# কনে বদল
শিমুল বনে আগুন লেগেছে, পুড়ছে কারো মন! আর অন্য কারো মনে শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে!!
শিখা দুচোখ ভরে দেখছে।আহ! এতো সুন্দর কেন সবকিছু!!
চোখে জল এসে যায়।
- এতো সুন্দর বসন্ত আগে কখনো দেখিনি।
মাহির কিছু বলে না, শুধু শুনে যাচ্ছে শিখার কথা।
শিখার গাল বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কালের যাত্রার ধ্বনি শিখা শুনতে পাও??
শিখা হয়তো শুনতে পাচ্ছে।।
লুকোচুরি লুকোচুরি.... সব কিছুতে কেমন একটা লুকোচুরি খেলা....!!
সবাই তার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে!!
শিখাও বাদ যাবে কেন? শিখাও এ খেলায় যুক্ত হয়ে গেছে। এমন ভাবেই থাকে যেন সে কিছুই জানে না!
কিন্তু শিখা সবটা জানে।কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না, যে ও সবকিছু জানে।
কি অদ্ভুত লুকোচুরি!
বেলকনিতে বসেই গোধূলির রঙ গায়ে মাখলো শিখা। শিখা একা নয়,মাহিরও।
জ্বলজ্বল করা সূর্যটা ধীরে ধীরে, নিভু নিভু হয়ে পশ্চিমে ডুবে গেছে, তার সাথে সাথে আধারে ডুবে গেছে সব।
শিখা জানে এই সূর্যটা যেমন নিভু নিভু হয়ে অস্ত গেছে, তেমনি সেও অসীমের পথে যাচ্ছে।
সূর্য অস্ত গেলেও উদয় হয়ে ঝলমলে রোদে হাসবে, কিন্তু শিখার জীবন প্রদীপ নিভে গেলে আর উদয় হবে না।
মানুষের সময় যখন ফুরিয়ে যায় তখন বাঁচার আকুতি আরও তীব্র হতে থাকে। সবকিছু মনে হয় এতো সুন্দর কেন! এতো মায়া কেন!
তবুও কিছু মানুষ মায়া কাটাতে চায়।
শিখার কাছে গোপন করলেও শিখা জেনে গেছে তার লিউকেমিয়া। নিজের অজান্তেই এই রোগ ধীরে ধীরে শেষ করে দিয়েছে তাকে,কখনো গুরুত্ব দেয়নি। অসুস্থ বোধ করলেও কাউকে বলেনি,দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছে, যার শেষ পরিনতি এই!!
একেবারে লাস্ট স্টেজে আসার পরে ডাক্তার দেখানোর হয়েছে।কিন্তু এখন আর কিছুই করার ছিলো না। তবুও হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।
কিন্তু বাড়িতে আসার জন্য ছটফট করায় ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিলো।ডাক্তাররাও মানুষ। দুঃখ, কষ্টের অনুভূতি তাদেরও আছে।
শিখার জন্য কিছু করতে পারবে না, শুধু ধরে বেঁধে কিছু মেডিসিন দিতে পারবেন! এটা ভালো করেই জানেন মেডিসিন দিয়েও কিছু হবার নয়।তারচেয়ে যে ক'টা দিন আছে, সেদিনগুলো মেয়েটার পরিবারের সাথে কাটানোই ভালো। এই ভেবেই ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তারা শিখাকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু শিখা জেনে গেছে।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিভে শুনে ইভা আপত্তি করছিলো।
সারোয়ার সাহেব, ইভা আর মাহির কথা বলছিলো নিচুস্বরে।শিখা ঘুমে ছিলো। কিন্তু যখন ঘুম ভেঙে গেছে তখন শুনতে পারলো ওকে নিয়েই আলোচনা।
কোনো সাড়া না দিয়ে ঘুমের মতো পড়ে রইলো, কারণ শিখা জানতে চেয়েছিলো ওর কি হয়েছে।
- বাড়ি নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে? এখানে তো ট্রিটমেন্ট ভালো চলছে। নিয়ে গেলে যদি আরও সমস্যা হয়??
- লাভ তো তেমন কিছুই হবে না, শুধু শুধু মেয়েটা বন্দী থেকে কষ্ট পেয়ে যাবে।
- কিছুই কি করার নেই বাবা? ডাক্তার কি আশার কোনো কথা বলেনি?
- না গো মা। লিউকেমিয়া একেবারে লাস্ট স্টেজে ডাক্তারের আর কিছু করার নেই।কেমো দিলেও এর ধকল সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই ওর শরীরে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবে না।
- বাবা, শিখাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। এখানে ওর কষ্ট হচ্ছে। সারাজীবন কষ্ট পেয়ে গেছে। শেষ ক'টা দিন এভাবে আজাব না দিয়ে ওর ইচ্ছের দাম দেয়া উচিত।
- হা। সেটাই ভালো হবে। সবার সামনে থাকলে মনে কিছুটা শান্তি পাবে।
- তাহলে সেটাই করো ভাই,মেয়েটার এই অবস্থা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।
শিখা সব কথা শুনেছে। ব্লাড ক্যান্সারে শেষ পর্যন্ত শিখা নিভে যাবে এটা জেনে গেছে।
সন্ধ্যা নামায় মাহির শিখাকে রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দেয়।
কেমন মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার উপর।
- আমার জন্য এতো কষ্ট করছেন কেন?
- কি কষ্ট করলাম?
- এইযে আমার এতো সেবা-যত্ন করছেন!
- তুমি অসুস্থ তাই।
- হুম।
- আমি আমাদের বাড়িতে যেতে চাই...
..
মাকে বলেছি...... উনি আসবেন আমাকে নিতে।
- বাড়িতে যাবে মানে কি?? এই অবস্থায় যাওয়া অসম্ভব। কোথাও যেতে পারবে না। এখানেই থাকবে।
শিখা মৃদু হাসে।
- যেতে পারবো। আমাদের বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।
- তুমি জানোনা ওখানে পরিস্থিতি? সেখানে তোমাকে কিছুতেই যেতে দিবো না।
- যাইহোক,ওটা আমার বাড়ি। জন্মের পর থেকে ওখানেই থেকেছি।এখন কেন জানি মন খুব টানছে সেখানে যেতে। আপনি না করবেন না।
- দেখো শিখা,আমি এই অবস্থায় তোমাকে পাঠাতে পারবো না। তুমি এখানেই থাকবে আমার কাছে।
তোমার মা বোন চাইলেও ঠিক মতো তোমার দেখাশোনা করতে পারবে না।
- ওসব নিয়ে চিন্তা করবেনা না। কিছু দিনেরই তো ব্যাপার!
- কিছু দিনের ব্যাপার মানে?
মাহির চমকে উঠে।
- কিছু দিন পরে তো চলে আসবো।
- হুম।
- আমাকে যেতে দিবেন না? বেশি কিছু চাইনি আপনার কাছে।
- তুমি বুঝতে পারছো না!
- আমি বুঝতে পারছি। আপনি না করবেন না।
আমাকে যেতে দিন।
মাহির গম্ভীর হয়ে গেলো।শিখাকে সে যেতে দিতে চায়না।মাহির চায় শিখা ওর সামনেই থাকুক।
কেন চায় সে নিজেও জানে না। হয়তো মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেছে, তাই।সেখানে গেলে শিখা শান্তি পাবেনা,সেবাযত্ন ও পাবেনা ঠিকঠাক। এসব ভেবেও মাহির ওকে যেতে দিতে চাচ্ছে না।
আর শিখা?
শিখা মনে মনে ভাবছে - আমার জন্য মাহিরের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মাহিরের জীবনে এক অভিশাপের নাম - ' শিখা'। মরেই তো যাবো।কেন অর উপর বোঝা হয়ে থাকবো??
সব দায় থেকে মরার আগেই মুক্তি দিয়ে যাই।
এতো যত্ন, এতো কেয়ার! এসব দেখলে বাঁচার ইচ্ছে হবে।
তারচেয়ে আমি চলে যাবো। সবাই এখানে কত কষ্ট করছে আমার জন্য!.
এইসব কথা ভেবেই শিখা যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ওদের উপর আর বোঝা হয়ে থাকতে চাইছে না শিখা।
মাহির অনেক ভেবে বললো -
আমাকে একটু ভাবতে দাও।
মাহির অনেক ভেবে বলল
- আমাকে একটু ভাবতে দাও।
মাহির অনেক ভাবলো শিখাকে যেতে দিবে কিনা।কিন্ত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।
ওর ইচ্ছে করছে না যেতে দিতে। এদিকে শিখা যাবার জন্য উতলা হয়ে আছে।
শেষ পর্যন্ত মাহির ওর বাবাকে বললো
- বাবা, শিখা ওর মায়ের কাছে থাকতে চাইছে।
- বেশতো,কাউকে পাঠিয়ে ওর মাকে নিয়ে আসো।
- না বাবা,ও ওবাড়িতে থাকতে চাইছে!
- তা কিভাবে সম্ভব? তুমি জানো না সেখানে কি হালে ছিলো?
- জানি বাবা।
- তবে এ কথা বলছো কি করে? তুমি ওকে মেনে নিতে পারোনি ভালো কথা, তাই বলে ওখানে অবহেলায় ছেড়ে দিবে?
- তুমি বুঝতে পারছো না বাবা,আমি যেতে দিতে চাচ্ছি না।
কিন্তু শিখা যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।
- হুমম।
আমিও বুঝতে পারছি না কি করা উচিত!
এখানে যে সেবাযত্ন পাবে সেগুলো পাবে কিনা জানি না। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা হলো এই সময় যদি ওর মনে টানে তবে যেতে দেয়াই দরকার। আফসোস রেখে....
- ঠিক আছে বাবা, আমি ওকে আবারও বুঝাতে চেষ্টা করবো যদি মানে তো ভালো আর না মানলে...
আফরোজা বেগমে যখন শুনলেন শিখা ওর বাড়িতে যেতে চাচ্ছে, তখন শিখার কাছে গেলেন। ওর কাছে গিয়ে বসে মাথায় হাত রেখে
- তোমার এখানে অসুবিধা হচ্ছে মা?
- না মা।আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।আপনারা এতো দেখাশোনা করেন, অসুবিধা হবার সুযোগ ই দিচ্ছেন কই?!
- তাহলে বাড়ি যেতে চাচ্ছো কেন?
- মা, কেন জানি মন খুব চাইছে একটা বার যেতে। কিছু দিন থেকেই চলে আসবো।
- সুস্থ হও আগে,তারপর যাবে।
- কিছু দিনের জন্যই তো।আপনি বাবাকে একটু বলেন না মা!
খুব যেতে ইচ্ছে করছে!
- আচ্ছা দেখি, তোমার বাবা কি বলেন!
মাহির শিখাকে আবারও অনেক বুঝালো। কিন্তু শিখা যাবেই বলে ঠিক করেছে। তাই মাহির শেষ পর্যন্ত রাজি হয় শিখাকে যেতে দিতে।
শিখার মা, মামা এসেছে ওকে নিতে।
মাহির শিখার কাছে এসে বললো
- সত্যিই চলে যাচ্ছো?
- হা।
আপনি দেখতে যাবেন আমাকে?
- নাহ!
- কেন?
- দেখতে যাবো কেন?
আমি যাবো নিয়ে আসার জন্য।
- তাই বুঝি?
শিখা হাসে।
- হা তাই।
একটা হাতে শিখার গাল ছুঁয়ে
- ভালো থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো তোমাকে আনার জন্য।
শিখার অজান্তেই চোখ ভিজে গেছে।
মাহিরের সেই হাতেই হাত রেখে বললো
- আপনিও অনেক ভালো থাকবেন। জামাকাপড় এগুলো এলোমেলো করে রাখবেন না।
নিজের খেয়াল রাখবেন।
শিখা অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে।
একদিন অজানা একটা ভয় নিয়ে বউ সেজে এবাড়িতে এসেছিলো। আজ এবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। আর কখনো ফেরা হবে না এবাড়িতে।কখনো এবাড়ির বেলকনিতে বসে শিমুলে আগুন ধরা বিকেল দেখা হবে না।
এ বাড়ি ছেড়ে শিখা চলে যাচ্ছে।
কি আজব! জটিল যায়গা এ দুনিয়া! মানুষ যখন বাঁচতে চায় না, তখন মৃত্যু ধরা দেয় না!
আর যখন বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে থাকে, বাঁচতে ইচ্ছে করে তখন চারদিক থেকে অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে মৃত্যুর কালো ছায়া।।
শিখার এখন মাঝে মাঝে বাঁচতে ইচ্ছে করে। পাছে এই ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে যায়! সেই ভয়ে রীতিমতো পালিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে।
তীব্র হলেও কোনো লাভ নেই জানে,মিছেমিছি মায়া বাড়বে।
ওর প্রতি মাহিরের ভালোবাসা নেই।যা আছে সেটা কেবলই সহানুভূতি।
এতো দিন একসাথে থাকা একটা মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছে, সেটা,দেখে যেকোনো মানুষের দয়া হবে, খারাপ লাগবে।
মাহিরের ও এমনই হয়েছে।
বড়জোর একটা মায়ায় পড়ে যাবে!!
কিন্তু কি হবে এই মায়ায় জড়িয়ে??
একা যেমন এসেছিলো, সেই একাই চলে যাচ্ছে। না হয় ভালোবাসা নামক অদৃশ্য অনুভূতি টা শিখার জীবনে আসলো না। শিখার জীবনের গল্প না হয় এখানেই থেমে যাবে।
কি ক্ষতি হবে তাতে?
সূর্য পূর্ব দিক বাদ দিয়ে পশ্চিমে উদয় হবে না। ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরবে না।কিছুই থেমে থাকবে না।
সব নিয়মমাফিক চলবে। হয়তো কিছু মানুষের দুঃখ হবে, কষ্ট হবে।
কিন্তু সেটা সাময়িক।
কারণ সময় এমন এক ঔষধ যা ধীরে ধীরে সব কিছু সহজ করে দেয়, ভুলিয়ে দেয়।
শিখার না থাকার দুঃখ ও একটা সময় ভুলে যাবে সবাই।
চলবে....