একটা স্বল্প পরিচিত মেয়ের জন্য এমন ভ্যাঁপসা গরমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আন্দাজ এক ঘন্টা৷
বন্ধুমহলে অধৈর্য্য খ্যাত আমি এভাবে অপেক্ষা করছি? এই কথা ভেবে নিজেই আশ্চর্য বনে গেলাম৷
ঢাকার এই জনবহুল জ্যামে ভরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চ্যালেঞ্জ এর মত।
আজকাল শরৎ কালের আকাশও বর্ষাকালের মত হুটহাট গোমড়ামুখো হয়ে যায়।
বাতাসের ছিঁটেফোঁটা নেই। প্রচন্ড ঘামছি তবু্ও কি জানি এক অকৃত্রিম আনন্দ আমার মনে লেগে রইল। কেনো যেনো ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম না আপনি কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?
এই করোনাকালে এভাবে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে হলে, ফোন করে পাঁচ দশেক গালিতে অপেক্ষার শ্রাদ্ধ করে বাড়ি ফিরে যেতাম৷ একটা অদেখা মানুষের জন্য এত কিসের আকুলতা ভেবে পেলাম না৷
মূহুর্তেই কালো মেঘ এসে সূর্যকে বোরখাবৃত করে দিয়েছে৷ একটা সুন্দর রোদ্দুরে ভরা বিকেল মাথায় করে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম৷ ঘামে ভেজার পালা শেষে বৃষ্টির তড়িঘড়ি শুরু হয়ে গেছে আমাকে ভিজিয়ে দেয়ার৷ ঝমঝমিয়ে নেমে পড়েছে। আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা টঙ দোকানে কাকের মত আশ্রয় নিলাম৷
পকেটে রাখা ফোনটা মৃদু কাঁপছে। পকেট থেকে বের করে দেখি ফাল্গুনীর ফোন। ফোনটা রিসিভ করতে হালকা উত্তেজনা অনুভব করছি৷ কখনো তার সাথে ফোনে কথা হয়নি৷ তার কণ্ঠস্বর চাপা নাকি চড়া জানিনা৷ কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করলাম৷
- হ্যা..এএ লো!
- আসসালামু আলাইকুম! আমি ফাল্গুনী।
- হ্যাঁ! চিনেছি। নাম্বারটা সেভ করে রেখেছিলাম৷
- আপনি কোথায়?
- আপনার স্বর্গের কাছেই৷
এই কথাটা বলার সাথে সাথেই ফাল্গুনী মৃদু শব্দে একটা হাসি দিল। সাথে আমিও হেসে ফেললাম কিন্তু তার হাসির শব্দটা ঝমঝমিয়ে কানে বেজে উঠলো।
আগে কখনো কারো হাসির শব্দ পর্যবেক্ষণ করিনি৷ এত নিঁখুত হাসিও হয়? আমার সাথে আজ কি ঘটছে এসব?
আমাদের টুকটাক কথা যতটুকু হয়েছে সব চ্যাটিং এ।
তাও সেসব নেহাৎ পরিচয় পর্ব ছাড়া আর কিছুই না৷
আমি চায়না বাংলা কন্সট্রাকশন কোম্পানির এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি করছি৷ আর ফাল্গুনী সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ায়৷ পরিবারে কে কে আছে? হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়? বর্তমানে কোথায় থাকে এই ধরনের সাধারণ আলাপচারিতা ছাড়া বিশেষ কোন আলাপ হয়নি। দুজনেই ব্যস্ত থাকি সময় করে আর কথা বলা হয়ে ওঠেনা৷
একদিন আমি বললাম,
-চলেন দেখা করি৷
ফাল্গুনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসির ইমোজি দিল।
আমি একটু বিব্রত হয়েই বললাম,
- দেখা করতে ভয় পেলে থাক। দেখা করা লাগবেনা৷
সে বলল,
- যতটুকু মনে হয় আপনি খুব একটা খারাপ না, দেখা করা যায়। বলেন কোথায় দেখা করবেন?
- উত্তরা, দিয়া বাড়ি আসেন৷ আমার এলাকা,আমার বাসার কাছেই।
- নাহ! অতদূর যাবনা৷
ফাল্গুনী একটা লাইব্রেরীর বিল্ডিংয়ের ছাদে দেখা করার কথা বলেছিলো৷
সেটা নাকি তার কাছে স্বর্গ৷
তাই আজ যখন বললাম, আপনার স্বর্গের খুব কাছেই তখন হেসে দিয়েছিল৷
.
.
তারপর বলল,আমি স্বর্গের বিল্ডিংয়ের নিচে এবার আসেন৷ তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু ভ্যাঁপসা গরম কমেনি। মাস্ক পরে থেকে আরও দম বন্ধ লাগছে৷ অনেকেই দেখি করোনাকে পাত্তা না দিয়ে মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমারও ইচ্ছে করছে কনভোকেশনের টুপির মত মাস্কটা ময়লার ভাগাড়ে ছুড়ে মারি৷ কনভোকেশনের টুপি মানুষ জয়ের আনন্দে আকাশে ছুড়ে আর আমার তীব্র অস্বস্তিতে ভাগারে ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করছে৷
আমি টঙ দোকান থেকে লাইব্রেরীর বিল্ডিংয়ের নিচে গেলাম৷ একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাস্কের জন্য চোখ দুটো ছাড়া মুখাবয়ব দেখার সুযোগ হচ্ছেনা৷ এটাই ফাল্গুনী বুঝতে অসুবিধে হলনা। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷
সে আবার সেই মৃদু হাসিটা দিয়ে বলল,
- নাভিদ! কি ঠিক তো?
এবারো শুধু হাসির শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলাম, হাসলে ফাল্গুনীকে কেমন দেখায় সেটা বুঝতে পারলাম না। খুব আস্তে করে উত্তর দিলাম,
- হ্যাঁ আমি নাভিদ। চলুন আপনার স্বর্গে গিয়ে বসি।
ছাদটা ৮ তলায়, ফাল্গুনী ৭ তলায় নামলো কেন তা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো।
দেখি একটা চঞ্চলা হরিনীর মত এক প্রকার আনন্দ নিয়ে লাইব্রেরীতে প্রবেশ করছে৷ আমিও অন্ধের মতো তাকে অনুসরণ করলাম৷
এ বই সে বই নাড়াচাড়া করছে। এক কোণা থেকে আরেক কোণায় ছুটোছুটি করছে। বুঝতে পারলাম মেয়েটা প্রচন্ড বই পড়ুয়া। এ জন্যেই লাইব্রেরী ছাদটাকে স্বর্গ বলেছে৷ অবশেষে হাতে কিছু বই নিয়ে কাউন্টারের দিকে গিয়ে বইয়ের মূল্য পরিশোধ করে আমার কাছে এসেছে৷
খুব কাতর হয়ে বলছে,
- স্যরি! এমনিতেই আপনাকে রাস্তায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি।
- সমস্যা নেই। এত স্যরি হতে হবেনা৷
- তার উপর এখানে এনেও সময় দিচ্ছিনা৷
আসলে আমার খুব পছন্দের কিছু বই এসেছে তাই ওমন বেহুশের মতো বইয়ের কাছে ছুটোছুটি করেছি৷
আসলে আমি সত্যিই স্যরি।
- এত যখন স্যরি বলছেন তবে কান ধরুন।
ফাল্গুনী হাসতে হাসতে বলছে,
-তাহলে আমি মোটেও স্যরি নই। চলেন ছাদে যাই৷
আমরা ছাদে গেলাম৷ ছাদটা বেশ বড়। রেলিং এর চারপাশ বিভিন্ন রকম ফুল আর বাহারি পাতার গাছে সজ্জিত৷ দুজনে বসার মত করে পুরো ছাদ জুড়ে সিমেন্টের বেঞ্চি৷ কিছু সংখ্যক মানুষ বেঞ্চিতে বসে গল্প করছে,কেউ কেউ বই পড়ছে। আমরা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম৷ আমি অসহ্য হয়ে মাস্কটা খুলেই ফেললাম। বৃষ্টি থেমে গেছে, আকাশ পরিষ্কার, হালকা বাতাস বইছে। ধীরে ধীরে শরীরটা জুড়িয়ে এসেছে৷
আমি ফাল্গুনীকে বললাম,
- এখানে তো মানুষের তত ভীড় নেই। মাস্কটা খুলে রাখতে পারেন৷ তাছাড়া যদি কোনদিন রাস্তায় দেখা হয় তখনতো চিনতেই পারবো না৷
আসলে মনে মনে আমি ওকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি তাই এই আজেবাজে কথা বলে দেখার সুযোগ খুঁজছিলাম। কথাটা বলেই আমি পশ্চিম আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম৷ সূর্য ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ ফাল্গুনী আমার পূর্ব পাশে বসা।
আচমকাই সে বলে উঠলো,
- কি মশাই? এই যে মাস্ক খুলেছি এবার খুশি?
আমি নির্লজ্জের মতো ওর দিকে কত মূহুর্ত তাকিয়ে আছি জানিনা। একটা গোলগাল মুখ, উজ্জ্বল চোখ,চাপা গায়ের রঙ সৌন্দর্যের সমাবেশটা যেনো মুখরিত করে তুলেছে৷ সাদামাটা থাকতেই বোধহয় বেশি পছন্দ করে ফাল্গুনী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনভ্যস্ত হাতে ঠোঁটে লিপষ্টিক আর চোখে কাঁজল এঁকেছে৷ মেকাপের জৌলুশ নেই৷
ফাল্গুনীও তাকিয়ে আছে কিনা খেয়াল নেই। সে মুখ ঘুরিয়ে ফেলাতে আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছি।
ফাল্গুনী আমার দিকে না তাকিয়ে আবার বলল,
- দেখা হয়েছে?
- কিছু দেখা বার বার অদেখার অতৃপ্তিতেই থেকে যায়।
- বাব্বাহ! বেশ কথা জানেন দেখছি৷
- বিশেষ কিছু জানিনা।
- বিশেষ কিছু জানলে বুঝি আরও উচ্চমার্গীয় কথা শুনতে পেতাম।
- তা হয়তো পেতেন।
দুজনের দৃষ্টি আকাশের দিকে৷ পাশাপাশি বসে দৃষ্টি বিনিময়ের বদলে শুধু কথা বিনিময় হচ্ছে৷
আমি একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে বসলাম,
- আচ্ছা! ফাল্গুনী, জীবনে কটা প্রেম করেছেন?
- হাহা! এটা কি ধরনের প্রশ্ন?
- আহা! বলুন না৷
- প্রেমে পড়ার তো কোন বয়স নেই। যেকোনো বয়সেই মানুষ প্রেমে পড়তে পারে।
- আমি প্রেমে পড়ার কথা বলিনি, করার কথা বলেছি৷
- হ্যাঁ আমি তো অনেক প্রেমে পড়েছি।
- হ্যাঁ জানি অসংখ্যবার পড়েছেন। আমিও পড়েছি। কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি সিরিয়াস প্রেমে ছিলেন।
- কেন আপনি ছিলেন না?
- হ্যাঁ ছিলাম৷ অনেক ভালোবাসতাম, একদিন শুনি অন্য একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে৷
- ওমা! তারমানে আপনি সিরিয়াস ছ্যাঁকা খেয়েছেন।
- হ্যাঁ ছ্যাঁকা খেয়েছি৷ কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন৷
- উহু এড়িয়ে যাচ্ছিনা৷ আমিও একজনকে প্রচন্ড পছন্দ করতাম৷ সে পাগলের মত বলতো ভালোবাসে। তার আচরণ আমাকে পছন্দ করতে বাধ্য করেছিলো কিন্তু আসলে সম্পর্কটা ঠিকমত গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে গেছে শেয়ারিং কেয়ারিং এর অভাবে৷
- আপনার কেমন ছেলে পছন্দ?
- এমন একটা মানুষ যে আমাকে বুঝবে, একটু যত্ন করবে,সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। আপনার কেমন মেয়ে পছন্দ?
- একটু ঢঙ্গী, বাচ্চামি করবে আবার প্রয়োজনে আমায় শাসন করবে। আমার সুখে দুঃখে আমার ভরসার জায়গা হবে৷
ফাল্গুনী খানিকক্ষণ চুপ থেকে কি ভাবল জানিনা৷ নিজের সাথে আমার চাওয়াগুলো মিলালো কিনা ঠিক আমারই মতো? কি জানি হয়তো আবার হয়তোবা না৷
নিরবতা ভেঙে আমিই প্রশ্ন করলাম।
- তো এখনো কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কেন?
- ভয় হয়। ভালোবাসাহীনতার ভয়, সম্পর্ক ভাঙার ভয়৷ চারিদিকে এত ডিভোর্স।
- আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়েছে? আপনার মা-বাবার হয়েছে?
- না।
- তাহলে? খারাপের দলে নিজেকে ভাবেন কেন?
- জানেন! আমার ফোনে আত্মীয় স্বজন, বাবা-মা ছাড়া কারোর ফোন আসেনা৷
- এখন থেকে আমার ফোন আসবে।
এই কথাটা প্রয়োজনের তুলনায় একটু আস্তে বলেছিলাম। ফাল্গুনী বোধহয় শোনেনি তাই প্রতিউত্তর করেনি অথবা করতে চায়নি৷
- অবশ্য আমি ফোন আসার মতো সুযোগ কাউকে দেইনি। অনেকেই ভালোবাসতে চায়, আমার ঠিক বিশ্বাস হয়না৷
ক্ষণকাল চুপ থেকে বললাম,
- তাহলে আপনার জন্য পাত্র দেখি৷
একটু কপট রাগেই সে বলে উঠলো,
- ঘটকালি করার জন্য দেখা করতে চেয়েছেন?
আমি হেসে ফেললাম,সেও হেসে দিল। এইবার খেয়াল করলাম তার হাসির শব্দ আর দৃশ্য মিলেমিশে আমাকে কোথাও একটা চোরাবালির মত ডুবিয়ে দিচ্ছে৷
তার দাঁত গুলো আঁকাবাঁকা, সৌন্দর্যের কোন বালাই নেই। তবুও হাসলে কি নির্মল লাগে অপূর্ব মাধুর্যতা এসে গ্রাস করে ফেলে৷
.
.
ফাল্গুনী কথা বলতে বলতে বাম হাতের আঙুল দিয়ে ডান হাতে পরা রঙ বেরঙের কাঁচের চুড়িগুলো নাড়াচাড়া করছে। চুড়ির টুং-টুং শব্দ পাশে রেখে
সমাজ, রাজনীতি, চাকরি বাকরি নানা বিষয়ে আমাদের কথা হল৷
ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়ে চাঁদ উঁকি দিয়েছে৷
ফাল্গুনী বলল,
- এবার ওঠা যাক! মা চিন্তা করবে,বলে এসেছি সন্ধ্যায় আগেই ফিরব কিন্তু দেখুন কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে গেল৷
- হ্যাঁ চলুন! আমি আপনাকে দেরী করিয়ে দিলাম এবার আপনি বকুনি খাবেন।
- আসলে বকুনি না, দেশের পরিস্থিতি তো ভালোনা৷ চারিদিকে খারাপ মানুষের বিচরণ তাই মা চিন্তা করে৷
দুজনে ছাদ থেকে নেমে রাস্তায় এলাম। হাঁটতে হাঁটতে রিকশার জটলার পাশে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করে দিলাম। ফাল্গুনী আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে রিকশায় চেপে বসলো। আমি অবাক করে দিয়ে বললাম একটু চেপে বসুন আমি উঠব।
প্রথমটা ফাল্গুনী বুঝতেই পারলোনা কেন আমি রিকশায় চাপলাম৷ রিকশা চলতে আরম্ভ করলো।
আমি বললাম,
- আপনি ভাবলেন কি করে এই ভর সন্ধ্যায় আপনাকে একা যেতে দেব? রাস্তায় কিছু হলে পরে তো আমাকেই দোষ দিতেন৷
ফাল্গুনী বলল,
- দরকার ছিলোনা,আমি একাই যেতে পারতাম শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করে উল্টো পথে আসছেন।
- তাহলে নেমে যাই? রিকশাওয়ালা মামাকে বলি রিকশা থামাতে৷
- নাহ! তা কেনো? আপনার আমার সাথে আসতে ভালো লাগলে আসেন৷
- চিন্তা করবেন না, আমি আপনার বাসায় যাব না। নিরাপদ দূরত্বে নেমে যাব৷
ও আবার সেই মোহনীয় হাসির জালে আমায় জড়িয়ে ফেলেছে৷
রিকশা চলছে।
পাশের আরেকটা রিকশাওয়ালা উত্তেজিত গলায় আমাদের রিকশা লক্ষ্য করে বলছে, আপা! আপনার আঁচল সামলান৷
আমিও তটস্থ হয়ে বললাম,এই আপনার শাড়ির আঁচল তাড়াতাড়ি টানেন৷
ফাল্গুনী শাড়ির আঁচল নিরাপদে এনে একটু মজার ছলেই বলল,
- আজীবন শাড়ির আঁচল আর ওড়না রিকশার সাথে আটকানোর পরিস্থিতিতেই গেল। সিনেমার মত কারো ঘড়িতে আটকালোনা আর পাশ থেকে উত্তেজিত জনতা শুধু বলেই গেল আপা! ওড়না সামলান৷
আমি ওর কথা শুনে হাসি আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লাম৷
তারপর ওর শাড়ির আঁচল টেনে একটা কোণা জোরপূর্বক ঘড়িতে পেঁচালাম। ঘড়িতে আটকানোর মত আসলেই কোন সরু জায়গা নেই৷
ফাল্গুনী হাসতে হাসতে বলল,
- আপনি জোর করে ধরে রাখলে তো আটকাবেই। এভাবে আটকালে হবে? আটকানোতেও একটা আর্ট থাকতে হয়।
চাঁদের আলো আরও উদার হয়ে পড়ছে আমাদের চোখে মুখে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতেও চাঁদের আলোকে আলাদা করা যাচ্ছে।
আমি কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে হঠাৎই বললাম,
- ওই যে আকাশে একটা চাঁদ৷
- এ মা! কি বলে, চাঁদ তো একটাই হয়।
- নাহ! চাঁদ দুইটা।
- কিভাবে?
- ওই যে একটা আকাশে আরেকটা আমার পাশে।
ফাল্গুনী ফিক করে হেসে বলে,
- তাই না? পটানোর ধান্ধা? এগুলো সব পটাইন্না কথা৷
রিকশা একটা গর্তের মধ্যে পড়ে ঝাঁকুনি খাওয়ায় ফাল্গুনী উপুর হয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো। ওমনি আমি খপ করে হাতটা ধরে বললাম,
- এখনি তো পড়ে যেতেন। নাকমুখ সব ভচকে যেতো।
- ভাবা যায়! নাকমুখ ভচকে গেলে আমার আর বিয়ে হতোনা৷
- হ্যাঁ আমি ছাড়া আর কেউ বিয়ে করতো না৷
এই কথাটা তুলনামূলক আস্তে বললাম।
শুনেছি হাসলে মানুষের চোখও নাকি হাসে মাস্কের জন্য ঠোঁট দেখা না গেলেও তার চোখ বলে দিচ্ছে কথাটা সে ঠিকই শুনেছে৷
গাড়ির হর্ণ, রিকশার টুংটাং ছাপিয়ে ফাল্গুনী বলল,
- আচ্ছা! আপনি কি সত্যিই রাস্তায় কিছু হলে আম্মুর বকুনি খাব এই ভেবে এতটা পথ আমার সাথে এসেছেন?
- আপনি বড় হয়েছেন না?
- হ্যাঁ হয়েছি।
- তাহলে বোঝেন না কেন এসেছি?
- নাহ! বুঝিয়ে বলেন।
- আপনার নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি। এবার আমায় নামতে হবে৷ আল্লাহ হাফেজ!
ফাল্গুনী আমায় হাত নেড়ে বিদায় জানালো৷
আমিও নেমে গেলাম৷
দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে রিকশাটা চলে গেল।
.
.
দেখা হওয়ার পূর্বে আমাদের আমাদের বিশেষ কোন কথা না হলেও অন্তত ক্ষুদে বার্তায় "শুভ সকাল" আর "শুভ রাত" স্রেফ দুটো কথা নিয়ম করে লেনদেন হতো। সেদিনের পর থেকে কি এক অজানা কারণে কেউই আর যোগাযোগ করলাম না।
সময় পাখির মতো উড়ে যেতে থাকে। দিন, সপ্তাহ, মাস অথবা বছর অপেক্ষার বয়স বাড়ায়।
অপেক্ষা না ঠিক, এটাকে প্রতীক্ষা বলে।
অথচ সেই সন্ধ্যায় আমি ফাল্গুনীর চোখে আমার জন্য প্রেম দেখেছিলাম, হয়তো ফাল্গুনীও দেখেছিলো।