বিসিএস! বিসিএস! বিসিএস! বর্তমানে চারিদিকে শুধু BCS CRAZE। বিসিএস যেন এখন আর option নয় বরং passion বা obsession হয়ে গেছে। সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণটি যেন এখন হীরার বা প্লাটিনামের হরিণ হয়ে গেছে! তাই না? এই হরিণটিকে খাঁচায় বন্দী করার অদম্য ইচ্ছা আজ তরূণ প্রজন্মের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। নবীনদের সবার তাই অতি পরিচিত প্রশ্ন: কখন থেকে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিব? পাস করার আগে না ছাত্রাবস্থাতেই? আমার অভিজ্ঞতার আলোকে উত্তর দেবার জন্য এই লেখা। আশা করি নবীনরা কিছুটা হলেও দিক নির্দেশনা পাবেন। আর দিকভ্রান্ত হয়ে পথ খুঁজে না পাওয়া কারও জন্য এটি হতে পারে অন্ধকারের শুকতারা। চলুন শুরু করি।
প্রথমেই আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন; আজ আপনি ক্যাডার হবার স্বপ্নে বিভোর, মরিয়া আপনি কি নিশ্চিত এই আকাঙ্ক্ষাটি কাল বা আগামী ৪-৫ বছর পর আপনার মাঝে এত তীব্রভাবে বিদ্যমান থাকবে? আপনি হয়ত অনার্স বা মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর সুপার পাওয়ার আমেরিকায় স্বপ্নের ঠিকানা গড়তে চাইবেন অথবা উদ্যোক্তা হতে চাইবেন। এভাবে ভেবে দেখেছেন কি? বিষয়টা কিন্তু মোটেই হেলাফেলার নয়। তাই এমনভাবে ক্যারিয়ার প্ল্যান করতে হবে তা যেন হয় ফিউচারপ্রুফ আর আপনি হয়ে ওঠেন বিশ্বনাগরিক –বিশ্বের যেকোন প্রান্তে যেন আপনার কাজের, মেধার মূল্যায়ন হবার সুযোগের দরজা ২৪*৭*৩৬৬ খোলা থাকে। একবার ভেবে দেখুন তো ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির বেতন স্কেল বৃদ্ধি না পেলে কি আজ তরুণ প্রজন্ম বিসিএস এর জন্য এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত? উত্তরটা আপনিই ভাল জানেন। আপনার প্রথম বর্ষের প্ল্যান আর শেষ বর্ষের প্ল্যান কিন্তু ভিন্ন হতেই পারে বয়স আর অভিজ্ঞতার তারতম্যের কারণে। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যে ছেলে ব্যবসা করার ব্যাপারে মনস্থির করল, ভার্সিটি শেষে সে হয়ত হয়ে গেছে একদম পাক্কা চাকরিজীবী। আপনার আশেপাশে তাকালেই এরকম উদাহরণ হয়ত দেখতে পাবেন। তাই ভাবিয়া কাজ করিতে হইবে, করিয়া ভাবিলে হইবে না। আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি; না কি আরও কনফিউজড করে দিলাম?
আপনি যদি এখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা শেষ বর্ষের ছাত্র হন, আপনার জন্য অঢেল সময় পড়ে আছে জীবনে কিছু করার জন্য। আপনি বিসিএস টার্গেট করলেও অঢেল সময় বা টার্গেট না করলেও অঢেল সময় আছে আপনার হাতে। প্রথম বর্ষ থেকে পড়া শুরু করে স্বেচ্ছায় বিসিএস এর জন্য সিজিপিএ বিসর্জন কেন দিবেন? কাল যে আপনি ক্যাডার হবেন তার নিশ্চয়তা আপনাকে কে দিল? কোন গ্যারান্টি/ওয়ারেন্টি আছে? দুই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে দুই হাজার ক্যাডার হলে আপনার সম্ভাবনা মাত্র ১%। হুম, এখন তো নন ক্যাডারেও প্রচুর নিয়োগ হয় কিন্তু সেটা পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার। যদি ভাবেন আসল পরীক্ষার্থী মানে সিরিয়াস পরীক্ষার্থী এত বেশি না তাহলেও কিন্তু সম্ভাব্যতার মান খুব বেশি বৃদ্ধি পায় না। ৫০ হাজার সিরিয়াস পরীক্ষার্থী ধরলে আর ক্যাডার, নন ক্যাডার মিলিয়ে ৫ হাজার ধরলেও তবুও সেটা ১০% এর বেশি হচ্ছে না। বুঝতে পারছেন আপনি কোথায় যুদ্ধ করতে নামছেন? কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছেন? মনোযোগ দিয়ে শুনুন, কাল হয়ত আপনি বিসিএস এর নাম শুনলেই বিরক্ত হতে পারেন বা অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারেন। যদি সরকারি চাকরির সুবিধা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আর বৃদ্ধি না পায় বা প্রাইভেট সেক্টর আরও দৃঢ় হয়? তখন কী করবেন? সব সময় মনে রাখবেন, বিসিএস এর জৌলুস কিন্তু এখনকার মত আগে ছিল না। তাই সম্ভাবনার সব কটা জানালা, দরজা খুলে দিতে হবে—বিসিএস, পিএইচ ডি, উদ্যোক্তা, প্রাইভেট চাকরি যা আছে সব।
ভালভাবে শুনুন, বিসিএস বারবার দিতে পারবেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রেজাল্ট শুধরানোর সুযোগ কি সেভাবে পাবেন? তাই স্বেচ্ছায় সিজিপিএ বিসর্জন দেবার কোন যুক্তি নেই। সিজিপিএ ভাল থাকলে আপনার জন্য বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে কিছু করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। তখন সারা বিশ্ব হবে আপনার কাছে উম্মুক্ত। আর রেজাল্ট খারাপ হলে আপনার কোন চয়েজই থাকবে না। পরিস্থিতিই আপনাকে বাধ্য করবে সিদ্ধান্ত নিতে। সুশান্ত পালের সিজিপিএ কম তার মানে এই নয় যে বেশি সিজিপিএ পেলে বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার হবার চান্স কমে যাবে। চাকরির বাজারে সিজিপিএ মূল্যহীন কথাটা মোটেই ঠিক নয়। সহজভাবে চিন্তা করুন আপনি ২.৮ পেয়েছেন আর আপনার প্রতিদ্বন্দী পেয়েছেন ৩.৮। কাকে আপনাকে বেশি যোগ্য মনে হবে ভাইভা বোর্ডে? হ্যাঁ, রিটেনে আপনি তার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে পারেন। তিনিও কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে পারেন। বুঝেছেন? তাই স্বেচ্ছায় সিজিপিএ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। তবে রেজাল্ট যদি খারাপ হয়েই যায় তাহলেও সরকারি চাকরি পাওয়া যায় এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। জেনেবুঝে কেন খারাপটা নিবেন যখন ভালটা পাবার মেধা, সময়, সুযোগ সবই আছে আপনার মুষ্টির মধ্যে।
প্রতিবছর বিসিএস এর রেজাল্ট বের হবার পর কম সিজিপিএধারীদেরও সফলতা দেখা যায়। তিনি পেরেছেন তাই বলে আপনি পারবেন এমন কোন নিশ্চয়তা আছে কি? তাহলে তো আমি এক ধাপ এগিয়ে বলব গ্রাজুয়েশনেরই দরকার নাই আর যুক্তি হিসেবে বিল গেটস, জুকারবার্গ এদের নাম বলব। তারা জীবনেও কখনো বলেন নি গ্রাজুয়েশন কর না, টাইম নষ্ট, প্রতিভা থাকলে মূল্যায়ন হবেই, তুমিই হবে নেক্সট জুকারবার্গ, তোমাকেই খুঁজছে ট্রাম্প। হার্ভার্ড ড্রপ আউট আর ছাগলচিপা কলেজ ড্রপ আউট এক নারে ভাই। তাই আবারও বলছি একাডেমিক পড়ার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিন। বিল গেটসের কোম্পানিতে যারা বড় বড় পদে আছেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাটাও একবার দেখে আসুন। শুধু এক চোখ দিয়ে মালিক, চেয়ারম্যানের যোগ্যতা দেখলে হবে না। Exception কে example হিসেবে ধরে সেই আনুযায়ী জীবন বাজি ধরার রিস্ক নেওয়াটা চরম নির্বুদ্ধতা ছাড়া আর কিছু না।
আরে ভাই, “আপনি খুব বেশি বুঝেন। যত আগে শুরু করব, ক্যাডার হবার সম্ভাবনা তত বেশি। বুঝেছেন? আপনি আপনার প্যাঁচাল বন্ধ করেন।’’ আসলেই কি তাই? আপনার মনে হয় যত আগে শুরু করবেন তত এগিয়ে থাকবেন? মোটেও না। তাহলে ৫-৬ বার কেউ প্রিলি ফেল করত না আর কেউ প্রথম বিসিএস পরীক্ষাতেই টপ ক্লাস চাকরি পেত না। কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলি। বাংলাতে একটা প্রবাদ আছে, যার হয় না নয়েতে, তার হয় না নব্বইয়ে। যিনি পারবেন, তিনি শুরুর দিকেই তার সফলতার প্রমাণ রাখতে পারবেন। আপনার কি মনে হয় সারাদিন প্র্যাকটিস করলে আমি-আপনি মেসি, রোনালদো, ম্যারাডোনা বা পেলে হয়ে যাব? তারা কি ২৪ ঘণ্টাই প্রাকটিস করেন? তাদের চেয়ে বেশি কি কেউ প্র্যাকটিস করেন না? সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটা জিনিস আছে সেটার জোরেই সফলরা আজ সফলতার আসনে আসীন। শুধু আগে শুরু করলে বা বেশি প্র্যাকটিস করলেই হবে না। অবশ্যই আপনাকে তাদের মত বিরল প্রতিভাবান হতে হবে না। আপনার ব্যাসিক ক্লিয়ার থাকতে হবে, স্ট্র্যাটেজি ঠিক থাকতে হবে, গাইডলাইন ঠিক হতে হবে, পরিশ্রমী হতে হবে, ধৈর্য লাগবে এবং সর্বোপরি ভাগ্যের সাহায্য তো লাগবেই। তবে শুধু ভাগ্যের উপর ভরসা করা আর ভাগ্যকে দোষারোপ করা যাবে না। আবারও বলছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করুন পড়ালেখা, সৃজনশীলতা, খেলাধূলা ইত্যাদি ইত্যাদি কাজে।
তবে একটা কথা আমি বলতে চাই যদি আপনার পড়ালেখার চাপ খুব কম থাকে, সব কিছু করেও আপনার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে, তাহলে বলব আপনি শুধু ম্যাথ আর ইংলিশ পড়ুন আর দেশ বিদেশের খবর রাখুন, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করুন। শুধু এই দুই বিষয় পড়ুন আর কিচ্ছু না। প্লিজ আর কিচ্ছু না। আবারও বলছি আর কিচ্ছু না। বিসিএস হোক বা না হোক আপনার কোন লস হবে না। ইংলিশ স্পোকেন, ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং এবং অনুবাদ প্র্যাকটিস করুন। ইংলিশ বলতে, লিখতে যত উন্নতি করতে পারবেন, ততই লাভ। ইংলিশের জন্য বিসিএস এর সিলেবাস ধরে পড়তে হবে না; যা পড়বেন তা ইতোমধ্যে বিসিএস এর সিলেবাসেই আছে। ইংলিশের ব্যাসিকে সমস্যা থাকলে তা মজবুত করার জন্য পিসি দাসের বইটা পড়তে পারেন, Anglo-Bangla ভার্সন অবশ্যই। মনে রাখবেন, বিসিএস মূলত ব্যাসিকের খেলা। যার ব্যাসিক যত মজবুত, তার কষ্ট তত কম হবে, সময়ও লাগবে কম। ব্যাসিক ক্লিয়ারের জন্য tense, voice, article ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়ুন। বেশি গভীরে পড়তে হবে না কারণ আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না সরকারি চাকরি পাবার জন্য। যেমন tense এর জন্য ১২ ধরনের টেন্স না পড়ে শুধু ৭-৮ টা ধরন ভালভাবে বুঝলেই আপনার ব্যাসিক ক্লিয়ার হয়ে যাবে। একইভাবে narration এর জন্য বেশী গভীরে যেতে হবে না। খুশির কথা বিসিএস সিলেবাসে narration নেই তবে প্রশ্ন যে এখান থেকে হবে না তার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। আর আপনার বিসিএস হবে সেটাও কিন্তু নিশ্চিত নয়। আপনি তো এনএসআই, দুদক, ডিজিএফআই ইত্যাদি টপ ক্লাস স্থানেও চাকরিও পেতে পারেন। স্পোকেন ইংলিশের জন্য বিবিসি জানালার ভিডিও বা বই দেখতে পারেন। ব্যাসিক ক্লিয়ার হবে, ভালও লাগবে। আর ইউটিউবে ইংরেজি শেখার অজস্র চ্যানেল তো আছেই। অনুবাদের জন্য প্রথম আলোর সম্পাদকীয় প্রতিদিন অন্তত ৫টি বাক্য অনুবাদ করুন। পত্রিকাটির ইংরেজি ভার্সন (এখন সাধারণত বিকালের দিকে ইংরেজির আর্টিকেলগুলো পাওয়া যায়) দেখে আপনার অনুবাদ যাচাই করুন, শাণিত করুন এবং প্রাঞ্জল করুন।
ব্যাসিকে সমস্যা না থাকলে ম্যাথের জন্য সরাসরি আগারওয়ালের Quantitative Aptitude বইটি দেখতে পারেন। আর ব্যাসিকের জন্য খাইরুল’স ব্যাসিক ম্যাথ দেখতে পারেন। খাইরুল’স এডভান্সড ম্যাথও দেখতে পারেন যদি আগারওয়াল কঠিন মনে হয়। আর একটা কাজ করতে হবে সেটা হচ্ছে নবম-দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত বইটা ভালভাবে শেষ করুন। আপাতত উচ্চতর গণিত দেখার দরকার নেই। সবই যদি আগে পড়ে ফেলেন তাহলে পরে পড়বেন কী? কিছু কাজ বাকি রাখুন প্লিজ। এভাবে ধীর ধীরে অবসর সময়ে নিজের ম্যাথ এবং ইংলিশের দক্ষতাকে আরও শাণিত করুন।
আর কথা বাড়াচ্ছি না। আশা করি বোঝাতে পেরেছি। না পারলে সরি; আপনার সময় নষ্ট করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধূলা করার জীবন, দৌড়-ঝাঁপ করার জীবন, ঘোরাঘুরি করার জীবন, সৃজনশীলতার শিখরে পৌছানোর জীবন। এক কথায়–না থেমে চলার জীবন। আপনাকে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিসিএস এর পিছে দিগভ্রান্তের মত ছুটতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শুধু পাগলের মত জব সলুশন পড়ার জন্য নয়, হে নবীন।
যেটাই করুন, আপনার জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।
লেখকঃ শাহেদ হোসাইন
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (কাস্টমস এন্ড ভ্যাট), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR), (সুপারিশপ্রাপ্ত, ৩৭তম বিসিএস নন ক্যাডার)
৩৭, ৩৮, ৪০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কৃতকার্য এবং আপনাদের সহযোদ্ধা (৪১তম বিসিএস)