নিখিল তাঁকে নরক-নগ্নতা দিয়েছিল অথচ সে চোখে রেখেছিল অমলিন দৃষ্টি।ভালোবাসার তীব্রতাকে যে কবি রূপ দিয়েছিলেন প্রতিবাদে,যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দ্রোহ আর প্রেমের কবি তিনিই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।পাঞ্জাবির সাথে জিন্সের প্যান্টকে যিনি বানিয়ে ছিলেন নিজস্ব পোশাক (যা রকস্টার গুরু জেমস পরে বিখ্যাত বানিয়েছেন) তিনিই বাংলা কবিতার বরপুত্র। রুদ্রর পিতৃ প্রদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন।শুধু নামের ক্ষেত্রে নয়,কবিতাতেও এই কবি এক নূতন বানানরীতির সৃষ্টি করেছিলেন।যা এখনো পাঠক মহলে বিশদভাবে গ্রহণযোগ্য।
১৯৭৩ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা "আমি ঈশ্বর আমি শয়তান"। কবি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র।বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে কিন্তু আজন্ম বাউন্ডুলে এই কবি নিজের ভাগ্যের চিত্রনাট্য লিখে ছিলেন নিজের হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে(ডাকসু) বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্যানেলের সাহিত্য সম্পাদক পদে লড়েছিলেন যদিও সেই নির্বাচনে বিজয়ী হন নি রুদ্র তবুও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থা অবিচল ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
ছাত্রজীবনেই ' উপদ্রুত উপকূল', 'ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম' নামে তাঁর দুইটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থগুলোর জন্য ১৯৮০-১৯৮১ সালে " মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরষ্কারও লাভ করেন তিনি।রুদ্র যখন টগবগে যুবক,কবিতাকে বেছে নিয়েছেন স্বপ্নের প্ররোচনা হিসেবে তখনি পরিচয় হয় তসলিমা নাসরিনের সাথে।পরিবারের অমতে বিয়েও করে নেন তিনি।বরাবরের মতো অনিয়ন্ত্রিত জীবন আর খামখেয়ালীপনায় এই সংসার খুব বেশি দিন টিকে নি।
বাউন্ডুলে এই কবির জীবনে নারীর আগমন ছিল অনেক,যারা তাঁর কবিতার নিয়ামক হিসেবে কাজ করতেন অনেক সময়।
রুদ্র ছিলেন সময় সচেতন মানুষ।১৯৭৫-১৯৯০ মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংগঠিত হওয়া প্রায় সকল আন্দোলনে রুদ্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল।তিনি ছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক।জাতীয় কবিতা পরিষদ,সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট,বাংলাদেশ সংগীত পরিষদের মত সংগঠন গুলো প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে রুদ্রর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম।
রুদ্রের কবিতায় ছিল এক অন্যরকম জাদু।রুদ্র লিখেছেন প্রেমের কথা,দ্রোহের কথা,বিপ্লবের কথা।লিখে গিয়েছেন ধর্মের সমার্থক হবে ফসলের সুষম বন্টন। রুদ্রের কবিতা এখনো পাঠকের নিঃসঙ্গ রাতের এক অপার স্বস্তির নাম।
"হায়রে আমার বয়স হয় না,সংসারী মন পোক্ত হয় না।" বলা এই কবি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন একজন কবি এবং কবি।পারিবারিক স্বচ্ছলতা থাকলেও নিজের চরম দারিদ্র্যতার মধ্যেও মুখাপেক্ষী হন নি কারো কাছে। লিখে গেছেন অসংখ্য গীতি কবিতা যা দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়।
ব্যক্তিজীবনে খুবই অনিয়মিত জীবন যাপন করেছেন তিনি। উপার্জন করেছেন সামান্য আর টাকা উড়িয়েছেন দু'হাতে। রুদ্র’র সিগারেট আর মদ্যপ্রীতি ছিলো বলিহারী! হুইস্কির তিনি বাংলা নামকরণ করেছিলেন ‘সোনালী শিশির ‘।😉
অতিরিক্ত অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা,তুখোড় ধূমপান আর মদ্যপানের ফলাফলে শেষমেষ আলসারে পেয়ে বসেছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে। পায়ের আঙ্গুলে রোগ বাসা বেঁধেছিল। এসবকে কখনোই গুরুত্ব দেন নি তিনি। ডাক্তার বলেছিলো পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-তে। এ সময়টায় তিনি অনেক নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে তসলিমা নাসরিন বলেছেন-
“কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয়নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বাঁ-পাশে রুদ্রকে একটা চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।”
অসীম সাহার ওখানে যোগ দিতেন কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, চিত্রকর সমর মজুমদার, সঙ্গীতশিল্পী কিরণচন্দ্র রায়, কবি কাজলেন্দু দে প্রমুখ। একদিন এই আড্ডাতে রুদ্রকে আর উপস্থিত পাওয়া যায়নি। অসীম সাহার কাছ থেকেই সবাই জানতে পারেন রুদ্র পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে হাসপাতালে। হাসপাতালের কেবিনে অসুস্থ রুদ্রকে দেখতে যান অনেকেই।
হাসপাতালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংবাদিক আবু মাসুম মাসিক নান্দনিক পত্রিকায় লিখেন-
“আমার হাতে রজনীগন্ধার ডাঁটি দেখে রুদ্রর চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দেখি, পাশে বসে আছেন আহমদ ছফা। রুদ্রর এক হাত জড়িয়ে রেখেছেন তার হাতে। কথা বলছিল অল্প অল্প, মৃদুস্বরে। আহমদ ছফা বেরুনোর সময় রুদ্রর মাথায় হাত রেখে বললেন- তুমি তো ভালো হয়ে গেছো। আমি আবার আসবো। যাওয়ার সময় আহমদ ছফা একটা ইনভেলাপ রেখে গেলেন রুদ্রর বালিশের নিচে।”
হাসপাতালে সপ্তাহখানেক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে কবি বাসায় ফেরেন। পরের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে কবি বেসিনে দাঁড়ান। হঠাৎ মুখ থুবড়ে বেসিনের উপরেই পড়ে যান। সিরামিকের বেসিন কবির ভার বইতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। কবির ভাই ডক্টর মুহম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।১৯৯১ সালের ২১ জুন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ চলে যান অন্তিমশয়ানে তার চিরচেনা, শৈশবের স্মৃতিধন্য, মংলার মিঠেখালিতে।
জীবনের ভগ্নস্তূপ জুড়ে যিনি আজীবন সুন্দরের ছবি আঁকতেন সেই রুদ্র চলে গিয়েছিলেন খুব কম বয়সে। এই স্বল্প সময়েই তিনি রেখে গেছেন তার ছাপ, করে গেছেন ঋণী, বেঁধে গেছেন অমোঘ মায়ার বন্ধনে।
রুদ্রের আজ ৬৪ তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে বাংলা কবিতার বরপুত্রকে জানাই,
"তোমার কবিতা নিয়ে আমরা ভালো আছি,তুমি ভালো থেকো।"
© Raihan E Khan Shubho
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,হিমেল বরকত সম্পাদিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা।