গল্পের নামঃ খাদক।

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আসাদ একটা ভালো ভিআইপি মানের হোটেলে এলো। বেশ তৃপ্তি সহকারেই খেলো। এখানের গরুর মাংস থেকে শুরু করে ভাজি-ডাল সবই সুস্বাদু। গতকাল এলাকার এক হোটেলে দুই লোকমা ভাত খেয়েছিল। তারপর আর খেতে পারেনি। রান্নার স্বাদ ভালো না হলে আসাদ তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারে না। খাওয়া শেষে বিল শুনে আসাদ মনে মনে একটা ধাক্কা খেলো। আড়াইশো টাকা বিল এসেছে। আসাদ ভাবতে লাগল এমন হলে তো বেতনের পুরোটাই খাবারের পেছনে চলে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে আসাদ সিদ্ধান্ত নিলো বাবা-মাকে শহরে নিয়ে আসবে। এই নিয়ে সে তার বাবার সাথে আলোচনা করলো। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার শহরে এসেছিলেন। শহরের চার দেয়ালের বন্দী পরিবেশে তাদের মন বসে না। অতঃপর আসাদ একটি সিদ্ধান্ত নিলো। তা নিয়ে সে তার মায়ের সাথে আলাপ করলো।

- মা, আমার জন্য ভালো থেকে একটা মেয়ে দেখো। সামনের মাসে ছুটি নিয়ে এসে বিয়ে করব।

ছেলের এমন কথা শুনে মোবাইলের ওপর পাশে থাকা রুকমনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মাত্রই ছেলেটা গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠেছে। এরইমধ্যে বিয়ে করতে চাচ্ছে? রুকমনি ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আর কিছুদিন যাক। আগে ঘর দুয়ার পাকাপোক্ত করা হোক তারপর বিয়েশাদী। এতে আসাদ রেগে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি ট্রান্সফার নিয়ে গ্রামে চলে আসি।”

- না বাবা, তোর গ্রামে আসতে হবে না। আমরা মেয়ে দেখতেছি।

রুকমনি ব্যাপারটা তার স্বামী জয়নালকে জানালেন। এতে জয়নালও অস্থির হয়ে উঠলেন। বিয়েশাদীর ব্যাপার, হুট করে তো মেয়ে পাওয়া যায় না। তারওপর আসাদ তাদের একমাত্র ছেলে। তাই বিয়ে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন আছে। আত্মীয়স্বজন ডেকে বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছেলের বিয়ে দিবেন। কিন্তু তাড়াহুড়োয় এসব সম্ভব না। রুকমনি ভালোভাবেই জানেন আসাদের কেমন মেয়ে চাই। সপ্তাহখানেক খোঁজাখুঁজির পরেও মনের মতো মেয়ে পেলেন না।

পাশের গ্রামে মারুফ তালুকদার টিনের ঘরের স্থানে ইট পাথরের বাড়ি তুলেছেন। তাই পাড়া-পড়শি ও আত্মীয়স্বজনকে ডেকে মিলাদ দিলেন। জয়নাল হলেন তালুকদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনে একই সাথে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সকল পরামর্শে দুজন একে অপরের পাশে ছিলেন। তাদের সেই বন্ধুত্ব আজও টিকে আছে। মিলাদে পোলাও-ভাতের আয়োজন করা হয়েছে। সাথে আছে পায়েস ও মিষ্টি। খাবারের প্রসংশায় সবাই পঞ্চমুখ হলেন। মারুফ গর্বের সাথে বলতে লাগলেন, রান্না তার মেয়ে নূরী করেছেন। এমনকি মিষ্টিও ঘরের বানানো।

রুকমনি তার স্বামীকে নূরীর ব্যাপারে বললেন। এই মেয়েই আসাদের সাথে সংসার করতে পারবে। জয়নাল প্রস্তাবটা তালুকদারকে জানালো। আসাদের ব্যাপারে গ্রামের সবাই জানে। সহকারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে আছে। প্রায় এক বছর ধরে গ্রামেই ছিল। সেই সুবাদে সবাই তাকে চিনে। কিছু মাস হয়েছে প্রমোশন পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পদে উপনীত হয়ে শহরে গেছে। এমন ছেলে যেকেউই হাত ছাড়া করতে চাইবে না। তালুকদারও চান না। তিনি বিষয়টা মেয়েকে জানালেন। নূরী কোনো আপত্তি করলো না।

নূরী বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে জেনে তার মা বেশ অবাক হয়েছেন। এমনকি তার বন্ধুবান্ধবও অবাক হয়েছে। সবাই ভেবেছিল নূরী শহরে কোনো বড় রেষ্টুরেন্ট দিবে। কেননা সে বিদেশ গিয়ে রান্নার ওপর দুই বছরের একটা কোর্স করেছে। সেখানের এক নামীদামী রেষ্টুরেন্টে তিন মাস কাজও করেছে। নানান দেশের নানারকম খাবার সে রাঁধতে পারে। সবার ধারণা ছিল নূরী নিজ পায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে তারপর বিয়ে করবে। কিন্তু সবার চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে নূরী বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল। হঠাৎই তার মধ্যে সংসার প্রবণতা জেগে উঠেছে। একটা সময় তার দুচোখে স্বপ্ন ছিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। এখন তার দুচোখে স্বপ্ন শুধু স্বামী-সন্তানের।

পরবর্তী মাসে আসাদ গ্রামে এসে মেয়ে দেখতে এলো। সাথে তার বাবা-মা, চাচা-চাচী এসেছেন। দেখা সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে দুজনকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। পরিচয় পর্ব শেষে আসাদ বলল, “কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?” নূরী সম্মতি জানালো।

- খাবারে তো অনেক আইটেম দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে আপনি কোনটা বানিয়েছেন?

নুরী হাসি দিয়ে বলল, “সবই আমি বানিয়েছি। আপনি বোধহয় আমার বায়োডাটা দেখেননি।” আসাদ আর কিছু বলল না। বায়োডাটায় সে বিদেশের কোর্সের ব্যাপারটা দেখেছে। তবে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এখন বিশ্বাস করেছে। কেননা খাবারের প্রতিটি আইটেমের গুনগত মান ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানিয়েছে।

বেশ ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। বিয়ের চতুর্থ দিনের মাথায় নূরীকে নিয়ে শহরে পাড়ি জমালো আসাদ। শহরের হাবভাবের সাথে নূরী বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। তাই মানিয়ে নিতে সময় লাগল না। নতুন ঘরে আজ তাদের প্রথম দিন। নূরী পুরো ঘর নিজের মতো করে সাজালো। ভালো কিছু রান্নাও করলো। সন্ধ্যার পর আসাদ চলে এলো। নূরী তাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দিলো। শরবত-টুকু শেষ করে আসাদ তৃপ্তির ঢেকুর ফেলে বলল, “আহ! সারাদিনের ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল।” এইটুকুতেই নূরীর খুশির সীমা রইলো না। খানিকক্ষণ বাদেই আসাদের ব্যস্ততা আবার শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরপরই তার ফোন আসতে লাগল। আর সে কথা বলতে লাগল। এভাবেই পুরো সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। নূরী সময় নিয়ে নিজেকে সাজালো।

যথাসময়ে আসাদ ডিনার খেতে বসলো। সবকিছু পরিবেশন করে নূরীও সাথে বসলো। নূরীর দিকে তাকিয়ে আসাদ বলল, “চমৎকার! কি সুন্দর! আহা! পরাণ জুড়িয়ে গেল।” নূরী লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসি দিলো। আসাদ আরও বলল, “অনেকদিন পর এমন সুস্বাদু খাবার খাচ্ছি।” এবার নূরী বিস্মিত হয়ে আসাদের দিকে তাকালো। তারমানে এতক্ষণ আসাদ যা বলেছে তা রান্নার প্রশংসা হিসেবে বলেছে। অথচ নূরী ভেবেছিল তার প্রশংসা করেছে। সে মনে মনে কিছুটা রাগ করলো। আসাদ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে যাচ্ছে আর প্রশংসা করে যাচ্ছে। খাওয়া শেষেও প্রসংশা করে বলল, “তোমার হাতের রান্না সত্যিই অসাধারণ। সকালে সবজি জাতীয় কিছু রান্না করিও।” নূরী মাথা দুলালো।

দুজন দুপাশে শুয়ে আছে। আসাদ ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাক না ডাকলেও লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। নূরী ভীষণ রেগে আছে। আসাদের কাছ থেকে সে কিছু প্রসংশা আশা করেছিল। কিন্তু আসাদ তো তাকে ভালোমতো দেখলোই না। পরেরদিন সকালেও একই ঘটনা ঘটলো। নূরী সকালেও খুব সুন্দর করে সেজেছে। লাল-সবুজের সংমিশ্রিত শাড়ি পরেছে, চোখে কাজল দিয়েছে, মাথায় বেলী ফুল গুজেছে। তবুও আসাদের নজরে পড়লো না। সে শুধুমাত্র খাবারের প্রশংসা করে চলে গেল। যাওয়ার আগে রাতে চিকেন বিরিয়ানি রাঁধতে বলে গেল। দিন যতো যেতে লাগল নূরী ততই বুঝতে পারলো যে, আসাদের সমস্ত ধ্যান খাবার ঘিরেই সীমাবদ্ধ। নূরীর প্রসংশা তো দূর তার দিকে আসাদ ভালোমতো তাকায়-ই না। অথচ নূরী ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নিজেকে সাজায় যাতে আসাদের নজর কাড়তে পারে। তার মুখে দুটো প্রশংসা শুনতে পারে। নূরীর অনেক স্বপ্ন ছিল স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনবে, দুজনে মিলে চায়ের কাপে ধোয়া উড়িয়ে গল্প করবে, বৃষ্টি বিলাস করবে। কিন্তু আসাদের সাথে এসবের কিছুই হচ্ছে না। একরাশ আক্ষেপ নিয়ে নূরী তার জীবনের চাকা চালিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষায় আছে কোনো একদিন আসাদ তার অনুভূতি গুলো বুঝবে।

সরকারি ছুটিতে আসাদরা গ্রামের বাড়ি এলো। নূরী তার শ্বশুরবাড়িতে দুদিন থেকে তারপর বাপের বাড়িতে বেড়াতে এলো। বিয়ের পর এই প্রথম মেয়ে জামাই বাড়িতে এসেছে। তাই আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। বড় দেখে বোয়াল মাছ আনা হলো। ছাগল জবাই করা হলো। ঘরে রান্নার ধুম পড়ে গেল। দুপুরে সবাই খেতে বসলো। আসাদের পাতে মাছের মাথা দেওয়া হলো। আসাদ দু লোকমা খেয়েই আটকে গেল। রান্না তার পছন্দ হয়নি। ব্যাপারটা নূরী আঁচ করতে পেরেছে। সে আসার আগেই রান্নাবান্না সব হয়ে গিয়েছিল। তবুও সে সময় করে সবজি ভাজি করেছিল। নূরী এগিয়ে এসে তা দিয়ে দিলো বলল, “তোমাদেরকে বলতে ভুলে গেছিলাম। ও বোয়াল মাছ খায় না। এলার্জি আছে।” নূরীর মা ছাগলের মাথাটা দিতে গেলেন। কিন্তু নূরী বাধা দিয়ে বলল, “ছাগলও খায় না।”

- সেকি! এই প্রথম জামাই এলো। আর নিরামিষ খাবে শুধু?

- আমারই দোষ। আমার বলে দেওয়া উচিত ছিল।

ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হলো।

পুকুর পাড়ে বসে আছে নূরী। আসাদ এসে বলল, “সবজি তুমি রেঁধেছ, তাই না?” নূরী মাথা ঝুলালো।

- যাক বাঁচলাম আজ। নয়তো আজ এসব খেতে খুব কষ্ট হতো।

- কেন? আমার মা কি খারাপ রান্না করে?

- তা নয়। তবে তোমার হাতের রান্না খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

- সকালে তো নিজের মায়ের হাতের রান্না ঠিকই চেটেপুটে খেয়েছ।

- আমার কাছে প্রথম সেরা রাঁধুনি আমার মা। তারপরেই তুমি।

নূরী ভেংচি কাটলো।

পরেরদিন সকালে আসাদরা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। নূরীর মা বললেন, “বাবা, তুমি তো গ্রামে আরও কিছুদিন আছ। তাই বলছি কি, নূরী এখানে কিছুদিন থেকে যাক। কতদিন পর মেয়েটাকে কাছে পেয়েছি!”

- হ্যাঁ, হ্যাঁ থাকুক কিছুদিন। আমি সময়মতো এসে নিয়ে যাব।

নূরীর মা খুশি হলেন। তবে নূরী বলল, “না, আমিও যাবো।” এতে নূরীর মা ব্যথিত হলেন। তবে নূরীর বাবা সাই দিলেন। নূরীরা চলে গেল। নূরীর মা অভিমানী সুরে বললেন, “মেয়েটা কি এখন তোমার কাছে বোঝা মনে হচ্ছে যে চলে যেতে দিলে?” জবাবে তার স্বামী বললেন, “আহা! ভুল বুঝো কেন? শহরে তো ব্যস্ততার কারণে ওরা দুজনে কথা বলারও সময় খুব বেশি পায় না। তাই আর আটকালাম না। নয়তো কি আমার ইচ্ছে করে না মেয়েটাকে কাছে রাখতে!” শেষ বাক্যটা তিনি বেদনায় ভরাক্রান্ত হয়ে বললেন।

এক সপ্তাহ পর আসাদরা রওনা দিলো। কিন্তু নূরী আরও কিছুদিন থাকার জন্য জিদ শুরু করলো।

- তুমি যাও। আমি আর কিছুদিন বাবা-মায়ের কাছে থাকি।

আসাদ আঁতকে উঠে বলল, “না, না। তা কিভাবে হয়? তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো?” এই কথা শুনে আসাদের বাবা-মা হাসলেও নূরীর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো না। কারণ সে জানে, সে না গেলে আসাদের খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হবে। আসাদ বুঝাতে লাগল যে, সামনে অনেক কাজ। নূরী না গেলে ঘর-দুয়ার নিয়ে সে বিপাকে পড়বে। অবশেষে রুকমনির কথায় নূরী যেতে রাজি হলো। বাসায় আসার পর নূরী চুপচাপ রুমে এসে শুয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আসাদ এসে বলল, “কি হলো? এভাবে শুয়ে আছ কেন? রাতের খাবার রাঁধবে না?”

- ভালো লাগছে না।

- কি বল! তাহলে?

- হোটেল থেকে আনো।

আচ্ছা বলে আসাদ চলে গেল। ঘর থেকে বের হবে এমন সময় নূরী এসে বলল, “যেতে হবে না। আমি রান্না বাসাচ্ছি।” আসাদ যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

রান্না শেষে নূরী খাবার পরিবেশন করে আসাদকে ডাকলো। আসাদ এসে খেতে বসলো। মনের সাধ মিটিয়ে খাচ্ছে আর প্রসংশা করছে। আহা! কি সুস্বাদু! কি চমৎকার টেস্ট! তোমার হাতের সবকিছুই দারুণ। হঠাৎ আসাদ লক্ষ্য করলো আজকের মাছ ভাজাটা অন্যরকম হয়েছে। আগের তুলনায় যেন আরও সুস্বাদু। আসাদ বলল, “বাহ! মাছ ভাজা তো আজ খুবই সুস্বাদু হয়েছে।” নূরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।”

- উম্মম্ম দারুণ। কালকেও নতুন কিছু করিও।

- এই! তুমি কি খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝ না?

- খাওয়াই তো সব। পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।

- আর মনের শান্তির ব্যাপারে কিছু ভাবো না?

- মনের আবার কি লাগে?

- ভালোবাসা লাগে, সঙ্গ লাগে, সময় লাগে।

- কি যে বল না।

- তুমি আমার দিকে কখনো ভালো করে তাকিয়েছ? আমি যে তোমার জন্য কত সময় করে সাজগোজ করি, তুমি কি কোনোদিন সেটার মূল্যায়ন করেছ? ভালোবেসে আমাকে সময় দিয়েছ? সুখ-দুখের আলাপ করেছ? আমার মনের অনুভূতি গুলো জানার চেষ্টা করেছ? আমাকে বুঝার চেষ্টা করেছ? বলো, জবাব দাও।

নূরী একনাগাড়ে কথাগুলো বলল। তার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট প্রকাশিত হয়ে আছে। আসাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর আঙ্গুল চুষে বলল, “আরেক টুকরো মাছ দাও তো।” নূরীর রাগ এবার আকাশ ছুঁয়ে গেল। রাগের মাথায় বাটির পুরো মাছ আসাদের প্লেটে ঢেলে দিয়ে বলল, “পেটুক একটা। খাও। খাও।” নূরী উঠে চলে গেল। আসাদ চুপচাপ খেতে লাগল। আর বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, “খাবারের সাথে রাগ করতে নেই।”

নূরী অন্ধকার বারান্দায় বসে আছে। খাওয়া শেষে আসাদ সেখানে এলো। পাশে বসলো। তারপর বলল, “তুমি কোন কোন দেশি আচার বানাতে পারো?” নূরী অবাক হয়ে গেল। সে ভেবেছিল হয়তো এখন আসাদ তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করবে। নূরী বলল, “সত্যিই আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না। এই! তোমার মধ্যে কি হৃদয়-মন বলতে কিছু নেই? আমি এখানে রাগ করে বসে আছি। কোথায় তুমি আমার রাগ ভাঙাবে, কিন্তু তা না করে তুমি আমাকে আচারের কথা জিজ্ঞেস করছো? কি অদ্ভুত!”

- আচারের কথা জিজ্ঞেস করার পরেই আমি রাগ ভাঙাতাম।

নূরী বারান্দা থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাগে তার মাথা ব্যাথা উঠেছে।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আসাদ রান্নাঘরে উঁকি দিলো। সাথেসাথেই নূরীর সাথে দেখা হয়ে গেল। নূরী কোমড়ে শাড়ি গুজে বলল, “রান্না করছি কিনা সেটাই দেখতে এসেছ‚ তাই না? এমন পেটুক আমি জীবনেও দেখিনি।” আসাদ না শুনার ভান করে চলে গেল। নূরী মনে মনে হাসতে লাগল। আসাদ যে মস্তবড় পেটুক তা নূরী বিয়ের আগেই জেনেছিল। রুকমনিই বলেছিল। সেদিনই নূরী বুঝেছিল নিয়তি তাকে আসাদের স্ত্রী হওয়ার জন্যই তৈরি করেছে। নয়তো বিদেশ গিয়ে কুকিং কোর্স করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ কেন স্বামী-সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল?

আসাদ অপলক দৃষ্টিতে নূরীর দিকে তাকিয়ে আছে। নূরী গোগ্রাসে একের পর এক লোকমা মুখে পুড়ে দিচ্ছে আর গিলছে। আসাদের দিকে চোখ পড়তেই নূরী বলল, “কি ব্যাপার, এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?”

- তোমার খাওয়া দেখছি।

- আমিও সেটাই ভাবছি। কারণ তুমি তো আমাকে দেখার মতো মানুষ না।

- তুমি তো ডায়েট করছ। তবে আজ এভাবে বেপরোয়ার মতো খাচ্ছ কেন?

- আমি ডায়েট করছি। কিন্তু ভেতরে যে এসেছে সে তো ডায়েট করছে না।

“ও আচ্ছা” বলে আসাদ নিজের খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। খেয়েদেয়ে উঠে চলে গেল। নূরী বোকার মতো বসে রইলো। এই মানুষটা কি কিছুই বুঝে না? কি অদ্ভুত!

আসাদ অফিসের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হতে লাগল। নূরী লান্স বক্সটা এগিয়ে দিলো। আসাদ বাইরে যাওয়ার জন্য পা দিলো। হুট করেই সে আবার নূরীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। আর তাত্‍ক্ষণিক নূরীর কপালে একে একে দুটো চুমো দিয়ে বলল, “একটা তোমার জন্য আরেকটা নতুন অতিথির জন্য।” আসাদের এমন আচরণে প্রথমে নূরী বিস্মিত হয়ে গেল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। আসাদ আরও বলল, “রান্নাবান্না সাবধানে করিও। আমি যত দ্রুত সম্ভব আম্মুকে নিয়ে আসবো।” লাজুক স্বরে নূরী বলল, “কিছুদিন না খেলে কি হবে?”

- না মানে আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে……

- হয়েছে আর বলতে হবে না। আমি সব করতে পারব। যাত্রা তো মাত্রই শুরু।

একচিলতে হাসি দিয়ে আসাদ চলে গেল। নূরী বারান্দায় এসে এক কাপ কফি নিয়ে বসলো। আসাদকে যতটুকু বোকা মনে করেছিল ততটুকু বোকা সে নয়। তবে ভীষণ রকমের খাদক। খাওয়া ছাড়া কিছুই বুঝে না। নূরী পেটে হাত রেখে বলল, “তুইও তো মনে হয় তোর বাবার মতোই খাদক হবি। ইতোমধ্যেই আমার ক্ষুধার মাত্রা বেড়ে গেছে। হায় কপাল! জীবনটা কি দুই খাদকের জন্য রাঁধতে রাঁধতেই চলে যাবে? কেন যে বিদেশ গিয়ে কুকিং কোর্স করলাম! তবে ভালোই লাগে যখন সে রান্নার প্রসংশা করে।” নূরী লাজুক হাসি দিলো। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালোবাসা কাজ করছে। নিজেকে নিজেরই খুব ভালো লাগছে। নূরী কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে আজ রাতে দুই পেটুকের জন্য স্পেশাল কিছু রাঁধতে হবে। একজন বাহিরের অন্যজন ভেতরের।

সমাপ্ত।

1
$ 0.09
$ 0.09 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments