ঘাসফুল

0 1
Avatar for Nipa1234
3 years ago

পর্ব ৮

‌রাত সাড়ে এগারোটা।

‌সামনে ফাইনার, আগারওয়াল, কালসি, পেলশিয়ারের অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি বই, একটা স্যাম্পল পেপার আর কুইনাইন এর ডিগ্রেডেশন এর স্টেপ বাই স্টেপ প্রসেসগুলোর ডেটা রেকর্ড নিয়ে ডেস্কে বসে আছে তাওহীদ। থিসিসেে কাজ প্রায় শেষের দিকে, কাজ শেষ করলেই থিসিস পেপার লেখায় হাত দেবে। কিন্তু আজকে কাজে মনোযোগ বসাতে পারছে না। কিছু একটা ঠিক মিলছে না,কিন্তু সমস্যাটা ঠিক তার ডেটা বা থিওরি তে না। কি যেন ভুলে গেছে সে, কোনোভাবে এখন মনে করতে পারছে না। উঠে গিয়ে এককাপ কফি বানিয়ে কিচেন থেকে ফেরার পথে দেখলো মিষ্টির রুমটা অন্ধকার। এত তাড়াতাড়ি তো মিষ্টি ঘুমায় না। তারপর মনে পড়লো রাতে খাবার টেবিলেও আসেনি মিষ্টি। হলো টা কি মেয়েটার?

কফির কাপ হাতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো তাওহীদ। ওদের বাড়িটা বানিয়েছিলেন তাওহীদের দাদা। তাওহীদের দাদা ছিল মুন্সিগঞ্জের এক বনেদি পরিবারের ছেলে। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। কিন্তু গ্রামে তার মন বসেনি কোনোকালেই। প্রথমে পড়াশোনা করতে তারপর চাকরিসূত্রে ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন, স্ত্রীকেও সাথে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাওহীদের দাদির মন পড়ে থাকতো গ্রামেই। গ্রামের খোলামেলা রান্নাঘর, ডানে গোয়াল, বায়ে পুকুরপাড়... এসব ছেড়ে শহরের ছোট, বদ্ধ বাড়িতে থাকতে পারতেন না তিনি। তাওহীদের দাদা এই শহরটাকে যতটা ভালবাসতেন ততটাই ভালবাসতেন স্ত্রীকে। স্ত্রীর কথা চিন্তা করে ভেবেছিলেন এই শহরেই তাকে একটা গ্রাম বানিয়ে দেবেন। কিন্তু চাকরির গোনা বেতনে তো এত কিছু সম্ভব না। কারণ আর যাই হোক অসৎ রাস্তায় জীবনে চলেননি তিনি। গ্রামের একমাত্র ওষুধের দোকানটা ছিল তাওহীদের দাদাদেরই। হোমিওপ্যাথি ওষুধ। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোমিওপ্যাথির দোকান খুলে বসেন এখানে, ডাক্তারি নিজেই করতেন। এলাকার তাবত গরীব অভাবিদের বিনা পয়সায়ই চিকিৎসা করতেন। সেজন্যই হয়তো আল্লাহও তাকে দিয়েছিলেন। যতই তিনি দান করতেন ততই সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। কয়েক বছরের মাথায় পুরো এলাকায় জমিজমা করে ফেলেন, অদূরে একটা মাদ্রাসার জন্য জায়গা দেন, এলাকার জামে মসজিদের মাসিক তহবিলে টাকা দিতে থাকেন। আর স্ত্রীর জন্য বিশাল খোলামেলা এই বাড়িটা বানিয়ে দেন,বাড়ির সামনে বাগান করে দেন, বড় বারান্দা দেওয়া রান্নাঘর করে দেন। তিন ছেলেমেয়েদের সবাইকেই এই এলাকাতেই বিয়ে দেন। এতসব করেও দাদির এখানে মন বসেনি, তাওহীদের দাদা মারা যাওয়ার বছরখানেক পর গ্রামে ফিরে যান দাদি। তিনতলার এই ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই তাওহীদের ফুপুর বাসা দেখা যায়।

সময় নিয়ে কফিটা শেষ করে রুমে ফিরে কাজে মনোযোগ দিতে গিয়েও পারলো না তাওহীদ। শেষমেশ ফাইলপত্র গুছিয়ে শুয়ে পড়লো সে। এভাবে বিক্ষিপ্ত মনে কাজ করা সম্ভব নয়। সকাল আটটায় ল্যাবে যেতে হবে,ঘুমানো দরকার। খচখচ মনে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো তাওহীদ, কি যেন তার মনে পড়ছে না… চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মিষ্টির মুখটা, ওড়নার আচলে আঙুল পেচিয়ে গোল গোল চোখজোড়া ওর দিকে তাকিয়ে আবদার করছে, ‘আমাকে নদী দেখতে নিয়ে যাবেন?’

“শিট!!” ঝট করে বিছানায় উঠে বসলো তাওহীদ। মামার কাছে বকা খেয়ে মন খারাপ ছিল মেয়েটার। আজ অফিস ছিল না, তাই মিষ্টির মনটা ভালো করে দিতেই কথা দিয়েছিল ঘুরতে নিয়ে যাবে। তাওহীদের ক্লাস যখন শেষ হয় তখনও তার সেকথা মনে ছিলো। তারপর সে বেমালুম ভুলে গেলো কিভাবে?? সে নাহয় কোনো এক কারণে ভুলে গেছে। মিষ্টি একবার তাকে ফোন করেও বললো না! কেন??

বিছানা থেকে উঠে চার্জে দেওয়া ফোনটা হাতে নিলো। বাসায় ফিরে এসে গোসল সেড়ে ফোনটা চার্জে দিয়েছিল। ফোনটা আনলক করেই তব্দা খেতে হলো তাওহীদকে। এতো ওর ফোন নয়! ঐশির ফোন। রেডমি নোট এইট প্রো। গতবছর শুভ্রের সাথে একসাথে কিনেছিল তাওহীদ। তাওহীদের নিজের স্যালারিতে কেনা প্রথম ফোন, আর শুভ্রের জমানো টাকায় কেনা ঐশির সাথে রিলেশনশিপের পর প্রথম বার্থডে গিফট। সেইম ফোন, দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা কার ফোন। ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঐশির সাথে যখন ধাক্কা খেয়েছিল, তখনই নিশ্চয়ই ফোনগুলো অদলবদল হয়ে গেছে। মিষ্টি যদি কল দিয়েও থাকে সেটা তাওহীদ অবধি পৌঁছাতে পারেনি। তাওহীদের মনে হলো একবার সরি বলা উচিত ওর।

ফোনটা আনলক করে ডজনখানেক মিসড কল আর মেসেজ চোখে পড়লো। সেগুলো পেরিয়ে মিষ্টির নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার। দুইবার। তিনবার ডায়াল করেও ফোন ধরলো না মিষ্টি। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। ভাবলেও শেষ আরেকবার ডায়েল করতে প্রথম রিঙএই ফোনটা রিসিভ হলো।

তাওহীদ কিছু বলে ওঠার আগেই ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো চিকন গলার তীক্ষ্ণ শব্দবান ভেসে এলো,

“আরেবাবা কে আপনি! রাত দুইটার সময় আননোন একটা মানুষকে কন্টিনিউয়াসলি ফোন করে যাচ্ছেন! এত ইল ম্যানারড কেন আপনি? ফান করেও তো মানুষ এত রাতে ফোন করে না কাউকে। আপনি জানেন এত রাতে কত খারাপ খবর দেওয়ার জন্য মানুষ ফোন করে? মাঝ রাতে ফোন বেজে ওঠা কতটা ভয়ংকর একটা ব্যাপার আপনি জানেন? আমার মতো দূর্বল হার্টের মানুষ যদি আজ এই ফোনের শব্দে ঘুমের ঘোরে মরে যেতাম তাহলে তার দায়ভার কার হতো? আপনার! ”

তাওহীদ ঘড়িতে দেখলো দুইটা না, বারোটা বাজে সবে। সেটা বলতেও চাইলো। তার আগে মিষ্টি ওপাশ থেকে আবার ভাঙা ভাঙা গলায় চেচিয়ে উঠলো, “কথা বলছেন না কেন? হ্যালো? ফাইন, আমি রাখছি।” লাইনটা কেটে গেলো। ফোনটা রেখেই তাওহীদ বুকে ফুঁ দিলো।

মিষ্টি কি জেগে ছিল না সত্যিই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসব বললো? এতো মানুষ না, সাক্ষাৎ সিংহের বাচ্চা।

পরদিন ক্লাসের পর অফিস শেষে বাসায় ফিরতে রাত হল। রুমে ঢোকার আগে করিডোরেই মিষ্টির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। সারাদিনে আর মিষ্টির সাথে কথা হয়নি একদমই। তাওহীদকে দেখে কোনো ভাবোদয় হলো না মিষ্টির। এত রাগ এই মেয়েটার! তাওহীদ মাথা চুলকে একটা অপরাধী হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“রেগে আছো আমার ওপর?”

উত্তরে মিষ্টি স্মিত হাসলো। একটু বেশিই স্মিত।

“রাগ করবো কেন?” সিল্কি গলায় বললো।

মিষ্টিকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা যে সে ভুলে গিয়েছিল এটা শুনলে মিষ্টি আর কথাই বলবে না।

তাই বললো,

“কালকে অন্য একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিলাম মিষ্টি। যখন ফ্রি হলাম ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। তুমি খুব রেগে আছো তাই না?”

মিষ্টি হাত দু'খানা বুকের ওপর ভাজ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর উদাসীন গলায় হাতের নখগুলো পরখ করতে করতে বললো,

“রাগ করলেও বলবো না। আমি কাল সন্ধ্যার পর পর্যন্ত রেডি হয়ে বসেছিলাম কিন্তু সেটা আপনাকে বলবো না। আপনাকে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ত্রিশ বার কল দিয়েছিলাম, আপনি ধরেননি কেন সেটাও জিজ্ঞেস করবো না।”

তাওহীদ সশব্দে হেসে ফেললো।

“হ্যালো! আমি ফোন চেক করেছি আজকে। মাত্র তিনবার কল দিয়েছিলে তুমি! আর কখনো এমন হবে না।”

ঐশির সাথে সকালে কথা বলে আজ একঘন্টা আগে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে এসেছে।

তারপর মিষ্টির অনুকরণ করে যোগ করলো, “আমি কি সরি বলবো?”

“আমি রাগ টাগ করিনি।” একই উদাসীন ভঙ্গিতে বললো মিষ্টি। “আর রাগ করলেও ঘুমালে আমার রাগ চলে যায়। তবু আপনার সরি বলতে ইচ্ছে হলে আমি তো আর আটকাতে পারি না।”

তাওহীদের মনে পড়লো কাল ঘুমের মধ্যে কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল মিষ্টি। ওর কি মনে আছে? জিজ্ঞেস করতে চেয়েও চিন্তাটা বাদ দিলো।

“জাস্ট..” শান্ত গলায় বললো মিষ্টি, “আপনি ব্যস্ত থাকতেই পারেন, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। জাস্ট আমাকে বলে দিলে পারতেন।”

“আমি কাল ঐশির সাথে ছিলাম।” জানালো তাওহীদ।

ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েই ঐশির সাথে দেখা হয়েছিল কাল, প্রায় তিনমাস পর। প্রথমে দেখে তাওহীদ প্রায় না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে যেতে গিয়ে ঠিক ঐশির মুখোমুখিই হয়। ওকে অবাক করে দিয়ে ঐশিই প্রথম এগিয়ে এসে কথা বলে। এক কথা থেকে দুকথা, ডিপার্টমেন্ট থেকে পুকুরপাড় , চোখের পলকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে।

“তুমি যখন ফোন করো তার আগেই কোনো এক ফাঁকে সম্ভবত ওর সাথে আমার ফোন এক্সচেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল।”

ওর কথা শুনে মিষ্টি মুখ কালো করে মাথা ঝাকালো, হাসলো।

“এবার বুঝেছি।”

তাওহীদ বুঝলো মিষ্টি আর তেমন রেগে নেই। রেগে থাকলে নিশ্চয়ই এতো কথা বলতো না। তবু মিষ্টি পুরোপুরি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে না। মিষ্টি যখন কারো সাথে কথা বলে তখন তার চোখে চোখ রেখে, সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে ও বলে। কথোপকথনরত মানুষটার কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হতে বাধ্য যে সেই যেন মিষ্টির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। অন্তত তাওহীদের এমনটাই মনে হয়। সেখানে আজ মিষ্টির এমন অনুৎসাহী কথাবার্তায় যেন শান্তি পাচ্ছিল না সে।

মিষ্টির নরমাল টোন ফেরত আনার জন্যই যেন বলে উঠলো,

“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে কাল নিয়ে যাবো নদী দেখতে। প্রমিস।”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিষ্টির চোখজোড়া জ্বলে উঠলো। তারপর কেন যেন আবার ক্ষরিত হয়ে বললো,

“নাড়া একবারই বেলতলায় যায়। আপনি আবার বাইরে গিয়ে কাল আমার কথা ভুলে যাবেন।”

“কালকে আমি চাইলেও তোমার কথা ভুলতে পারবো না। কাল শুক্রবার।” বলে থামলো তাওহীদ।

শুক্রবার? শুক্রবার কেন সে বাইরে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছে? শুক্রবার বাইরে যাওয়া তাওহীদের জন্য কুফা। যত যাই হোক শুক্রবার বের না হওয়ার নিয়ম তাওহীদ নিজেই বানিয়েছিল, আর নিয়ম তো নিয়মই। এবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো মিষ্টি আগ্রহী হয়ে কিছু ভাবছে।

না বলে দে, ভেতরে ভেতরে ঝাকিয়ে তাওহীদের মনোযোগ কাড়ার সিগনাল পাঠালো মস্তিষ্কটা।

না, মনে মনে বললো তাওহীদ।

আমাকে না ইডিয়ট, মিষ্টিকে না বল!! আবার ভেতর থেকে বললো কেউ। তাওহীদ তাকে পাত্তা না দিয়ে মিষ্টির দিকে ফিরলো, বললো,

“সিরিয়াসলি, যাবে?”

মুখে বলার আগেই ওর নিরঁজন, নিখাদ, কপোলে ঢেউ খেলানো হাসিটা দেখে তাওহীদ বুঝে নিলো মিষ্টি যাবে।

“যাবো।”

চলবে

আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/groups/526513374820830?view=permalink&id=848171649321666&ref=m_notif&notif_t=feedback_reaction_generic

1
$ 0.02
$ 0.02 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments