মিষ্টির চেহারার পরিবর্তন দেখে ফাহিম বলল,
-তুমি কি তোমার মায়ের পথে হাঁটতে চাচ্ছো নাকি?
-এইতো ভাইয়া ধরে ফেলেছেন।আপনিও একটু আমার সাথে বাবার পথে হাঁটেন না।নিচ তলা থেকে আলাপটা খুব দ্রুত উপর তলায় নিয়ে যান প্লিজ।আমার আর ভালো লাগছে না।
-ঐ দিন কিন্তু আমি তোমার মাকে সবকিছু বলতে চেয়েছিলাম।এখন বেশি বাড়াবাড়ি করলে সত্যিই বলে দিবো।
-বললেন না কেন?
-তোমার মায়ের কথা শুনে মনে হয়েছিল এই ব্যাপারে আলাপ করলে সেখানে বসেই তোমার মা বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে নিতেন।
-আমারও তাই মনে হচ্ছিল।আমিও চাচ্ছিলাম আপনি যাতে মাকে সত্যি কথাটা বলে দেন।
তাদের কথার মাঝখানে ফাহিমের ভাবি ঢুকে বলল,
-কী হয়েছে তোমাদের?
কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি তোমরা গোপনে কী সব যেন বলছো।
মিষ্টি বলল,
-তেমন কিছু না।আমি তো ভাইয়ার সাথে আড্ডা দিতে আসি মাঝেমধ্যে।আমাদের বাসায় তো আড্ডা দেওয়ার কোনো মানুষ নেই।তাই আপনাদের বাসায় আসি।
-তা নাহয় বুঝলাম।কিন্তু ফাহিম ছাড়াও তো আমাদের বাসায় আরো অনেক মানুষই আছে আড্ডা দেওয়ার।আমি আছি,কণা,স্নেহা,মা তাদের সাথেও তো আড্ডা দেওয়া যায়।
-আপনারা সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই আপনাদের সাথে আড্ডা দিতে যাই না।আর ফাহিম ভাইয়ের তো কোনো কাজ নেই সারাদিন শুয়ে বসে থাকে তাই তার কাছেই আসি।
-ও,আচ্ছা।এখন আমার রুমে আসো,হাতে কোনো কাজ নেই।স্নেহাকে ঘুম পারিয়ে এসেছি তাই বিরক্ত করার কোনো মানুষ নেই এখন।তোমার যখন ইচ্ছা আমার রুমে চলে আসবে।ব্যস্ত থাকলেও কথা বলতে সমস্যা হবে না।
ফাহিমের ভাবি মিষ্টিকে নিয়ে তার রুমে চলে গেলে ফাহিম তার বোন কণার রুমে চলে গেল।
কণাকে গিয়ে বলল,
-তোর তো অন্যের কথা লুকিয়ে শুনার ভালো অভ্যাস আছে।
-হুম ভাইয়া।আমার লুকিয়ে কথাবার্তা শুনতে খুব ভালো লাগে।
-এখন এক কাজ কর,ভাবি মিষ্টিকে নিয়ে তার রুমে চলে গেছে।তুই লুকিয়ে তাদের কথাবার্তাগুলো শুনে আমাকে জানা।
-বিনিময়ে আমি কি পাবো?
-যদি মনের মতো কোনো কথাবার্তা বলে তাহলে তোকে কিছু দিতে আপত্তি থাকবে না।আগে শুনে আয়।
-যাচ্ছি।
ফাহিমের ধারণা তার ভাবি বুঝে গিয়েছে যে মিষ্টি তাকে পছন্দ করে।এ বিষয়েই তাদের মধ্যে কথাবার্তা হবে এখন।তাদের বাসায় সবচেয়ে জ্ঞানী লোক হচ্ছে তার ভাবি।
এদিকে ফাহিমের ভাবি আর মিষ্টির মধ্যে কথাবার্তা চলছে।কিছু কথাবার্তার পর ভাবি মিষ্টিকে বললো,
-ফাহিমকে পছন্দ করো কবে থেকে?
মিথ্যে কথা বললে কিন্তু আমি ধরে ফেলবো।
-এই কিছুদিন হলো।
-তাকে পছন্দ করার কারন?
-কিছুদিন আগে শপথ করে ঘুমিয়ে ছিলাম যাকে স্বপ্ন দেখবো তাকেই বিয়ে করবো।তখন ফাহিম ভাইয়াকে স্বপ্নে দেখেছিলাম।স্বপ্নে দেখেছিলাম...
-স্বপ্নে কি দেখেছো সেটা আমার জানার প্রয়োজন নেই।তাহলে ঐ স্বপ্নের পর থেকেই ফাহিমকে পছন্দ করো।
-জি ভাবি।
-ফাহিমও কি পছন্দ করে তোমাকে?
-হয়তো।বুঝতে পারছি না।
-আমার তো মনে হচ্ছে সেও পজেটিভ। তুমি এখন চলে যাও।এভাবে যখন তখন আমাদের বাসায় আসলে মা সন্দেহ করে ফেলবে।আর মায়ের চোখে যদি একবার খারাপ হয়ে যাও তাহলে মা তোমাকে কোনোদিনই তার পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিবেন না।উনার মাথায় একবার কোনো কিছু ঢুকে গেলে সেটা আর বের করা যায় না।
-ঠিক আছে,ভাবি।তাহলে আমি চলে যাই।
-হুম যাও।আমি দেখছি কীভাবে সবকিছু সমাধান করা যায়।
মিষ্টি বাসা থেকে চলে গেলে কণা ফাহিমের রুমে ঢুকে হুবুহু তাদের কথোপকথন তুলে ধরলো।
ফাহিমের ধারনাই ঠিক।সে আগে থেকেই ভেবেছিল এরকম কোনো কথাবার্তাই হবে।
বিকেল বেলা ফাহিম স্নেহার ড্রয়িং খাতায় আপেল এঁকে দিচ্ছে। স্নেহা মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
স্নেহার মা এসে বললেন,
- ড্রয়িং আঁকা শেষ হয়েছে,ফাহিম?
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।আগে আঁকা শেষ করো।
-এই তো প্রায় শেষ।স্নেহা তো এখন নিজেই খুব ভালো আঁকতে পারে।ভাইয়া যখন আসবে তখন তো খুব অবাক হয়ে যাবে।তার ছোট মেয়ে কত বড় হয়ে গেছে।
ভাইয়ার আসতে আর কতদিন বাকি ভাবি?
-এখনও প্রায় দুইমাস।
-তাহলে তো বেশি দিন বাকি নেই।দেখতে দেখতেই সময় চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর স্নেহাকে তার মা ড্রয়িং খাতা দিয়ে রুম থেকে বিদায় করে ফাহিমকে বলল,
-মিষ্টি যে তোমাকে পছন্দ করে আমাকে আগে বললে না কেন?
-সময় পাই নি ভাবি।এই তো কয়েকদিন হলো বুঝতে পেরেছি।ভেবেছিলাম বলবো,পরে আর বলা হয়নি।
-মিষ্টিকে দেখে তো মনে হলো সে তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।তোমার কী অবস্থা?
-আমার অবস্থা খুব ভালো।এখনও তার প্রতি কোনো আকর্ষণ কাজ করছে না।তবে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই কাজ করবে।
-তাহলে অপেক্ষা করো।এখনই আকর্ষণ কাজ করানোর কোনো প্রয়োজন নেই।আগে আমি দেখি কীভাবে সব কিছু ঠিক করা যায়।যদি ঠিক না হয় কিংবা আমার কাছে মনে হয় তোমাদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না তাহলে আকর্ষণ তৈরীর কোনো প্রয়োজন নেই।
-আচ্ছা।
-তোমার তো তাহলে কোনো মতামত নেই।আমি যা বলবো সেটাই মেনে নিবে।
-একটা মত আছে।মিষ্টি খুব বেশী কথা বলে।দরকারের চেয়ে অদরকারী কথাবার্তা বেশী বলে।এর একটা সমাধানের চেষ্টা করো।
-এটা কোনো সমস্যাই না।বিয়ের আগে আমিও অনেক কথা বলতাম।এখন তো খুব বেশী প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলি না।আর বেশী কথা বললে সমস্যা কী?
-তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে বিয়ের আগে তুমি বেশি কথা বলতে।আমি আর ভাইয়া যখন তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম তখন তো তুমি কোনো কথাই বলো নি।মাথাটাও উচু করে রাখো নি।এদিকে আমি আর ভাইয়াও প্রথম বার কোনো মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম।কি একটা পরিস্থিতি ছিল।
ভাইয়া তো তোমাকে ঠিকমতো দেখেই নি লজ্জায়।
-তাহলে সম্মতি দিয়েছিল কেন?
-তোমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি তোমাকে দেখেছি কিনা।আমি বললাম দেখেছি,খুব ভালোই লেগেছে।
তারপর আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলো দেখে কি সুস্থ স্বাভাবিক মনে হয়েছে?
আমি হ্যা সূচক সম্মতি দিলাম।
এরপর বাসায় এসে ভাইয়া বলল,মেয়ে তার খুব পছন্দ হয়েছে।এখন তোমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখো।
-আমিও কিন্তু বিয়ের আগে তোমার ভাইয়ার মুখ দেখিনি।এখন তো আর এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই।এখন চারপাশ অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত একবারও মিষ্টি ফাহিমদের বাসায় আসলো না।
এরমধ্যে একদিন কলিং বেলের শব্দ শুনে দিলারা বেগম দরজা খুলে দিয়ে দেখলেন মিষ্টি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর হাপাচ্ছে।
-কি হয়েছে,মিষ্টি?
কাঁদছো কেন?
-আন্টি বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।অফিস থেকে আসার সময় হয়েছে।কিছুক্ষন আগে একজন ফোন করে বলল।
মিষ্টির কান্নার শব্দ শুনে ফাহিম দরজার পাশে এসে বলল,
-কি হয়েছে,মিষ্টি?
-ভাইয়া,বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।হাসপাতাল থেকে বলেছে খুব দ্রুত রক্ত জোগাড় করে সেখানে যাওয়ার জন্য।
-রক্তের গ্রুপ কী?
-ও নেগেটিভ।
-তুমি কান্না বন্ধ করো।আমি রক্ত জোগাড় করার চেষ্টা করছি।আমি আমাদের ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে দেখছি। আমার পরিচিত দুই একজন বন্ধুর রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। চিন্তা করার কিছু নেই।
ফাহিমের মা বললেন,
-মিষ্টি,তোমার মা কোথায়?
-মা বাসায়।কোনো কথা বলছে না,কাঁদছে।
-ফাহিম তুই হাসপাতালে গিয়ে রক্তের ব্যবস্থা কর।আমি তাদের বাসায় গিয়ে তার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে আসি।বৃষ্টি তুমিও আসো,আমার সাথে।
-না আন্টি,আমিও ফাহিম ভাইয়ের সাথে যাবো।
-এখন না।এখন অনেক কাজ করতে হবে।পরে আমরা সবাই যাবো।
এক ঘণ্টার মধ্যে ফাহিম তার দুই বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল।আংকেলের অবস্থা মোটামুটি। মাথা আর পিঠে অনেক ব্যথা পেয়েছে।মাথা থেকে অনেক রক্ত বের হয়েছে।তাই রক্ত দিতে হবে।ফাহিমের সাথে যেই দুইজন এসেছে তাদের রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ।নার্স এদের মধ্যে একজনকে নিয়ে গেলেন রক্ত দেওয়ার জন্য।
পরদিন সকালে...
মিষ্টির বাবার জ্ঞান ফিরেছে।এখন অনেকটা সুস্থ। ডাক্তার বলেছে আপাতত কোনো ঝুঁকি নেই।দুইদিন বিশ্রাম নিয়ে চলে যেতে পারবেন হাসপাতাল থেকে।
মিষ্টি তার বাবার পাশে বসে রয়েছে।
-এখন কেমন লাগছে বাবা?
-ভালো।তোর মা আসেনি?
-না।আসতে চেয়েছিল কিন্তু আন্টি আসতে দেইনি।
-তুই কখন এসেছিলি?
-আমি রাতে এসেছি।
ফাহিমও ঘটনাস্থলে এস বলল,
-ডাক্তার বলেছে এখন আর কোনো সমস্যা নেই।দুই-একদিন বিশ্রাম নিয়ে চলে যেতে পারবেন।
-তোমার যেই বদ্ধুরা রক্ত দিয়েছিল তাদের তো দেখছি না।
-ওরা এখানেই আছে আংকেল।খুব ভালো ছেলে ওরা।সারারাত আমার সাথেই ছিল।নেশাজাতীয় কোনো কিছু সেবন করে না।ওরা তো কোমল পানীয় পর্যন্ত স্পর্শ করে না।রক্ত খুব পরিষ্কার।
ফাহিমের কথা শেষ না হতেই তার দুই বন্ধু কোমল পানীয় হাতে নিয়ে পান করতে করতে বলল,
-চিল আংকেল।আমরা আছি তো আপনার চিন্তার কোনো কারন নেই।
মিষ্টির বাবা দুইজনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন একজনের চুল গুলো অনেক লম্বা আর আরকজনের মুখে গালে কাটা কাটা দাগ।একজনকে দেখেও সুবিধার মনে হচ্ছে।
একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার জীবনের স্বপ্ন কি?
-স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবো।মা-বাবারও তাই স্বপ্ন ছিল।কিন্তু পূরণ করতে পারলাম না।
-কেন?
-ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বায়োলজিতে ফেল করে বসি।চতুর্থ বিষয় ছিল বলে ফেল আসেনি।
এ ছেলের কথা শুনে মিষ্টির বাবা ফাহিমকে বললেন,
-ফাহিম,তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে এখান থেকে চলে যাও তো।আমার একটু বিশ্রাম দরকার।
-ঠিক আছে,আংকেল চলে যাচ্ছি।যেকোনো প্রয়োজনে ফোন দিও মিষ্টি।
-আচ্ছা।
ফাহিমের বন্ধুরা যাওয়ার সময় মিষ্টির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-চিল আংকেল,চিল।সব ঠিক হয়ে যাবে।
তিনদিন পর বাসার পরিস্থিতি আবার আগের মতো স্বাভাবিক।কিন্তু দিলারা বেগম একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত।কিছুদিন যাবত তিনি অমঙ্গলের লক্ষণ পাচ্ছিলেন এই বাসায় কিন্তু দূর্ঘটনা ঘটলো আরেক বাসায়।এই বাসার সাথে ঐ বাসার কি সম্পর্ক?
(চলবে...)