'বাবা, নাবিল ভালো ছেলে। আর ও খুব মেধাবী। তুমি একবার ওর সঙ্গে কথা বলো, তুমি বুঝতে পারবে।'
বাবা হুংকার দিয়ে বললেন, 'শুধু ভালো দিয়ে আজকাল জগৎ চলে না। সঙ্গে আকার থাকা চাই। আর তোমার কী ধারণা যারা বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে এরা সবাই মেধাহীন? ভালো রেজাল্ট দিয়ে যদি ভালো চাকুরি পাওয়া যেত তবে বেকারের সংখ্যা এতবেশি হতো না।'
মাথা নিচু করে বাবাকে বললাম, 'আমি নাবিলের সঙ্গেই অনেক ভালো থাকবো বাবা৷'
ধমক দিয়ে বাবা বললেন, 'কিশোরীর মতো কথা বলো না তৃণা। এসব আবেগের ঠাই নাই বাস্তবতায়। সোহান অনেক ভালো ছেলে। সেও খুব মেধাবী। ভালো চাকুরি করে, মাস গেলে মোটা অংকের টাকা বেতন পায়। সোহানই তোমাকে ভালো রাখতে পারবে।'
বাবাকে নাবিলের কথা বললে বাবা চেঁচিয়ে উঠলেও আমার বিশ্বাস বাবা যদি একবার নাবিলের সঙ্গে কথা বলেন, নাবিল সম্পর্কে বাবার অবশ্যই ভালো ধারণা জন্মাবে। আমার মতো বাবাও নাবিলের উপরে আস্থা রাখতে পারবেন। কিন্তু বাবা নাবিলের ছায়াটাও দেখতে চান না। বাবার কথার উপরে কারো কথাও এ বাড়িতে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমার হয়ে মা যতবারই বাবাকে বোঝাতে গিয়েছেন বাবা ততবারই মাকে কড়া স্বরে প্রসঙ্গ বদলাতে বলেছেন। এখন তাই মা আমাকেই বোঝান বাবার কথা মেনে নিতে। এ সংসারে বাবার কথাই যে শেষ কথা।
সদ্য পড়াশোনা শেষ করা নাবিলের পক্ষে দুম করে চাকুরি জোগাড় করা সম্ভব নয়। তবে প্রচেষ্টার কমতি রাখছে না সে। দুম করেই যে কোনো একদিন চাকুরি পেয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করার সময়টা এখন আর আমার কাছে নেই। বাবা সময় বেধে দিয়েছেন। আগামী মাসে বিয়ে ঠিক করেছেন।
'নাবিল?'
মুঠোফোনের ওপাশ থেকে নাবিল শান্ত স্বরে জবাব দেয়, 'বলো তৃণা।'
'একবার আসবে বাড়িতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে?'
'তিনি তাহলে অনুমতি দিলেন অবশেষে।' বেশ খুশি মনেই নাবিল বলে উঠলো।
খানিক চুপ থেকে বললাম, 'বাবা বলেননি। তুমি যদি আসতে। আমার বিশ্বাস, তুমি এসে কথা বললে তোমার সম্পর্কে বাবার যত ভুল ধারণা রয়েছে সব দূর হয়ে যাবে।'
'এভাবে যাওয়াটা কী ঠিক হবে বলো?'
'বাবা যেহেতু স্বেচ্ছায় দেখা করতে চাচ্ছেন না। তাহলে জোর করেই দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে।'
'যদিও আমার মন সায় দিচ্ছে না। তিনি এতে আরও চটে না যান। তবুও তুমি যখন বলছো, আমি আসবো।'
বাবা কলেজের অধ্যাপক। বাড়িতে এবং কলেজে দু'জায়গাতেই বাবা বেশ কঠোর ব্যক্তি। দু'দিন বাদেই নাবিল এলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ির সকলে আতিথেয়তা করলেও বাবা ভীষণ রেগে গেলেন৷ বেশ অপমানবোধ নিয়ে নাবিল চলে গেলো। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। অযথা ডেকে এনে নাবিলকে অপমান করার অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে খাচ্ছিলো।
ফোনে নাবিলের সঙ্গে ভীষণ কাঁদতে লাগলাম। নাবিল আমাকে নানা কথা শুনিয়ে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো। কিন্তু মন কিছুতেই শান্ত হলো না। এই মুহুর্তে বাড়ি থেকে পালিয়ে নাবিলের কাছে আশ্রয় নিতে মন একদম সায় দেয় না। ভালোবাসার মানুষ হয়ে আমি বেকার মানুষটার উপর সংসারের এত বড় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেই কী করে!
নাবিল আসায় বাবা বেজায় ক্ষেপে গিয়ে পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সময় আরও এগিয়ে আনেন৷ কঠোর আদেশ জারি করেন, আমি যেন বাড়ি থেকে এইকয়দিনে আর বের না হই। নাবিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও বারণ করেন৷
অস্থির লাগতে শুরু করলো, ভেতর জুড়ে ছটফট করে চলছি। এবার বাবা আমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই বাধ্য করছেন৷ নাবিলকে ছেড়ে দিলে তাকে পাওয়া অসম্ভব কিন্তু বাবার অমতে গেলে পরিবারের সঙ্গে ভাঙ্গা সম্পর্কটা পরেও জোড়া লাগানো সম্ভব।
নাবিলের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখি নাবিলের ফোনকল৷ ইদানীং নাবিল যতবারই কল করে, আমার মন আনন্দে নেচে ওঠে৷ মনে হয়, নিশ্চয়ই কোনো খুশির খবর জানানোর জন্যই কলটা করা হয়েছে।
খুশি মনে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে হাসিমুখে 'হ্যালো' উচ্চারণ করতেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা করে উঠলো। নাবিল কাঁদছে।
আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করলাম, 'কী হয়েছে নাবিল?'
'মা আর নেই তৃণা।' বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নাবিল।
কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ নাবিলকে এই মুহুর্তে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ আমার কাছে নেই। নাবিলের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। চোখ ভিজে জল গড়াচ্ছে।
নাবিল গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে৷ কবে ফিরবে এই প্রশ্নটা করিনি৷ এই প্রশ্নটা এখন স্বার্থপরতার প্রকাশ করবে। আমি কখনোই স্বার্থপর হতে চাই না৷ কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলাম৷
বিষাদে ভরে উঠেছে আশপাশ। ক্রমশ ভয় জন্মাতে থাকলো নাবিলকে হারানোর। বাবা দৃঢ় স্বরে জানিয়ে দিয়েছেন, তার সিদ্ধান্তে কোনোমতেই বদল ঘটাবেন না। অটল হয়ে রইলেন বাবা তার নিজ চিন্তায়।
কেটে গেলো আরও কয়েকটা দিন। নাবিলকে বলি বলি করে আর বলা হয়ে উঠলো না কথাগুলো। শোকের মধ্যে চিন্তার পাহাড় চেপে দিতে খুব সংকোচবোধ হচ্ছিলো। সুযোগ খুঁজতে গিয়ে সময় চলে গেলো আর কথাগুলো অব্যক্তই রয়ে গেলো।
নাবিলকে যতবারই বলতাম, 'তোমাকে ভালোবাসি নাবিল।'
নাবিল ততবারই বলতো, 'তোমাকে আরও অনেক বেশি ভালোবাসতে চাই তৃণা।'
কিন্তু এখন আর নাবিলকে দেওয়ার মত অনেক সময় আমার হাতে নেই। দু'দিন বাদেই বিয়ে। গতকাল রাতেও জানতাম না, পাত্রপক্ষই এবার সময়টাকে কমিয়ে দিয়েছে। সকালে বাবা এসে মুঠোফোনটা নিয়ে গেলেন আর খবরটা দিয়ে গেলেন। নাবিলের সঙ্গে যোগাযোগের সব রাস্তা এই মুহুর্তে বন্ধ।
চোখের জল চোখে শুকায়। বাবার মন তবুও গলেনি। বিয়েটা হয়ে যায়। এবার বাবা বেজায় খুশি আর আমি মৃতপ্রায়।
বিয়ের ফটোশুট করার সময় ফটোগ্রাফার আমাকে বারবার বলতে লাগলেন, 'আপু, একটু হাসুন।'
হাসি কী এতই সস্তা জিনিস, চাইলেই হাসা গেল! আমায় বরং কেউ মন খুলে কাঁদতে বলুক। আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাই।
বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে বাবা পাশ থেকে বললেন, 'পরিবার ছেড়ে দূরে যাচ্ছে। হাসি কী আসে এই মুহুর্তে!'
