সম্প্রতি এক তরুণ চদ্রনাথ পাহাড় থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এর আগে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলেছে, আমি জারজ নই। জারজ এই সমাজ- যে আমাকে জন্ম দিছে। জারজ এই সিস্টেম- যে আমাকে জারজ বইলা গালি দেয়।
তাঁর এই চিৎকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে। আর সে পাহাড় বেয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে চলে যেতে থাকে। তখন ভোরের সূর্য উঠছিল।
জানা গেছে, ওই তরুণের নাম পালক। উনিশ বছর আগে টোঙ্গির ব্যাংক কোলনির পাশে রোমেলা তাকে পায়। রোমেলা তখন তেইশ বছরের সুন্দরী যুবতী। গার্মেন্টসের কাজ হারিয়ে পেশায় ভ্রাম্যমাণ পতিতা। রাত এগারোটার দিকে ডাস্টবিনের পাশে বড় রেইন্ট্রি গাছের নিচে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিল একজন 'ক্ষুধার্ত পুরুষের'। কিছুক্ষণ পর তিন তিনজন ক্ষুধার্ত পুরুষ রোমেলার সামনে হাজির হলো। তারা গাছের আড়ালে অন্ধকারে একে একে রোমেলাকে ভক্ষণ করল। কিন্তু রোমেলার পেট ভরানোর কথা ভাবলো না। বস্তুত সেই দায়ও তাদের নেই। কারণ, তারা এই এলাকার নিরাপত্তারক্ষী। তাদেরকে তৃপ্তি দেয়া রোমেলার জন্য রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেয়ার মতোই কর্তব্য।
পুরুষ তিনটি হাতের লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে শীষ দিতে দিতে চলে গেল। আধো আলো আধো অন্ধকারে তাদেরকে আর ঠাহর করা যাচ্ছে না। এমন সময় একটা নবজাতকের ক্ষীণ কণ্ঠের কান্না ভেসে এলো। সেই সাথে কুকুরের কুঁই কুঁই আওয়াজ। রোমেলা কান খাড়া করে এগোতে থাকে। ডাস্টবিনের সামনে গিয়ে দেখতে পায়, নেড়ি কুত্তার গলায় প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলছে। তার ভেতর থেকে আসছে মানুষের বাচ্চার চিৎকারের আওয়াজ। খুব তীক্ষ্ণ কিন্তু খুবই দূর্বল।
রোমেলা কী করবে ভেবে পায় না। তার পেটে ক্ষুধা। শরীর অবসন্ন। ঘরে চাউল নেই। শিশু কন্যা হয়ত ঘুম ভেঙে এতোক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছে। এখন এই আরেকটা ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে সে কী করে? বেচে দেয়া যায়। তাতে কিছু টাকা আসবে। কিন্তু রোমেলা এখনো অতটা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেনি। এইসব ভাবনার ভেতর শিশু আরেকবার কেঁদে ওঠে।
রোমেলা তাকিয়ে দেখে নেড়ি কুত্তাটা খুব করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। তার মনে হয় কুত্তাটা যেন বাঁকা চোখে হাসছে। রোমেলার লজ্জা লাগে। যদিও কেউ দেখছে না, যদিও খুব নির্জন রাত, তবু এই আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নেড়ি কুত্তার দেয়া লজ্জা সে হজম করতে পারে না। ডাস্টবিনের গন্ধ এড়াতে হাফ পেট দম নিয়ে সে কুকুরের দিকে এগোয়। কিন্তু কুকুরটা তাকে ধরা দেয় না। রোমেলা ছলাকলা দেয়। কিন্তু কুকুর তো ক্ষুধার্ত পুরুষ না। তাই ছলাকলায় ভোলে না। রোমেলার মনে হয় নেড়ি কুত্তাটা তার মনের ভাব বুঝে ফেলেছে। বাচ্চাটাকে তাই দিতে রাজি না।
এই সময় বাচ্চাটা আবার চিৎকার দেয়। রোমেলা তাকিয়ে দেখে লাল পিপড়ে সারি বেধে ব্যাগের ভেতর ঢুকছে। কী করা যায়? কুকুর তো ছলাকলায় ভুলছে না। কিন্তু রুটিকলায় ভুলবে।
দূরে গলির মোড়ে কোহিনূরের চা-বিড়ির দোকানে পচিশ ওয়াটের লাইট জ্বলছে। রাস্তার কারেন্টের খুঁটি থেকে নেয়া চোরাই লাইন। দিনে কুড়ি টাকা চার্জ নিয়ে কানা রতইন্যা এই লাইট দেয়। সেই লাইটে কলা রুটি চকচক করে ঝুলতেছে। কোহিনূর কি বাকিতে দুইটা কলারুটি দেবে না?
