লেখাটা খারাপ লাগতে পারে, দয়া করে নিজের দায়িত্বে পড়ুন
#একজন_কোভিড_আক্রান্ত_ব্যাক্তির_ডাইরি
রাজকুমার মাহাতো
________________
২০ অক্টোবর,২০২০
আজ আমার ছোট্ট সোনাটাকে বাড়িতে রেখে একটু ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছিলাম। মা তো বছরে একবার আসে। তাও যদি এই রোগের ভয়ে তাকে না দেখি একটু আনন্দ না করি। তাহলে কি ভালো লাগে। বাচ্ছাটা নতুন জামা পড়ার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু ওকে নিয়ে বেড়োনোটা এখন একটু রিস্ক তাই ওকে রেখেই গেলাম ।আর বউ কাল থেকে মুখ ফুলিয়ে বসেছিল তাকে একদিন অন্তত প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতেই হবে। অগত্যা কি আর করা। আজ চতুর্থির দিনেই বেড়িয়ে পড়লাম শহরের অলি-গলি ঘুরে ঠাকুর দেখতে। ঘরে বুড়ো মা বাবাকে বলেছিলাম বেড়োতে কিন্তু ওনারা বেরোয় নি। আজই আবার হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে প্যান্ডেলের দশ মিটার গণ্ডির মধ্যে সাধারন মানুষ প্রবেশ করতে পারবে না। তবে দশ মিটার ছেড়ে যা ভিড় দেখলাম তাতে আদালতের রায়ে হাসি পেল।মহামান্য আদালত হয়ত চায়না সাধারণ মানুষের থেকে মা দূর্গার রোগ ছড়িয়ে পড়ুক। তাই মা দূর্গাকে বাঁচাতে তার এই পদক্ষেপ।যাই হোক দশ মিটার দূর থেকেই দেখে বেশি রাত না করে বাড়ি ফিরে আসলাম।এসে বাইরের বাথরুমে স্নান করে জামা-কাপড় ধুয়ে তবে ঘরে ঢুকে দেখলাম ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। দারুন কাটল আজকের দিনটা।
____________
২১ অক্টোবর,২০২০
সকালে উঠে দেখলাম মাথাটা একেবারে ধরে আছে। একেই ওয়েদার চেঞ্জ হচ্ছে কখনো ঠান্ডা কখনো গরম আর তার ওপর রাতে আবার বেশ করে সাবান মেখে স্নান করার ফলাফল এটা। গিন্নিকেও দেখলাম বেশ ভালোই ফোঁসফোঁস করছে। সকালে ব্রেকফাস্ট করে ছেলেকে একটু আদর করে মা বাবাকে পায়ে নমস্কার করে অফিসে বেড়িয়ে গেলাম। আজকেই লাস্ট অফিস তাই যেতেই হল।অফিসে গিয়ে কাজ করে সবার সাথে ভালোই কথাবার্তা বলছিলাম কিন্তু দুপুরের পর থেকে সর্দি আর কাশি শুরু হল। বস বলল “বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিতে।“ সবাইকে পুজোর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। গা-হাত-পা ম্যাচ ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে। মনে একটু ভয় ভয় ও লাগছিল।ভাবলাম নিজেকে আইসোলেট করে রাখব। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আর আইসোলেট কি হবে। একবার মা এসে দরজা খুলছে তো একবার বাবা এসে দরজা খুলছে।আর ছেলেতো বাবা বাবা করে পাগল। আসলে এগুলো ওয়েদার ফিভার। এত মাথাব্যাথার কিছু নেই এগুলো নিয়ে। সব ঠিক আছে। করোনাকে ভয় পেলে হবেনা। করোনা যেন আমাকে ভয় পায়। একটা অদেখা ভাইরাস কি আর করবে।
______________
২২ অক্টোবর,২০২০
রাতে ভীষন জ্বর এসেছিল। মেপে দেখেছিল গিন্নি ১০২…তারপর কাশিটাও বেশ ভালই পরিমানে শুরু হয়েছে। নিজেকে ঘরে বন্দি রেখেছি। একেবারে লক করেছি। দুপুরের খাবারটা গিন্নি জানালা দিয়ে দিয়েছে । শরীরে একটা অজানা যন্ত্রনা ঘিরে ধরেছে আর তার সাথে খামোকা একটা ভয়। মায়েরও দেখালাম সকাল থেকে কাশি শুরু হয়েছে। ছেলেটা এখনও ঠিক আছে। ভগবান, মা দূর্গা ওর যেন না কিছু হয়।
এখন রাত ১ টা………সন্ধ্যের দিকে একটু শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। একটা বন্ধুকে ডাকলাম সে সব শুনে ফোনটা কেটে দিল। তারপর থেকেই সুইচ অফ তার ফোন। আমার এতে এক্টুকুও রাগ হয়নি। কারণ সে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখতেই এই পদক্ষেপ নিল। বাহবা দেওয়া উচিৎ তাকে।আমি নিজেই এম্বুলেন্সে ফোন করেছিলাম। তারা পি.পি.ই কিট পড়ে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হল। শহরের পাচটা বড় হাসপাতাল ও সরকারি হাসপাতাল গুলো ঘুরেও বেড পেলাম না। সবাই ফিরিয়ে দিল। বেসরকারি হাসপাতাল গুলো যদিও বলল “বেড নেই স্যার।বাড়িতে চিকিৎসা করান।“ সরকারী হাসপাতাল গুলো গেট না খুলেই ফিরিয়ে দিল। ল্যাবে টেস্টের জন্য স্যাম্পেল দিয়ে আর প্রাথমিক একটা চিকিতসকের পরামর্শে অক্সিজেন নেওয়ার যন্ত্র কিনে বাড়ি ফিরলাম। এসে শুনলাম ছেলের কাশি শুরু হয়েছে। এখন কোরোনা কে একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করেছে। জয় মা দুর্গা সব ঠিক করে দিও মা।
___________
২৪ অক্টোবর,২০২০
গতকাল লেখার সময় পাইনি একদম। রিপোর্টে করোনা পজিটিভ এসেছে আমার এবং আমার পরিবারের। তাই স্থানীয় বিধায়য়েক হাতে পায়ে ধরে আমি একটা সরকারী হাসপাতালে বেড পেয়েছি।ছেলেকে আর গিন্নিকে দিয়েছি একটা বেসরকারি হাসপাতালে আর মা বাবা আছেন অন্য একটা সরকারি হাসপাতালে। সকালে বাবাকে ফোন করেছিলাম। কথা বলতে পারল না। খুব হাঁপাচ্ছে শুনলাম। গিন্নিকে ফোন করতে বলল “ছেলে আর ও প্রায় ঠিক আছে।“ ডাক্তারদের অনুরোধ করে ডাইরিটা সঙ্গে রেখেছি। আজ অষ্টমী, মায়ের পায়ে পুস্পাঞ্জলি দেওয়া তো দূর একবার মায়ের মুখটাও দেখা হলনা। মাগো মা দুর্গা আমার পরিবারটাকে বাঁচিও মা। এ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করো মা আমায়। বলতে ভুলে গেছি, আমার অফিসের দুটো কলিগ ও তার পরিবারও করোনা পজিটিভ। বুঝতে পারছি না আমার থেকে ওদের হল না ওদের থেকে আমার। সে যাই হোক, সবাই যেন ঠিক থাকে মাগো।
_____________
২৫ অক্টোবর,২০২০
বুকে একরাশ কষ্ট নিয়ে আজ ডাইরিটা লিখতে বসলাম। না, লেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার কাছে আজ। দুপুরের দিকে ফোন এসেছিল মা আর নেই। সকাল ১১ টা নাগাদ করোনা তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে।আমি একবারও দেখতে পেলাম না।আমার মা’টা চলে গেল আমার জন্য। যদি সেদিন না বেরোতাম হয়ত এই দিনটা আজ আমায় দেখতে হতনা। ছেলে আর গিন্নিকে ফোন করতেও ভয় লাগছে। কি যে করব। মা দুর্গা তুমি ওদের বাঁচাও মা।আমাকে নিয়ে নাও কিন্তু ওদের ঠিক রেখো মাগো।
ভোর তিনটে বাজে ঘড়িতে……
গিন্নি ফোন করেছিল। প্রথমে ক্ষমা চাইল। বলল যদি সে মুখ ভার করে না থাকত আমি হয়ত বেরোতাম না । আর এই দিনটা আজ দেখতে হতনা। তারপর বলল “বাবা আর নেই, একটা পাঁচ নাগাদ করোনা তাকে হারিয়ে দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।“ আমি কেবল শুয়ে শুয়ে ডাইরি লিখছি। আর কোন উপায় নেই আমার। নিজেকে পাথর করে ফেলেছি। চেঁচিয়ে বলছি করোনাকে “করোনা আমি তোমাকে খুব ভয় পেয়েছি,আমার পরিবারকে রেহাই দাও।ক্ষমা করো আমায় করোনা আমায় ক্ষমা করো।“ ভগবানের কাছে আর চাওয়ার কিছু নেই। তিনি যেভাবে কাড়তে শুরু করেছেন আমাকে নিঃস্ব না করে শুনবেন বলে মনে হয়না।
______________
২৬ অক্টোবর,২০২০
আজ আমার আর লেখার কিছু নেই। বিজয়া দশমীর সাথে সাথে আজ আমার পুরো পরিবারটার দশমী হল। হ্যাঁ একদম ঠিক লিখছি। করোনা আমাকে হারাতে পারেনি। কিন্তু আমার গোটা পরিবারটাকে হারিয়ে দিল। কাল ভোররাতে আমার ছেলেটাও চলে গেল। বউটা শুনলাম ধুক-ধুক করছে। জানি, ছেলে চলে যাওয়াতে ওর অর্ধেকের বেশি অংশ মারা গেছে। এখন খালি ওর যাওয়ার অপেক্ষা। চেঁচিয়ে বলছি আমি ডাইরির পাতায় অনবরত লিখছি “করোনা তোমাকে আমি ভয় পাইনা, একেবারে ভয় পাইনা। কি করবে তুমি আমার। হেরে গেছ তুমি,হেরে গেছ। এস আমাকে নিয়ে যাও। আমি তৈরি তোমাকে আর ভয় পাইনা আমি। এসো নিয়ে যাও।“ এবার শুধু অপেক্ষা কখন করোনা আমাকে এসে নিয়ে যায়। মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার কাছে। আমার সব শেষ হয়ে গেল। নিজের হাতেই সব শেষ করলাম আমি। হয়ত কাল থেকে আর ডাইরি লিখব না। আমাকে কেঊ মনে রেখোনা। খালি হাত জোড় করে অনুরোধ। নিজেকে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে “করোনাকে ভয় পাও।“আসি তাহলে। সবাই ভালো থাকবে।
_____________
__________________
_________________________
২৯ অক্টোবর,২০২০
হ্যাঁ, ডাইরি লিখব না বলেছিলাম। কিন্তু করোনা সত্যি আমাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। আমি বেঁচে আছি। করোনার সাথে চ্যালেঞ্জটায় বাইরে থেকে দেখলে আমি জীতে গেছি, কিন্তু আমার মন জানে করোনা আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। আমার সর্বস্য কেড়ে আমাকে একা করে চলে গেছে। বাড়ি ফিরে এলাম আজ। আমার বাবার বসার টেবিলে ধূলোর একটা আস্তরন জমে গেছে। মায়ের সদ্য পড়া শাড়ীটা আজ ঘরের ভিতরের একতা দড়িতে ঝুলছে। গিন্নির রান্নার তেলের কৌটোটা উলটে বেশ অনেকখানি তেল মেঝেতে পড়ে তাতে লাল পিঁপড়ে ধরেছে। ছেলের ছোটা ভীম পুতুলটাকে ঘুম পাড়ানো বিছানার এক কোনে। আর আমি একা পড়ে আছি এদের এই সব স্মৃতি দেখব বলে।
বেশ কিছুক্ষন পড় আবার লিখছি। সিলিং ফ্যানের সাথে গিন্নির চুড়িদারের একটা ওড়না আটকে রেখে ফাঁস দিয়ে রেখেছি। ডাইরির এই পাতাটা শেষ করে ঝুলে পড়ব বলে। করোনাকে বলতে চাই “করোনা তুমি জীততে পারনি আমার থেকে। আমি আমার পরিবারের কাছে যাচ্ছি। ওরা সবাই আমার অপেক্ষা করছে। “ আর আপনাদের বলতে চাই “ আপনি বীর পুরুষ আমি জানি। করোনার সাথে চ্যালেঞ্জে কেবল একরাশ না পাওয়া জুটবে কপালে। তাই বীরত্বটা নিজের পরিবারকে সুস্থ রেখে দেখান। “আসি তাহলে। বিদায় বন্ধু। আবার আসব ফিরে।