একজন অসহায় 'মা' বাসের সীটে বসে নিরুপায় ভাবে ডানে বামে তাকাচ্ছেন! সে-যে কি ছটফটানি!!!
.
কিছুক্ষণ আগেও কোলের শিশুটি শান্ত ছিল। ছোট ছোট হাতে 'চিপ্স' চটকে মুখে মাখাচ্ছিলো। হঠাৎ হালকা কাশি শুরু হয়েগেলে শিশুটির মা দ্রুত পানি বের করতে উনার সীটের নীচে রাখা বেশ বড় সর ব্যাগটি কোনভাবে টেনেটুনে সামনের দিকে আনেন। কিন্তু ব্যাগের 'চেইন' এ ঘটলো বিপত্তি! কোনভাবেই নিচু হয়ে খুলতে পারছেন না, আর পানি বের করতেও পারছেন না। একেতে কোলে ছোট্ট শিশু তার উপর সহী সুন্নত মোতাবেক একজন পর্দা করা নারীর পক্ষে বেশ খানিক টা কঠিনই শিশু সহ নীচু হয়ে এই অল্প যায়গার ভেতর নাড়াচাড়া করে কিছু করা। তার উপর যদি পাশে অপরিচিত একজন পুরুষ মানুষ বসে থাকে!!!
.
তখন সকাল ৮ টা বেজে ৪৯ মিনিট, হালুয়াঘাট যাওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহের ব্রীজ মোড় থেকে বাসে উঠেছি। প্রথম দিকের বাস তার উপর আজ শুক্রবার। ঢাকা থেকেই প্রায় পূর্ণ হয়ে এসেছে বাসটি। কিছু যাত্রী ব্রীজ মোড় নেমে যাওয়ার পর সীট ফাঁকা আছে কি না বাসের 'হেল্পার' মামাকে জিজ্ঞেস করে উঠে দেখি একদম শেষ সারির সামনে বিভক্ত হওয়া উভয় পাশে দুটি দুটি আসন খালি। কি আর করা আমার জরুরী তার উপর প্রচন্ড ভীড়, পবিত্র জুমার দিন। পেছনে বসেই আজ চলে যাই, এই ভেবে ডান পাশের দুটির একটিতে বসে গেলাম। আমার সাথেই আরেক জন বসতে চাইলো, উনি জানালেন উনি জানালার পাশে বসতে চান- উনার বমির সমস্যা আছে। আমি উনাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে আমি এপাশে বসলাম। তো আমার ডান পাশের কলামের দুটি আসনে আরেকজন পুরুষ জানালার পাশে বসেছেন। কিছুক্ষণ পর একজন আপাদমস্তক ঢাকা 'মা' একটি বাচ্চা শিশু সহ আসলেন। পেছনে পেছনে একজন দাঁড়ি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক - যার হাতে একটি বড় ব্যাগ। উনি আমার দু-তিন সীট সামনের একজন পুরুষকে অনুরোধ করলেন যেন উনি পেছনে চলে আসেন আর উনার সীট এই মহিলা(মা) বসতে পারেন। তাহলে মহিলা মহিলার সাথে বসতে পারবেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমার দু'তিন সীট সামনের পুরুষ রাজি হন নি পেছনে আসতে!!! কিছু উপায় না দেখে পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক লোকটি আমার পাশের কলামের ওই ফাঁকা সীটেই উনাকে বসালেন পায়ের কাছে ব্যাগটি রেখে কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নিলেন। এতক্ষণে বাস পুরো ঠাসা মানুষজনে!!!
.
যাইহোক, ওই মা'য়ের এমন অসহায় ভাবে ব্যাগ টানাটানি দেখে আমি নীচু হয়ে ব্যাগটি টান দিয়ে মেঝের দিকে নিয়ে বললাম কোন 'পার্ট' খুলবো? উনি হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে দেখালেন। আমি খুলে পানির একটা 'পট' বের করে উনার হাতে দিয়ে 'চেইন' আটকে ব্যাগটি রেখে দিলাম। বাচ্চা শিশুটি পানি পান করলো। ওই মহিলার পাশে থাকা লোকটি দিব্যি ফোন চাপাচাপি করছেন ফুল ভলিউম এ কিসের যেন ভিডিও দেখছেন!! অথচ উনি একটু 'হেল্প' করতে পারতেন। উনার যায়গা থেকে ওটা আরো বেশি 'ইজি' হতো!!
.
কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে। কিছুটা পথ চলে এসেছি। পেছনের সীটে বসলে বরাবর ই আমার 'আরব বেদুঈনদের' কথা মনে পরে! আর যদি রাস্তার অবস্থা থাকে বেশামাল তাহলে তো কথাই নেই!!! নিজেকে উটের পিঠে আরোহনকারী মনে হয়। যদিও উটে চড়া হয় নি এখনো!!
.
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি অনেকটা বিরক্তি নিয়ে। প্রচন্ড রোদ উঠেছে আর আমাদের জানালা দিয়েই ঢুকছে সাথে জানালাটাও খোলা তাই ঢুকছে ধুলো! জানালার পাশে পর্দা বাঁধা থাকে কিন্তু এই জানালায় নেই!! আমার পাশের লোকটি দিব্যি ঘুমোচ্ছেন, যাক তাও ভাল বমির সমস্যাটি হচ্ছে না উনার ঘুমের কারণে। তীব্র রোদ উনার মুখে পরছে। এমন সময় প্রচন্ড কান্নার শব্দ! হ্যাঁ ওই শিশুটি প্রচন্ড কান্না করছে, কোনভাবে 'মা' নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। শিশু বাচ্চাটির সম্ভবত ক্ষুধা লেগেছে তাই তার মা'কে এভাবে বার বার অস্থির করে তুলে কান্না করছে। আমি একবার ওদিকে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ওই 'মা' খুব অসহায় ভাবে এপাশে ওপাশে তাকাচ্ছেন, লজ্জায় কাচুমাচু হচ্ছেন এবং খুব অস্থির হয়ে পরেছেন এটি স্পষ্ট!! কি করবেন উনি বুঝতে পারছেন না, আমি কিছু বলব কি না দোটানায় আছি, কি-ই বা বলবো!!?!!
এতক্ষণে আমার পাশের লোকটির ঘুম ভেঙে গেছে। উনি জিজ্ঞেস করে বসলেন একটু বিরক্তি নিয়েই 'এত কাঁদছে কেন!??
এবার 'মা'য়ের মুখ থেকে আওয়াজ এলো। কাঁপা গলায় বললেন-
'ক্ষিদা লাগছে তো তাই কানতাছে ' এইটুকু বলেই শিশুটিকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন - ' বাবা বাবা, এইযে আয়া পরছি। কাইন্দো না কাইন্দো না বাবা...'
কিন্তু কোলের অবুঝ শিশুকে বুঝ দেয়া যায়?!! বোঝের পরিণত মানুষ-ই আমরা যেখানে অনেক সময়ই বুঝতে চাই না কত শত ব্যাপার! আর সেখানে দুধের অবুঝ শিশু!!!
.
কিছুক্ষণ চুপ করেই ছিলাম কেননা কি করতে পারি আমি ?!- কিছুই না। শিশুটির কান্না থামছেই না। হঠাৎ মনে হলো অসহায় মা'য়ের জন্য কিছু করা অবশ্যই দরকার!!
এতক্ষণে আমার পাশের সীটের লোকটি নেমে গেছেন। বাসও কিছু টা ভীড় মুক্ত যদিও ম্যাক্সিমাম সীট এই লোক বসা। বাসের ' কন্ট্রাক্টর' মামাকে ডাক দিলাম জিজ্ঞেস করলাম -
সামনেদিকে তিন-চারজনের মত যায়গা হবে??
উনি হ্যাঁ বললেন কিন্তু জানালেন ড্রাইভার এর পাশের ডালাউ যে সীট ওখানে বসা লাগবে। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে আমার পেছনে (বাসের শেষ সারির) লোকদের বললাম ভাই এখান থেকে দু'জন আমার সীটে এসে বসুন। আর আপ্নারা তিন জন দয়াকরে কিছু সময়ের জন্য হলেও সামনের দিকে একটু গিয়ে বসুন। এই শিশুটিকে নিয়ে ওর মা পেছনের সীটে বসুক। এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে হয় নি সবাই বুঝে নিয়েছে বিষয়টি। শিশুর মা' কোনো আপত্তি করেন নি।
আমার কথা বলার সাথে সাথে আমার পেছনের একজন ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন বের হতে হতে বললেন ঠিক বলেছেন ভাই। উনিও বাকিদের অনুরোধ করলেন আসেন ভাই। ধীরে ধীরে সবাই সামনের দিকে চলে গেলো। এতক্ষণ যে দু'জন মুরব্বী পেছন থেকে বাচ্চার কান্নার থামানোর নানান পরামর্শ দিচ্ছিলেন উনারাও উঠে গেলেন আর যাওয়া আগে বলে বলে গেলেন ভবিষ্যতে যেন এভাবে একা না মহিলাটি(মা) বের না হন। সাথে যেন কেউ থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চলে গেলেন সামনের দিকে। আমিও সামনের দিকে এসে বাসের দরজার দিকে এসে দাঁড়িয়েছি। এতক্ষণে শিশুটি তার মা'কে নিয়ে পেছনের ফাঁকা সীটে চলে গেছে। কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমরাও প্রায় আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি এগোচ্ছি। ' কন্ট্রাক্টর ' মামাকে বলে দিয়েছি আপাতত বাসের পেছনের দিকে কাউকে না যেতে। উনি খুব-ই ভদ্র ভাবে বিষয়টি মেনে নিয়েছেন এবং আস্বস্ত করেছেন কেউ না যাওয়ার ব্যাপারে। অসহায় মা'য়ের কোলে শান্ত শিশুটিকে নিয়ে এগোচ্ছে বাস।
.
#আমরা_চাইলেই_সম্ভব_অনেক_কিছু
#কিছু_নিকৃষ্টের_জন্য_সবাই_দোষী_নয়