ডক্টরের চেম্বারের সামনে বসে আছি হঠাৎ মনে হলো ঘাড়ে কেউ হাত দিচ্ছে। পিছনে ফিরে দেখি একজন পুরুষ লোক! আর কোনো কথা নাই ঠাস্ করে এক চর মেরে বসলাম!
-- বদমাইশ, লুচ্চা কোথাকার মেয়ে মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকেনা! এইসব মানুষ এখানে কিভাবে যে ঢুকে?
এতোই রেগে গেলাম যে মুখে যা আসলো তাই ফেললাম। লোকটি একবার কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম। এরপর লোকটি একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলো না। আশেপাশের লোকজন আমার অবস্থা দেখে এমন অবাক হলো যে তারাও আর কোনো কথা বলল না। শেষে আমিই ক্লান্ত হয়ে যাই আর শান্ত হয়ে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমার সিরিয়াল আসে আর আমি ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরে ঢুকে যাই। এরপর সেদিন আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় চলে আসি।
ঘটনার ১৫ দিন পর আজকে আবার আমি ডাক্তারের কাছে আসি। তিন তলায় উঠেই দেখি আজকেও সেদিনের লোকটা চেম্বারের সামনে বসে আছে। আমি লোকটাকে দেখতে পেয়ে একটু দূরে গিয়ে বসি। আর লোকটার উপর নজর রাখছি যে আজকে আবার পিছন থেকে কোনো মেয়ের শরীরে হাত দেয় কি না। আজকে যদি কারো শরীরে হাত দিতে দেখি তাহলে আজকে লোকটাকে ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করব।
যেই ভাবা সেই কাজ আমি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের এ্যাসিস্ট্যান্ট "তৌফিক সাহেব আছেন এবার আপনার সিরিয়াল" বলে ডাকলো। আমি দেখলাম একজন ভদ্র মহিলা লোকটির হাত ধরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল, লোকটির হাতে সাদা ছড়ি। আমি বুঝতে পারি লোকটি অন্ধ, চোখে কিছু দেখতে পায় না।
আর এই অন্ধ লোকটাকে আমি সেদিন এত অপমান করলাম! এখন আমার নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছে।
ইশ্ আমি না জেনেই সেদিন এই অন্ধ লোকটাকে চড় মেরেছি! কত বড় ভুল হয়ে গেছে।
আমি বারবার অনুতপ্ত হতে লাগলাম।
১০ মিনিট পর ভদ্রমহিলা লোকটিকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই আমি তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যাই।
-- এক্স কিউজ মি আন্টি। একটু কথা বলতে পারি?
-- হ্যা অবশ্যই বলো মা কি বলবে?
-- উনি কি আপনার ছেলে?
-- হ্যা, ও আমার একমাত্র সন্তান তৌফিক।
-- উনার চোখে কি হয়েছে?
-- সে অনেক কথা মা একটি দূর্ঘটনা আমার ছেলেটার চোখের আলো কেড়ে নেয়। ও এখন আর কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু তুমি কে মা? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।
-- আমার নাম মিলি। আমিও ডাঃ আরিফুল ইসলাম স্যারের পেশেন্ট।
-- ও আচ্ছা। তা মা তোমার কি ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে?
-- না আন্টি আজকে আমার সিরিয়াল অনেক পরে।
-- তাহলে মা আমার একটু উপকার করবে?
-- জ্বি অবশ্যই বলুন আন্টি কি করতে হবে।
এতক্ষণ লোকটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো, এবার একটু এগিয়ে আসলো।
-- আম্মু কার সাথে কথা বলছো?
-- এইতো বাবা একটি মেয়ের সাথে।
-- ও আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কথা শেষ করো আমি এখানেই বসছি।
-- আন্টি কি করতে হবে বলেন।
-- হ্যা মা আমাকে এই ঔষধগুলো এনে দিতে পারবে? আমিই যেতাম কিন্তু ওকে একা রেখে যেতে পারছি না। সেদিন ওকে রেখে ৫ মিনিটের জন্য বাথরুমে গিয়েছিলাম। আমি ওর ছড়িটা সামনের চেয়ারে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এসে শুনি ওর ছড়িটা নাকি নিচে পরে যায় তারপর সেটা খুঁজতে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে থাকা কোনো একজন মেয়ের গায়ে হাত লেগে যায়। মেয়েটি সবার সামনে ওকে আজেবাজে নানারকম কথা তো বললোই এমনকি ওকে চড় মেরে বসে। তৌফিকের কথাটা পর্যন্ত মেয়েটা শুনলো না। সেদিন ও একটু প্রতিবাদও করেনি। কারণ না জেনে হলেও ও অন্যায়টা করেছে।
সেদিন বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করে। জানো মা আমার ছেলেটা অনেক মেধাবী ও ভদ্র-নম্র একটা ছেলে। ও মেকানিক্যাল ইন্ঞ্জিনিয়ার আবার কোরআন এ হাফেজ। খুব ভালো কবিতা লিখত ও আবৃত্তি করত। দূর্ঘটনার পর এখন আর কিছুই করতে পারে না। নামাজটা পর্যন্ত মসজিদে গিয়ে পড়তে পারে না। আর আগে সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করত। এখন আর সেটাও পারে না। আর এমন একটা সোনার টুকরো ছেলেকে কোন মেয়ে কত কি বাজে বাজে কথা বললো।
ভদ্রমহিলা কাঁদতে লাগলো। আর এসব কথা শুনে আমার আরো বেশি নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমার চোখেও জল গড়িয়ে পড়লো।
-- একি মা তুমি কাঁদছো কেন?
-- আপনার কান্না দেখে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আমি কারো চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা।
-- ঠিক আছে মা এইতো আমি চোখের জল মুছে ফেললাম।
-- আন্টি প্রেসক্রিপশনটা আমাকে দিন, আর আপনি উনার সাথে বসুন আমি এখনি গিয়ে ঔষধগুলো নিয়ে আসছি।
আমি প্রেসক্রিপশন নিয়ে নীচতলা থেকে গিয়ে ঔষধগুলো নিয়ে এসে ভদ্রমহিলার হাতে দিলাম।
-- অনেক ধন্যবাদ মা তোমাকে। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক।
-- ঠিক আছে আন্টি এ আর এমন কি।
-- তা মা তোমার বাসা কোথায়?
-- কলাবাগান ২ নাম্বার লেন।
-- ওহ তাই নাকি! আমার বাসাও তো কলাবাগানের ডলফিন গলিতে ৬৯ নাম্বার বাসা। তাহলে মা একদিন বিকেলে বাসায় চলে এসো, চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
-- ঠিক আছে আন্টি অবশ্যই যাবো।
মিস মিলি আছেন? মিস মিলি আপনার সিরিয়াল এখন।
-- আন্টি স্যারের এ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে ডাকছে।
-- ঠিক আছে মা তুমি তাহলে ডাক্তারের চেম্বারে যাও। আমরাও বাসায় চলে যাচ্ছি। আর হ্যা একদিন কিন্তু অবশ্যই আসবে কথা দিয়েছ কিন্তু।
-- ঠিক আছে আন্টি আসবো। আপনারা সাবধানে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ।
-- আল্লাহ হাফেজ।
আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় আসতে আসতে রাত ১ টা বেজে যায়। আমার পরে আরও ১০ জন পেশেন্ট! মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ডাক্তাররা একদিনে এত রোগীর প্রেশার কিভাবে নিতে পারে! আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেদিনের ঘটনাগুলো ভাবতে লাগলাম।
-- আমার আসলে সেদিন ঐভাবে রিয়্যাক্ট করাটা একদমই ঠিক হয়নি। আমার উচিৎ লোকটির কাছে ক্ষমা চাওয়া। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই উনাদের বাসায় যাবো ক্ষমা চাইতে।
এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
কিন্তু এরপর আমি নানারকম কাজের ঝামেলায় তৌফিক সাহেবের কথা একদম ভুলেই যাই।
তিনদিন পর। সকাল ৭.৩০।
আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমি একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার। মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন একমাত্র ছোট ভাই আমেরিকা প্রবাসী। তাই স্কুলই আমার আপন ঠিকানা। আজকে স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় স্কুল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ছুটি হয়ে গেছে। আমি একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরে আসছি।
-- মামা মামা একটু রিকশাটা দাঁড় করান তো।
আমি রিকশা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি রিকশা ভাড়া দিয়ে একটু পিছনে গেলাম।
-- আরে তৌফিক সাহেব আপনি এখানে কি করছেন?
-- আপনি নিশ্চয়ই মিলি?
-- ও মাই গড! আপনি আমাকে চিনতে পারলেন কেমন করে?
-- আপনার কণ্ঠস্বর আমার মনে আছে।
-- শুধুমাত্র আমার কন্ঠস্বর শুনে আপনি আমাকে চিনে ফেলতে পারলেন সত্যিই অবিশ্বাস্য! তো আপনার সাথে কাউকে দেখছি না যে?
-- আমার তো কেউ বলতে শুধু আম্মু। আর আম্মু তো এখন অফিসে।
-- একা একা বের হলেন কেন? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়?
-- আসলে আমার ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল তো আম্মুকে বলতে মনে ছিল না।
-- তা ঔষধ কিনেছেন?
-- না যাচ্ছিলাম আরকি।
-- ঠিক আছে চলুন আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।
-- ঠিক আছে চলুন আপনি যেহেতু চাচ্ছেন।
আমরা হেঁটে যাচ্ছি। কিন্তু আমার অপরাধবোধের জন্য আর কোনো কথা বলতে পারছি না। তৌফিক সাহেব নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন।
-- তো আপনি কোথাও যাচ্ছিলেন নাকি ফিরছেন?
-- আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম।
-- ওয়াও! আপনি তাহলে একজন টিচার!
-- আপনি এত অবাক হলেন কেন?
-- আসলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার। আমার বাবাও একজন টিচার ছিলেন তো।
-- আপনি চাইলে এখনো শিক্ষকতা করতে পারেন।
-- না তা আর সম্ভব না। আচ্ছা বাদ দেন এই প্রসঙ্গ। আপনার তো বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আপনার ছেলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বাসায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
-- হা হা হা হা।
-- কি ব্যাপার আপনি হাসছেন কেন?
-- আপনার কথা শুনে। আমার তো বিয়েই হয়নি!
-- ও আচ্ছা আমি দুঃখিত।
-- আসলে আমার মা-বাবাও বেঁচে নেই। একটা ছোট ভাই আছে ও আমেরিকা থাকে। তাই আমার জন্য অপেক্ষা করার কেউ নেই। আমরা ফার্মেসিতে চলে এসেছি। আপনার প্রেসক্রিপশনটা দিন।
আমরা ঔষধ কিনলাম। তারপর তৌফিক সাহেবকে নিয়ে উনার বাসায়
আসি।
-- আপনি এখানে বসুন আমি আপনার জন্য একটু চা নিয়ে আসছি। আর এরমধ্যে আম্মু চলে আসবে।
-- না না আপনি এত ব্যস্ত হবেন না। তাছাড়া আমি চা খাই না। আমি শুধু ব্ল্যাক কফি খাই।
-- আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমিতো চা কফি কিছুই বানাতে পারিনা, তাই আম্মু শুধু চা বানিয়ে ফ্লাস্কে রেখে যায়।
-- আপনি কফি খান তো?
-- তা খাই।
-- বাসায় কফি আছে?
-- হ্যা আছে। কিন্তু বানানোর মত কেউ নেই।
-- আপনি এখানে বসুন। আর রান্নাঘরটা কোথায় আমাকে বলুন আমি এক্ষুনি দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি। আমার হাতের বানানো কফি কিন্তু অনেক ভালো হয়।
-- আপনি অতিথি আপনি কেন শুধু শুধু কষ্ট করবেন?
-- আপনি বসুনতো তৌফিক সাহেব।
আমি ঝট করে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসি এবং তৌফিক সাহেবকে এক কাপ কফি দেই।
-- বাহ্! অসম্ভব রকমের ভালো কফি হয়েছে।
-- ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। আসলে এতটাও ভালো না, মোটামুটি।
-- তৌফিক সাহেব আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো।
-- ওসব কথা ভুলে যান। আমি কিছু মনে করিনি আমিও সব ভুলে গেছি।
তৌফিক সাহেবের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
-- আপনি কি জানেন আমি কোন কথা বলতে চাচ্ছিলাম?
-- দেখুন মিস মিলি, সেদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য আপনি খুব অনুতপ্ত হয়েছেন, আপনি বুঝতে পেরেছেন প্রকৃত ঘটনা না জেনে কাওকে অপরাধী মনে করে শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। আপনি যেহেতু আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই আপনাকে আর ক্ষমা চাইতে হবে না।
-- আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন যে, আমিই সেদিনের সেই মেয়ে?
-- আপনার কণ্ঠস্বর আমি কখনো ভুলতে পারবনা। কাউকে চিনতে পারার এটাইতো আমার একমাত্র মাধ্যম।
-- সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই ভীষণ অনুতপ্ত। প্লীজ আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন।
-- ছিঃ আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে আর লজ্জা দিবেন না তো। আমি আপনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি।
-- যাক বাবা এখন মনে একটু শান্তি পাচ্ছি।
এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।
-- নিশ্চয়ই আম্মু চলে এসেছে! আপনি বসুন আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।
-- আরে আপনি বসুন তো তৌফিক সাহেব, আমি দরজা খুলছি।
-- আরে এত দেখছি মিলি মা। তা কখন এসেছ মা?
-- আসলে আন্টি আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম, হঠাৎ তৌফিক সাহেবকে দেখি রাস্তায় আর তারপর আসি।
-- তৌফিক তুই আবারো একা একা বাসা থেকে বের হয়েছিস? তোকে কতবার করে মানা করেছি।
-- মা আসলে চোখের ড্রপটা শেষ হয়ে গেছে।
-- ইশ্ আমারই মনে ছিলোনা কিনে দিয়ে যেতে।
-- তুমি একা মানুষ আর কত কি মনে রাখবে মা। আমি তো তোমার অভাগা ছেলে। আমার জন্যই তোমার এত কষ্ট। সব দোষ আমার।
-- তোর কোন দোষ নেই বাবা। সব দোষ ঐ মেয়েটার।
-- মা শুধু শুধু না জেনে একটা মেয়েকে দোষ দিওনা তো। মেয়েটি তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। মেয়েটি নিশ্চয়ই জানেও না তার জন্য আমার চোখের আলো নিভে গেছে।
-- তুই যতোই বলিস সব দোষ ঐ মেয়েটার।
-- আচ্ছা মা তুমি এসব কথা কেন তুললে? বাসায় একজন গেস্ট এসেছে, উনাকে কিছু খেতে দাও।
-- ওহো সরি মা, তুমি বসো আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি।
-- আন্টি আপনি এত ব্যস্ত হবেন না। আপনি অফিস থেকে ফিরেছেন আপনি আগে ফ্রেশ হোন। তাছাড়া আমি আর তৌফিক সাহেব দুজনেই কফি খেয়েছি।
-- হ্যা আম্মু, আমি উনাকে মানা করেছিলাম কফি বানাতে, কিন্তু উনি আমার কোনো কথাই শুনলেন না। তবে আম্মু উনি অসম্ভব রকমের ভালো কফি বানিয়েছেন। তোমার ভাগ্য খারাপ তাই মিস করলে।
-- মোটেও ভাগ্য খারাপ না। আন্টি আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো আমি আপনার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।
-- না মা আজ আর তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। অন্য কোনো দিন বানিয়ে খাওয়াবে।
-- ঠিক আছে আন্টি। আন্টি আজকে আমি তাহলে আসি।
-- ও মা আসবে কি! বসো আমি তোমার জন্য পায়েস রেঁধে নিয়ে আসছি।
-- ওয়াও পায়েস! পায়েস আমার খুব প্রিয়। দিলেন তো লোভ দেখিয়ে আটকে।
-- হা হা হা হা। তাই নাকি! তৌফিকও পায়েস খেতে খুব পছন্দ করে। শেষে পাতিলে একটু লেগে থাকলে সেটা পর্যন্ত আঙ্গুল দিয়ে চেটে চেটে খায়!
হা হা হা হা।
-- আম্মু তুমি কিন্তু আমাকে লজ্জা দিচ্ছ! তুমি যাওতো তাড়াতাড়ি পায়েস বানিয়ে নিয়ে আসো। পায়েসের নাম শুনলে যতক্ষন না খাবো ততক্ষণ আমার জিহ্বা শান্তি পাবেনা!
হা হা হা হা।
এবার তিনজনেই হা হা হা হা করে হাসতে লাগলাম।
-- অনেকদিন পর এভাবে প্রাণ খুলে হাসলাম।
-- আন্টি আমিও অনেকদিন পর হাসলাম।
-- ঠিক আছে মা তুমি বস আমি এখনি আসছি।
আন্টি ভিতরে চলে গেলেন।
-- আচ্ছা তৌফিক সাহেব কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
-- আপনি বলুন কি জানতে চান?
-- আচ্ছা আপনার দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটেছিল? কোনো একটা মেয়ের কথা যেন আন্টি বলছিলেন।
-- সে অনেক কথা আপনি বিরক্ত হয়ে যাবেন।
-- না না আমি বিরক্ত হব না। আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আপনি বলেন, আমি শুনবো।
-- একবছর আগের ঘটনা। সময়টা ছিলো বর্ষাকাল, বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি আমরা অনেকেই একটা শপিং মলের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। তখন একটা গাড়ি আসে আর একটা মেয়ে গাড়িতে উঠার জন্য দৌড় দেয় আর আমার সাথে ধাক্কা লাগে। আমি নিজেকে ব্যালেন্স রাখতে পারিনি আমি পিছলে পড়ে যাই এবং মাথায় প্রচণ্ড রকমের আঘাত পাই। মেয়েটির খুব তাড়া ছিল তাই আমার পড়ে যাওয়া হয়তোবা লক্ষ্য করেনি। মেয়েটি গাড়িতে উঠে চলে যায়। আর লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু বৃষ্টির জন্য হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসলো আমি আর চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন ডাক্তাররা সব পরীক্ষা করে জানাল আমার দুটি চোখই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র নতুন চোখ প্রতিস্থাপন করতে পারলে আমি দেখতে পারব। এই ছিলো সেদিনের ঘটনা।
-- তৌফিক সাহেব সেদিন আপনি কোন শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
-- স্টার ওয়ার্ল্ড শপিং মল।
-- কি!
-- সেদিন কত তারিখ ছিল?
-- ২২ শেষ আষাঢ়।
-- কি বললেন!
তৌফিক সাহেবের কথা শুনে আমি বসা উঠে পড়লাম।
-- তৌফিক সাহেব আপনার কি ঠিক মনে আছে সেদিন ২২ তারিখ ছিলো?
-- আমি কি করে ভুলতে পারি সেদিনের ঘটনা? কিন্তু আপনি এত অবাক হয়ে গেলেন কেন?
-- কই নাতো। তৌফিক সাহেব আমি আজকে উঠি।
-- একি আম্মু আপনার জন্য পায়েস রেঁধে আনতে গেলো, একটু বসুন।
-- না তৌফিক সাহেব আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমাকে এখুনি বাসায় যেতে হবে।
আমি আর একমুহুর্ত দেরি না করে তৌফিক সাহেবের বাসা থেকে বের হয়ে যাই।
চলবে...
(ভুলত্রুটি মার্জনীয়)
লেখক: সাইফুল ইসলাম