রোমেলা প্রায় দৌঁড়ে দোকানের কাছে যায়। হঠাৎ মনে পড়ে কোহিনূর একহালি কন্ডমের দাম পায়। বাকি চেয়ে লাভ নাই। রোমেলা খুট করে কলারুটি ছিড়ে হুট করে দৌঁড় দেয়। এক দৌঁড়ে ডাস্টবিনের কাছে এসে নেড়ি কুত্তার সামনে বসে। তারপর হাপাতে হাপাতে কুত্তার সাথে ভাগাভাগি করে কলারুটি খায়। কুত্তার মনে একটা আস্থা জন্মায়। তার গলা থেকে ব্যাগ খুলে বাচ্চাটাকে বেড় করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
বাচ্চাটাকে দেখে রোমেলা মুগ্ধ হয়ে যায়। কী দারুণ টানা টানা চোখ। গোলাপী গাল। ছেলে না মেয়ে? হ্যাঁ, পুরুষই তো। নিমকহারাম পুরুষ। কার ছেলে কে জানে। একদিন হয়ত এই ছেলেও কাউকে ধোঁকা দেবে। মিঠা মিঠা কথা বলে বিছানায় নেবে কোনো মেয়েকে। তারপর সময় মতো ছুড়ে ফেলে অন্যত্র পালাবে। আর ধোকা খাওয়া মেয়ে সমাজের রক্তচক্ষু এড়াতে কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে দেবে সদ্য নাড়ি ছেড়া সন্তান।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রোমেলা পথ চলছে। রাস্তা ফাঁকা। তবু খুব সাবধানে ওড়নার নিচে শিশুটাকে লুকিয়ে রেখেছে। কেঁদে উঠলে দ্রুত অন্ধকারে লুকাচ্ছে। সে জানে এই শহরে গরীবের কথার কোনো দাম নাই। যে কেউ দেখলে তাকে চোর বলে সন্দেহ করবে। কোটি টাকা চুরি করে এই শহরের বড়লোকেরা বিদেশে পাঠায়। জুম্মার নামাজ পড়ে ফ্লাইটে তারা ব্যাংকক যায়। সেখানে নাইট ক্লাবে উদ্দাম নৃত্য করে ফরেনার সুন্দরি দিয়ে শরীর টেপায়। দেশে ফিরে পরদিন এই সব চোরেরাই হাজি সেজে সালাম আর শ্রদ্ধা কুড়ায়। তাদের কথার দাম আছে। তাদের কথায় চলে সমাজ। কিন্তু রোমেলার মতো ক্ষুধার্তরা এক পিস রুটি চুরি করলে গণপিটুনিতে প্রাণ যায়। এ বড় আজব শহর। তাই পথ চলতে হয় খুব সাবধানে, খুব হিসেব করে।
রোমেলা যখন তাদের গলিতে পৌঁছায় তখন দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল জোয়ার্দার স্টোরে আলো জ্বলছে। দোকানের কর্মচারী সিদ্দিক মিয়া। বছর ত্রিশেক বয়স। চোখ দু'টো কুতকুতে। আট মাস হলো তার বউ এক ট্রাকের হেলপারের সাথে ভেগে গেছে। এখন দোকানেই ঘুমায় সিদ্দিক। ফ্লোরে বিছানা করছিল। রোমেলা গিয়ে দাঁড়াতেই কুতকুতে দুটি চোখ তুলে তাকালো। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই সে রোমেলাকে চেটেপুটে খেয়ে ফেলবে।
ওড়নার নিচ থেকে বাচ্চাটাকে বের করে রোমেলা। ঘুমাচ্ছে। রোমেলা বলে, এইটারে কুড়ায় পাইছি। কোন খানকির পোলায় যে ফালায়া গেল। এখন কী করি কও তো সিদ্দিক ভাই। ঘরে নাই চাইল-ডাইল৷ বিজনেসও হয় নাই আজ।
সিদ্দিক বলে, দুধ আছে। গুড়া দুধ। কিন্তু হ্যার তো ম্যালা দাম।
রোমেলা খানিকটা ঝুঁকে দাড়াল। ওড়নার ফাঁক দিয়ে বুকের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। সিদ্দিক মিয়া ঢোক গিলল। রোমেলা ঢং করে বলে, দামটা বুঝলা সিদ্দিক মিয়া। এই মাসুম বাচ্চার লাইগা মায়া বুঝলা না।
রোমেলার বুক থেকে চোখ না সরিয়ে সিদ্দিক বলে, এই সব হাইরা-জাইরার লাইগা মায়া কইরা কী লাভ কও।
রোমেলা বলে, আমার লাইগাও তোমার মায়া জাগে না? নাকি একটা শিমার তুমি?
সিদ্দিক বলে, বুক তো কাঁপে। তয় তোমার উপর মায়া দেখাইলে জোয়ার্দার সাব আমারে কাঁচা চাবায় খাইবো না?
রোমেলা হাসে। তারপর কামিজ উঠিয়ে পুরুষ্ট স্তন শিশুটার মুখে গুজে দেয়। রোমেলা বলে, নাই, এই বুকে দুধ নাই। মায়া হয় না সিদ্দিক ভাই? নাকি ঢাইকা দিমু?
সিদ্দিক চোখ সরায় না। হাত বাড়ায় দুধের প্যাকেটের দিকে। ব্যস্ত হয়ে বলে, না না ঢাকবা ক্যান? ঢাইকো না। মায়ায় আমার বুক ফাইটা যায়।
রোমেলা হাত বাড়িয়ে দুধের প্যাকেট নেয়। সিদ্দিক বলে, তুমি যদি জোয়ার্দার সাবের মাল না হইতা, তুমারে লইয়া আমি নিরুদ্দেশে যাইতাম রোমেলা।
দুধের প্যাকেট নিয়ে রোমেলা বাসায় এসে দেখে রাহেলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সাত বছর বয়স তার। মেয়েটা একদম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। মায়ের কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা দেখে রাহেলা কান্না থামিয়ে ড্যাবডেব করে চেয়ে রইল।
রোমেলা বলল, এইটা তোমার ভাই। এরে আমি পালক নিছি। তোমার পালক ভাই। সুন্দর না?
রাহেলা বলল, প্যাট পুড়তাছে মা।
রোমেলা একবাটি দুধ গুলিয়ে পালক আর রাহেলাকে খাওয়ায়। তারপর টিনের ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। জোয়ার্দারের চিলেকোঠার ঘরে বাতি নেভে নাই। রোমেলার পেটে রাক্ষসের মতো ঘাই মারছে ক্ষুধা। একবার ঢুঁ দেবে চিলেকোঠায়?
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে রিনঝিন শব্দ। পেট ভরা থাকলে এই শব্দ গানের মতো মিঠে লাগে। কিন্তু এখন বিরক্ত হচ্ছে রোমেলা। পালককে শুইয়ে দিয়ে রোমেলা রাহেলাকে বলে, ওরে একটু দেইখো। আমি আইতাছি।
তারপর বৃষ্টির ভেতর সে ঘর থেকে বের হয়। গলির মাথায় রোডলাইটটা জ্বলছে আর নিভছে। রোমেলা আবছা আলোয় মৃদু পায়ে হেটে জোয়ার্দারের চার তলার চিলেকোঠায় গিয়ে কলিংবেল টেপে।
এককালে ট্রাক ড্রাইভার ছিল জোয়ার্দার। ট্রাকের চাকা ঘোরারা সাথে সাথে জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। তিন শতক জমির উপর চার তলা এই বাড়িটা তার নিজের। তিনটা ট্রাক আর দুইটা পিকআপেরও মালিক সে। বিয়াল্লিশ বছর বয়স। তয় শরীরের গাথুনি খুব মজবুত৷ এখনো বাইশ বছরের তাগড়া জুয়ানের মতো তাগোদ। তেইশ বছরের রাহেলাকে সে তুড়ি মেরে ঘায়েল করে দেয়।
তিন বছর হলো জোয়ার্দারের বউটা মরছে। কেউ কেউ বলে জোয়ার্দার নিজেই মারছে। মেরে ব্যালকনি থেকে নিচে ফেলে দিছে। তারপর সবাইকে বলছে, আকাশে পূর্ণিমার চান উঠলে বউটার মাথা বিগড়ায়। ক্যান যে বিগড়ায়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাই বইলা ব্যালকনি থেইকা লাফায়া পড়তি হবি?
এই ঘটনার পর খুব চাপ গেছে। জোয়ার্দার বলে, এইটা এক জাইড়্যা দ্যাশ। চারদিকে সব খানকির পোলায় ভরা। ঘুষ ছাড়া এক পয়সার কাম হয় না। কোথায় একটু বউর জন্য শোক করুম তা না। ঘুষ দিতে দিতে নিজেরই জান যায়।
কিন্তু জোয়ার্দারের মেয়ে বলে, এই জাইড়্যা সিস্টেম ছিল বইলায় তুমি বাইচা গ্যালা। তয় কয়দিন। একদিন তো মরবাই। ওই পাড়ে যায়া বুঝবা।
মেয়ে আর কোনো দিন বাপের বাড়ির দিকে মুখ করে নাই। জোয়ার্দার তিন তলা ভাড়া দিয়ে চিলে কোঠায় গিয়ে উঠছে। এই বিয়ালিশ বছর বয়সে সে বাইশ বছরের মতো যৌবন নিয়ে এখানে ওখানে ঢুঁ মারে। ট্রাক আর পিকআপের তদারকির নাম করে আজ গোয়ালন্দ তো কাল টাঙ্গাইল চলে যাচ্ছে। যখন যখন বাসায় থাকছে হরহামেশা জোয়ান জোয়ান 'কাজের বেটি' ডাকছে। রোমেলা তাদেরই একজন।
দরজা খুলে জোয়ার্দার বিগলিত হাসি দেয়। তার ঠোট বেয়ে পানের কষ গড়াচ্ছে। বলে, আহো রোমেলা আহো। তোমার কথাই ভাবছিলাম। রোমেলা ভেতরে ঢুকে দেখে রোগা মতো এক যুবতী পায়জামার ফিতা বাঁধছে।
জোয়ার্দার বলে, বুঝলা রোমেলা, আইজকালকার মাইয়াগুলার তাগোদ নাই। কাজকামে কোনো গোছগাছ নাই। বেগুন দিয়া ট্যাংরা মাছ রান্ধে। মুখে দিয়া মনে হয় ঢ্যাঁড়স ভাজি।
রোগা মেয়েটাকে বলে, তুমি তাইলে আহো। ঠিক দুই দিন পর আইবা। সন্ধ্যায়। ট্যাকা দিয়া দিমু।
মেয়েটা বের হয়। জোয়ার্দার দরজা আটকে রোমেলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, বুঝলা রোমেলা শিয়ানে শিয়ানে ডেরাইভার পাইলাম না। কম তো দেখলাম না। তয় তুমি ছাড়া আমার লগে গিয়ার মাইরা কেউ পারে না।
রোমেলা চোখ তুলে বলে, ক্ষিধা লাগছে জোয়ার্দার।
জোয়ার্দার বলে, ভাত চাপাইয়া আহো তাইলে। আমারও ক্ষিধা মেটে নাই।
রোমেলা ভাত উঠিয়ে বেডরুমে চলে যায়। এদিকে ভাতের পানি গরম হতে হতে বলক ওঠে। ওদিক থেকে নারী-পুরুষের দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় মাইলের পর মাইল দৌঁড়ে তারা যেন হাপাচ্ছে। রোমেলার কণ্ঠ ভেসে আসে, সাথে খিলখিল হাসি, তোমার বয়স একটু হইছে। তয় মুরদ কমে নাই। আমারে নিকা করবা তুমি জোয়ার্দার?
জোয়ার্দার হাসতে হাসতে বলে, তোর মাথা নষ্ট রোমেলা। সমাজে আমার একটা সম্মান আছে না?
রোমেলা বলে, আমার সাথে শুইলে তোমার সম্মান যায় না। বিয়া করলেই জাত যায়?
জোয়ার্দার বলে, হেইডা তুই বুঝবি না। তাছাড়া তুই হইলি বারো জনের আইঠা মাগী। তোর লগে দুই বেলা শুয়া যায়। তয় ঘরের বউ করা যায় না।
রোমেলা একটা বিশ্রী গালি দেয়। তারপর হাসে। হাসতে হাসতে বলে, তুই একটা আসল খানকির পুত। আর তোর এই সমাজ রোমেলার চেও বড় খানকি।
এক মুহূর্ত পর আরও দ্রুত নিশ্বাসের শব্দ শুরু হয়। জোয়ার্দার যে আসল 'খানকির পুত' তা প্রমাণে সর্বশক্তি ঢেলে দিচ্ছে। ঠিক তখন বলক উঠে ভাতের পাতিলের ফ্যান উপচে পড়ছে।
পেটেভাতে দিন ভালোই চলতে পারত রোমেলার। জোয়ার্দারকে বললে ট্রাকের হেলপারের চাকরি পেয়ে যেত পালক। তারপর একদিন ড্রাইভারও হতো। আর জোয়ার্দারের ঘরে কাম করে রোমেলার পেট আর গতর চলত মন্দ না। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় রোমেলার তাই হলো। পালককে 'মানুষের মতো মানুষ' বানানোর ইচ্ছা হলো তার।
পালককে সে স্কুলে ভর্তি করল। যাতে একদিন সসম্মানে বাঁচতে পারে। কিন্তু শর্ষের মধ্যেই যে ভূত রোমেলা তা বোঝে নাই। স্কুলের বাচ্চারা পালককে জাইড়্যা জাইড়্যা বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সহ্য করতে না পেরে পালক একদিন এক পিচ্চির নাক ফাটিয়ে ছুটে বাসায় এসে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো। পরের দিন রোমেলাকে ডাকলেন হেড স্যার। কাচুমাচু মুখ করে বললেন, স্টুডেন্টদের প্যারেন্টসরা চাচ্ছেন না পালককে আমরা এই স্কুলে রাখি। তাহলে তারা অন্য স্কুল দেখবেন। আমি খুবই স্যরি। খুব স্যরি।
রোমেলার ইচ্ছা করল গলা খুলে গালি দেয়। কিন্তু কাকে দেবে? কী গালি দেবে? বুঝতে না পেরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে।
পালকের তখন বয়স কত আর? আট কী নয়। তার হাত ধরে রোমেলা এক সকালে মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মক্তব্যের হুজুর পালকের হাত ধরে তাকে মসজিদের ভেতর নিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানেও পালক দলছুট।
মহল্লার বাচ্চারা তাকে খেলতে নেয় না। বলে, তোর বাপ-মায়ের দিশা নাই। তোরে খেলায় নিমু না। তাইলে আমরা নষ্ট হয়া যামু। তুই না জাইড়্যা?
পালক হীনমন্যতায় ভোগে। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে একা। নিঃসঙ্গ। বিমর্ষ। একদিন ছোট ছোট পায়ে একটি বালিকা এসে পাশে তার দাঁড়ায়। মাথার চুলগুলো রুক্ষ। এলোমেলো। মুখখানা মলিন। বালিকা বলে, আমারে একটা ফড়িং ধইরা দিবা? আমি পালুম।
পালক বলে, দিমু। কিন্তু ফড়িং পামু কই?
