আপন ভাবে। কিন্তু যত বয়স বাড়ে, যৌবনের গভীরতায় পৌছায় সেই পাগলামিগুলা বাবা, ভাইয়ের কাছ থেকে আড়াল হতে থাকে৷ মনের ভিতর জমা হয়৷ যখন কাঙ্খিত পুরুষটা পেয়ে যায়, তার মুখামুখি হয়৷ তখন আবার পাগলামিগুলা সব বেড়িয়ে আসে। যা শুধুমাত্র ঐ পুরুষটার জন্যই। ভাই কখনোই ছিলো না। বাবাকেও খুব ছোটবেলা হারিয়েছি৷ তাই নিজের ভিতরের পাগলাটে সত্ত্বাটা কখনোই বেড়িয়ে আসেনি। পাগলামি করার জন্য কাউকে আপন ভাবতে পারিনি। তোমাকে একটু আপন মনে হচ্ছে বলে জমে থাকা পাগলামি সব বেড়িয়ে আসছে। তুমি বিরক্ত হইয়ো না। হলে আমার আর আপন বলতে কেউ থাকবে না।'

তায়েফ অপর্ণার এক হাত মুষ্টি করে ধরে নিয়ে বলে, 'কখনোই বিরক্ত হবো না। কখনোই না।'

অপর্ণা হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। নিজের হাত ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে তায়েফের হাতে দিয়ে কলার ধরে বলে, 'নেন! এখন থেকে মোবাইলে না পেলেই হয়। তখন আপনাকে মজা বুঝাবো!' হালকা কাশির শব্দ পেয়ে অপর্ণা তড়িঘড়ি করে কলার ছেড়ে দেয়। সামনে তাকিয়ে দেখে শাহেন আলম দাঁড়িয়ে আছেন৷ শাহেন আলম কোনো ভণিতা না করে বলে, 'তায়েফ! তোমার সাথে অপর্ণাকেও নিয়ে যাও।'

'কিন্তু স্যার!'

'কোনো কিন্তু নয়। যেটা বলেছি সেটাই করো৷' বলে শাহেন আলম চলে যায়। তখন অপর্ণা ভুরু নাচিয়ে বলে, 'ব্যপার কী? আমাকে নিতে এতো আপত্তি কিসে? অন্য কোনো মতলব আছে বুঝি!'

'না তা নেই।'

'হয়েছে আর বলতে হবে না। আপনি বাসায় যান। আমিও কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আপনার বাসায় আসছি। আপনাকে গোছাতে সাহায্য করলাম!'

'লাগবে না। আমি পারবো।'

'হ্যা গতকাল তো দেখেছি, আপনি কেমন গুছাতে পারেন। আল্লাহ কি অবস্থা থাকে বাসার৷ আমি কাল গুছিয়ে দিয়ে আসছি বলেই আপনার ঘর একটু গুছানো হয়েছে৷' বলে অপর্ণা দাঁড়ায় না। নিজের ডেস্কের দিকে চলে যায়। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রগুলো নিয়ে বাসায় চলে যাবে। তায়েফও আর দাঁড়ায় না। বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়৷

চলবে......

পূর্ববর্তী অংশের লিঙ্ক

https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/846750862797078/

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
4 years ago

Comments