#কোথায়_সেই_গয়নার_বাক্স
#শেষ_পর্ব
আমার ছোট ফুপুরকানেও এই কথা চলে আসে,তার পরে সেই দিন রাতে আমাদের বৈঠক খানায় সবার সাথে বসে ছোট ফুপু,সেই মিটং এ অনেক অজানা বিষয় খুলাসা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো ছোট ফুপুর তালাকের বিষয়। সেই মিটিং এ ছোট ফুপু তার দুই ভাই, দুই ভাবি, এবং আমাদের ছোট দাদু ছিলো। আমার ছোট ফুপুর মুখে আমরা সেই দিন এমন কিছু দেখেছিলাম, যা দেখে আমরা ভেবেছিলাম, ফুপু মনে হয় আজকে বৈঠক খানার সবাই কে গুলি করে দিবে। আমরা একটু পর পর বৈঠক খানার দিকে যেতে চাই, আর গামা আমাদের দেখে বলে
-ছোট আম্মাজান মানে (আমাদের ফুপু)জরুরী মিটিং ঢাকছে এখন বৈঠক খানার দিকে কেউ যেতে পারবে না।
আমরা আশেপাশে ঘুর ঘুর করছিলাম আর কান খাড়া করে রেখেছিলাম আর আশা করছিলাম ফুপু ফাঁকা গুলি হলেও যেন করেন,আসলে আমরা ছোট'রা ফুপুর সব কিছুতেই আলাদা একটা রোমাঞ্চকর কিছু ভেবে নিতাম। কারন ফুপু দুপুর বেলা বলছিলো, এখন থেকে বন্দুক নিয়ে ঘুরবো কেউ উল্টা পাল্টা কিছু বললে সোজা গুলি করে দিবো!
আমাদের নিরানন্দ জীবনে ফুপুই ছিলো একমাত্র আনন্দের এবং স্বপ্ন বুনার কারিগর।
ফুপু আমাদেরকে, আমাদের ভেতরের আমিকে দেখতে সাহায্য করেছিলো, আমাদের শক্তি কে এবং আমাদের কে মূল্যবান ভাবতে শিখিয়েছিলো। আমরা একসময় আবিষ্কার করলাম আমরা সব পারি। একসময় আমাদের অবসর কাটতো গুপ্তধন খুঁজে, আর এখন আমরা কোন অবসর পাই না, কারণ আমরা সবাই সারাক্ষণ আমাদের নিজের কাজ করি এবং সব চাইতে বড় কথা আমরা একসময় কোন কিছু কিনতে হলে মায়ের পেছনে ঘুরতাম, মা যদি বাবাকে বলে টাকাটা নিয়ে দেন, তা হলে কিনতে পারবো।আর এখন আমাদের সবার নিজেস্ব ব্যাংক আছে আমরা এখন আমাদের নিজের উপর্জনের টাকা সেই ব্যাংকে রাখি।
এক ঘটনা বলতে গিয়ে আরেক কথায় চল গিয়েছিলাম। আসলে আমাদের ছোট ফুপুর কথা বলতে গেলে দু'চারটা উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে।
সেই দিন সেই বিচার সভায় আমার ছোট ফুপু তার বড় দুই ভাই এবং বড় দুই ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন -আমাকে তালাক দেওয়ার পেছনের কারণ কি বলে আপনারা জানেন? আমি কয়মাস সংসার করেছি? আমি কেমন তা কি,আমার পরিবারের মানুষ ভালো জানে? না হারুন লম্পট টা ভালো জানে? আমার পরিবার কি এখন থেকে আমাকে, আমার তালাক দেওয়া নিয়ে, আমার মূল্যায়ন করবে?আমার চরিত্রের সাটিফিকেট এখন হারুনের তালাকনামা?
-আমাকে কে কি বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু আমি জানতে চাই আমার পরিবারের মানুষ গুলোর চিন্তা- ভাবনা নিয়ে? সবাই তার মনের কথা গুলো এখনই আমাকে বলবেন এবং এটাই সবার মনের কথা বলার শেষ সুযোগ।
এদিকে আমার আম্মার তো ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে।
-আমার আব্বা আর ছোট চাচা ছোট ফুপু কে শুধু আস্তে করে বলে ছোট বুবু তুমি (আমাদের ছোট ফুপুকে আমার আব্বা আর ছোট চাচা কিছু দিন দাদিজান ডাকতো পরে তারা আমাদের পর দাদির সাথে ছোট ফুপির হুবহু মিল থাকায় ছোট বুবু বলে ডাকে। আমাদের দিকে দাদি কে বুবু বলার রেওয়াজ ছিলো)ঠান্ডা হও তুমি এত রেগে গেলে অসুস্থ হয়ে যাবে,আর তুমি অসুস্থ হলে আমরা কার কাছে যাবো? আমাদের তো তুমি ছাড়া কেউ নাই।
আব্বা আর ছোট চাচা শুধু না ,আসলে এই পরিবারের সবাই, সব কিছুতে ছোট ফুপুর প্রতি অনেক নির্ভরশীল ছিল।সবাই আমাদের পর দাদির ছবি দেখতে পেতো ফুপুর ভেতরে। সেদিন বৈঠক খানায় আমাদের ছোট দাদু, যে ছিলো চিরকুমার। উনি বিয়ে করেন নাই এবং বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকতেন না। তিনি কিছু দিন পর পর কিছু জমি বিক্রি করে দেশ ভ্রমনে চলে যেতেন। একবার হিমালয়ে চলে গিয়েছিলিন সাধুসন্ন্যাসী হবেন বলে, সেবার ছোট দাদু তিন বছর টানা বাড়িতে আসেন নাই,সেবার গোটা ইন্ডিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন দাদু। তার পর আজমীর-শরিফ এ খাজা বাবার মাজারে টানা ছয়মাস ছিলেন, তার পর ছোট দাদুর এক বন্ধু, ছোট দাদুকে আজমির শরীফে দেখে চিনতে পারে, আর তখন দাদুকে বলে তুমি বাড়ি যাবে না? তখন দাদুর বন্ধু বাবাকে আজমির থেকে কল দিয়ে ছোট দাদুর কথা জানায়, তখনও ঠিক ছোট ফুপুই ছোট দাদুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। ছোট ফুপু ছোট দাদুর খোঁজ পাওয়ার পরে এমন কান্না - কাটি শুরু করে যে, বাসার সবাই অস্হীর হয়ে যায়। তার পর ছোট দাদুর কে জানানো হয় সে কথা,ছোট দাদু যদি বাড়িতে ফিরে না আসে, তা হলে ছোট ফুপুকে নিয়ে বাবা ইন্ডিয়াতে যাবে দাদুর কাছে, তা না হলে ছোট ফুপু খাওয়া বন্ধ করে দিবে। তারপর ছোট দাদু নিজেই হুলুস্থুল করে বাড়িতে ফিরে আসে।এই হলো আমাদের ছোট ফুপু।
সেই দিন ছোট দাদু জানতে চায়,ছোট ফুপু কেন রেগে গেছে?
রুবাই কেন রেগে আছে?এই বিষয়ে কে কি জানো আমাকে বলো?
দাদু আরো বলে
-আমাদের বাড়ির মেয়ের সন্মান আমরা যদি দিতে না পারি? তবে আমরা কিভাবে বাহিরের মানুষের কাছ থেকে সেই সন্মান আশা করবো?
-তার পরে ছোট দাদু সবার উদ্দেশ্য বলে, আজকে তোমরা সবাই আছো তা-ই আমি তোমাদেরকে একটা কথা পরিস্কার করে জানাতে চাই, যা তোমরা হয়তো-বা জানো না, তা-ই তোমাদের মধ্যে বিশেষ, করে বৌমাদের ধারণা আমাদের রুবাই কে হারুন তালাক দিয়েছে, আসলে হারুন কে আমি বাধ্য করেছি রুবাই কে তালাক দিতে।
-রুবাই এর কাবিন নামায়, মেয়ে কে তালাকের অধিকার দেওয়া হয় নাই এক্ষেত্রে রুবাই রশিদ কে তালাক দিতে গেলে যথেষ্ট পরিমানে ঝামেলা করতে হতো সেক্ষেত্রে আঙুল বাকা করতে হয়েছে একটু।
রুবাই কে আমরা একটা অমানুষের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম।
সেই অমানুষটা ভেবেছিলো রুবাই কে নানা ভাবে অত্যাচার করে আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নিবে, তোমরা দেখেছো রুবাইয়ের বিয়ের পরে ওরা আমাদের বাড়ি থেকে রুপার পান দান এবং আরো কিছু পুরাতন জিনিস চেয়ে পাঠায়, আসলে রশীদ অনেক দিন থেকে দালালী করে বিভিন্ন বিষয়ে। আর ও ঢাকা শহরে কিছু দিন থাকার সময় এন্টিক জিনিসের মূল্য সম্পর্কে জানতে পারে, ওর ধারণা ছিলো আমরা আমাদের বাড়ির জিনিসপত্রের মূল্য জানি না।
আর তার চাইতে বড় কথা হলো রশিদ রুবাই কে ভয়ঙ্কর রকমের অপমান করেছে। আর সেই কথা রুবাই কেন, তোমাদের বলতে পারে নাই? তোমরাই বা, কেন, রুবাই এর চেহারায় কষ্ট দেখতে পাও নাই?
- রুবাই কে দেখে তো আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম, কারণ আমি মৃত একটি মুখ দেখতে পেয়েছিলাম, আজ আমি আবার আমাদের প্রান-চঞ্চল রুবাই কে দেখতে পাচ্ছি।
-রুবাই কে আমি শুধু একটা কথা বলি ছাদে নিয়ে ? রুবাই সমস্যা ছোট থাকতেই সমাধান করে ফেলা ভালো। আর আমাকে তোমার সমস্যা না বললে আমি কি ভাবে তার সমাধান করবো? রুবাই তখন আমার কথা এড়িয়ে যেতে চায় , তখন আমি শুধু বলি আমি আমার মায়ের মৃত মুখ দেখতে পারবো না, আমি তা হলে চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে।তখন রুবাই বলে
-ছোট কাকা রশীদ একটা লম্পট, সে আমাকে বিয়ের প্রথমদিন থেকেই বিভিন্ন ভাবে অপমান এবং অত্যাচার করছে, তবে আমি ওকে কঠিন শিক্ষা দিয়ে তবেই ছাড়বো।
-রশিদ আমাকে বলে,জমিদার বাড়ির মেয়ে কে , বিয়ে করেছি তাকে দিয়ে পা টেপানোর জন্য। অনেক মেয়েছেলে দিয়ে পা টিপিয়েছি কিন্তু জমিদার বাড়ির মেয়েছেলে পাই নাই! এখন সেই শখ মিটাবো। আমি যখন এক কথায় বলে দেই আমি কোন কেনা দাসী না। আমার পরিবারের প্রতিটা ছেলে তার বউ কে সন্মান করে। তেমন আমাদের বাড়ির মেয়েদের কেও তাদের স্বামীরা সন্মান করবে, এটাই আমাদের শেখানো হয়েছে, তখন আমি ঘরে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাদের বাড়িতে আশ্রিত একজন নারী কে ঘরে নিয়ে আসে।
তখন ছোট দাদা ফুপু কে বলে
- ঐ শয়তানের বাড়িতে তো আমি আর তোমাকে ফেরত যেতে দিতে পারি না, তুমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছো ওর সাথে সংসার করবে না, সেখানে তোমার জীবন নিয়ে আমি রিস্ক নিতে পারি না। তার পর গামা রশীদের শরীর বানিয়ে দেয়, আর সাথে গামার বউ রুপার একটা বাক্স রশীদের হাতে দেয়, রশীদ সেই বাক্স খুলে দেখে আর চিৎকার দিয়ে উঠলে, তাকে বলা হয় রুবাই আর তার বাড়িতে যাবে না। আর রশীদ কে জীবিত ফেরত যেতে দেওয়া হলো এই কারণে, সে যেন বাড়িতে গিয়ে ভালোয় ভালোয় তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের ছোট দাদা সবাই কে তখন বলে
-একদিন এই পরিবারের একজন নারী তার প্রানপ্রিয় স্বামীর অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছিলো এবং সে নারীর সন্মান করতে যে শিক্ষা এই পরিবারে দিয়ে গেছে তার ফল এখন সবাই ভোগ করছে আমাদের পরিবারে নীতি হলো তারা সব সময় নারীকে তাদের স্ত্রীকে সন্মান করবে, আমরা আমাদের জমিদারী বিসর্জন দিয়েছিলাম আমাদের পর দাদি তার হীরা জহরতের বাক্স ফেলে দেন যা দিয়ে তখনকার দিনে আরো দুবার জমিদারি কেনা যেতো।
আর সেই বাড়ির মেয়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে অন্যয় আচরণ মেনে নিবে এটা কিভাবে তোমরা ভাবতে পারো?
-এখন থেকে তোমরা সবাই মনে রাখবে মেয়ে বিয়ে দেওয়া মানে তার সব ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া না, বরং মেয়ের প্রতি আরো বেশি দায়িত্ব শীল হওয়া, তাকে সব সময় এই সাহস দিবে যে আমরা তোমার পাশে সব সময় আছি আর তুমি বিয়ের আগে যেমন এই বাড়ির মেয়ে ছিলে সারাজীবন এই বাড়ির মেয়ে থাকবে তোমার বাড়িতে চলে আসতে হলে তুমি একবারও ভাববে না।
সেই দিন ছোট ফুপুর তালাকের বিষয় সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। আর যেহেতু ছোট দাদু ফুপুর বিষয়টা, সুন্দর ভাবে সবাই কে বুঝিয়ে দেন, আর সবাই ছোট দাদুর কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচে। ছোট দাদুর কারণে কাউকে আর আলাদাভাবে ছোট ফুপুর প্রশ্নের জবাব দিতে হয় নাই। তাই আর কোন ধরনের হইচই হয় নাই সেদিন। ছোট দাদু সবাই কে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। এবং তিনি আবারও এই পরিবারের নিয়মগুলো সবাই কে নতুন করে মনে করিয়ে দেন।
ছোট দাদু যেহেতু বিয়ে করে নাই, তাই ছোট দাদুর সম্পত্তির ওয়ারিশ, আমার বাবা'রা ভাই- বোনেরা হবে এটাই স্বাভাবিক ছিলো। তবে সেদিন ছোট দাদু সবাই কে বুঝিয়ে দেন যে, ছোট ফুপির মনে কেউ কষ্ট দিলে ছোট দাদু তাকে কখনো ক্ষমা করবে না। আসলে ছোট দাদুকে তার বোহেমিয়ান জীবন থেকে ঘর মুখি করেছে ছোট ফুপু। ছোট ফুপু দাদু কে এমন যত্ন করতো,আর বকাও দিতো অনিয়ম করলে, মনে হতো ছোট দাদু'র মা হচ্ছে ছোট ফুপু।
বড় পরিবার গুলোতে স্বার্থের সাপ গর্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকে, একটু সুযোগ পেলেই ছোবল মারে।আমাদের পরিবারটা ধরে রাখা হয়েছে, কঠিন ভাবে। কারন আমাদের পরিবারের সাথে যুক্ত পরিবার হচ্ছে আমার মায়ের পরিবার, আমার চাচীর পরিবার, আমার বড় ফুপির শ্বশুর বাড়ির পরিবার। কোন পরিবারের মানুষই অন্য পরিবারের মতো হয় না। আমাদের পরিবারের যৌথ অবস্থা ভাঙ্গার চেষ্টা খুবই সচেতন ভাবে আমার মায়ের এবং চাচির পরিবার করতে চেয়েছে, কিন্তু পারে নাই।এর কারণ ছিলো ছোট দাদুর সম্পত্তি ভাগ না পাওয়ার ভয়। আর ছোট ফুপু যা করছিলো তাতে সবার লাভই ছিলো। সবার ধারণা ছিলো ছোট ফুপু যাই করবে তা তো বাড়ির ছেলে মেয়েদের জন্যই থাকবে, তার তো ছেলে মেয়ে সংসার কিছুই নাই।
ফুপুজানের টাকায় করা বাগান আর পুকুরের মাছ চাষ থেকে বছরে যা আসে, তা দিয়ে পারিবারিক সমস্ত ব্যয় মিটিয়েও, যথেষ্ট পরিমানে টাকা জমা হতে থাকে, যা থাকতো ফুপুর একাউন্টে।এটা নিয়ে টুকটাক অনেক কথা হতো, যা আমাদের ছোট ফুপু শুনেও শুনতো না।
আমাদের ছোট ফুপু আমাদের কে এমন ভাবে তৈরি করেছে যে, এখন আমরা সবাই বিজি থাকি আমাদের কাজ নিয়ে, ছোট ফুপু আমাদের বাড়ির ভেতরে, আমাদের বাগানের মধ্যে সবার জন্য আলাদা আলাদা সীমানা ভাগ করে দিয়েছে এবং পুরাতন আম কাঠাল গাছ কেটে নতুন বাগান করার কাজ হাতে নিয়েছে, সবাই কে একই পরিমান গাছ কিনে দেওয়া হয়েছে আমরা সবাই স্কুল, কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে দুই তিন ঘন্টা সময় বাগানে কাটাই, সবাই পাল্লা দিয়ে বাগানের যত্ন করি, কার বাগান কত সুন্দর করতে পারি সেটা নিয়ে।
আমাদের বাড়ি একসময় খামার বাড়ি হয়ে গেলো, আমাদের বাড়িতে গরু আছে, হাস,মুরগী আছে, সবজি বাগান আছে পুকুরে মাছ আছে আমাদের বাড়িতে শুধু কাপড় বুনা হতো না।
একসময় যে জমি বিক্রি করে আমাদের প্রয়োজন মিটানো হতো, আজ সেই জমি কাজে লাগিয়ে আমরা আবার আমাদের সচ্ছলতা ফিরে পেয়েছি।
আমাদের ফুপু এদিকে আবার আইন পড়া শুরু করে, ফুপুর কথায় বাড়ির জমি জমা ধরে রাখতে হলে আইন জানা খুবই জরুরি। আসলে ফুপু এক সেকেন্ড বসে থাকতে চাইতো না, ফুপু বলতো মানুষ যতক্ষন কাজ করে ততক্ষণ তার ভেতরে কোন টেনশন বা ডিপ্রেশন কাজ করে না। চুপচাপ বসে থাকলেই মাথায় অযথা চিন্তা আসে, কি পেলাম? কি পেলাম না, সেই হিসাব করে কি হবে? কাজ করার মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। তোমার লাগানো একটা গাছে, যখন ফল ধরবে তখন বুঝতে পারবে তুমি সফল। প্রকৃতির সাথে মিশে যাও দেখবে শান্তি পাবে। আমাদের বাসায় আধুনিক সব উপকরণ ছিলো, আমাদের সবার মোবাইল আছে, বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহার হয়, তার পরেও আমরা কখনো প্রযুক্তি নিয়ে পড়ে থাকতাম না, আমাদের বন্ধু'রা সবাই সারাদিন মোবাইলে নিয়ে পড়ে থাকে,আমাদের বন্ধু'রা আস্তে আস্তে সবাই যখন ফেসবুক আর ইউটিউব, ভিডিও গেমস নিয়ে বিজি আমরা তখন বিজি বাড়িতে জৈব সার তৈরি করা সঠিক নিয়মে কাছের, যত্ন করা নিয়ে বিজি।
আমরা প্রতি সপ্তাহে একদিন পিকনিক করতাম আর সেই পিকনিকের সব কিছু থাকতো আমাদের বাড়ির চাল, মুরগি, ডিম, সবজি আর মাছ দিয়ে পিকনিক হতো। আর পিকনিকের রান্না কিন্তু আমাদের করতে হবে, সেদিন মা, ফুপু বা কাকি কোন কাজ করবে না। ফুপুর এক কথা এখন আধুনিক যুগ, ছেলেরা রান্না না জানলে হবে?
আমাদের অবশ্য গামা আর গামার বউ সাহায্য করতো আর একটা নিয়ম ছিলো তা হলো সেদিন আমরা আমাদের বন্ধু'দের পিকনিকে নিমন্ত্রণ করতে পারতাম।
ডিসেম্বর মাসে আমাদের বড়ফুপু, ফুপা আর আমাদের কাজিনরা বেড়াতে আসলো তারা এখন ছুটি পেলেই চলে আসে, আমাদের বড় ফুপা সব সময়ই ছোট ফুপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো, প্রতিবার যে পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসতো, সেই পাত্রই নাকি পৃথিবীর সেরা পাত্র, তার পর সবাই মিলে একদিন -দুদিন সেই বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা তার পর ছোট ফুপু কঠিন কোন শর্ত দিয়ে দিবে তখন বড় ফুপা বলবে এটা কি বলো ছেলে কেন ঘরজামাই থাকবে? তখন ফুপি বলবে মেয়েরা যদি বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যেয়ে থাকতে পারে? তা হলে আপনার মতে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো পাত্র, তার শ্বশুর বাড়িতে থাকতে কি সমস্যা? তারপর আর কি! বিয়ের কথা সেখানেই শেষ।
আসলে ছোট ফুপু ছিলো অনেক সাহিত্যক মনের একজন মানুষ, আর ছোট বেলা থেকে প্রচুর গল্পের বই পড়তো, ফুপুর তার জীবন নিয়ে খুব সুন্দর পরিকল্পনা ছিলো ছোট ফুপু কে আমাদের পরিবারের সবাই সব সময় অনেক বেশি আদর করতো। ফুপুর মনটা ছিলো টলটলে পুকুরে জলের মতো স্বচ্ছ। কিন্তু ফুপুর বিয়ের পরে ফুপু এত বড় আঘাত পান, আমাদের ফুপার কাছ থেকে যা তার কল্লনার বাহিরে ছিলো, ফুপু প্রথম কোন মানুষের এমন কদাকার রুপ দেখেন, তাও তার জীবন সঙ্গীর কাছ থেকে। এমন ঘটনা ঘটলে সাধারণত মেয়েরা মানিয়ে চলার চেষ্টা করে, তা না হলে নিজেকে ঘুটিয়ে ফেলে, তা না হলে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রিতার মতো জীবন যাপন করে। আর সেখানে আমাদের ফুপু তার সমস্ত জীবনের পড়ালেখা তার পরিবারের শিক্ষা এবং ফুপুর নিজের তৈরি ব্যক্তিত্ব কাজে লাগিয়ে সে নিজেকে, সবার সেরা প্রমানিত করে।তিনি দিখিয়ে দেয় জীবন বহমান, জীবন কে নিজের মতো তৈরি করে নিতে হয়, এবং ভালো থাকতে জানতে হয়।
আমাদের ছোট ফুপুর জীবনেও আবার, একজন রাজপুত্র আসে, সেই গল্প বলেই শেষ করবো এই কাহিনি।
আমাদের বড়ফুপার মধ্যে ইদানীং আমাদের বাড়ির প্রতি বেশ আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়,আসলে এখন আমাদের বাড়িটা খুবই সুন্দর হয়েছে, পুকুর ঘাটগুলো সংস্কার করা হয়েছে, বাড়ি টা এখন আবার জমিদার বাড়ি বা বাগান বাড়ি বলা যায়, তবে পরাতন বাড়ি সংস্কার করা অনেক টাকার বিষয়, আর বাড়ির কিছু কিছু জায়গা একটা নাজুক হয়ে পড়েছে।
যেহেতু আমরা আমাদের পুরাতন জমিদার বাড়িতেই এখনো বাস করছি, আর আমাদের এই বাড়ি ভাঙ্গার পক্ষে কারোই মত নাই। তাই বড়ফুপা সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করে, তার এক বন্ধুর ছোট ভাই লন্ডনে থাকে, সে একজন ভালো স্থপতি। তিনি দেশে এসেছে বেড়াতে, তিনমাস থাকবেন, আর ওনার পুরাতন স্হাপনার প্রতি খুবই আগ্রহ। ওনাকে আমাদের বাড়ির কথা বলা হয়েছে তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন বাড়িটা দেখার জন্য। সবাই যদি একমত হয় বাড়িটা না হয় ব্যাংক লোন নিয়ে হলেও সংস্কার করা যাবে। এই প্রস্তাব শুনে ছোট দাদু বলেন ওনাকে আসতে বলো, আগে বাড়ি দেখুক তার পর শুনি সেকি বলে। ছেলে -মেয়ে নাতিপুতি নিয়ে সংসার, বাড়িটা এখনো কতটুকু বসবাসের উপযোগী আছে তাও তো জানা দরকার।
তার দুই দিন পরেরেই ফুপার বন্ধু'র ছোট ভাই চলে আসে আমাদের বাড়িতে। তাকে বৈঠক খানার সাথের গেস্ট রুমটা ভালো করে পরিস্কার - পরিচ্ছন্ন করে টিপটাপ করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। আসলে আমাদের বাড়িতে অনেক দিন পর বাহিরের মেহমান আসলো।
ওনার নাম ছিলো ইমরান আমরা ওনাকে ইমরান চাচু বলে ডাকতাম।
ইমরান চাচু বাড়ি দেখা বাদ দিয়ে হাঁসের ডিম দেখা শুরু করলেন, আসলে ইমরান চাচু আমাদের বাড়ির যা দেখেন তাতেই মুগ্ধ হন। ইমরান চাচু আসার পরের দিনের কথা তিনি আমাদের পুকুরের কাছে হাঁটতে গিয়ে হাঁসের ডিম কুড়িয়ে পান, আসলে আমরা তো হাস পালি আর হাস গুলো অনেক সময়ই পুকুর পারে ডিম পারে এমনও হয় পানিতেও ডিম পারে, এটা দেখে আমরা অভ্যস্ত, আর ইমরান চাচু তিনটা হাঁসের ডিম নিয়ে বাসায় এসে গামাকে দেয়, আর বলে এই ডিম আমি কুড়িয়ে পেয়েছি , এই ডিমের মালিক এখন আমি। আমরা তখন ইমরান চাচুর ছেলেমানুষী দেখে খুবই মজা পাচ্ছিলাম।
ইমরান চাচু সব সময় ছোট ফুপুর পিছনে পিছনে ঘুরতো, আর ছোট ফুপু কে রাজকুমারী বলে ডাকতো। আমরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম, শুধু মনে হতো, ফুপু ইমরান চাচুকে যেকোন দিন বলে বসবে, আপনি তো কোন কাজই করছেন না, তা হলে এখানে কেন বসে আছেন? আজই ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাবেন।
আসলে ইমরান চাচু দারুণ সব গল্প বলতো, আমরা মুগ্ধ হয়ে শোনতাম।
তার পর ইমরান চাচু একসময় আসলেই বাড়ির কাজ শুরু করেন। আমাদের বাড়ির প্রতিটা কোন পর্যবেক্ষন করেন তার পর কিছু ইটের নমুনা পরীক্ষা করেন, উনি কিছু যন্ত্রপাতি আনান ঢাকা থেকে, সাথে একজন মানুষও আসে তিনি ইমরান চাচুকে তার কাজে হেল্প করেন। তার পর উনি চলে যান। এদিকে ইমরান চাচু আমাদের বাড়িতে আছেন প্রায় একুশ দিন থেকে, উনি তিনদিন থাকবে এমন কথা ছিলো। বড় ফুপা এর মধ্যে কয়েক বার কথা বলেছে, বাড়ির সবার সাথে। ইমরান চাচু থাকাতে আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানার জন্য । সবাই একবাক্যে বলেছে কোন সমস্যা নাই ইমরান চাচু অনেক ভালো।
ইমরান চাচুর খাবার সব সময় ওনার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, একদিন উনি খাবার প্লেট নিয়ে পুকুর পাড়ে চলে যান আর বলে, একা-একা ঘরে খাওয়ার চাইতে পুকুরের মাছদের সাথে খাবার ভাগ করে খাওয়া ভালো। তারপর থেকে ওনাকে আমাদের সাথে ভেতর বাড়িতে খেতে বলা হয়েছে। আর আমাদের বাড়ির সব মহিলারা ওনাকে পছন্দ করতো।
এর মধ্যে আমাদের সাপ্তাহিক পিকনিকে ইমরান চাচু দারুণ রান্না করে সবার মন জয় করে নেয়। আমরা ছোটরাও বুঝতে পারছিলাম ইমরান চাচু সব সময় ছোট ফুপুর ভালো লাগার মতো কাজ গুলো করতে চাইতো। ইমরান চাচু আমাদের বাড়ির সব ছবি নিয়ে পড়লেন তিনি আমাদের বাড়ির ছবি গুলোকে নতুন করে বাঁধাই করা এবং কিভাবে এগুলো আবার ঠিক করা যায় তার জন্যও অনেকের সাথে যোগাযোগ করেন।
তারপর একদিন ইমরান চাচু চলে যাবে, আমরা সবাই মন খারাপ করে আছি, তখন আমার আম্মা ইমরান চাচুকে বলে, আরো কয়েক টা দিন থেকে যেতে ভাই, তুমি থাকায় বাড়ি টা কেমন হাসিখুশি ছিলো।
ইমরান চাচু তখন যা বললেন তা শুনে সবাই অবাক উনি তখন বললেন, ভাবি আমি তো আমার কিছু দরকারী কাজ আছে ঢাকাতে তা শেষ করে, আর আমার কিছু জিনিস আছে তা আনতে যাচ্ছি এই ধরেন সাত আট দিন লাগবে, বড় জোর দশদিন তার পরে তো আবার চলে আসবো এখানে। আর আমি থাকাতে তো আপনাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না, আমি এবার দেশে থাকার সময়টা এখানেই থাকবো। আর আপনাদের বাড়ির ভেতরে অনেক কাজ আছে তা করে দেবার বদলে খাওয়া থাকা ফ্রি। ইমরান চাচু সব সময়ই মজা করে কথা বলে আমরা সবাই এই কথা কে খুব সিরিয়াস হিসাবে নেই নাই।
ইমরান চাচু চলে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যে বড়ফুপা আর ইমরান চাচুর বড় ভাই আমাদের বাড়িতে আসে। আর ছোট দাদুর কাছে ছোট ফুপুর সাথে ইমরান চাচুর বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলে, আর বড় ফুপা ছোট ফুপি কে অনেক বুঝায় ইমরান চাচু কে বিয়ে করার জন্য। ছোট ফুপির এককথা, ইমরান ভালো তবে আমি এখন আমার মতো করে জীবন গুছিয়ে নিয়েছি এবং অনেক ভালো আছি, আমি নতুন করে আবার কোন ঝামেলা নিতে পারবো না।
বাড়ীর সবাই বিয়ের পক্ষে মত দিয়েছে, শুধু ছোট ফুপুর মত হলেই বিয়ে হবে, আমরা সবাই এখন সারাক্ষণ শুধু ভাবি ছোট ফুপু কেন মত দেন না, ফুপু কেন এত পাষাণ!
শেষ পর্যন্ত সবাই হার মানে ছোট ফুপুর সিদ্ধান্তের কাছে। শুধু একজন হার মানেন নাই, সে হচ্ছে আমাদের ইমরান চাচু। ইমরান চাচু লন্ডনে ফিরে যাওয়ার আগে আমাদের বাড়িতে আবার এসেছিলো এবং সাতদিন ছিলো এই সাতদিন উনি ফুপুর সাথে অনেক কথা বলে। শেষ পর্যন্ত ইমরান চাচু ফুপির শর্তে রাজি হয়। ইমরান চাচু বলে একবছর মনোযোগ দিয়ে কাজ করবো সব কিছু গুছিয়ে চলে আসবো। তারপর তোমাদের বাড়ির গুপ্তধন খোঁজার কাজ নিবো।
ফুপুর সাথে ইমরান চাচুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, ইমরান চাচু এক বছরের মধ্যে লন্ডনের পাট চুকিয়ে দেশে চলে আসবে, তার পর ফুপুর সাথে ইমরান চাচুর বিয়ে হবে।
আমাদের ছোট ফুপু এখনো খুবই রাগী একজন মানুষ, তবে আমরা এখন ফুপি বকা দিলেই, বা কিছু হলেই বলি, ফুপি আমরা কিন্তু ইমরান চাচুর দলে চলে যাবো!তখন ফুপি হেঁসে ফেলে বলে, তার মানে ইমরানের সাথে তোমাদের জায়গা হবে বাড়ির বাহিরের কুঁড়েঘরে।
এখন আমরা সবাই খুবই খুশি, কারণ ছোট ফুপির মন সব সময়ই খুশি থাকে। ফুপির এখন অনেক সময় কাটে ইমরান চাচুর সাথে কথা বলে।
আমি এই পরিবারের সপ্তম পুরুষ আমি এখনো আশা ছাড়ি নাই গুপ্তধনের, ইমরান চাচু আমাকে বলেছে তোমাদের বাড়ির পুরাতন একটা নক্সা আমি পেয়েছি, সেই নক্সায় একটা পাতাল ঘর আছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আবার অনেক সময় এমনও হয় নক্সায় আছে কিন্তু, পরে বাদ দেওয়া হয়েছে। তখন আমি জোর দিয়ে বলি না না আমাদের বাড়িতে সুরঙ্গ আছে। ইমরান চাচু হাসে আর বলে, মানুষের বাঁচার জন্য শুধু বাস্তববাদী হলেই চলে না, তার সাথে কল্পনাও থাকতে হয় তবেই জীবন সুন্দর হয়।
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/861772211294943/