একটু ভয়ের
রহস্য মানবি -৩
কানিজ ফাতেমা
রাহাত ঘরে গিয়ে নীসাকে ঘর থেকে জোরে জোরে নীসা নীসা বলে ডাকতে লাগল। আর তার গলার আওয়াজ শুনে নীসা তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসলো।
ঘরে আসতেই রাহাত খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, কি নীসা তুমি এই বুড়া মানুষটাকে নিয়ে কি শুরু করেছ? একা ছিলে তখনও তোমার ভয় করছিল এখন কত খুঁজে একটা মানুষ পাওয়া গেছে তাকে নিয়েও তোমার ভয় করছে কেন?
নীসা দরজার কাছে দাঁড়িয়েই ভয়ে কাপঁতে কাঁপতে বলল, রাহাত আমি বাড়ি যাবো- আমার এখানে ভালো লাগছে না।
এবার রাহাত একটু নরম হয়ে বলল, আচ্ছা এস তো, এখানে এসে বস- বলে উঠে এসে নীসার হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসল। এমন করছ কেন নীসা এখন বাড়ি যাবে কেন?
আমার তো আর দুই সপ্তাহ পরেই দেড় মাসের ট্রেনিং পড়েছে ঢাকায়, তখন তো আমরা এক সাথেই যাবে। আর তুমি না থাকলে আমার একা বাসায় ভালো লাগবে বলো?
আচ্ছা তুমি এমন করছ কেন নীসা- তোমার কি আমার সাথে থাকতে ভালো লাগছে না?
নীসা কোন কথা না বলে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল তুমি এই মহিনী বুড়িকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমার আর ভয় করছে বলব না।
আচ্ছা ঠিক আছে পাঠিয়ে দেব, এই তো মাত্র পনের দিন তারপর আমারা ঢাকায় যাওয়ার সময় তাকে বলে কয়ে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। বুড়া মানুষ হুট করে চলে যেতে বললে কি মনে করবে বলো তো?
আর তুমি এত বেশি চিন্তা ভাবনা করো না তো,সে জন্য হয়তো তোমার কাছে সবকিছু ওলট পালট লাগছে।
নীসা কাঁদতে কাঁদতে রাহাতকে আবার জেদ করে বলল, না তুমি আজই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে না হলে আমিই কাল ঢাকা চলে যাব।
রাহাত অনেক বুঝিয়েও তাকে শান্ত করতে পারল না। এদিকে রাতের খাবার সময় কোন ভাবেই নীসা খাবার টেবিলের কাছে গেল না তাই রাহাত ঘরেই তার জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলো কিন্তু তার কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেমন যেন দুর্বল লাগছে শরীরটা, তবুও জেদ করে বলতে লাগল কাল সকালেই মহিনী বুড়িকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।
রাহাত শেষমেশ তার কাছে নতী স্বীকার করতে বাধ্য হল । ঠিক আছে সকালেই পিয়ন হাবিবুল্লাহকে দিয়ে মহিনী বুড়িকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিব এবার একটু খেয়ে নেও।
না আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না- বলে শুয়ে পড়ল না খেয়েই।
রাহাত প্লেট গ্লাস ডাইনিং টেবিলে রাখতে ঘরের বাইরে এসে মহিনী বুড়িকে রান্না ঘরে সবকিছু গুছাতে দেখে ডেকে বলল, মহিনী বুড়ি তুমি না হয় কাল সকালে বাড়ি যাওয়। কিছুদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।
আর তোমার বুবুর শরীরও খারাপ তাই ভাবছি কদিন পরে ঢাকাতে নিয়ে যাব। আর তাছাড়া আমার ট্রেনিং শুরু হবে, আমাকেও যেতে হবে তাই কাল সকালে হাবিবুল্লাহর সাথে তোমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।
রাহাতের এক সাথে কথাগুলো বলতে দেখে মহিনী বুড়ির মুখটা কেবল ম্লান হয়ে গেল। ভাই, বুবু আমাক দেখি ভয় পাচ্ছে তাই তুমি আমাক চলি যাতে কচ্ছাও। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কিচ্ছু করি নি।
না না তেমন কিছু না, আমার ট্রেনিং আর তুমি একা এ বাসায় কি করে থাকবে- বলে রাহাত ঘুমাতে চলে গেল।
পরদিন শনিবার তাই রাহাতের অফিস ছুটি তেমন তাড়াহুড়ো নেই বাইরে যাবার। ঘুম থেকে উঠেই নীসার দিকে তাকাল সে, মেয়েটা এত ভয় পাচ্ছে কেন?
সারা রাত ঘুম আসেনি আবার রাহাত কেও ঘুমাতে দেয়নি। ভোর বেলা একটু ঘুমিয়েছে তাই রাহাত তাকে না ডেকে ঘর থেকে বাইরে এসে মহিনী বুড়িকে নাস্তা বানাতে দেখল। মহিনী বুড়ি আসার পর থেকে বাসার সব কাজ সে ই করে, বয়স বেশী হলেও এখনও বেশ শক্ত সামর্থ্য। তার কাজ করা দেখলে বোঝার উপায় নেই সে একজন বৃদ্ধা।
তাকে দরজা খুলে বের হতে দেখে মহিনী বুড়ি বলল, ভাই উঠিচাও নাস্তা সব টেবিলে দিয়ে রাখিছি খায়ে নেও আর বুবুর কি হয়ছে- খাবি না? কাল রাতেও তো খাইলো না ওরম করছে ক্যে?
কিছু হয়নি এমনিতেই ঘুমাচ্ছে।
দেখ ভাই একটা কথা কই কিছু মনে কইরি না, তোমার বৌয়ের মাথা টাথাা খারাপ নাকি- একবার ডাক্তার দেখা নিয়ে আইসো না হলে ওরম করে ক্যা সারাদিন? আমারই তো বুবুর পাগলামি দেখি কেমমা কেমমা যেন ঠেকে।
কি সব বল, মাথা খারাপ হতে যাবে কেন?
ভাই তুমি ভালো কথায় কইচাও বুবুকও না হয় বাপের বাড়ি পাঠায় দেও, কিছুদিন থাকি চিকিৎসা হয়ে আসুক।
রাহাত যত সম্ভব চুপচাপ খাচ্ছিল আর মহিনী বুড়ির কথা শুনছিল। হঠাৎ তার মনে হল হাবিবুল্লাকে রাতে ফোন করা হয়নি, এখন ফোন করে আসতে বলি। সে এসে মহিনী বুড়িকে সাথে করে নিয়ে যশোরে তার বাড়িতে রেখে আসুক।
হুম সেই ভালো- খেতে খেতে কথাগুলো ভেবে চেয়ার থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাতটা ধুতে ধুতে মহিনী বুড়িকে বলল, তোমার সব গুছানো হয়েছে? একটু পরই আমার অফিসের পিওন হাবিবুল্লাহ আসবে তোমাকে নিতে।
আমার আর গুছানোর কি আছে ভাই? দুই খান শাড়ি শুধু আর বুবু আসার পর তার কয়খান কাপড় দিছিলো আমার মিয়াডার জন্যি এই। আমি সারা দিনের রান্না সব করি রাখি দিছি তোমার আজ আর রান্না নিয়ে ভাবা লাগবিনানে।
তার সাথে কথা বলেই রাহাত হাবিবুল্লাকে ফোন করে সব কথা বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় আসতে বলল, তারপর ঘরে গিয়ে নীসার পাশে বসে তার মাথায় হাতবুলিয়ে দিয়ে নীসা বলে ডাকল।
নীসা রাহাতের কথা শুনেই ঘুম থেকে এক লাফে উঠে বসল। কি হয়েছে?
না কিছু হয়নি উঠো খাবে না?
না আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
কি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না- কাল রাতেও খাওনি শরীর খারাপ করবে, উঠো তো- বলে নীসার হাতটা ধরে টেনে ধরল। নীসার মাথাটা একেবারে ধরে আছে তবুও রাহাত হাত ধরে টানছে বিধায় সে উঠে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল।
মহিনী বুড়ি রান্না ঘরে গোছগাছ করছে দেখে নীসার মুহুর্তেই বুকের মধ্যে ধপাস্ করে উঠল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ টেবিলে বসে নাস্তা করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু গলাটা একেবারে শুকনা মনে হচ্ছে, তাই বারবার পানি খেতে লাগল।
রাহাত পাশের চেয়ারে বসে অসহায়ের মত বলল, এমন করছো কেন নীসা? আমাকে তো কাল থেকে অফিসে যেতে হবে তুমি এমন করলে আমার অফিসে গেলেও টেনশন হবে।
নীসা এবার চমকে উঠার মত করে বলল- তোমাকে কি আজ অফিসে যেতে হবে? আমি একা একা বাসায় থাকব?
আজ তো শনিবার ছুটি তোমার মন কোথায় থাকছে বলো তো?
না তুমি আর অফিসে যাবে না বাসায় থাকবে।
কি পাগলের মত কথা বলছ?
আচ্ছা রাহাত আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
না তুমি একেবারে সুস্থ, আচ্ছা এক কাজ করি বিকালে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। কি যাবে?
জানি না।
মার সাথে কথা বলবে?
না।
আচ্ছা আমার মা কে ফোন দেই- বলে রাহাত তার মাকে কল করল।
কেমন আছো মা। হ্যাঁ আমরা ভালো তারপর রাহাত তার মাকে আসতে বলে বলল, এই যে নীসার সাথে একটু কথা বলো তো- ওর কি রকম যেন লাগছে বলছে।
আস্ সালামুআলাইকুম মা। কেমন আছেন?
আমরা তো ভালো আছি মা, রাহাত বলল তোমার নাকি শরীর খারাপ লাগছে।
না মা ঠিক আছি আপনারা কবে আসবেন?
তোমরা তো শুনলাম ঢাকায় যাচ্ছ তাই এখন এসে আর কি করবো?
আর তোমরা ঢাকায় গেলে মহিনী বুড়িকে কি করবা?
আমি জানি না মা আপনার ছেলের সাথে কথা বলেন।
রাহাত ফোনটা ধরে তার মায়ের সাথে কথা বলে বলল, মা এক কাজ কর তুমি আব্বার সাথে কালই কয়েকদিনের জন্য বাগেরহাট চলে এসো। আর আজ হাবিবুল্লাহর সাথে মহিনীবুড়িও বাড়ি চলে যাবে। তাই তুমি আর আব্বা কদিন থেকে যাও। নীসার একটু কেমন ভয় ভয় করছে, আর কান্নাকাটি করছে- এদিকে আমারও অফিস, খুব ঝামেলা হচ্ছে।
বিয়াই বেয়াইনকে বলেছিস নীসার কথা।
না মা এখনও বলিনি, ভাবছি ট্রেনিংএ যখন যাবো তখন না হয় ও বাবার বাড়ি থেকে বেড়াই আসবে।
কি কাল আসতে পারবা?
আজ বললি কালই কি করে আসি দেখি। আর এক কাজ করতো বাবা- কোন এক দোয়া কালাম জানা কাউকে যদি ওখানে পাস তো নীসাকে একটু ফুঁ দেওয়াই নিস তো।
আমি ওসব পারবো না। তুমি আব্বাকে বলে আব্বার সাথে কালই বাগেরহাট চলে এসো।
সকালের নাস্তার ঘন্টা খানেক বাদে হাবিবুল্লাহ বাসায় আসলো, মহিনী বুড়িও তৈরী নীসা ঝিম ধরে বসার ঘরে সোফায় রাহাতের পাশে বসে রয়েছে। হাবিবুল্লাহ নীসাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, স্যার ম্যাডামের কি শরীর খারাপ?
একটু খারাপ, তুমি মহিনী বুড়িকে ঠিকমত যশোরে তার মেয়ের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরতি বাসে ফিরে আসবে।
মহিনীবুড়িও তৈরী হয়ে আসলো, রাহাত আর নীসার সামনে দাঁড়িয়ে খুব অসহায়ভাবে বলল, ভাই বুবু তোমরা আমার কোন কথায় কিছু মনে কইরি না। আমি গরিব মানুষ অত বুঝি টুঝি না, কি কতি কি কইছি।
আর ভাই তুমি বুবুক ডাক্তর দেখায়ো।
আচ্ছা তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি বলে রাহাত ঘর থেকে মানিব্যাগ আনতে গেল আর হাবিবুল্লাহ দরজার বাইরে বেড়িয়ে গেল।
এমন সময় মহিনী বুড়ি নীসার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হেসে উঠল তারপর চোখ লাল করে বলে উঠল- এই বুড়িকে বিদায় করলেই কি আমি এখান থেকে যাব ভেবেছিস! এই বাড়ি এই ঘর আমার, আমি কত বছর ধরে এখানে আছি।
তোরা কেন আমার বাড়িতে এসেছিস, আমার বাড়ি থেকে তুই আমাকে তাড়াতে চাস?
আমি মায়া বুঝলি আমি মায়া আমি এখানেই থাকবো এখানেই থাকবো - বলে চোখ লাল করে নীসার দিকে তাকিয়ে হলুদ উচুনিচু দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগল।
মহিনী বুড়ির চোখের দিকে তাকিয়ে নীসার মনে হচ্ছে চোখদুটি বোধ হয় এক্ষুনি বেড়িয়ে আসবে।
নীসা সোফায় বসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নির্বাক হয়ে মহিনী বুড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
এই বাড়ি মায়ার, বুঝলি মায়ার, কথাগুলো বলতে বলতেই মহিনী বুড়ি মেঝেতে ধপ্ করে বসে পড়ল।
মহিনী বুড়িকে পড়ে যেতে দেখে হাবিবুল্লাহ বাইরের সিঁড়ি থেকে দৌড়ে এসে বলল, কি কি ঠিক আছেন তো?
না ভাই কিছু হয়নি কো, ঠিক আছি। কেমমা জানি লাগলো মনে হইল হঠাৎ মাথাডা ঘুরি গেল। একটু অস্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বললো সে।
এদিকে নীসাকে কাঁপতে দেখে হাবিবুল্লাহ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, ম্যাডামের শরীর কি বেশী খারাপ?
এর মধ্যে রাহাত এসে টাকা বের করে হাবিবুল্লাহর হাতে ধরিয়ে দিল আর কিছু টাকা মহিনী বুড়ির হাতে দিয়ে বলল- সাবধানে যাও।
হাবিবুল্লাহ বলে উঠল, স্যার ম্যাডাম ঠিক আছে তো? আমার তো কেমন জানি একটু অন্য রকম লাগতেছে। আপনারা আবার এই বাসায় থাকেন? কেমন যেন সন্দেহ নিয়ে হাবিবুল্লাহ কথাটা বললো।
হুম ঠিক আছে চিন্তা করোনা।
আচ্ছা স্যার তাহলে এখন রওনা দেই , আসসালামুআলাই কুম বলে হাবিবুল্লাহ মহিনী বুড়িকে সাথে করে বেরিয়ে চলে গেল। রাহাত নীসাকে বলল, কি এবার ঠিক আছে তোমার ভয় কমেছে
নীসা কাঁপছে কোন উত্তর দিচ্ছে না। শুধু ভাবছে মহিনী বুড়ি এ কথা বলল কেন- সে অনেক বছর এ বাসায় আছে এ বাড়ি তার?
এটাতো সরকারি কোয়াটার আর মায়া কে? এই নামতো সে এখানে আসার পর কোনদিন শোনেনি। সে হুট করে রাহাতকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো-মায়া কে?
চলবে------
-----কানিজ ফাতেমা-----
(কাল্পনিক ঘটনা ও চরিত্র অবলম্বনে গল্পটি লেখা।)
https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/858210854984412/
পর্ব ১ ও ২ এর লিংক।