বালিকা গলির ভাঙা দেয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখায়। দেয়ালের উপর বেওয়ারিশ জন্মানো ধুন্দল গাছ। ফুল ফুটেছে। সেখানে উড়ছে কয়েকটি ফড়িং।
পালক বালিকার সঙ্গে ফড়িং ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সহজে দেয় না ধরা ফড়িং। কিন্তু পালকের আনন্দ তাতে একটুও কমে না। যত বার ফড়িং পালককে ফাঁকি দেয়, ততোবার পালক দ্বিগুন উৎসাহে চেষ্টা শুরু করে। এমন মধুর বিকেল, খেলার এমন সুখ পালকের জীবনে তো আর আসে নাই।
এক, দুই, তিনদিন যায়। কতদিন যে যায় ঠিক হিসাব নাই। রোজ বিকেলে রুটিন করে তারা ফড়িং ধরতে বের হয়। গলি ছাড়িয়ে, দূরে, অনেকটা দূরে- কাশবনে, ঘাসবনেও পৌঁছে যায় এই দুই বালক-বালিকা। তারপর এক গোধূলিলগ্নে ঘাসবনে পালক একটি ফড়িং যখন ধরে বালিকার সে কী আনন্দ। পালক বালিকার হাতে ফড়িংটা তুলে দেয়। বালিকা আনন্দে চোখ গোলগোল করে বলে, কী সুন্দর, না?
পালক বলে, তোমার মতো।
বালিকা বলে, ছাইড়া দেই?
কেন?
সন্ধ্যা হইছে। ওরে না পাইলে ওর মায়ে কানবো না?
পালক হাসে, আইচ্ছা। ছাইড়া দাও তাইলে।
বাকিকা মুঠো থেকে ফড়িং উড়িয়ে দেয়। তার মুখে তখন গোধূলির আলো পড়েছে। ছোট ছোট রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে। মুখে তার অপার্থিব আনন্দের আভা। পালক সেই মুখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে, নাম কী তোমার?
বালিকা বলে, কেয়া। কেয়া বইলাই আমারে সবাই ডাকে।
পালকের বন্ধুহীন জীবনে একটুকরো সবুজ মরুদ্যান হয়ে ওঠে কেয়া। সৎ মায়ের সংসারে সে একটা বোঝার মতো। এককোণে পড়ে থাকে। কখন খায়, কখন নায় কে তার খেয়াল রাখে? কিন্তু পান থেকে চুন খসলে সৎ মায়ের হাতে তার দুর্গতির সীমা থাকে না। কেয়ার সবজি বিক্রেতা দরিদ্র পিতা মেয়ের জন্য গোপনে চোখ মোছেন। কিন্তু মুখরা স্ত্রীকে শাসন করে অন্যায়ের প্রতিকার করার মুরোদ তার নাই।
কেয়াকে কোনো কোনোদিন সে বাজারে নিয়ে যায়। পালকও যায় কেয়ার বাবার সঙ্গে। বলে, চাচা আমারে ব্যবসা বুঝাইবা?
কেয়ার বাপে হাসে, বুঝবি। ধীরে ধীরে বুঝবি।
বাজারে শেষে সবজির ঝুড়িতে বসিয়ে কেয়াকে মাথায় নেয় তার বাপ। পালক তার হাতের আঙুল ধরে রাস্তা পাড় হয়। কোনোদিন মিষ্টির দোকানে বসে রসগোল্লা খায় তারা। কেয়ার বাপে চোরের মতো মুখ করে বলে, বাসায় যাইয়া কইস না আবার। তর মা'য় ক্ষ্যাপবো।
এইভাবে একটা মিষ্টি মধুর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় কেয়া আর পালকের। তারা বড় হতে থাকে। কেয়ার পোশাকের পরিধি বাড়তে থাকে। সেই সাথে সমাজের নগ্নতা ধরা দিতে থাকে তাদের চোখে।
চলবে....
গল্প #পালক
(১ম পর্ব)
© হাসনাত কাদীর