পড়া ও জানা প্রয়োজন
‘যার উপকার করিনি, সে কেন আমার বিরুদ্ধে!’
আনিসুল হক
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৮২০ সালে জন্মেছিলেন তিনি।
বিদ্যাসাগরের বেশভূষা খুব সাধারণ ছিল। পরনে ধুতি, গায়ে মোটা চাদর আর পায়ে এক জোড়া চটি।
একদিন তিনি গেছেন রেলস্টেশনে। ট্রেন থেকে নামলেন এক ডাক্তার বাবু। হাতে ছোট্ট ব্যাগ। সহজেই বয়ে নেওয়া যায়। তবু তিনি ডাকলেন ‘কুলি’ ‘কুলি’ বলে। ঈশ্বরচন্দ্র এগিয়ে গেলেন। কুলি ভেবে ডাক্তার বাবু তাঁর হাতে ব্যাগটি দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও ব্যাগ নিয়ে গিয়ে বাবুকে পালকিতে তুলে দিলেন। ডাক্তার বাবু পয়সা দিতে গেলে তিনি বললেন, ‘পয়সা দিতে হবে না। আমি ঠিক কুলি নই। এত ছোট ব্যাগ নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন বলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলাম। আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।’
ঈশ্বরচন্দ্র এক রোববার নিজের বাড়ির সামনের বাগানে কাজ করছিলেন। এমন সময় মেদিনীপুর থেকে চারজন লোক এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা ভাবলেন, এ নিশ্চয়ই বাগানের মালি। বললেন, ‘বিদ্যাসাগর মশায় কি বাড়ি আছেন?’
‘তিনি একটু ব্যস্ত। আপনারা বসুন।’
একটু পরে অতিথিরা বললেন, ‘ওহে, একটু তামাক খাওয়াতে পারো?’
‘আজ্ঞে, পারি।’
বিদ্যাসাগর তামাক সাজিয়ে দিলেন অতিথিদের।
‘বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। দ্যাখো না বাবু বিদ্যাসাগর মশায় কোথায়?’
‘আমিই ঈশ্বরচন্দ্র। বলুন।’
ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলায় ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে ছিলেন। বাবা হয়তো বললেন, ‘ঈশ্বর, যাও, স্নান করে এসো।’ সেদিন আর ঈশ্বরচন্দ্র স্নান করবেনই না। আর বাবা যেদিন বলবেন, ‘আজ বেশ ঠান্ডা, আজ আর স্নান করার দরকার নেই’, সেদিন বালক ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্যই স্নান করবেন। বাবা বুঝে ফেললেন। তাই তাঁকে পড়তে বসতে বলতে হলে তিনি বলতেন, ‘ঈশ্বর আজ পড়বে কম, খেলবে বেশি।’ ব্যস। ওই দিন ঈশ্বরচন্দ্র বেশি বেশি করে পড়তেন।
বড় হয়েও তাঁর একরোখা ব্যাপারটা বহাল ছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র ৯ বছর বয়সে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তাঁর শরীরটা ছিল ছোট। মাথাটা ছিল বড়। তাঁকে সহপাঠীরা খ্যাপাতেন ‘যশুরে কই’ বলে। পরে সেই কথাও উল্টে তাঁরা বানালেন ‘কশুরে যই’। ‘কশুরে যই’ শুনলেই তিনি তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠতেন।
কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বাবা আর তাঁর ভাইসহ অনেকে মিলে একটা বাড়িতে থাকতেন। ভোরবেলা উঠে তিনি সবার জন্য রান্না করতেন। তাঁকেই বাজার করতে হতো। তারপর তিনি ১০টার মধ্যে কলেজে হাজির হতেন।
একদিন রেঁধে সবার সামনে তিনি খাবার পরিবেশন করছেন। নিচতলার আধো অন্ধকার ঘর। স্যাঁতসেঁতে মেঝে। পোকা কিলবিল করে। ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন, তরকারির হাঁড়িতে একটা তেলাপোকা। এখন এতগুলো মানুষের খাবার নষ্ট করা যাবে না। তিনি তেলাপোকাটা নিজের মুখে চালান করে দিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন ১৪ কি ১৬। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান। আগে ঈশ্বরচন্দ্র কনের মুখও দেখেননি। কিন্তু ঘরের মধ্যে কজন মেয়ে, এর মধ্য থেকে নিজের বউকে খুঁজে নিতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বয়সের একজনের হাত ধরে বললেন, ‘এই আমার কনে।’ হইচই পড়ে গেল। মেয়েটি কেঁদেকেটে বলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও।’ বড়রা তখন কনেকে এনে হাজির করলেন তাঁর সামনে। ‘এই নাও তোমার কনে।’
হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন কার সাহেব। একদিন বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কার সাহেব জুতাসহ টেবিলের ওপরে পা তুলে বসে ছিলেন। বিদ্যাসাগর কাজ সেরে ফিরে এলেন। একদিন কার সাহেব এলেন বিদ্যাসাগরের ঘরে। বিদ্যাসাগর তাড়াতাড়ি তাঁর চটি জুতাসমেত পা তুলে দিলেন টেবিলের ওপরে।
কার সাহেব শিক্ষা বিভাগের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। বিদ্যাসাগরের জবাব, ‘এটা শিখেছি স্বয়ং কার সাহেবের কাছ থেকেই।’
সংস্কৃত কলেজের উন্নতি করার জন্য একটা পরিকল্পনা লিখে জমা দিলেন বিদ্যাসাগর। কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত সেটা কাটাছেঁড়া করলেন। প্রতিবাদে বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে দিলেন। লোকে বলাবলি করতে লাগল, ‘ঈশ্বরচন্দ্র যে চাকরি ছেড়ে দিল, ও খাবে কী?’ শুনে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘বলে দাও ঈশ্বরচন্দ্র আলু-পটোল বেচবে।’
১৮৪৯ সালে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগ দেন। ১৮৫০ সালে ফিরে আসেন সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হয়ে। ৩১ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, বেতন ১৫০ টাকা। তখনো তিনি তাঁর জন্মভূমি মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে যেতেন ৬০ মাইল পথ হেঁটে। আর টাকাপয়সা দান করতেন ব্যাপকভাবে।
বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্রের এক খেলার সাথি ছিল। এক পড়শি কন্যা। ছোটবেলাতেই একদিন কলকাতা থেকে ফিরে এসে ঈশ্বর দেখা পেলেন তাঁর খেলার সাথির। ‘এই তুই কি খেয়েছিস?’ ঈশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আমি আজ খাব না। আজ একাদশী। আজ আমার উপোস?’
‘উপোস কেন?’
‘ও মা তুমি জানো না, একাদশীতে বিধবাদের খেতে নেই।’
মনে মনে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, ১৩–১৪ বছরের বিধবার এই দুঃখ দূর কর
তিনি বিলাতের পার্লামেন্ট বরাবর চিঠি লিখলেন বিধবা বিয়ের অনুমতি দিয়ে আইন পাস করতে। সে আইন পাস হলো। কত বাদ–প্রতিবাদ হলো। তাঁকে মারার জন্য লোক ঘুরত আর তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখা হলো। তিনি খুঁজে খুঁজে অর্থ সাহায্য দিয়ে বিধবাবিবাহের আয়োজন করতে লাগলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি হলো বাংলা ভাষা, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।’
বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বিরোধ ছিল। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র একাই ছড়ি ঘুরিয়েছেন। বিদ্যাসাগর জবাব দিতেন না।
বিষবৃক্ষ উপন্যাসে সূর্যমুখী চরিত্রটি একটি চিঠিতে লিখছে, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’
বর্ধমানে এক বাড়িতে ভোজে অতিথিদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন। রান্না খেয়ে বঙ্কিম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুরু করলে তাঁর ভাই সঞ্জীবচন্দ্র বললেন, ‘কে রেঁধেছে জানো তো, ঈশ্বরচন্দ্র!’ ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ‘না হে না, বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মতো মূর্খ দেখেনি।’ হাসির রোল উঠল।
বিদ্যাসাগরের গদ্যের সমালোচনা করেছেন বঙ্কিম, তাঁকে অনুবাদক হিসেবে তাচ্ছিল্যও করেছেন। তবে শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর।’
একদিন এক লোক বিদ্যাসাগরকে বলল, ‘অমুকে আপনার পেছনে খুব লেগেছে। সারাক্ষণ আপনার নিন্দামন্দ করছে।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘অমুকের তো আমার বিরুদ্ধে লাগার কথা নয়। আমি তো তাঁর কোনো উপকার করেছি বলে মনে করতে পারছি না।’
লাখ কথার এক কথা বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। আপনি দেখবেন, আপনার বিরুদ্ধে সে-ই সবচেয়ে উচ্চরব, যিনি আপনার কাছ থেকে কোনো উপকার গ্রহণ করেছিলেন.