গল্পঃ #বেখেয়ালি_ভালবাসা
লেখাঃ #সাবেরা_সুলতানা_রশিদ
#পর্ব_১০
২৮.
সৈকত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের ঘুমন্ত শহর টাকে দেখছে ।
আকাশের তারা গুলো মিটমিট করে জ্বলছে । ঠান্ডা বাতাসে কাপুনি ধরে যাচ্ছে তারপরও সৈকত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করে কি করা যায় !!
যদিও তখন বাবা তার অপূর্ণ ইচ্ছাটা কি সেটা বলে নি । কিন্তু সৈকত সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে ।
বাবা তখন মেঘের কথাই বলছিল।
সৈকত ভাবে মেঘ কে এভাবে কষ্ট দেওয়া আমার একদমই উচিত হয়নি।
যে মেয়েটা তার সবকিছু উজাড় করে আমাকে এতটা ভালবাসলো আর আমি তাকে ------!!
শুধুমাত্র বাবার উপর রাগ দেখিয়ে !!
আচ্ছা আমিও যে মেঘকে ভালবাসি সেটা কি মেঘ নিজ থেকে বুঝতে পারে না!??
এতদিন যা করেছি সেটাতো সবটাই বাবাকে ভুল বুঝে করেছি ।
কিন্তু আজ !!?
আমার সব ভুল গুলো ভেঙ্গে দিয়ে যে মানুষটি আমার চোখের সামনে থেকে মিথ্যার জালটা সরিয়ে দিল তাকেই প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি----
না এটা ঠিক করছি না আমি ।
কিন্তু মেঘ সে কেন আমার উপর জোর খাটাল না!?
কেন এখান থেকে আমার কথা মত চলে গেল??
কেন একবারের জন্যেও বললো না যে সে এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না,আমাকে ছেড়ে যাবে না!!?
ধুরঃ কি সব ভাবছি।
দোষটা তো আমারই । আমিই তো ওকে এক প্রকার জোর করেই এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছি।
ও তো যেতে চাইনি।
আমি সবসময় ওর সাথে ইচ্ছা করেই খারাপ ব্যবহার করেছি।
আমি যে খারাপ সেটা ওকে মানতে বাধ্য করেছি।
সত্যিই মেয়েটা বড্ড বেশী অভিমানী ।
আজ আমার উপর অভিমান করেই বাবা অসুস্থ হওয়া সত্বেও এ বাড়িতে না এসে ঠিক বাবার বাড়িতেই চলে গেল।
অথচ ওখানে যেয়েও যে মেঘ একটা মুহুর্তের জন্য ও ভাল নেই সেটা আগের দিন ক্লিনিকে দেখেই বোঝা গেছে।
হঠাৎ করে গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে হর্ন বাজাতেই সৈকতের সব ভাবনার জগৎ বিচ্ছিন্ন হয় ।
সৈকত তাকিয়ে দেখে তার অফিসের এক্যাউনটেন্ট ম্যানেজার রাকিবের গাড়ি ।
এত রাতে রাকিব এখানে !!
কি দরকার ??কখনও তো এভাবে অফিসের কেউ বাড়িতে আসেনি। তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হলো!!?
সৈকত আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিজেই নিচে চলে যায়।
—কি ব্যাপার রাকিব সাহেব এতরাতে আপনি এখানে??কোন সমস্যা??
—জ্বি স্যার ।
—কি সমস্যা ?কি হয়েছে খুলে বলুন।
—আসলে স্যার আজ দুপুরে পুলিশ নাকি সুইটি ম্যাডামকে থানায় নিয়ে গেছে।
—হোয়াট!!?কি বলছেন আপনি!!?
—হ্যা স্যার সত্যি । প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যখন থানা থেকে ফোন আসলো তখন বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্যে।
—হঠাৎ পুলিশ কেন সুইটিকে এরেস্ট করবে??
—জানিনা স্যার ।
—আপনারা থানায় যোগাযোগ করেন নি??
—আসলে স্যার ঘটনা ঘটেছে দুপুরে । কিন্তু আমি জানতে পেরেছি কিছুক্ষণ আগে ।
—ও।
—পুলিশকে রিকুয়েস্ট করে সুইটি ম্যাম আমাকে ফোন দিয়েছিল। তারপর বললো আপনাকে যেন আমি ঘটনাটা বলি আর সকালে উকিল নিয়ে তাকে জামিনে বের করে আনি।
তাই এ কথা জানানোর জন্য আমার এত রাতে এখানে আসা।
—আচ্ছা ঠিক আছে । আপনি এক কাজ করুন আমার যে আইনজীবী আছেন আমার কথা বলে তার সঙ্গে সব যোগাযোগ করুন।
—ওকে স্যার ।
—আমি আগামীকাল সকালে থানায় যাবো।
—ঠিক আছে স্যার ।তবে আরেক টা কথা স্যার ।
—কি কথা?
—আপনি সেদিন সুইটি ম্যাডামকে টাকা দিতে বলেছিলেন।
—হ্যা ,তো ?
—না মানে সেদিন আমি টাকা দিয়ে ছিলাম। তারপর আজ সকালেও উনি আমার থেকে আগের থেকে দ্বিগুন টাকা নিয়েছেন আপনার কথা বলে ।
এ কথা শোনার পর সৈকতের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।
একটু চিন্তা করে বলে ঠিক আছে কথাটা বলেছেন এ জন্য ধন্যবাদ ।
—স্যার তাহলে এখন আমি যাই।
—ওকে
সৈকত রুমে এসে ভাবতে থাকে হঠাৎ কি কারণে পুলিশ সুইটিকে এরেস্ট করতে পারে !!?আর সুইটি বা কেন আমাকে না জানিয়ে আবার দ্বিগুন টাকা নিল??
মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
এরেস্ট যদি করার দরকার হয় তাহলে তো সুইটির এক্স হাজবেন্ড কে করা দরকার । সুইটি কে কেন??
অবশ্য বাবা অসুস্থ হওয়ার পরে সুইটির সঙ্গে আর দেখা হয়নি কথাও হয়নি।
অনেক রাত হয়েছে এখন এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে । আগামীকাল সকালে পুলিশ স্টেশনে গেলেই বোঝা যাবে ।
সৈকতে পরনের কাপড়টা চেন্জ করে আলমারি খোলে ।
সৈকত ভুল করে আলমারির অন্য কাবার্ড খোলে।
আরে এটা তো মেঘের কাবার্ড !!
খুলতেই সৈকত অবাক হয়ে যায়
কি ব্যাপার মেঘের সব শাড়ি কাপড় এখানে রাখা তাহলে ও যাওয়ার সময় কি কিছুই নিয়ে যায় নি??
নিবেই বা কি ও তো এখনো ঠিক করে শাড়িটাও পরতে পারেনা।
বিয়ের পরের দিন সকালে শাড়ি পরে হোচট খেয়ে পড়েছিল আমার উপর ।
আবার এইতো সেদিন সিলেটে ঘুরতে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছিল ।
ভাগ্যিস আমি ধরে ফেলেছিলাম না হলে----
সৈকত দেওয়ালের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ।
সৈকত মেঘের শাড়ি গুলোতে হাত বুলায় মনে হচ্ছে শাড়ি গুলোতে মেঘের স্পর্শ খুজে পাচ্ছে।
হঠাৎ সৈকতের চোখ পড়ে সেই খয়েরী রঙের শাড়ীটার দিকে ।
সেদিন রাতে যেটা পরে সুন্দর করে সেজে সৈকতের জন্য অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু হঠাৎ মোমবাতির আগুন সব শেষ করে দিল--------
সৈকত হাসতে থাকে সে রাতের মেঘের পাগলামি কথা মনে করে ।
যে কোনদিন পানি ছাড়া কিছু খাইনি আর সে কিনা সেদিন হুইস্কির মতো জিনিস খেয়ে ছিল তাও আবার অর্ধেক বোতলের ও বেশী।
সৈকত শাড়িটা বের করে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে । কি মনে করে শাড়িটা নাকের কাছে দেয় এই ভেবে যে শাড়িটাই হয়তো মেঘের শরীরের গন্ধ লেগে আছে।
কিন্তু------
সেদিন রাতে উগরানোর পর পরিষ্কার করার পরে আর মেঘের শরীরের কোন গন্ধ এতে অবশিষ্ট নেই যা আছে সব ডিটারজেন্টের গন্ধ।
সৈকত শাড়িটা রেখে আরেকটা শাড়ি খুঁজতে শুরু করে যেটা মেঘকে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু কই সেটা!!?
কোথাও তো নেই।
কোথায় গেল শাড়িটা??
মেঘ সঙ্গে করে নিয়ে গেল?
না আমার উপর রাগ করে ওটা কাউকে দিয়ে দিল??
সৈকত শাড়িটা খুজতে খুজতে হঠাৎ চোখ পড়ে একটা ডায়েরির উপর ।
সৈকত ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দেখে ডায়েরিটা একটু পুরাতন মতো ।
তারমানে এটা মেঘের ব্যক্তিগত ডায়েরি।
এটা পড়া ঠিক হবে না।
সৈকত ডায়েরিটা উল্টে পাল্টে দেখে রেখে দেয় । আবার কি মনে করে ডায়েরিটা বের করে এনে সোফায় গিয়ে বসে ।
মনে মনে বলেঃ
জানি কারো ব্যক্তিগত কিছু অনুমতি ছাড়া দেখতে হয় না । কিন্তু আজ তোমার অনুমতি ছাড়াই আমি তোমার ডায়েরিটা পড়তে যাচ্ছি জানিনা কি আছে এর ভিতরে । পারলে ক্ষমা করো।
প্রথম পৃষ্টা উল্টেই সৈকত একটু ধাক্কা খায় ।
♣ভবিষ্যতের বর ,♣
“এটা তোমার জন্য আমার পক্ষথেকে লেখা আমার অপূর্ন জীবনের কিছু কথা, কিছু স্মৃতি ,কিছু মধুর মুহূর্ত । অপূর্ণ বললাম কেন জানো??তুমি নেই তাই,যখন তুমি আসবে তখন আমার জীবনটা পূর্নতা পাবে ।
এখন তুমি নেই তাই এটাতে সব কিছু শেয়ার করছি ভবিষ্যতে তোমাকে দিব বলে ।তারপর এর ছুটি তখন তুমি হবে আমার একমাত্র ডায়েরি। প্রতিদিনের সবকিছু আমি তোমার সাথে শেয়ার করবো । রাতে যখন আমরা ঘুমাতে যাবো তখন আমি তোমার বুকের বামপাশে মাথা রেখে শুবো। তারপর তোমার ডানহাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আমার বামহাতের আঙ্গুল দিয়ে ধরে, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার সারাদিনের না বলা কথা গুলো বলবো। জানি তুমি সারাদিন অফিসের কাজ করে এসে ক্লান্ত হয়ে যাবে তারপরও আমি তোমাকে আমার কথা গুলো শেয়ার করবো। ”
এই
মনে থাকবে??
যদি তোমার ঘুম আসে তাহলে কফি করে খাওয়াবো।
আর এরপরও যদি ঘুম আসে তাহলে তোমাকে ----------
এখন বলবো না পরে বলবো । আগে আমার অপূর্ন জীবনটাকে পূর্ণ করো তারপর ----
সৈকত লেখাটুকু পড়ে হাসতে থাকে ।
পাগলি একটা তা না হলে কি কেউ এভাবে লিখতে পারে!!?
সৈকত পৃষ্টা উল্টায় আর পড়তে থাকে ।
এক এক করে পড়তে পড়তে শেষের দিকে চলে আসে ।
মেঘের জীবনের অনেক কথাই সৈকত ডায়েরি তে পাই।
প্রতিদিনের লেখার ডেট আর সময় দিয়ে ডায়েরিটি লেখা।
সৈকত হিসাব করে বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত মেঘ ডায়েরি লিখেছে ।
“আজ শেষ ডায়েরি লেখা। আগামী কাল থেকে আমার জীবনের ডায়েরিটা হবে একজন মানুষ। জানিনা সে কেমন হবে তবে যেমনই হোক আমি ভালবাসবো আমার সবটা দিয়ে । খুশি রাখার চেষ্টা করবো তাকে। ”
তারপর মাঝের কিছু পৃষ্টা ফাঁকা পড়ে আছে ।
তারপর আবার লেখা—সৈকত মেঘের দেওয়া তারিখটাতে চোখ বুলায় তারা যেদিন সিলেটে গিয়েছিল সেদিন লেখা—
ভাবিনি আবার কিছু লেখার প্রয়োজন পড়বে !!
কিন্তু পড়েছে তাই লিখছি —
বিয়ের দিন আর বিয়ের রাতে মানুষটাকে দেখে খুব রাগ হয়ছিল।
মনে হয়েছিল মানুষটিকে কখনো মন থেকে মানতেই পারবোনা।
এরাকম মানুষের সাথে ঘর করা হলেও মন থেকে কখনো ভালবাসতে পারবো না।
কিন্তু কখন যে এই বদমেজাজী মানুষটার সাথে থাকতে থাকতে এই মানুষটাকে ভালবেসে ফেলেছি তা নিজেও জানিনা।
আমার নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি তার মধ্যে ।
কিন্তু মানুষটা কেন এমন ??
সবকিছু বুঝেও যেন না বুঝে থাকে ।
কেন এমন??
কেন এত অবহেলা করে ??
মেঘের লেখা গুলো পড়ে সৈকতের বুক থেকে না চাইতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
২৯.
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে সৈকত তার বাবার রুমে যায় ।
চৌধুরী সাহেব তখনও ঘুমাচ্ছেন তাই সৈকত কোন শব্দ না করে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
সৈকত নিচে এসে দেখে বাকি সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে। সৈকত রোজিকে বলেঃ
—ভাবি বাবা উঠলে বাবাকে সময় মত নাস্তা দিয়ে দিও সাথে ঔষুধ গুলোও মনে করে খাইয়ে দিও।
—ঠিক আছে তোর এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুই কি এখন অফিসে যাবি?
—হ্যা ভাবি, একটু কাজ আছে।
—আচ্ছা তুই কি বলতো!?
—কেন!আমি আবার কি করলাম!??
—তুই জানিস না তুই কি করছিস??
—না জানিনা। বলো কি করেছি??
—আমরা বাড়িতে এতগুলো মানুষ আমাদের কথার কি কোন দাম নেই তোর কাছে?
—আচ্ছা ভাবি এতঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজাসুজি বললেই তো পারো।
—তোর আজকে অফিস যেতে হবে না।
—কেন !!?
—তুই আজ তোর শ্বশুর বাড়ি যাবি । বিয়ের পর একটা বারের জন্যও ঐবাড়িতে যাসনি। মেঘ তোর উপর অভিমান করে চলে গেছে । এখনো যদি তুই ওকে আনতে না যাস তাহলে কি করে হবে !!?মেঘের বাড়ির সবাই কি মনে করবে বলতো??
—এসেছিল তো আবার চলে গেল কেন??
—এসেছিল মানে!!?
—কেন বাবাকে দেখতে ক্লিনিকে এসেছিলতো । তাহলে আবার চলে যাওয়ার কি দরকার ছিল।
—সৈকত !!হ্যা মেঘ এসেছিল কিন্তু সেটা শুধুমাত্র বাবার অসুস্থতার কথা শুনে । আর নইতো কিন্তু ও আসতো না।
—হুম আসবেই বা কেন!!?আমাকে তো আর মন থেকে ভালবাসে না যে আসবে। (কথাগুলি মনে মনে বলতে থাকে সৈকত)
—আর এমনতো না যে তুই মেঘ কে একবারের জন্যেও থাকতে বলেছিস।
তুই যদি একবার মুখ ফুটে ওকে থেকে যাবার কথা বলতিস তাহলে ও ঠিকই থেকে যেত।
—হুম থাকতো না ছাই।
—তুই কি জানিস ও ক্লিনিক থেকে চলে যাওয়ার আগে বার বার শুধু তোর দিকে তাকাচ্ছিল। তুই তো খেয়াল করিস নি।
আমি জানি তখন ওর মনের ভিতরটা কেমন হচ্ছিল।
—হ্যা তুমি তো সব জানো!!
—এই একদম রাগাবি না। তোরা ছেলেরা কি করেই বা বুঝবি একটা মেয়ে কতটা আশা ভরসা করে থাকে তোদের কাছে ।
বাবার বাড়ির সব কিছু ফেলে নতুন জায়গায় নতুন মানুষদের সাথে তাদের মত করে মানিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করে । আর তোরা ছেলেরা শুধু ঘুরে ফিরে কষ্ট দিস। বিয়ের পরে একটা মেয়ের কাছে তার স্বামী হয়ে যায় সব । বলতে পারিস স্বামীকে ঘিরে গড়ে ওঠে তার পুরো জগৎ । স্বামীর খুশী, স্বামীর ভালবাসা পাওয়ার জন্য একটা মেয়ে সবকিছু করতে পারে। আর সেই স্বামী যখন কষ্ট দেয় তখন আর সেই মেয়ের বেচে থাকা আর না থাকা সমান হয়ে যায়।
রোজির কথা গুলো শুনে সৈকতের মেঘের সেই ডায়েরিটার কথা মনে পড়ে । সত্যিই তো মেঘের কত ইচ্ছা কত স্বপ্ন কত আশা ছিল তার স্বামীকে ঘিরে । আর আমি না জেনে না বুঝে মেঘকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। একটা দিনের জন্য মেয়েটার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করিনি।
আর মেয়েটাও না কেমন!!কখনও মুখ ফুটে কিছু বলতে চাই না।আমার দেওয়া সব কষ্ট গুলি নিজের ভিতরে কি সুন্দর করে যত্নে লালন করছে।
একটি বারের জন্য অন্যে কাউকে কিচ্ছু বলেনি। এমনকি মেঘের আম্মু পর্যন্ত কথা গুলি জানেনা মনে হয় ।
—কিরে কি ভাবছিস!!!আমার কথা কিছু শুনতে পাচ্ছিস?
রোজির কথাই মৌনতা ভাঙ্গে সৈকতের ।
—হ্যা ভাবি শুনছি বলো ।
—শুনেছিস যখন তখন ভাল। আমি বা আমরা তোর আর কোন কথাই শুনতে চাইনা । তুই আজ এবং তাও এখন নাস্তা শেষ করে সোজা মেঘদের বাসায় যাবি । তারপর কিছুক্ষণ থেকে মেঘকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসবি।
আমি মেঘকে ফোন করে দিচ্ছি যেন গুছিয়ে থাকে ।
—না ভাবি, আজ না। আজ আমার একটা জরুরী কাজ আছে । পরে সময় করে কোন একসময় নিয়ে আসবো ।
—তার মানে তুই যাবি না??এতক্ষন ধরে তাহলে তোকে কি বুঝালাম??
—প্লিজ ভাবি একটু বোঝার চেষ্টা করো।
আজ আমার একটা জরুরী কাজ আছে ।
—কি এমন কাজ যেটা বউয়ের থেকেও জরুরী !!?
সৈকত নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় ।
হঠাৎ ঝিনুক বলে ভাইয়া তুই কিন্তু ভুল করছিস। আমি জানি তোর জরুরী কাজটা কি। কিন্তু মনে রাখিস এখন যাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিস সেই এক সময় --------
ঝিনুকের কথা শুনে বাকিরা সবাই একটু অবাক হয়ে যায় ।
ঝিনুকের কাছে আসল ঘটনা জানতে চাইলে ঝিনুক কোন কথা না বলে উঠে চলে যায় ।
রোজি সৈকতের কাছে জানতে চাই কি হয়েছে??ঝিনুক এমন কথা কেন বললো??তুই কাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিস তোর লাইফে !!?
সৈকত মুচকি হেসে বলে ভাবি ছাড়োতো এসব। ঝিনুক ছোট মানুষ ও কি বুঝে না বুঝে কথা গুলো বললো আর তোমরা সে কথা নিয়ে পড়ে আছো। আমার অফিসে যাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাকে যেতে হবে ।
সৈকত রেডি হয়ে দরজা পর্যন্ত পৌছাতেই দারোয়ান এসে সৈকতের সামনে দাঁড়ায় ।
—কি হয়েছে ?কিছু বলবেন??
—ছোট সাহেব একটা লোক এসে এই জিনিসটা তাড়াতাড়ি করে আপনেরে দিতে কইলেন।
—কি জিনিস বলে সৈকত হাত বাড়ায় ।
আরে এটাতো একটা পেনড্রাইভ!!
কে দিল??কি আছে এতে?
—তা তো কইতে পারিনা সাহেব।
—সে লোকটা কোথায়??
—তিনিতো জিনিসটা দিয়েই অনেক আগেই চইল্লা গেছে । তবে জিনিসটা দিয়ে কইলো আপনার কাজে লাগবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান।
দারোয়ান চলে যেতেই সৈকত পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। তারপর হল রুমের একটা সোফাই বসে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করে অন করে ।
পেনড্রাইভটা ল্যাপটপে দিতেই একটা ফ্লোডার দেখতে পাই( সুইটি ক্রাইম)।
ফ্লোডারের নামটা দেখেই সৈকতের মনে একটা ধাক্কা লাগে ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে ল্যাপটপটা অফ করে নিজের রুমে চলে যায় ।
রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে ফ্লোডার টি ওপেন করতেই একটা ভিডিও ফ্লোডার আর একটা ছবির ফ্লোডার ভেসে ওঠে ।
সৈকত ভিডিও ফ্লোডার টা ক্লিক করতেই
মনে হচ্ছে সুইটির অজান্তে ওর সামনে বসে
কেউ একজন গোপন ক্যামেরায় ভিডিওটা করেছে। যে ভিডিওটা করেছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু কথা শোনা যাচ্ছে।
—আরে এতদিন পর তুমি কি মনে করে ?(সুইটি)
—কেন এসে মনে হচ্ছে বিরক্ত করলাম। (অগান্তুক)
—তুমি আর বিরক্ত!!?
—তাহলে!!?
—কি বলতে এসেছো সেটা বলো?
—সুইটি প্লিজ ফিরে চলো । কেন এমন করছো ??তুমিতো জানো আমি তোমাকে এখনও ভালবাসি??
—তুমি সেই আগের মতোই আছো রাজু সেই বোকাটাইপের।
সুইটির মুখে নামটা শুনে বুঝা যাচ্ছে যে লোকটা সুইটির সামনে বসে ভিডিওটা করছে তার নাম রাজু।
—হ্যা আমি সেই বোকা টাইপেরই আছি।
—এই জন্যইতো তোমার সঙ্গে আমার যায় না। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি??
একবার নিজের দিকে তাকাও আর আমার দিকে তাকাও।
—তুমি যে পথটা বেছে নিয়েছ সেটা ভুল পথ। প্লিজ ফিরে চলো আমার সঙ্গে।
—ভুল!কিসের ভুল? আমার টাকা চাই শুধু টাকা। দিতে পারবে!!?যদি পারো তাহলে যাবো।
—তুমি টাকার নেশায় পাগল হয়ে গেছ।
—হ্যা আমি পাগল হয়ে গেছি । দেখ দেখ এখন আমার কত টাকা বলেই পাশ থেকে ব্যাগটা টেনে বিছানার উপর ঢেলে দেয় ।
—এত টাকা তোমার কাছে কি করে এলো!কে দিল??
—হা হা হা। টাকা কেউ দেয় না। আদায় করে নিতে হয় বুদ্ধি খাটিয়ে ।
—মানে?
—মানে খুব সহজ। তুমি রায়হান চৌধুরীকে চিনো?
—কোন রায়হান চৌধুরী?
—নেতা।
—হ্যাঁ । কেন
—এই টাকা গুলি তার ছেলের কাছ থেকে ফাঁদে ফেলে আদায় করেছি। আরো করবো। আস্তে আস্তে শুধু ডিমান্ড বাড়বে।
—কি বলছো তুমি!!?কি করেছ তুমি তার সাথে??
—তোমার শুনে কি লাভ!?তোমাকে তো বলেছিলাম আমার সঙ্গে থাকতে কিন্তু তুমি কি করলে !!?আসলে তুমি না থেকেই ভালই হয়েছে । তোমার মত নির্বোধ,বোকা আর এরাকম সহজ সরল সত্যবাদী মানুষ থাকলে আমারই সমস্যা হতো ।
—কি করেছ তুমি যার জন্য তোমাকে এতগুলি টাকা দিল?
—কিছুই করিনি। আবার অনেক কিছু করেছি।
—যেমন?
—আজ তোমার কি হয়েছে যে আমার কাজ জানতে চাইছো??এতদিন তো ঘৃনায় মুখ ও দেখতে না। আজ হঠাৎ কি এমন হলো?
—আসলে তেমন কিছু না সুইটি। আমি অনেক ভেবে দেখেছি আমি তোমাকে ভালবাসি আর তুমি টাকা কে। তুমি যেমন টাকার নেশা ছাড়তে পারছো না ঠিক তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়তে পারছিনা। তাই ভাবলাম দুজনের কেউ এক জনকে তো কমপ্রোমাইজ করতেই হবে ।
—যদি কমপ্রোমাইজ তুমি করতে চাও তাহলে ঠিক আছে । আর যদি আমাকে করতে বলো তাহলে বলবো দরজা খোলা আছে যেতে পারো।
—রেগে যাচ্ছো কেন। ভালবাসার জন্য এটুকু ছাড় না হয় আমিই দিলাম।
—হা হা হা। খুবই ভাল সংবাদ । তাহলে তুমি একটু বসো আমি একটু কিছু নিয়ে আসি। আজ দুজন মিলে অনেক আড্ডা দিব।
—এখন না সুইট হার্ট । আজ আমার অনেক কাজ। আগে তোমার গল্প টা শেষ করো ।
—কি কাজ(বিরক্তি নিয়ে)।
—তুমি তো জানো বাবা মা এখন আর কেউ তোমাকে মন থেকে মানতে পারবে না। তাই ভাবছি এখন থেকে আমি তোমার কাছে থাকবো ।
— ওয়্যাও গ্রেট!!এই না হলে------
এখন আমি খুব খুশী এতদিনে তাহলে তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম আর তুমি!!?
—আচ্ছা এসব বাদ দাও এখন বলো তারপর কি হলো ?নেতার ছেলেকে কিভাবে ফাসালে ?
—আসলে তেমন কিছুই না। শুধু ড্রিংকসের ভিতরে কয়েকটা ঘুমের ঔষুধ দিয়ে আমার বেড পর্যন্ত নিয়েছিলাম।
—তার মানে তুমি তার সঙ্গে রাত কাটিয়েছ?OMG!!
—আরে না ,তুমি যা ভাবছো তার কিছুই হয়নি। শুধু শুধু সন্দেহ করছো। শোন সুইটি টাকার লোভি হতে পারে কিন্তু চরিত্রহীনা নয়। আসলে সেদিন সৈকত আর আমি অফিসের একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম । তারপর যে দিন কাজ শেষ হলো সেদিনই আমাদের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু আমি আগে থেকেই প্লান করে রেখেছিলাম যে সৈকতকে যেকোন ভাবেই একটা রাত রাখতে পারলেই আমার ফাদে সে পা দিবে ।
—এত না জটিল করে সোজা করে বলো।
—আসলে সেদিন রাতে ড্রিংকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ার পর যখন সৈকত প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই আমি ওকে ওর রুম থেকে ধরে আমার রুমে নিয়ে আসি। তারপর আগে থেকে রুমে রাখা গোপন ক্যামেরায় আমি সৈকতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি তুলি । তারপর সারারাত সৈকত ঘুমিয়ে ছিল আর আমি ওর ঘুম ভাঙ্গার আগে ওর কাছে গিয়ে এমন ভাবে শুইয়ে ছিলাম যাতে সৈকত ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারে যে-------
—তারপর কি হলো??
—তারপর আর কি যা হবার ছিল তাই হলো। আমার প্লানটাই সাকসেস হলো।
—উনি এত সহজে সব মেনে নিলেন??
—না প্রথমে মানতে চাইনি তারপর একটু ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে হলো।
আর সৈকত তো আমার সম্পর্কে ভাল করে জানেই না। আমি যা বলি সেটাই বিশ্বাস করে । গাধা টাইপের একটা নিজের বুদ্ধি খাটায় না। ওর বাবা যতটা বুদ্ধিমান সে অনুযায়ী ছেলের এক রতিও বুদ্ধি নেই।
—সে তো তোমাকে তার বন্ধু ভাবে বলেই বিশ্বাস করে । যদি কখনও তোমার আসল রুপটা তার সামনে চলে আসে তখন কি করবে??
—বুঝিয়ে দেব অন্যে কিছু বলে ।
সৈকত সম্পূর্ণ ভিডিওটা না দেখেই ল্যাপটপটা রাগে বন্ধ করে দেয় ।
কি দেখলো সে এতক্ষন যাকে সে এতদিন বন্ধু ভেবে সব রকম সাহায্যে সহযোগিতা করছে । সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছে আর সেই কিনা!!?
ছিঃছিঃ
এত দিন ওর ঐ ভাল মানুষী মুখোশের পিছনে যে এতটা বিদঘুটে আর বিশ্রী মন মানসিকতার মুখটি লুকিয়ে ছিল তা ভাবতেই আজ সৈকতের কষ্ট হচ্ছে।
ইচ্ছে করছে সুইটিকে কাছে পেলে ----
আসলেই আমি একটা গাধা।
নিজেকে নিজেই গালি দেয় মনে মনে।
আমার আশে পাশে থাকা মানুষ গুল
সবাই বুঝতে পেরেছিল মেয়েটি ভাল না আর আমি!!!???
এই শীতেও রাগে সৈকতের শরীর গরম হয়ে যেতে লাগলো ।
তাড়াতাড়ি করে কোর্ট টা খুলে এসি টা চালু করে বিছানায় বসে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলো ।
কি করা যায় এখন??
মেঘের কথা খুব মনে পড়ছে। এই মুহূর্তে মেঘ পাশে থাকলে খুব ভাল হতো । এই মেয়েটা কি করে যে এত কিছু বুঝতে পারে কে জানে!!?
বাবা আর ঝিনুকের পরে মেঘই তো আমাকে সেদিন ক্লিনিকে সুইটির কথা বলে সাবধান করে দিয়ে ছিল।
তারপরও আমি-----
সৈকতের এ মুহূর্তে ইচ্ছা করছে মেঘের সঙ্গে কথা বলতে ।
কি করে কথা বলবে তার তো মোবাইল নেই।
মোবাইলের কথা মনে হতেই মনে পড়লো মেঘ যে ফোনটা সৈকত কে গিফট করেছিল সেটার কথা।
সৈকত তাড়াতাড়ি করে আলমারি খুলে ফোনটা বের করে ।
আগের দিন অফিস থেকে ফিরে সৈকত মেঘের হাতে ফোনটা তুলে দিয়েছিল।
আর সেটা মেঘ যত্ন করে সৈকতের আলমারি তে রেখে ছিল।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে বন্ধ তারমানে চার্জ নেই।
থাকবেই বা কি করে এতদিন তো এমনিতেই পড়ে ছিল।
সৈকত তাড়াতাড়ি করে চার্জারটা বের করে ফোন চার্জে লাগিয়ে ফোনটা অন করে ।
ভাগ্যিস রিসিভ কলে নম্বরটা এখনো আছে ।
সৈকত নম্বরটা ডায়াল করতেই মেঘের নম্বরটা সুইচ অফ বলে।
সৈকতের মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
কত আশা নিয়ে আজ ফোনটা ধরল আর সেটি কোন কাজেই আসছে না।
৩০.
সৈকত তাড়াতাড়ি করে ল্যাপটপ পেনড্রাইভ আর মেঘের দেওয়া ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ।
গাড়ি ড্রাইভ করে আর ভাবে আগে একবার থানায় যাওয়ার দরকার রাতে তো সুইটির কুকর্ম না জেনে রাকিবকে বলে ছিলাম উকিল দিয়ে জামিনে বের করে নিয়ে আসতে । কিন্তু এখন সব জেনেশুনে এটা আমি হতে দিতে পারি না।
সৈকত ফোনটা গাড়িতে চার্জে বসিয়ে বার বার মেঘের নম্বরে ট্রাই করছে কিন্তু যতবার কল করছে ততোবারই বলছে সুইচ অফ।
মেঘের উপর মনে মনে খুব রাগ হতে শুরু করে সৈকতের । এই ভেবে যে আগে যখন এ বাড়িতে ছিল সব সময় মেঘ তার
সাইরেনটা সঙ্গে নিয়ে বেড়াত কখন কে কল করছে সব দেখত আর আজ আমি যখন কল করছি এখন নিশ্চয় কোথাও পড়ে আছে । এখন আর সাইরেন নামক যন্ত্রটা বোধহয় আর সঙ্গে রাখে না।
দেখতে দেখতে থানার সামনে এসে গাড়ি থামায় সৈকত।
গাড়ি থেকে নামার আগে একটু ভেবে নেয় যদি পুলিশ তাকে আবার উল্টো জেরা করে যে কি সম্পর্ক আমার এরাকম একটা মেয়ের সাথে তাহলে কি বলবো??
কিছু একটা ভেবে গাড়ি থেকে নেমে সোজা থানার মধ্যে ঢুকে সৈকত।
সৈকত কে দেখেই সবাই স্যালুট দেয়। তারপর পুলিশ কর্মকর্তা তাড়াতাড়ি করে জানতে চাই কি ব্যাপার স্যার আপনি এখানে?
এত কষ্ট করে এখানে আসার কি দরকার ছিল একটা ফোন করতেন আমি আপনার কাছে যেতাম।
সৈকত মুচকি হেসে বলে থাক সেসবের কোন দরকার নেই ।
আসলে আমি একটা কাজে এসেছি
—বলুন স্যার কি করতে পারি আপনার জন্য?
—আমার ম্যানেজার বলছিল আপনারা নাকি আমার অফিসের একটা মেয়েকে এরেস্ট করেছেন তার ব্যপারে ।
—জ্বি স্যার ,সুইটি আসলে তার নামে অনেক গুলো ব্লাকমেইল চিটিংয়ের কেস আছে। এতদিন আমাদের হাতে কোন প্রমান ছিল না তাই তার বিরূদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নিতে পারি নি । কিন্তু গতকাল কেউ একজন প্রমান গুলো জোগাড় করে আমাদের ফোন করে তাই আমরা এই মেয়েটাকে প্রমানের ভিত্তিতে এরেস্ট করতে পেরেছি।
—আমি কি একটু দেখা করতে পারি?
—হ্যা স্যার অবশ্যই । চলুন আমার সঙ্গে।
—আপনাকে যেতে হবে না ,আমি তার সঙ্গে কিছুক্ষণ একা কথা বলতে চাই।
—ওকে স্যার ,তাহলে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।
—ঠিক আছে।
পুলিশ অফিসার ও অন্যেরা কিছু সময়ের জন্য বাইরে যায় ।
সৈকত ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সুইটির দিকে ।
—কেমন আছো সুইটি?
—সৈকত তুমি!আমি জানতাম তুমি আসবে । আমাকে এখান থেকে বের করো সৈকত । এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
—কেন করলে এসব??
—আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো ,সত্যিই আমি কিছু করিনি। আমাকে ফাসানো হচ্ছে। তুমি তো জানোই সব।
—আর কত মিথ্যা বলবে আমাকে??আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আর তুমি আমার সেই বিশ্বাস টাকে পুজি করেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে??
—সৈকত তুমিও আমাকে ভুল বুঝতেছ।
—চুপ আর কথা বলোনা তুমি। আমি তোমাকে বন্ধু মনে করে তোমার পাশে দাড়িয়েছিলাম আর তুমি!!!ছিঃ
আমার ভাবতেও ঘৃণা করছে যে তোমার মতো একটা মেয়েকে আমি বন্ধু রুপে গ্রহণ করেছিলাম। এতো লোভ তোমার এত টাকার নেশা!!? তুমি এতটা নীচে নামতে পারো শুধুমাত্র টাকার জন্য তা ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।
সুইটি কি বলবে আর কিছু বুঝতে পারছে না। সৈকত কি তাহলে সবটাই জেনে গেছে !!!লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে সুইটি । চোখ দিয়ে পানি ঝরে । নিজের কৃত কর্মের জন্য আজ তার এ অবস্থা।
শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে ।
সৈকত একটু থেমে বলেঃ
—আর কত টাকা চাই তোমার??
বলো আজ যা চাইবে তাই দিব। তবে এখান থেকে তুমি আর কখনও বের হতে পারবেনা। এই নাও ব্লান্ক চেক তোমার ইচ্ছা মত সংখ্যা বসিয়ে নিও। তবে মনে রেখ তোমার এই লোভের জগতে তুমি শুধু একা। আর কেউ নেই তোমার পাশে । এই এখানে তোমাকে দিনের পর দিন মাসের পর মাস একা কাটাতে হবে । তোমার চারিদিকে এখন শুধুই অন্ধকার । তুমি একবারের জন্য তোমার বাবা মার কথা ভাবলে না যে তারা যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হবে ??
সৈকত আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসে ।
বাইরে এসে দেখে সৈকতের নিজস্ব আইনজীবী আর রাকিব দাড়িয়ে আছে ।
সৈকতকে দেখেই রাকিব একটা কাগজ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে ।
—স্যার এই যে সুইটি কি জামিনে বের করার জন্য কাগজ গুলো রেডি করা হয়েছে। এখন শুধু জমা দিলে হবে ।
সৈকত কোন কথা বলছে না। রাগে থমথম করছে । সৈকত কাগজ গুলো নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় ।
রাকিব কাগজ গুলো দেওয়ার সাথেই সৈকত কাগজ গুলো নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে সব টেনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে ।
রাকিব সৈকতের এমন আচারনে অবাক হয়ে যায় ।
যেই বলে স্যার এটা কি করছেন ??
সৈকত হাত উচু করে থামতে বলে ।
রাকিব বুঝে যায় সৈকত কি বলতে চাইছে ।
রাকিব আর কথা না বলে সরি বলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে বেয়িয়ে পড়ে ।
সৈকতের অবস্থা আর কেউ কোন কথা বলতে সাহস পাইনা।
সৈকত থানা থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে উদ্দেশ্য মেঘ।
মেঘের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই মেঘের আম্মু এগিয়ে আসে ।
সৈকত কে এভাবে হঠাৎ না বলে আসতে দেখে মেঘের আম্মু খুব অবাক হয়ে যায় ।
—সৈকত বাবা তুমি!!!কেমন আছো ?
—জ্বী আমি ভাল আছি । আপনারা কেমন আছেন?
—ভাল আছি। চলো ভিতরে চলো ।
সৈকত তার শ্বাশুড়ীকে অনুসরণ করে ভিতরে প্রবেশ করে ।
মেঘের আম্মু সৈকত কে বসতে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে নাস্তার ব্যবস্থা করতে যায়। জামাই যে তার হুট করে এভাবে চলে আসবে ভাবতেও পারেনি।
সৈকত বসে আছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিয়ের দিন হুপ করে এসে মেঘকে বিয়ে করে নিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর তো সৈকত এর আগে আসে নি । তাই সব কিছু ভাল করে চিনতে পারছে না। সৈকত এদিক ওদিক তাকিয়ে মেঘ কে খুজতে থাকে। কিন্তু বাড়ি এতটাই শান্ত পরিবেশ হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে না তৃতীয় আর কেউ বাসায় আছে।
হঠাৎ মেঘের আম্মু ট্রে ভর্তি নাস্তা এনে সৈকতের সামনে দিয়ে বললো নাও বাবা কিছু মুখে দাও।
সৈকত মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না । আমি বাসা থেকে খেয়েই বেরিয়েছি তারপরও আপনি যখন বলছেন বলে হালকা কিছু নিল।
—তোমার আব্বু এখন কেমন আছে?
—জ্বী আলহামদুল্লিলাহ ভাল আছে।
—আর বাকি সবাই?
—সবাই ভালো আছে। কাউকে বাসায় দেখছি না ,আব্বু (শ্বশুর)তো অফিসে তাই না?
—হ্যা তোমার শ্বশুর অফিসে । আর ----
বলতে না বলতেই ফোনটা বেজে ওঠে
তুমি বসো আমি কথা বলে আসি।
সৈকত ঘাড় নেড়ে হ্যা বলে।
সৈকতের আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। কখন থেকে বসে আছে অথচ তারই দেখা পাচ্ছে না। এত কষ্ট করে এতদূর থেকে এসে কি হলো !!?অভিমানীর মুখটাই এখনো পর্যন্ত দেখা গেল না।
সৈকতের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে মেঘকে দেখার জন্য । মনটা আকু বুকু করছে কখন চোখে দেখবে তার প্রিয় মুখটা।
সৈকত উঠে দাঁড়ায় ধীর পায়ে বাড়ির ভিতরের এদিক ওদিক তাকাতে থাকে ।
মনে মনে ভাবছে মেঘ মনে হয় তার রুমেই আছে । কিন্তু এ বাড়িতে মেঘের রুম কোনটা সেটাই তো সে জানেনা।
কেউ নেই যে তার কাছে জিঙ্গাসা করবে।
সৈকত মনে সাহস নিয়ে মেঘের রুমটা খুজতে থাকে একটা রুম থেকে হালকা শব্দে গানের কন্ঠ ভেসে আসছে ।
সৈকত সেই রুমের দিকে এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে।
বাতাসে দরজার পর্দা দুলছে সৈকত তাকিয়ে দেখে দেওয়ালে মেঘের ছবি ঝুলছে । ছবিটা দেখে সৈকত মনে মনে নিশ্চিত হয় এটাই মেঘের রুম।
সৈকত রুমে ঢুকে দেখে রুমটা খালি । সাইন্ড বক্সে গান বাজছে ।
হঠাৎ মেঘের আম্মু এসে বলে তুমি এখানে আর আমি তোমাকে---
দেখেছ মেঘের কান্ড !বলে সাইন্ড বক্সটা অফ করে দেয় ।
সৈকত লজ্জা ভেঙ্গে জিঙ্গাসা করেঃ
—মেঘ কোথায় ওকে তো কোথাও দেখছি না।
—ওহ!কথাই কথাই তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেলাম রাজু আর মেঘ তো আজ কক্সবাজার গেল ওর কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে। মেঘ প্রথমে যেতে চাইনি একা তারপর আমি রাজুকে বলে ওর সঙ্গে পাঠিয়েছি।
—কিহ!!?ওহ শীট। কখন??
—এইতো ওরাও বের হলো তুমিও আসলে । এই যে কেবল রাজু ফোন করেছিল মেঘের ফোনটা নিতে নাকি মনে নেই।
—রাজু নামটা শুনে সৈকতের সকালের সেই ভিডিও টার কথা মনে পড়ে । এই রাজু সেই রাজু নইতো!!ধূর এখন ওসব ভাবার সময় নেই । এতক্ষন মেঘদের গাড়ি হয়তো বেশী দূরে যায় নি । আমাকে ও এখনি যেতে হবে।
সৈকত কে চুপ থাকতে দেখে মেঘের আম্মু
মনে করে মেঘের যাওয়ার কথা শুনে সৈকত মনে হয় রাগ করেছে ।
—তুমি রাগ করো না বাবা। মেঘ আর তোমার মধ্যে কিছ হয়েছে কিনা আমি জানিনা। আর জানতেও চাই না । তবে এটুকু বলবো মেয়েটা আমার এখানে আসার পর থেকে কেমন জানি হয়ে গেছে । সারাক্ষন মন খারাপ করে থাকে । হাসে না ,খুব কম কথা বলে । সারাক্ষন নিজের রুমে বসে থাকে কি যেন ভাবে ।
তাই গতকাল ওর বন্ধুরা এসে যখন মেঘকে ওদের সঙ্গে যেতে বললো আমি আর তোমার শ্বশুর মেঘকে জোর করে রাজী করিয়েছি। তুমি মেয়েটাকে ভুল বুঝনা।
—না এতে ভুল বোঝার কি আছে । আপনি এক কাজ করুন আপনি মেঘের মোবাইলটা আমার কাছে দিন । আমি নিয়ে যাচ্ছি। আর রাজু ভাইয়ার ফোন নম্বর টা দিন । আমি যোগাযোগ করে নিব।
মেঘের আম্মু সৈকতের কথা শুনে খুব খুশী হয় ।
—তুমি যাবে বাবা ??
—হ্যা যাবো ।
—তুমি দাড়াও আমি এখনি মেঘের মোবাইল আনছি।
—আচ্ছা।
সৈকত মোবাইল নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হতেই ডান পাশের রুমে চোখ পড়ে
একটা ছবি তে মনে হল সুইটির মত কাউকে দেখতে -------------
(চলবে)
৯ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/628271060543805/permalink/3317579888279562/