গল্প--# কন্যাকাহন #
আমাদের বাসায় যখন কোন যুবক আত্মীয় ছেলে বেড়াতে আসে, মায়ের আত্মীয় হোক আর বাবার আত্মীয়ই হোক।তখনি মায়ের মেজাজ হিমালয়ের সমান উঁচু হয়ে যায়।মা আমার রুমে এসে রাগে গজগজ করতে করতে বলতে থাকে,তুই আমার রুমে বেশী থাকবি।রাতেও আমার সাথেই ঘুমাবি।নিজেকে সেইফ রাখতে হয় জোয়ান ছেলে বাসায় থাকলে।এমন করে মিশবিনা।অমন ভাবে চলবিনা।দুরত্ব বজায় রাখবি।খালাতো ভাই,ফুফাতো ভাই,মামাতো ভাই হইছে কি হইছে?
মা আজ তোমাকে নিয়ে এক সেমিনারে যাবো। বিকেলে রেডি হয়ে থেকো।
কিসের সেমিনার রে?
গেলেই বুঝবে মা।
তুই বলতে পারিসনা?
নাহ।পারিনা।
একটা আজব মেয়ে জন্ম দিয়েছি। যন্ত্রণা!
তোমরা মায়ের জাতটাও আর ও বেশী আজব!হুহ!
বিকেলে আমার মাকে নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম।স্থান শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরীর সুফিয়া মিলনায়তন। সেমিনারের আয়োজন করেছে আমার পরিচিত এক বড় আপু। সব কন্যা সন্তানদের উদ্দেশ্যে করেই গঠিত তার সংগঠনের নাম কন্যাকাহন।বিশাল হলরুমে একজন পুরুষ ও নেই।
শতশত নারী ও তাদের কন্যারা উপস্থিত।স্টেজ সবার জন্যই উম্মুক্ত। সব মায়েরা ছোটবেলায় কোন সম্পর্কের কার দ্বারা কিভাবে, কেমন করে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে,তা অবলীলায় বলছে। আমার মা একটু উসখুস করছে।আমি মাকে সহজ করে দিয়ে বললাম, মা যাও।যা লজ্জায় কোনদিন কাউকে বলতে পারনি।তা এখানে বলে, সেই শিশুমনের গোপন চাপাক্ষোভ আর ঘৃণার সমাধি দাও।
মা বলল,নাহ থাক!বলে কি হবে সবার সামনে। আর এখন যা বোঝার বুঝেছি।মাকে জোর করলাম না আর।বুঝলাম মা নিজের মেয়ের সামনে বলতে পারবেনা।
বাসায় এসে মাকে বললাম, এই আপুটা এখন যেমন সুন্দর, ছোটবেলায় নাকি আরও বেশী সুন্দর ছিল।তাই নিকট আত্মীয়, দূরাত্মীয় কারো নখের আর ঠোঁটের ছোবল থেকে রেহাই পায়নি তার নরম শরীরখানি।কাউকে বলতেও পারেনি লজ্জা আর আড়ষ্টতার জন্য।উনার ও দুই মেয়ে আছে এখন। তাই নিজের জীবনাভিজ্ঞতা থেকেই সিদ্ধান্ত নিল কন্যাশিশু ও নারীদের সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতামূলক একটি সংগঠন গড়ে তুলবে।আমিও এর মেম্বার।চাইলে তুমিও হতে পার।
হুম,আমাকে এড করে দিস।নারী জীবনের নানাকিছু সম্পর্কে জানতে পারবো।
মা, তুমি সেমিনারে গিয়ে কি বুঝলে এবার বলতো?
শুন,আসলে আমরা মায়েরা কিংবা বড়রা, কন্যা সন্তান ছোট থাকতে,কখনো চিন্তাই করতে পারিনা যে, ওই কচি বয়সেই কোলে নেয়া,বাজারে নেয়া,আদর করা,ড্রেস চেঞ্জ করা,গোসল করানো,একটু খেয়াল রাখার অজুহাতে নিজের চেনা পুরুষ লোকেরাই যৌন নিপীড়ন করে মেয়ে শিশুদের।এটা অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যা আজ এই সেমিনারে না গেলে উপলব্ধিই করতে পারতাম না।
এতদিন মনে মনে ভাবতাম, হয়তো আমার মত বাল্যবেলায় অল্পসংখক মেয়েরাই এমন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।কিন্তু আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছি, যখন দেখলাম, তোর ওই আপুটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
আজ এই মঞ্চে বসা একজন বিবাহিত নারীও ও কি আছেন,যিনি ছোটবেলায় এমন বিশ্রী পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি?
ঘাড় ঘুরিয়ে সবার দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, একজন নারীর হাত ও উপরে উঠেনি।
হায় খোদা!তখন আমার কলিজা সেই ছোটবেলার মত আবার ও কেঁপে উঠলো।
রাইট মা। প্রতিটি মা,বাবারা নিজে সতর্ক হয় আর মেয়েকে ও সতর্ক থাকতে বলে ঠিক সেই বয়সে,যেই বয়সে বলার প্রয়োজন পড়েনা।তখনতো নিজেই নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে পারে একজন মেয়ে।এই যে তুমি সবসময় বাসায় কোন ছেলে আসলেই অস্থির হয়ে যাও আমার নিরাপত্তা নিয়ে।তখন বেশ রাগ হয় আমার মা।আরেহ।এখন ত আমিই আমার ভালোমন্দ রিয়েলাইজ করার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে।এমনকি কার সাথে কি রকম দুরত্ব রেখে চলতে হবে তাও বুঝি। যখন বেশ ছোট ছিলাম,তখন ত এমন করে খেয়াল রাখনি,আর সেই সুযোগেই কম হলেও এবিউজের শিকার কি হইনি?হয়েছি মা।
মা ক্ষেপে গেল শুনে।
কিহ?তুই আমাকে বলিসনি কেন?কোন জানোয়ার আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে নাম বল?
দূর মা।বাংলা সিনেমার মত ডায়ালগ দিওনাত।তুমি পেরেছ তোমার সময়ে বলতে?
৫ - ৭ বছর বয়সে কেউ বলতে পারে?৮-১৩ বয়সেরটাও লজ্জায়,ভয়ে,সংকোচে বলতে পারেনা কোন মেয়ে।
আমাদের দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ কন্যাশিশু নিজের পরিবারের মধ্যেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।এটা জান?
না জানতামনারে মা।
শুননি,আপুটা কি বলছে?কন্যাশিশুদের জন্য নিজের বাসাটাই সবচেয়ে বেশী অনিরাপদ।
মারে এটাত বুঝিনি তখন।এখন থেকে চেনা অচেনা সবাইকে অনুরোধ করবো যেন কন্যাশিশুকে একা কারো কাছে না দেয়।সে চাচা,মামা হোক আর খালাত, মামাতো ভাই যেই হোক না কেন।
ধন্যবাদ মা।আজকের সেমিনারের মূল মেসেজ এটাই ছিল যে,কন্যাশিশুদের দিকে যেন মায়েরা বিশেষভাবে খেয়াল রাখে।যেকোন পুরুষের বা ছেলের কাছে একা কিছুতেই যেন না রাখে।সেই ব্যক্তি, হোক ভাই,হোক চাচা।এই পৃথিবীতে একমাত্র মা ছাড়া কন্যাসন্তানের জন্য কেউই নিরাপদ নয়।সে যত কাছের কেউই হোকনা কেন।শিশুবয়স ও বাল্যবয়স, এই দুই বয়সেই খেয়াল রাখতে হবে,নিজের কন্যাকে সুরক্ষিত রাখতে চাইলে।
তুই নারীদের নিয়ে এমন কোন সেমিনার হলেই আমাকে নিয়ে যাস কিন্তু।
অবশ্যই মা।আমার বিয়ের পর মেয়ে হলে আমি সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবো।
তাই করিস মা।আল্লাগো! আমার ছোটবেলার কিছু মুহূর্তের কথা মনে পড়লে এখনো গা গুলিয়ে আসে,বিরক্ত ও লাগে বেশ।
থাক মা বাদ দাও।বরং প্রার্থনা করো, মরচে ধরা বিবেকগুলোর দেয়াল থেকে যেন খসে পড়ে সেই পশুদের ইতর আর অসভ্য দৃষ্টিভঙ্গির পলেস্তারা। আর আমি থেকে তুমি,তুমি থেকে তারা,তারা থেকে অনেক,সেই অনেক থেকে সব মায়েরাই শুনবে, জানবে সচেতন হবে ধীরে ধীরে।এভাবেই একদিন পৃথিবীর সব কন্যাশিশুরা সুরক্ষিত থাকবে।নির্ভয়ে ঘরের আঙিনায় রঙিন প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়াবে।কন্যাশিশুদের খলবল করা নিষ্পাপ হাসিতে মুখরিত হবে চারপাশ।সুস্থ ও প্রাণময় হয়ে বেড়ে উঠবে জগতের সকল মায়ের কন্যাসন্তানেরা।