নাবিলকে হারিয়ে ফেলার শোকে আমি অস্থির। ওদিকে মা সবাইকে বুঝিয়ে চলছেন, পরিবার ছেড়ে যাওয়ার শোকে আমি পাথর।
তারপর আর নাবিলের সঙ্গে কথা হয়নি কোনোদিন। নাম্বারটাও বদলে নিয়েছি। নাবিলের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই। সোহানের সঙ্গে আমার সাংসারিক জীবনটা সবার চোখেই বেশ সুখের। কেবল আমিই জানি, কতটা পানসে সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
সোহানের সঙ্গেই আমার বাকিটা জীবন কাটাতে হবে, এই চিন্তায় আমি সব যন্ত্রণা চাপা দিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি। এই মানিয়ে নিতে নিতে কেটে গেলো বেশ ক'টা বছর। বাবার বাড়ি তেমন একটা যাওয়া হয় না। মন টানে না। বাবার উপর জমে থাকা রাগটা এখনো পানি হয়নি। অবশ্য বাবাও চেষ্টা করেননি। তিনি ভাবেন, তিনি যা করেছেন এটাই তার করা উচিৎ ছিলো।
পানসে জীবনের অপূর্ণতা ঘোচাতে আনন্দ হয়ে আসে আমার মেয়ে সম্পূর্ণা। ওকে ঘিরেই এবার আমার জগৎ। ভালো থাকা বলতে আমি এখন কেবল সম্পূর্ণাকেই বুঝি।
মেয়েটা একটু একটু করে কথা বলতে শিখছে, দৌড়ানো শিখছে, বুঝতে শিখছে, দিনে দিনে চোখের সামনে মেয়েটা বড় হয়ে উঠছে। ওকে নিয়েই আমার সময়গুলো ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
তারপর যখন সম্পূর্ণার স্কুলে যাওয়া শুরু হলো, ওকে রোজ স্কুলে নিয়ে যেতে এবং বাড়ি নিয়ে আসার দায়িত্বে আমি আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। এই ব্যস্ততার মাঝেই আমি যেন ভালো থাকি। কিন্তু কিছু বছর বাদেই এই ভালো থাকার সময়ে চিড় ধরে বিপদ নেমে আসে। সোহানের চাকুরিটা চলে যায়।
অনেক চেষ্টা চালিয়েও একটা ভালো চাকুরি জোগাড় হচ্ছে না।
বিষয়টা বাবাকে জানালে বাবা ভরসা দিয়ে বললেন, 'চিন্তা করিস না। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার এক ছাত্র আছে রবিন, খুবই ভালো জানে আমায়। ও এখন অধ্যাপক হয়ে গিয়েছে।'
'সে কিভাবে সোহানের চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?'
'রবিনের বোন বিয়ে দিয়েছে বছর দুয়েক আগে। আমায় খুব করে যেতে বলেছিলো, কিন্তু তখন তোর মা অসুস্থ থাকার কারণে আর যাওয়া হলো না। তারপর মাঝেমধ্যেই ফোন করে যেতে বলে, কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না। এবার যাব তাহলে।'
'কিন্তু বাবা এর সঙ্গে সোহানের চাকুরির কী সম্পর্ক?'
'ও হ্যাঁ। সেটাইতো বলতে ভুলে গিয়েছি। ওর বোনকে যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে, শুনেছি ছেলেটা নাকি খুবই ভালো। অল্প বয়সে অনেক কিছু করে ফেলেছে। বেশ মেধাবী আর অনেক পরিশ্রমী। নিজের একটা আইটি ফার্ম আছে। আমি রবিনকে বললে, ও ঠিক ওর বোনের জামাইকে বলে সোহানের একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিবে।'
'তাহলে তুমি একটু কথা বলো বাবা। এই মুহুর্তে সোহানের একটা চাকুরি ভীষণ দরকার।'
'চিন্তা করিস না৷ আমি আছি তো।'
বাবা তার প্রাক্তন ছাত্র রবিনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন গত মাসে রবিনের বোনের মেয়ে হয়েছে৷ মেয়ে দেখার অজুহাতে রবিন তার বাসায় আমাদের সপরিবারে আমন্ত্রণ জানান৷ ওখানেই তার বোনাইয়ের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনীয় কথোপকথনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। চাকুরির বিষয়েও তিনি নিশ্চিত করেন। মাথার উপর থেকে একটা ভারী বোঝা সরে গেলো।
খুব শীঘ্রই সময় করে আমরা বাবা মা'র সঙ্গে রবিনের বাসায় গেলাম। রবিনের বোনাই তখন ওখানে উপস্থিত ছিলেন না। জানা গেলো কিছুক্ষণ বাদেই চলে আসবেন৷ রবিনের বোনের সঙ্গে ততক্ষণে আমার আলাপ বেশ জমে উঠলো।
তিনি আমার মেয়ের নাম জানতে চাইলে বললাম, 'সম্পূর্ণা।'
নামটা শুনে হেসে বললেন, 'আমার মেয়ের নামও সম্পূর্ণা। ওর বাবা রেখেছেন।'
'আমার মেয়ের নাম আমিই রেখেছি। মজার কথা হলো, বিয়ের আগেই ভেবে রেখেছি মেয়ে হলে নাম রাখবো সম্পূর্ণা।' হাসতে হাসতে বললাম।
বেশ খুশি হয়ে তিনি বললেন, 'তাই নাকি! আমার মেয়ের বাবাও তো নাকি বিয়ের আগে ঠিক করে রেখেছিলেন মেয়ের নাম।'
'বাহ্! বেশ মিল তো তার সঙ্গে আমার!' মজার ছলেই কথাটা বললাম আমি।
তিনি হেসে বললেন, 'তাই তো দেখছি।'
'কখন আসবেন তিনি?'
'এই তো এখনই চলে আসবেন।'
খানিক বাদেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বাবাও চুপ করে রইলেন। মা ভীষণ বিব্রতবোধ করছেন৷
ভদ্রলোক হেসে সালাম দিয়ে বললেন, 'আমি নাবিল।'
রবিন সবাইকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সোহান হাসিমুখে কথপোকথন চালিয়ে যেতে থাকলো। আমার চোখ জুড়ে পুরাতন দৃশ্যেরা জমাট বাধলো। ভেতর জুড়ে স্মৃতিরা জেগে ওঠার যন্ত্রণায় ছটফট করছি প্রতিনিয়ত। বাবা যেন এবার কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেললেন।
রবিনের বোন একগাল হেসে নাবিলের উদ্দেশ্য বললেন, 'জানো নাবিল, তৃণা আপুর মেয়ের নামও সম্পূর্ণা। তিনিও নাকি তোমারই মতো আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। কী অদ্ভুত তাই না বলো?'
নাবিল প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে সম্পূর্ণাকে কাছে টেনে নিয়ে হেসে বললো, 'তোমার নামটা ঠিক তোমার মতই মিষ্টি।'
নাবিলের চোখে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেলো, কথা ছিলো আমাদের দু'জনের ভালোবাসা সম্পূর্ণ করে একজন সম্পূর্ণা আসবে। আর এখন, দু'জনের ভালোবাসার অসম্পূর্ণতা মনে করিয়ে দিতেই দু'জন সম্পূর্ণার আবির্ভাব ঘটলো।
গল্প: সম্পূর্ণা।
লেখা: মাহ্ফুজা রহমান অমি।