গল্প: সমস্যার সমাধান

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

চিরকুট হাতে নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো মাহজাবীন। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আশপাশে তাকিয়ে কোন ডাস্টবিনও খুঁজে পেল না যে চিরকুটটা ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। অপরদিকে চিরকুট বুঝিয়ে দিয়েই হতচ্ছাড়াটা পালিয়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চিরকুট খোলে মাহজাবীন। সেটাতে লেখা-

“বন্ধু তুমি একা হলে

আমায় কইরো সরণ,

কথা বলবো দিবানিশি

যদি না হয় মরন!”

রাগে পুরো শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে মাহজাবীনের। কী রুচি, আর কী ছড়া! তার উপর দুটো বানান ভুল। সরণ আর মরণ বানান দুটি স্মরণ ও মরণ হবে। মাহজাবীন বেশ শব্দ করেই বলে উঠলো- ‘শালা অশিক্ষিত ফাজিল কোথাকার। দিবানিশি কথা বলার সখ তো, সামনে আবার পাইলে থাপ্রায়া তোর সখ মিটায় দেবো!’ যেই ছেলেটা চিরকুট দিয়েছে তার নাম জলিল। এলাকার টপ লেভেলের ভবঘুরে। বেশ কিছুদিন হলো মাহজাবীনের পিছু লেগেছে। মেয়েটা ওকে পাত্তা না দিলেও ছেলেটা একদম নাছোড়বান্দা। একেবারে হাত ধুয়ে পেছনে লেগেছে।

মাহজাবীন এইচএসসি পাশ। অথচ জলিল টেনেটুনে এইট পাশ করেছে। অবশ্য সেটা নিয়েও অনেক কানাঘুষা আছে। সবার ধারণা, জলিল পাশ করেনি। অলমোস্ট অশিক্ষিত হওয়া সত্বেও জিমটিম করে মোটামুটি বডি বানিয়েছে ছেলেটা। তার উপর আজব কিসিমের ড্রেস পরার অভ্যাস এবং ফেসবুকে উল্টাপাল্টা স্ট্যাটাস দেবার জন্য বহু মানুষের কাছে সে বেশ পরিচিত মুখ।

.

মাহজাবীনের হয়েছে এক জ্বালা। হতচ্ছাড়া জলিল তাকে এখন বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে উইশ করে। দুনিয়াতে যে এতো এতো দিবস আছে তা আগে সে জানতোই না। এইতো সেদিন, জলিল লাফাতে লাফাতে মিনি সাইজের একটা টেডি বিয়ার পুতুল নিয়ে হাজির।

‘মাজাবীন, শোনো।’

‘আমার নাম মাহজাবীন।’

‘ওইতো, শোনো। আজকে ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ। টেডি ডে।’

‘তো?’

‘এই নাও টেডি। তোমার মতোই কিউট।’

‘যা ভাগ।’

সেদিনকার মতো মুখ ফিরিয়ে চলে আসে মাহজাবীন। তার পরের দিন আবার জলিল লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। হাতে একটা ফুল আর কার্ড।

‘মাজাবীন, শোনো।’

‘আবার কেন এসেছিস?’

‘আজকে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ। প্রমিজ ডে।’

‘তো?’

‘প্রমিজ করো তুমি আমার হবে।’

‘যা ভাগ।’

মাহজাবীন চূড়ান্ত পর্যায়ে বিরক্ত। খুব মুশকিল হয়েছে। এই হতচ্ছাড়াকে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। তার একদিন পরে আবার জলিল লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। মাল্টিকালার এক আলখেল্লা টাইপের কী যেন পড়ে এসেছে। দেখতে সঙ এর মতো লাগছে।

‘মাজাবীন, শোনো।’

‘আবার কী হলো রে ভাই?’

‘আজকে তো ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ। হাগ ডে।’

‘তো?’

‘চলো হাগি আমরা!’

‘তবে রে হারামজাদা...!’

জলিলকে ছোটখাটো একটা দাবড়ানি দেয় মাহজাবীন। হাতের নাগালে পেলে মেরে একদম হাগিয়ে ছাড়তো। এই টর্চার আর নিতে পারছে না মাহজাবীন। সিদ্ধান্ত নেয়, এর একটা বিহিত করতেই হবে। এদিকে জলিল খুশিতে আটখানা। এতদিন ধরে সে মাহজাবীনের পিছু পিছু চলেছে। আজ প্রথমবার মাহজাবীন নিজে জলিলের পিছু নিয়েছিল। যদিও বিষয়টা ঠিক পিছু নয়, দাবড়ানি ছিল। তবুও মন্দ কী, ইমপ্রুভ তো হয়েছে। জলিল আরও কয়েকটা দিবস লিস্টে যোগ করে। মে দিবসে সে মাহজাবীনকে বলবে- ‘তুমিই আমার জীবনে একমাত্র মেয়ে।’ মা দিবসে বলবে- ‘আমার সন্তানের মা হবে?’ বাবা দিবসে বলবে- ‘আমি তোমার সন্তানের বাবা হতে চাই।’ এসব ভেবে জলিল খুশিতে বাকবাকুম। আনন্দে হাসে কাঁদে, শুয়োরের মতো নাক দিয়ে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে।

.

এর মাঝেই এক কান্ড ঘটে যায়। মাহজাবীনের ফেসবুক প্রোফাইলে যত ছবি আছে, সেগুলোতে গণহারে লাইক-কমেন্ট করতে থাকে জলিল। সবগুলোতেই লাভ রিঅ্যাক্ট, কমেন্টের ধরণও এক। কমেন্টের বিষয়বস্তু- মাহজাবীনের পোশাক। এই যেমন প্রোফাইল পিকচারে দেখা যাচ্ছে মাহজাবীনের পরনে নীল শাড়ি। জলিল কমেন্ট করেছে- ‘তোমাকে নীল শাড়িতে পরীর ছাঁও লাগতেছে। কিন্তু পরী গো, তোমার ওড়না কই? হিজাব কই? এখন থেকে বোরখা পড়বে। নিজেকে ঢেকে রাখবে, ওকে।’ কমেন্ট পড়ে মাহজাবীন রাগে প্রায় স্ট্রোক করে এমন অবস্থা। আরে ব্যাটা, শাড়ির সাথে ওড়না পড়ে কে? আর আমি যাই পড়ি না কেন, তাতে তোর কী? এসব বলার তুই কে? হাজারটা প্রশ্ন মাহজাবীনের। অথচ কী অদ্ভুত! জলিলের কমেন্টে প্রায় অর্ধশত হাহা রিঅ্যাক্ট। কিন্তু কেউ এই কথার বিরোধিতা করছে না। পাল্টা জবাব দিচ্ছে না। মাহজাবীন প্রায় সবগুলো কমেন্টের উচিত জবাব দিল। তারপর ব্লক দিলো জলিলের ফেসবুক একাউন্ট।

.

জলিলের বিষয়টা দিনদিন জটিল হওয়াতে মাহজাবীন বাসায় বাবা-মাকে সব খুলে বললো। ভেবেছিল বাবা-মা বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নেবে। কোন একটা সমাধানে পৌঁছাবে। কিন্তু হলো উল্টো। বাসায় সব বলতেই হাউকাউ লেগে গেল। চিল্লিয়ে সবাই বাড়ি মাথায় তুললো। মা বললেন- ‘ওরে কী হলো রে, আমার মেয়ের তো সর্বনাশ হয়ে গেল।’ এরপর বাবা বললেন- ‘এখন আমি কী করি, ওরে এখন আমি কী করি?’ মাহজাবীন মাথা চুলকায়। এসব হচ্ছেটা কী? ওর আবার কী সর্বনাশ হলো, মা এসব কী বলছে, বাবাই বা বুক চাপড়াচ্ছেন কেন?

সমাধান দূরে থাক, উল্টো নতুন সমস্যা ঘাড়ে এসে পড়েছে। মাহজাবীনের বাবা-মা চান যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে। নাহলে সামনে কখন কী ঘটে যায় বলা মুশকিল। ইতোমধ্যে মাহজাবীনের বাবা-মা সকল আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিদের বলেছে তাদের মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে। মাহজাবীন কী বলবে ভেবে পায় না। নিজের পায়ে সে নিজেই কুড়াল মেরেছে। এদিকে এক প্রতিবেশি এসেছে বাসায়। বাবা তার সাথে তুমুল আলোচনায় লিপ্ত।

‘ভাইজান আপনেই দেখেন, কী একটা অবস্থা। মেয়েকে নিয়ে আমি যে ভীষণ অসহায়।’

‘শোনেন ভাই, মিষ্টি খোলা অবস্থায় রাখলে মাছি তো বসবেই।’

‘কী কন? তাইলে এখন কী উপায়?’

‘মিষ্টি ঢেকে রাখলেও সুবিধা হবে না। বেচে দেন।’

‘অ্যাহ! কিন্তু বাসায় তো মিষ্টি নেই।’

‘আরে ব্যাটা আপনের মেয়ের কথা কই। রূপক অর্থে বুঝাইলাম।’

‘তার মানে নিজের মেয়েকে বেচে দেবো?’

‘এ কয় কী রে! বললামই তো রূপক অর্থে বুঝাইছি। মেয়েকে বেচবেন কিভাবে! বুঝাইলাম বিয়ে দিয়ে দেন।’

‘ও আচ্ছা। তাইলে ঠিক আছে। বিয়ে দিয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ।’

প্রতিবেশি ও বাবার আলাপ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শোনে মাহজাবীন। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে। পরিবার থেকে কোন সাপোর্ট যে পাবে না তা নিশ্চিত হয়ে যায়।

.

পরিবারের আশা ছেড়ে মাহজাবীন নিজেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কোথাকার এক হতচ্ছাড়ার জন্য ওর জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে তা সে মেনে নেবে না। তাই কোন আওয়াজ না করে সোজা থানায় চলে যায় মাহজাবীন। গিয়ে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলে। কিন্তু আফসোস! ওর সমস্যাটা এখনো সেভাবে ভাইরাল হয়নি বিধায় পুলিশরা তেমন একটা পাত্তা দিল না। বললো- ‘এসব বিষয় পারিবারিকভাবে মিটিয়ে ফেলেন। গ্যাঞ্জামে যাওয়ার দরকার নেই।’

কিছুটা হতাশ হয় মাহজাবীন। কিন্তু ভেঙে পড়ে না। বরং সাহস নিয়ে ছুটে যায় নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কতক এনজিও আর সংগঠনে। দুঃখের বিষয়, এখানেও মাহজাবীন কোনপ্রকার পাত্তা পায় না। এখানকার লোকেরা মাহজাবীনের সমস্যাকে ঠিক সমস্যাই মনে করছে না। এসব এনজিও আর সংগঠন নাকি সমাজের বড় বড় সমস্যা নিয়ে কাজ করে। এখনও বেশ কিছু আলোচনায় থাকা কেস নিয়ে কাজ করছে। মানববন্ধন, আলোচনা সভা, প্রেস এন্ড মিডিয়া কাভারেজ নানাবিধ বিষয় নিয়ে তারা এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে মাহজাবীনকে দেখার বা ওর কথা শোনার কেউ নেই।

মাহজাবীন এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে হতাশ হয়। চোখ ফেটে কান্না চলে আসে। তবে নিজেকে ঠিকই সামলে নেয়। এখন কাঁদা যাবে না। কাঁদলে মাথাব্যথা করবে। আর মাথাব্যথা করলে ঘুমের দরকার পড়বে। কিন্তু এখন ঘুমানো যাবে না। জেগে থাকতে হবে। মাথা ঠান্ডা রেখে সমাধান খুঁজতে হবে। সে বাসার পথ ধরে। বাসায় ঢোকার আগে এক মুদি দোকান থেকে হাফ কেজি মুড়ি কিনে নেয়।

.

বাসায় ফিরে মাহজাবীন প্রথমেই যে কাজটি করলো তা হলো পেঁয়াজ-মরিচ কেটে লবণ সর্ষে তেল দিয়ে ভালো করে মুড়ি মাখিয়ে নিল। এরপর সেটা খেতে খেতে চললো গভীর চিন্তা-ভাবনা। মুড়িটা ভীষণ টেস্টি হয়েছে। তাই সমাধান পেতে দেরি হলো না।

মাহজাবীন হাতে মোবাইল তুলে নিল। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলো। নিজের সমস্যা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা তুলে ধরলো। ওর পোস্টটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে সময় নিল না। দারুণ সাড়া পেল। পোস্টটি দেবার ২৪ ঘণ্টার ভেতর ফলাফল পাওয়া গেছে। সারাদেশের বহু সংখ্যক মানুষ মাহজাবীনের হয়ে কথা বলছে। বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও ছুটে এসেছে। পুলিশ পর্যন্ত এসেছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিদের অনেকেই যোগাযোগ করছে। মাহজাবীনের বাবাকে বোঝানো হলো- বিয়ে কোন সমাধান না। আপনার মেয়ের তো কোন দোষ নেই। তাকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে দিন। সবাই আপনাদের পাশে আছে। মাহজাবীনের বাবা আশ্বস্ত হন। মেয়েকে পরম মমতায় বুকে টেনে নেন। আর জলিল? লাস্ট আপডেট হলো- তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জলিল এখন পলাতক।

.

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments