ঈদী(আমি কান পেতে রই, দ্বিতীয় পর্ব)

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

সব গল্পের দুটো দিক থাকে।গতকাল আমি' কান পেতে রই' গল্পটি পড়ে যারা মিতুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছিলেন, তারা আজকে ছেলেটির দিকটা জানতে পারবেন। বরাবরের মতোই রিপোস্ট হাইলাইট করে দিয়েছি, সুতরাং অতীতে পড়ে থাকলে এড়িয়ে যাবেন।আর যারা মনে করেন আমি খালি দুঃখের গল্প লিখতে পারি, তারা গল্পটি পড়ে আমার সম্বন্ধে মতামত বদলাবেন বলে আমার ধারণা। কালকে শেষ পর্ব পাবেন। প্রথম পর্ব না পড়ে থাকলে উপরের সার্চ ইঞ্জিনে' আমি কান পেতে রই' লিখে সার্চ দিবেন।

আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!

রিপোস্ট

ছোট গল্প

শাহাদুল চৌধুরী

ইংরেজীতে একটা কথা আছে "মর্নিং শোজ দ্য ডে।"সারা দিন কেমন যাবে তা কিন্তু সকালবেলায়ই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। প্রায় চার বছর পর দেশে ফিরছে রাজিব। সবকিছু ঠিক ঠাক মতোই চলছিলো। হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যের এই শহরটিতে এসেই বিপত্তি ঘটলো। প্লেন ডিলে করল। এমনিতে রাজিব বেশ ধৈর্যশীল। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে, প্লেন এশিয়ায় ঢুকবার পর পর তার মনের মধ্যে ভীষন এক আলোড়ন শুরু হয় দেশের মাটির জন্য। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা গেলেই দেশ। দেশমা তার নিজস্ব ভাষায় সন্তানদের ডাকে। যারা কখনো বিদেশে যান নাই, তারা ভাবতেই পারবেন না কি তীব্র সেই ডাক।

সে যখন মাস্কোট এয়ার পোর্টের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল, তখনই সে দুঃসংবাদ টা শুনতে পেল । গালফ এয়ারের ঢাকাগামী ফ্লাইটটি উড্ডয়নে দেরী হবে। যে সময় এর কথা বলছি তখন গাল্ফ এয়ার বলে একটি এয়ারলাইন ছিল। সময়টা ২০০০ সন, জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। নতুন শতাব্দী এবং সহস্রাব্দের শুরু হয়েছে মাত্র। রমজান মাসের শেষ দিন তখন মাত্র শুরু হচ্ছে বাংলাদেশে। সেদিনটা পেরোলেই শতাব্দীর প্রথম ঈদ।

যদিও তার দেহটি পড়েছিল একটি বিদেশি এয়ারপোর্টে, তবে মনে মনে সে তখন পৌঁছে গেছে তার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশে। মনোজগতের এই অদ্ভুত আনন্দময় পরিস্থিতিতে এই বিপত্তিকর ঘোষণা তাকে এলোমেলো করে দিল। সে কান খাড়া করে যা শুনতে পেল তা হচ্ছে, গালফ এয়ার আকস্মিক এই সমস্যার জন্য দুঃখিত, তারা পার্শ্ববর্তী রেস্টুরেন্টে সকল যাত্রীকে হালকা নাস্তা খাবার জন্য আমন্ত্রণ করেছে।

সে প্রায় এক যুগের উপর আমেরিকায় থাকে।পাশ্চাত্যের দেশগুলোর নিয়ম হলো আপনি যখন কাউকে নাস্তা খেতে ডাকবেন, নরম পানীয় তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আর তাই হালকা নাস্তা হিসেবে দেয়া দুটি সামুচা খেয়ে তার যখন পিপাসা লাগলো, তখন আশেপাশে পানির সন্ধানে তাকিয়ে সে দেখল পার্শ্ববর্তী সালাদ বারে বরফ কুচির ভিতরে বেশ কিছু পানি উল্টো করে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোর একটা হাতে তুলে নিতেই দেখল বেশ কিছু কর্মচারী আরবি ভাষায় আউখা খাউখা বলতে বলতে তার দিকে ছুটে আসছে। তাদের আসার ভঙ্গি তার কাছে ভাল লাগলো না। তারা খুব সম্ভবত ভেবেছে সে এই পানিটা চুরি করছে।সে স্পষ্ট তার মনশ্চক্ষে দেখতে পারলো আগামী জুমার নামাজের দিন এই চুরির অপরাধে তার হাত কাটা হচ্ছে। সে বেশ ঘাবড়ে গেল। তাকে তারা ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা সব নবীজিকে যে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছেন তার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগটাকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন । সামান্য শিক্ষার আলো যে সেখানে পৌঁছায় নি তা বলা যাবে না। ম্যানেজার ভদ্রলোককে বেশ শিক্ষিত মনে হল। রাজিব তার পানি নেবার ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলার পর, তিনি বললেন "নো ব্রবলেম।" সে যে এত সহজে ছাড়া পাবে তা সে ভাবতেই পারেনি। সে নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও তখনো সে জানেনা তার সমস্যার মাত্র শুরু। সে বিক্রমপুরের ছেলে। বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে,"হপাই শুরু!"তার দুর্ভাগ্যেরও তখন সবে শুরু !

রাজীবকে বহনকারী গালফ এয়ার টির চাকা যখন ঢাকার রানওয়ের মাটি স্পর্শ করছিল,তখন চারদিকে আলো করে সবে মাত্র ভোর হচ্ছে এই তিলোত্তমা নগরীটিতে। বসে থাকতে থাকতে তার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। প্লেনের চাকা মাটি স্পর্শ করা মাত্র যে প্রচন্ড ঝাঁকুনির সৃষ্টি হল,তাতে তার তন্দ্রা ভাব উবে গিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হল।নিজের সেই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রন করে সে যখন এয়ারপোর্টের লম্বা করিডোর পেরিয়ে ইমিগ্রেশন এর সামনে পৌঁছালো, তখন সত্যি সত্যি ভোর হয়ে গেছে।

ইমিগ্রেশন এর ঝামেলা শেষ করে সে যখন ব্যাগেজ ক্লেইম এরিয়ায় পৌঁছাল তখন ঘড়িতে বাজে সাতটা।বাইরে তাকে নিতে আসা আত্মীয়-স্বজনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার বেরিয়ে আসবার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সে তার দুটো লাগেজ এর একটি লাগেজ পেল।অন্যটি কেন পাওয়া যাচ্ছে না তার কারণ অনুসন্ধান করতে যেয়ে সে যে তথ্য আবিষ্কার করল ,তা তাকে ভাবিত করে তুলল। কাল ঈদ হবার কারণে আজ একসঙ্গে ৬টি বোয়িং নেমেছে। যাত্রী সংখ্যা প্রায় বারোশো। এদের সাথে আড়াইহাজার লাগেজ। এত লাগেজ কার্গো থেকে নামানোর মত যথেষ্ট লোকবল কর্তৃপক্ষের নেই। সুতরাং অধিকাংশ লোকই তাদের সব লাগেজ ফিরে পেল না। এই বিশাল হতাশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজিবও রয়েছে।হারানো লাগেজ পুনরুদ্ধার এর প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে রাজিব আরো হতাশ হয়ে গেল।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের একজন লোক একটি ডেস্ক এর পিছনে বসে রয়েছে। তার পিছনে একটি পোস্টার লাগানো রয়েছে দেয়ালে। সেই পোস্টারে বিভিন্ন ধরনের লাগেজের ছবি। যাত্রীদের ঐ পোস্টার টির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চিহ্নিত করতে হবে তার লাগেজ দেখতে কি রকম এবং বলতে হবে কি রংয়ের। রাজিব ঠিক করলো সে লাইনে দাঁড়াবে না। কিন্তু অনুসন্ধানে বের হয়ে আসলো সে যদি কিছু না জানিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যায়,তবে কতৃপক্ষ ধরে নেবে সে তার হারানো লাগেজটির দাবী চিরতরে ত্যাগ করেছে।এই কথা জানার পর মত বদলিয়ে রাজিব যখন সেই লাইনে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হলো ,ততক্ষনে লাইনটি অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে বেশ লম্বা হয়ে গেছে। তার স্থান হলো একেবারে শেষের দিকে।

ঘুম ভেঙ্গে ইদ্রিস প্রথম যে কাজটি করে তা হল বালিশের নীচে রাখা সস্তা ঘড়িটার ডায়ালটির দিকে তাকায়। ঘড়িটি তার বাবার দেয়া। মেট্রিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তার বাবা হাত থেকে খুলে তাকে এই ঘড়িটি দিয়েছিল। সে মেট্রিক পাশ করেছে বহুদিন হলো। এত সস্তা ঘড়ির এতদিন সময় দেবার কথা নয়।কিন্তু ঘড়িটার মধ্যে বাবার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে বলেই হয়তো বা এতদিন টিকে রয়েছে। ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে। সে ট্যাক্সি চালায়।একজন ট্যাক্সি চালকের জন্য এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠা খুবই অন্যায়। কিন্তু গাড়ি জমা দিয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও সে কোনোদিনই ভোরবেলা উঠতে পারে না।

প্রতিবার ঈদের সময় ব্যবসায়ীরা একটা নতুন কোন পণ্য বাজারজাত করেন, যা কি না সেই ঈদের বিশেষ পণ্য বলে বিবেচিত হয়। কয়েকদিন আগে এরকম ডিস্কো শার্টের চল হয়েছিল। মূল শার্টটি যে রংয়ের তারচাইতে ভিন্ন রংয়ের একটি কাটপিস শার্টের উপরের অংশে তৃতীয় বন্ধনীর মত সেলাই করে জুড়ে দেয়া হতো। এইবারের ঈদে তেমনি বিশেষ পণ্যের নাম সিনডেরালা হিল জুতা। ইদ্রিস এর একটিই মেয়ে ,নাম হানিফা। সে রোজার শুরুতেই তার বাবার কাছে এই হিল জুতার আবদার করে রেখেছে। কোন এক বিচিত্র কারণে ইদ্রিস তার মেয়ের কোন কথাই মানা করতে পারে না।এই ব্যাপারটিতেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। সে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিয়েছিল। ভেবেছিলে প্রতিদিন একটু একটু করে টাকা সরিয়ে রাখবে। মাস শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সিনডেরালা ফান্ডে একটা টাকাও জমা পড়েনি। তবে আজকে চাঁদ রাত। প্রচুর লোক মার্কেটে যাবে ঈদের কেনাকাটা করতে। হয়তো আজ দিন শেষে কিছু টাকা জমলেও জমতে পারে।

১০

মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক।আজ সারাদিন প্রচণ্ড চেষ্টার পরেও ইদ্রিস জমার টাকাটাই তুলতে পারল না। সারাদিন গাড়ি চালানোর মতো তেলের টাকাও ছিল না তার কাছে। তবে তার চেনা একটা বাসা আছে, যেখানে চুরির পেট্রোল পাওয়া যায়। চুরির জিনিস কিনতে তার ঠিক মন সায় দেয় না, তবুও সেখান থেকে ইদ্রিস এর তেল কেনার পেছনে একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। এরা খুব সস্তায় এবং বাকীতে তেল বেচে। তাছাড়া ইংরেজীতে একটা কথা আছে ,"Beggars cannot be choosers."সকাল বেলা সেখান থেকে বেশ কিছুটা তেল নিয়েছিল। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সেই তেল এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সে বাড়ির অবশ্য একটা বিশেষ নিয়ম রয়েছে, নতুন করে তেল নিতে হলে পুরনো হিসাব চুকিয়ে ফেলতে হবে। তার পকেটে যে টাকা আছে, এটা দিয়েই মহাজনকে জামার টাকা দিতে হবে। সুতরাং সেখান থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে খুব কাছেই বিমানবন্দর। সেখানে গিয়ে একটু চেষ্টা করা যেতে পারে। যদি কোনো যাত্রী পাওয়া যায়,তবে সেখানে থেমে যাত্রীর থেকে টাকা নিয়ে পুরনো হিসেব চুকিয়ে দেবে।

১১

ইদ্রিস যখন বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো, কাকতলীয় ভাবে তখনও তার ঘড়ির ডায়ালে সাত টাই বাজে। এত রাতে যাত্রী পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাছাড়া বিদেশ ফেরত যাত্রীরা অপরিচিত ট্যাক্সিতে উঠতে ভয় পায়। তবে আপনারা কি সেই বাউল গানটি শুনেছেন, যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে?

১২

পিঁপড়ার সাড়ি কতটা মন্থর গতিতে এগিয়ে যায় তা আমার জানা নেই,তবে রাজীব যে লাইনটিতে দাঁড়িয়ে ছিল সেটি যে তার চাইতে মন্থর গতিতে এগিয়েছিল সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই! রাজিব যখন তার হারানো লাগেজের বর্ণনা দিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে বের হয়ে আসলো তখন চারদিক অন্ধকার করে সবে সন্ধ্যা নামছে তার প্রিয় শহরটিতে।তার আত্মীয় স্বজনেরা তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় আশা ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে গেছে। তাকে পুরো বারটা ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। গত ৪৮ ঘন্টা ধরে সে একই কাপড় পড়ে রয়েছে। তার পুরো শরীর তখন ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। আর তাই ইদ্রিস যখন তাকে তার ট্যাক্সিতে আহ্বান করলো, তখন তার ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না রাজীবের। তখন তার মনে' যা হবার হবে' ধরনের একটি বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে।

১৩

বিমানবন্দর থেকে যে রাস্তাটি মহাখালীর দিক গিয়েছে,ইদ্রিস সে পথে কিছু দূর এগোবার পর হঠাৎ করে বাম দিকের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিতে ঢুকে গেল। যদিও রাজিব বহুদিন দেশের বাইরে, তবুও সে জানে এই পথ ধানমন্ডির দিকে যায় না। সে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই গাড়িটি একটি বাড়ির উঠোনে এসে থামল। উঠোনটির তিন দিকেই সেমি পাকা কিছু ঘর । তারই একটির বারান্দায় উঠে এসে ইদ্রিস কড়া নাড়তে শুরু করল।

১৪

এই মুহূর্তে রাজিবের মনে কোন সন্দেহ নেই কি হতে চলেছে। এই ট্যাক্সির ড্রাইভারটি খুব সম্ভবত এই লোকগুলোর কাছে তাকে তুলে দেবে।তারা এসে তার পকেটে হাত দিয়ে তার সাথে থাকা ১০ হাজার ডলার নিয়ে যাবে এবং সে যেন পুলিশকে চিনিয়ে এই বাসায় না নিয়ে আসতে পারে, তাই তাকে খুন করে কাছেপিঠে কোথাও পুঁতে রাখবে। সচরাচর সে এত টাকা নিয়ে দেশে ফেরে না। দেশে এক মাস চলার মত যত টাকা খরচ হতে পারে, আনুমানিক সেই পরিমাণ টাকা নিয়ে সে আসে। তবে এবার তার একটি বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। বছর দুয়েক আগে তার একটি বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল। একটি বিশেষ দিন ধার্য করা হয়েছিল যেদিন তার মা এবং দুলাভাই যেয়ে মেয়েটিকে আংটি পরিয়ে দিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই দিনটির কয়েকদিন আগে সে একটি অভূতপূর্ব ব্যবসার সুযোগ পায়। আপনাদের একটি মজার কথা বলি। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি বিশেষ সুযোগ আসে। সাহসী এবং বুদ্ধিমান মানুষেরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জীবন বদলে ফেলে, নির্বোধ এবং ভীত মানুষেরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে না। তারা কুয়োর ব্যাঙের মতো একই জায়গায় আটকে থাকে।

১৫

আমাদের এই গল্পের নায়ক রাজীব অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে হঠাৎ পাওয়া সুযোগটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে, এবং তার মাকে জানায় আগামী দুই বছর সে দেশে আসতে পারবে না। তার মা যেন পাত্রী পক্ষকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন। এখানে তার মা একটি ভয়ানক অন্যায় করেন, তিনি পাত্রীপক্ষকে ব্যাপারটি জানান না।পাত্রী পক্ষ যথারীতি নির্ধারিত দিনে তাদের আত্মীয় স্বজন কে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে পানচিনি উপলক্ষে।নির্ধারিত দিনে মেয়েটি তার আত্মীয়-স্বজনের সামনে ভীষণভাবে লজ্জা পায় যখন কিনা পাত্রপক্ষ আংটি পরিয়ে দিতে আসে না অথবা কোন ফোন করে না। যার মাধ্যমে এই বিয়ের কথা এসেছিল, তিনি সম্পর্কে রাজিবের মার পিঠাপিঠি বোন। তিনি যখন পুরো ব্যাপারটা রাজীবকে জানান, তখন রাজিব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,যখনি সে দেশে ফিরবে ,তখন সে মেয়েটির সাথে কথা বলে পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলবে, এবং মেয়েটি তাকে ক্ষমা করলে সে মেয়েটিকে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দিবে।

১৬

তবে এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন উঠোনে বসে রাজিব নিশ্চিত, এই ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারটা মেয়েটির আর কোনদিন জানা হবে না। কারণ এখানেই শেষ হয়ে যাবে ৩০ বছর বয়সী এই যুবকের ইতিহাস। কিন্তু রাজিব এর ধারণায় ভুল ছিল। ইদ্রিসের ডাকে সে ভাবনার জগত থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসে।

"স্যার আপনার কাছে কি ১০০ টা টাকা হবে? সকালে তেল নিছিলাম বাকিতে। সেই টাকা শোধ না করলে নতুন করে তেল দিব না বলতে আছে।"

ইদ্রিস এর কথায় রাজিব যেন হালে পানি পেল। টাকা যখন চাচ্ছে তখন এরা তাকে নিয়ে কোন অন্যায় করবে না। সাধারণত দেশের থেকে ফিরবার আগের রাতে, সে সামান্য কিছু টাকা রেখে সব টাকা ড্রাইভার এবং কাজের লোকের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে তার মানিব্যাগে ১০০টা টাকাই ছিল। সেই টাকা আজকে ভীষণ ভাবে কাজে লেগে গেল।

১৭

সামান্য কিছু পেট্রোল ভরে তারা যখন আবার বড় রাস্তার উপর উঠলো, তখন রাত বেশ গভীর হতে শুরু করেছে। মৃত্যু ভয় কেটে গেলে মানুষ কিন্তু বেশ সহজ হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় সে যেন নতুন জীবন পেল। রাজিব ও এর ব্যতিক্রম নয়। সে খুব সহজভাবেই ইদ্রিসের সাথে গল্প করতে শুরু করল।

"আপনার নাম কি ভাই?"

"ইদ্রিস"

"বিয়ে-শাদী করছেন?"

"জি স্যার করছি ,মেয়েও আছে একটা।"

"বউ-বাচ্চা নিয়া ঈদের বাজার করতে যাবেন না, চান রাতে কাজ করতেছেন?"

"গরিবের আবার ঈদ, স্যার। মেয়ে একটা জুতা চাইছিল ঈদে,ঈদের দিন একটু পোলাও কোরমা খাইতে চাইছিল ,ভাবছিলাম গাড়ি জমা দিয়া নিয়া যাবো মেয়েকে মার্কেটে। গাড়ির জমার টাকাই তুলতে পারলাম না স্যার। আপনার ভাড়ার টাকা পাইলে যদি গাড়ির জমার টাকা উঠে।তার মধ্যে ১০০ টাকা তো আবার হাওলাত নিয়ে নিলাম তেল কিনার জন্য।"

"আপনি ওই টাকা নিয়ে চিন্তা কইরেন না, ঐটা আপনাকে আমি বখশিস দিলাম, চাঁদরাতে কাজ করতেছেন। ভালো কথা, আপনার মেয়ের নাম কি?"

"ওর নাম হানিফা, বয়স কম তো সার , টাকা পয়সার ব্যাপারটা ঠিক বুঝে না। এই জন্য এরকম অন্যায় আবদার করে।"

১৮

কথায় কথায় কখন যে তারা ধানমন্ডি এসে হাজির হয়েছে, রাজিব খেয়ালই করেনি। অথচ এখান থেকেই সে কলেজের বাসে উঠত।সে যখন তাদের বাসার সামনে নামলো তখন গভীর রাত। সে ইদ্রিসকে রেখে ভিতরে গেল। বাসার লোকেরা তখন মশারি টানিয়ে ঘুমানোর পায়তারা করছে। তারা ধরেই নিয়েছে আজকে রাজিব দেশে ফিরতে পারেনি।

১৯

রাজিবের মা সব সময় কিছু টাকা ঘরে রাখেন, হঠাৎ করে কখন কি প্রয়োজন পড়ে। সে এমন কিছু টাকা না ,তবে একেবারে কম ও নয়। প্রায় হাজার দশেক টাকা। রাজীব সেই পুরোটা টাকা এনে ইদ্রিস এর হাতে দিয়ে বলল, আজ আর কাজ করবার দরকার নাই। গাড়ি জমা দিয়ে বাসায় চলে যান।তারপর একটা রিকশা ডেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে মার্কেটে যেয়ে ঈদের বাজার করেন। অবশ্যই হানিফাকে ওর পছন্দের জুতা কিনে দিবেন, সাথে মিলিয়ে সুন্দর জামা কাপড় কিনে দিবেন। ভাবিকেও একটা শাড়ি কিনে দিবেন। কালকে ভাবি যেন পোলাও রান্না করতে পারে সে ব্যবস্থাও করবেন। তারপর যদি কিছু বাঁচে তাহলে সেটা হানিফার হাতে দিয়ে বলবেন, বিদেশ থেকে তার একজন চাচা আসছে,সে তাকে ঈদী দিছে।"

২০

এ পৃথিবীতে কোন রকম কার্য কারণ ছাড়াই কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ইদ্রিস হঠাৎ করে রাজীবের হাত দুটো ধরে বাচ্চাদের মত ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করল। গল্পটি শুরু করেছিলাম একটি ইংরেজি প্রবাদ দিয়ে। আসুন গল্প শেষও করি আরেকটি ইংরেজি প্রবাদ দিয়ে। "It is not how you start, it is how you finish that counts." রাজিবের দিনটি শুরু হয়েছিল খুবই খারাপ ভাবে, কিন্তু দিনটি কি ভাবে শেষ হয়েছে বলে আপনাদের ধারণা?

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments