হৃদয়ের কথা

0 1
Avatar for Nipa1234
3 years ago

আজ আট বছর পর আবার ওকে দেখলাম এসেছিলাম চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে।

কখনো ভাবিনি যে আজ আবার এতোবছর পর হঠ্যাৎ আবার

আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমার অতীত।

আমি সাফিয়া সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আমি।

ভালোবাসা নামক অনুভূতির সাথে তখন সবেমাত্র পরিচিত হতে শুরু করি যখন ওকে প্রথম দেখি।

যে জিনিসটা ওর আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল সেটা হলো ওর হাসি।

অদ্ভুত এক মায়া ছিল ওই হাসিতে এই প্রথম কোন ছেলেকে এত ভালো লেগেছিল আমার।

সবেমাত্র ক্লাস নাইনে উঠেছিলাম শুরুর দিকে তেমন ভালো করে ক্লাস হতো না।

খেলাধুলা আর সংস্কৃত অনুষ্ঠানের জন্য অনুশীলন হতো।

সেদিন আমি আমার বান্ধবীদের সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

হঠ্যাৎ পিছন থেকে কেউ একজন আমাকে মোটু করে ডাক দেয়।

আমি ফিরে দেখি ইমন। ও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ত।

কিন্তু ও ছিল সান্য়েস এর ছাত্র আর ওর ক্লাস রুম ছিল আমাদের থেকে আলাদা।

আমাদের পাশের রুম সেকশন এ তে কিন্তু আমরা একসাথে কোচিং করতাম।

ও এসেছিল আমার থেকে কোচিং এর খাতা নিতে।

কিন্তু ইমনের কোন কথায় তখন আমার মনযোগ ছিল না কারন

আমার দৃষ্টি তখন আটকে ছিল সেই ছেলেটার উপর যার হাসিতে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

ইমন খাতা নিয়ে চলে গেল সাথে সেই ছেলেটা ও।

কিন্তু আমি কিছুতেই সেই ছেলেটাকে ভুলতে পারছিলাম না।

বার বার আমার সামনে ভেসে উঠছিল সেই ছেলেটার হাসি মাখা মুখ।

আমি খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ছেলেটাকে তা জানার জন্য।

আমি পরে ইমন থেকে অনেক কৌশলে জানতে পারলাম ছেলেটার নাম সবুজ।

আর সবুজ ইমনের সাথে একই ক্লাসে পড়ে।

সবুজের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার কি হয় আমি নিজেও জানতাম না।

বার বার তাকে দেখতে ইচ্ছা করত তাই আমি সান্য়েসর কিছু ছত্রীর সাথে বন্ধুক্ত করি।

কোন না কোন বাহানায় বার বার আমি ওরা যে রুমে ক্লাস করত সেখানে যেতাম শুধু সবুজকে দেখার জন্য।

পরে ইমনের মাধ্যমে আমার সবুজের সাথে কথা বলা শুরু হয়।

ধীরেধীরে আমাদের মাঝে বন্ধুক্ত হতে থাকে।

আমিতো খুব খুশি ছিলাম। স্কুলে গেলে আমার চোখ শুধু সবুজকে খুঁজত।

ওর দেখা না পেলে মনটা যেন কেমন কেমন করত।

বৃষ্টি বাদলার দিন ও আমি স্কুলে যেতাম শুধু এক নজর সবুজকে দেখার জন্য কেনো এমন হতো।

কেনো এত ভালো লাগত আমার সবুজকে তা আমার নিজের ও জানা ছিল না।

এই যে সবুজকে নিয়ে আমার যে অনুভূতি তা আসলে কি সেই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিল না।

আমি শুধু এটা জানি সবুজকে আমার খুব ভালো লাগে।

সেদিন ছিল আমাদের স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন।

আমি জানতাম না সেদিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করছিল।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে চলছিল পুরষ্কার বিতরণী পর্ব।

একপর্যায়ে স্যার ঘোষনা করল এখন মঞ্চে পুরষ্কার নিতে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সাইকেল প্রতিযোগিতায় প্রথম বিজয়ী সবুজ দাশকে।

নামটা শুনে আমি একটু চমকে গেলাম। আমি আগ্রহের সাথে তাকালাম ছেলেটাকে দেখার জন্য। নিজের চোখকে কোন মতে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে এই সবুজ সেই সবুজ যাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।

ওইদিন আমি এক অনেক বড় আর অনাকাক্ষিত সত্যের সম্মুখীন হয়।

জানতে পারি যে ছেলেটাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি সে একজন হিন্দু।

আমি এত দিন একটা মিথ্যা স্বপ্ন দেখছিলাম আমি চাইওলেও যে ওর কাছে যেতে পারব না।

ওর হতে পারব না কারন আমাদের মাঝে আগে থেকেই যে অনেক বড় একটা দেয়াল আছে সেটা ধর্মের দেয়াল।

আমার দুইজন ছিলাম দুই তীরের বাসিন্দা।

আমি মুসলিম আর সবুজ ছিল হিন্দু আমি শুধু জানতাম ওর নাম সবুজ।

আমি ওকে মুসলিম ভেবেছিলাম এত বড় একটা সত্য আজ এইভাবে আমার সামনে আসবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি।

নিজেকে কোনভাবে সামলে পারছিলাম না।

অনুষ্ঠান থেকে বান্ধবীদের কিছু না জানিয়ে অনুষ্ঠান থেকে বাসায় চলে এলাম।

অনেক কেঁদেছি সেদিন।

এরপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হবার হয়ে গিয়েছে সময় থাকতে সত্যিটা সামনে এসে গেছে।

সিদ্ধান্ত নিলাম সবুজকে ভুলে যাবো।

এরপর থেকে সবুজকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।

এখন আর আগের মত ওর সাথে কথা বলতাম না।

কিন্তু সবুজ আমাকে দেখলে আমার সাথে কথা বলতে চাইত।

আমি সবুজকে যত এড়িয়ে চলতে চাইতাম ততোই ও আমার সাথে আরো কথা বলতে চাইত।

একদিন সবুজ হঠ্যাৎ আমাকে দেখে বলে তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে সাফিয়া।

আমি ক্লাসের বাহানায় ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলে আমাকে বলে প্লিজ খুব জরুরি কথা চল আমার সাথে আমি গেলে সবুজ আমাকে বলে আচ্ছা তুই কি আমাকে পছন্দ করিস।

ওর মুখে এমন কথা শুনে আমি চমকে যাই।

আরো বলে দেখ যদি তুও আমাকে পছন্দ করিস তাহলে বলে দে।

মনের কথা গোপন রাখতে নেই আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি তোকে আনার বন্ধু ভাবতাম আর তুই এমন চিন্তা কেমনে মাথায় আনিস।

আমি সেখান থেকে চলে আছি।

সবুজ পেছন থেকে আমাকে ডাকছিল কিন্তু আমার আর পিছনে ফিরে তাকানোর মত অবস্থা ছিলনা। আমি আর এইভাবে থাকতে পারছিলাম না খুব কষ্ট হতো আমার।

আমি আবার ভাবতে লাগলাম সবুজ ও মনে হয় আমাকে পছন্দ করে তা নাহলে ও আজ আমায় এমন কথা বলত না তাহলে কি একবার আমি সবুজকে আমার মনের কথা বলে দেখব?

হোক না আমাদের ধর্ম আলাদা তাতে কি হয়েছে আমি আমার আর ও ওর ধর্ম পালন করবে।

আমি খুব অস্থির থাকতাম আমার এই অস্থিরতা আমার বড় বোনের নজরে পড়ল।

আমার থেকে জানতে চাইল ব্যাপারটা কি আপু শুধু আমার বোন না ও আমার বন্ধুর মত ছিল।

তাই আমি আপুকে সব কিছু খুলে বললাম।

সবকিছু শুনে আপু আমার সাথে রাগ করে নি বরং খুব শান্ত হয়ে বলল

তাহলে তুই মনে করিস সবুজ ও তোকে পছন্দ করে তাই তুও ওকে তোর মনে কথা বলতে চাইছিস।

আচ্ছা মানলাম সবুজ তোকে পছন্দ কর ও তোর মনের কথায় সায় ও দিতে পারে।

কিন্তু তোদের এই ভালোবাসার পরিনিতি কি হতে পারে তুই কি ভেবে দেখেছিস।

তুই বল তুই আর সবুজ একজন একজনকে মেনে নিলেও আমাদের দুজনের পরিবার কি তা মেনে নিবে। এমন ও এক পর্যায় আসবে যখন সবুজ বা তোকে নয় পরিবারকে বেচে নিতে হবে বা তোদের একে অপরকে।

তোরা যদি পরিবারকে বেচে নিস তাহলে তোদের দুইজনেরই কষ্ট পেতে হবে আর যদি তোরা একে অপরকে বেচে নিস তাহলে দুই পরিবার কষ্ট পাবে।

পরিবার তাদের সন্তান হারাবে প্রতিনিয়ত সমাজে অপমানিত হতে হবে।

আর পরিবারকে কষ্ট দিয়ে কি তোরাও কি ভালো থাকতে পারবি?

সবুজকে ওর পরিবার থেকে আলাদা করে তুই কি ভালো থেকতে পারবি??

মনে রাখিস সাফি ভালোবাসায় কোন স্বার্থপরতা থাকে না।

আর যে ভালোবাসায় স্বার্থপরতা থাকে ওটা ভালোভাসা হয় না।

আমি তোকে বলছি এই ভালোবাসার পরিণতি কোন দিক থেকে ভালো হবে না।

তাই আমি বোন হিসেবে বলছি সবুজকে ভুলে যা এতেই সবাই ভালো থাকবে।

আমি এবার বুঝতে পারলাম না আমি যে স্বপ্ন দেখছি তা সম্ভব নয়।

আর আমি মা বাবার কথা এর আগে ভাবিনি।

সত্যি তো সবুজ আমাকে ভালোবাসলেও আমাদের পরিবার মানবে না।

আর আমার কারনে আমার মা বাবা সমাজে অপমানিত হোক তা আমি কখনো চাই না।

সবুজ ওর পরিবার থেকে আলাদা হোক এটা আমি কখনও চাই না।

সব ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ভুলে যাবো সবুজকে।

কখনো ওকে আমি জানাবো না যে আমি ওকে কখনো ভালোবেসেছিলাম।

আমি ধীরেধীরে স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দেই যাতে ওর সাথে আমার দেখা না হয়।

লুকিয়ে থাকতাম ওর থেকে অবশ্যই ওই ঘটনার পর সবুজ আমার কাছে অনেক বার ক্ষমা চেয়েছিল।আমি ও একে মাফ কিরে দিলাম না করে উপায় ছিল না।

আমার পিছনে ও পড়ে ছিল তাই মাফ করে দিলাম।

কিন্তু বললাম আর যে এমন কথা যেন মাথায় না আনে।

ও আমার কথায় সায় দিল এরপর থেকে আমাদের খুব কম কথা হত আর দেখা ও কম হত।

এইভাবে যেতে থাকে দিন আর দেখতে দেখতে আমাদের এস. এস. সি পরিক্ষা হয়ে যায়।

অবশেষে পরিক্ষা শেষ হলো আমার আমাকে আর এই স্কুলে থাকতে হবে না।

আর সবুজের সামনে পড়তে হবে না ওকে ভুলতে আরো সহজ হবে কষ্ট অনেক কমবে আমার।

যেখানে আমার এই বিষয় নিয়ে খুশি হওয়ার কথা।

সেখানে কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল আগে লুকিয়ে লুকিয়ে হলে সবুজকে দেখতাম এখন তাও আর হবে না। হয়ত এই বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু এটাই ভালো হবে আমার আমার জন্য আর সবুজের জন্য কাছে থেকে আমি শুধু কষ্ট পাচ্ছিলাম সবুজকে আমি কখনো পাবোনা এই কথা আমাকে বার বার কষ্ট দিত তাই দূরে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় এরপর ওর সাথে আমার আর কখনো দেখা হয় নি।কোন যোগাযোগ ও ছিল না। কখনো ভাবিনি আজ এত বছর পর আবার আমি সবুজকে দেখতে পাবো।

-কিরে মোটু না কেমন আছিস? ?

কতবছর পর তোকে দেখলাম এমন একটাই কথায় ভাবনার ছেদ পড়ল আমার।

হুশ ফিরলে দেখতে পেলাম সবুজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ?

তার হাসিমুখ দেখে মনে হল যেন অনেক বছর পর কোন আপনজনকে দেখতে পেল।

আজ আট পর আবার আমরা অনেক কথা বললাম।

অনেক অভিযোগ ছিল আমার প্রতি এত বছর কোথায় ছিলাম কেন দেখা করি নি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কথায় কথায় জানতে পারলাম সবুজের বিয়ে হবে সামনে বছর ওর ভালোবাসার মানুষটার সাথে।

এই কথা শুনে ভিতরটা কেমন মচর দিয়ে উঠল তবু আমি খুশি কারন আমি আমার ভালোবাসা না পেলে আমার ভালোবাসার মানুষটা তো তার ভালোবাসা পেল।

আমার খুব ভালো লাগল এটা ভেবে যে আট বছর আগে আমি আমার মনের কথা সবুজকে না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওটাই ঠিক ছিল।

আমার এই সিদ্ধান্তের কারনে ভালো আছে দুটি পরিবার ভালো আছে আমার ভালোবাসার মানুষটা।

থাক না আমার মনের কথা চিরদিনই অগোচরে থাক আমার ভালোবাসা অপূর্ণ।

তবুও আমি ভালো আছি সবুজ তুমি ও ভালো থেকো ।

গল্পঃ অন্তরের কথা

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments