'ভাবী। শুনেছেন, সাফিন ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।'
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোন সাফিন?'
আদনান সাহেব মুঠোফোনের ওপাশ থেকে আস্তে বলে উঠলেন, 'আপনার স্বামী, আমাদের সাফিন ভাই।'
মাথায় চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে এলো।
শুকনো গলায় প্রশ্ন করলাম, 'কেন?'
'অফিসের পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে।'
হঠাৎ মনে হলো পায়ের নিচে মাটি নেই। আমি তলিয়ে চলছি কোনো ঘুটঘুটে অন্ধকারে। মাথাটা ঘুরিয়ে এলো। অন্ধকার দেখছি চোখে। কানের পাশে যেন ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকছে। তারপর কিছুই মনে নেই।
'আম্মু! আম্মু! তোমার কী হয়েছে? ওঠো তুমি।'
শেফার এমন কান্না জড়ানো কথা আর দু'হাত দিয়ে অনবরত ধাক্কায় চোখ খুলে তাকাতেই দেখি আমি ফ্লোরে শুয়ে আছি। মাথার পেছনটায় খুব ব্যথা করছে। অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে গিয়েই ব্যথাটা পেয়েছি। মাথায় হাত চেপে উঠে বসলাম।
শেফাকে বললাম, 'আমরা এখন বের হবো মা।'
শেফা জিজ্ঞেস করলো, 'আমরা কী হাসপাতালে যাব আম্মু? তোমার কী হয়েছে আম্মু?'
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, 'আমরা এখন হাসপাতালে যাব না। চিন্তা করো না, আমি এখন একদম ভালো আছি।'
'তাহলে কোথায় যাব?'
'আমরা এখন তোমার আব্বুর কাছে যাব।'
মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো। বাবার সঙ্গ তার বেজায় পছন্দ। কিন্তু শেফা জানে না বাবা আর আজ হাসিমুখে নেই৷
শেফাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হলাম। সাফিনের ফোনটা বন্ধ। আদনান সাহেবের মাধ্যমে থানার কথা জেনে নিলাম। সেদিকেই ছুটছি এখন৷
'আম্মু, আমরা পুলিশের কাছে এসেছি কেন? বাবাকে কী কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে?'
খুব মন খারাপ নিয়ে প্রশ্ন করলো শেফা। শেফার ধারণা কোনোকিছু চুরি গেলেই পুলিশের কাছে মানুষজন আসে। এর অবশ্য কারণ আছে। একবার আমার একটা ফোন চুরি গেলে শেফাকে নিয়ে থানায় এসেছিলাম। আর একবার পাশের বাসায় চুরি হলে পুলিশ বাড়িতে এসেছিল। এই দুই ঘটনার পরে শেফা মনে করে কেবল চুরি হলেই পুলিশের শরণাপন্ন হয় মানুষ।
শেফার বয়স সাড়ে চার বছর। আমার আর সাফিনের বিয়ে হয়েছে আট বছর হলো। বিয়ের দিন থেকে সাফিনকে আমি চিনি। এরকম একটা কান্ড ঘটানোর মত মানুষ সাফিন নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাফিন এমনটা করতেই পারে না। কত অভাব অনটনেও আমাদের সময় গিয়েছে কিন্তু সাফিন কখনো নিজের সততা থেকে এক পা সরে দাঁড়ায়নি। অভাবে যার স্বভাব বদলায়নি, তার এই সুসময়ে স্বভাব বদলানোর প্রশ্নই আসে না।
সাফিনের সঙ্গে দেখা করলাম। এতদিন মাথার উপরে ছায়া হয়ে থাকা মানুষটা আজ বেজায় অসহায়। দু 'ঠোঁটে সবসময় যার হাসি লেগে থাকতো, তার ঠোঁট জুড়ে আজ মলিনতা।
শুকনো মুখে তবুও বৃথা হাসার চেষ্টা করলো সাফিন।
'চিন্তা করো না তৃষ্ণা। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। ওরা শুধু শুধু আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। দেখবে ঠিক হয়ে যায় সব। সত্য চাপা থাকে না, বের হয়ে ঠিক আসবে। তুমি ধৈর্য ধরো, মন খারাপ করো না।'
চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি নামছে৷ আমি জানি সাফিন কিছুই করেনি, তবুও ওর উপর দোষের বোঝা চাপালো মানুষ। শেফাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম। শেফা একের পর এক প্রশ্ন করেই চলছে। আমি তাকে একের পর এক মিথ্যা কথা বলেই চলছি। মা হয়ে মেয়ের ছোট্ট মস্তিষ্কে এত বড় বোঝা চাপিয়ে দেই কী করে!
আদনান সাহেবের মাধ্যমে অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তৈরি হলো। আমি তাকে অনুনয় বিনয় করে যতই বলতে লাগলাম না কেন, তিনিই একই কথা বললেন।
তার কথ্য, 'মিসেস তৃষ্ণা। আপনি যদি আপনার স্বামীর হয়ে পাঁচ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারেন, তবে আমরা কেস উঠিয়ে নিতে পারব। না হলে আমাদের কিছুই করার নেই।'
বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরে এলাম। পাঁচ কোটি টাকা! কল্পনাতেই মানায়, বাস্তবতায় এতগুলো টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। কপালে ঘাম জমেছে। শেফা মুখ কালো করে বসে আছে। বাবা কেন তার সঙ্গে বাড়ি ফিরলো না এটাই তার অভিমানের কারণ।
বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতক্ষণে সব ঘটনাই জেনেছেন। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে রওনা হয়েছেন শ্বশুর শ্বাশুড়ি। বাবা মা'ও এসে পৌছাবে হয়তো খানিক বাদেই। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের কাছে পাঁচ কোটি টাকা কেবল উচ্চারণেই সীমাবদ্ধ৷
বিয়ের বছর খানেকের মাথায় শ্বাশুড়ির ক্যান্সার ধরা পড়লে খুব দুর্দশায় পড়ে যায় সাফিন। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে চারিপাশে অন্ধকার নেমে এলো। দিন যেতে লাগলো আর ঋণের বোঝা বাড়তে লাগলো। কিন্তু নিজের সততা বিসর্জন দেয়নি কখনো সে।
সাফিন সবসময় বলে, 'অভাব অনটন চিরদিন থাকে না। কিন্তু নিজের নামে একটা দাগ লাগলে, ওই দাগ আর কখনো মুছে না।'
চিকিৎসা শেষে শ্বাশুড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। আস্তে আস্তে সব ঋণের বোঝা একটু একটু করে কমতে থাকলো। শেফা এসে ঘর আলো করে রাখলো। শেফাকে নিয়ে আমার আর সাফিনের সংসার বেশ সুখেই চলছিলো। ক'দিন আগে সাফিনের পদোন্নতিও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ এই অমাবস্যা যেন সব ওলোট পালোট করে দিলো।
তারপর শুরু সাফিনকে ছাড়িয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টার পর প্রচেষ্টা। খাওয়া দাওয়া ভুলে ছুটতে লাগলাম কীভাবে সাফিনকে মুক্ত করে আনা যায়। আমার গহনা থেকে শুরু করে বাসার দামী আসবাবপত্রও বিক্রি করতে বাকি রাখিনি। বাবা-মা আর শ্বশুর-শ্বাশুড়িও সাহায্য করেন। কিন্তু তবুও সাফিনকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হলো না। কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে যায়।
যেদিন রায় হয়, সেদিন মনে হলো আমি শূণ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস হচ্ছিলো না, সাফিনকে অফিসের সবাই মিলে অপরাধী প্রমাণ করে ছাড়লো। অথচ এই মানুষগুলোকে সাফিন কত ভালোবাসতো। কান্নায় বুকের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছিলো। মনে হলো, যেন আমার সব শেষ হয়ে গেল।
সাফিনকে একা ফেলে শহর ছাড়তে কোনোভাবেই রাজি নই আমি। বাধ্য হয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়িও আর গ্রামে ফিরলেন না। এবার সংগ্রামের সময় শুরু। সংসার চালানোর দায়ভার এবার আমাকেই নিতে হচ্ছে। ছোট্ট শেফা গোমড়া মুখে ব্যালকনিতে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি থামতে দেখলেই ভাবে, এই বুঝি তার বাবা এলো। কিন্তু বাবা তো ফেরে না।
এই শহরে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি জোটানো খুব কঠিন। আমার এখন খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার মত একটা চাকুরি দরকার। হোক তা যেমন তেমন। অসহায় ব্যক্তিকে সৃষ্টিকর্তা খুব সাহায্য করেন বলেই একটা চাকুরি জুটে যায়। সপ্তাহে একদিন সাফিনের সঙ্গে দেখা হয় আমার। সাফিনের মুখে এখন আর হাসির রেখা নেই। ঠোঁট জোড়া দেখলে মনে হয়, হাসতে যেন ভুলেই গেছে সাফিন। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে বেশ। হাসতে ভুলে গিয়েছি আমিও। আয়নাও দেখা হয় না অনেক দিন।
সেদিন শেফা এসে বললো, 'আম্মু। আব্বু কী চোর? সে কী চুরি করেছে?'
শেফার মুখে এমন কথা শুনে বেশ হতভম্ব হয়ে গেলাম।
'তোমায় এসব কে বলেছে শেফা?'
শেফা মুখ গোমড়া করে বললো, 'পাশের বাসার তুশি। ও আমাকে খেলতে নেয়নি। ওর আম্মু আমার সঙ্গে খেলতে নিষেধ করেছে তাই।'
'কী বলেছে তুশি?'
'বলেছে, তোমার আব্বু একটা চোর। তোমার সঙ্গে আমি খেলব না। আম্মু নিষেধ করেছে।'
চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠলো। শেফাকে বুকে টেনে নিয়ে চেপে ধরলাম।
চোখের পানি মুছে বললাম, 'ওরা ভুল জানে মা। তোমার আব্বু পৃথিবীর সেরা আব্বু। তাকে লোকজন ভুল বুঝেছে। দেখবে খুব শিঘ্রই লোকজন আবার তোমার আব্বুকে খুব ভালোবাসবে।'
'সত্যি বলছো?'
'একদম সত্যি।'
এখানকার লোকজন আঁড় চোখে তাকায় আমাদের দিকে। এতদিন মেনে নিয়ে থাকলেও এখন আর থাকা সম্ভব নয়৷ আস্তে আস্তে সবাই আমাদের এক ঘরে করে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাসা ছাড়তে হলো। নতুন বাসা নিলাম। শেফার মন খারাপ, আগের বাসাটাকে সে ভুলতে পারছে না।
মাসের পর মাস কাটলো। শেফাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সকাল হলে আমি কাজে ছুটি। সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফিরি। সপ্তাহে একদিন তারপর পনেরো দিনে একদিন করে দেখা হচ্ছে সাফিনের সঙ্গে। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সাফিনকে মুক্ত করে আনার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
তারপর বছর পেরুলো। বয়স যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো সংসারে ঘানি টানতে টানতে। সাফিনের বয়সটাও যেন বেড়েছে খুব। অথচ সময় এক বছর।
সময়ের গতিতে চলছে সময়৷ আশেপাশের লোকজনের কথার খোঁটা শুনে আর দিন গুনে কাটছে একের পর এক দিন। শেফাকে স্কুলের বন্ধুরাও নানান কথা শোনায় সুযোগে। মেয়েটাও এখন আর তেমন হাসে না। অল্প বয়সেই যেন বুঝতে শিখেছে বেশ।
আরও একটা বছর ফুরিয়ে গেলো। উকিলের পেছনে টাকা ব্যয় করলেও আশার বাণী শুনাতে পারছে না কেউ। এদিকে একা একা হাপিয়ে উঠেছি আমি। সাফিনকে আমার খুব প্রয়োজন। অন্ধকার জানে আমার চোখের জল শুকানোর কাহিনী। রাত হলেই বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ভরে ওঠে পৃথিবী। নিজেকে আর কত লুকানো যায়!
খুব কষ্টের পর সুখ আসে। কথাটা বিশ্বাস করি। অপেক্ষা করছি সেই দিনটার।
তারপর একদিন হঠাৎ খবর আসে সাফিনের অফিস থেকে এবার দশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আদনান সাহেবকে। যিনি কিনা সাফিনের সবথেকে কাছের ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন।
আদনান সাহেবের সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে অফিসের আরও কয়েকজন কর্মচারী।
এবার নিখুঁত তদন্ত চালায় কর্তৃপক্ষ। বেরিয়ে আসে বিগত ঘটনার অপরাধীদের কথাও। আদনান সাহেবসহ আরও কয়েকজন মিলে গভীর ষড়যন্ত্র করে নিজেদের কুকর্মের দায়ভারে ফাঁসিয়েছিলো সাফিনকে। প্রশাসনও বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করেই সাফিনকে গ্রেফতার করে। তারপর জীবন থেকে খসে যায় দুইটা বছর।
সাফিন ফিরে আসে আমাদের কাছে। কিন্তু আগের সেই সময় আর ফিরে আসে না। হাসতে ভুলে যাওয়া মানুষের মুখে জোর করে আনা হাসির দৃশ্য বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। নিরপরাধ সাফিনের গায়ে এঁটে দেওয়া সে দাগ আমরা ভুলে গেলেও সমাজের লোক এখনো ভুলতে পারেনি৷ এখনো বহুজনেরাই সাফিনকে জেল খাটা আসামি হিশেবেই দেখেন।
মাঝেমধ্যে ফিরে পাওয়ার আনন্দ যেন এঁটে দেওয়া মিথ্যা সে দাগের কাছে ম্লান হয়ে পড়ে।
গল্প: দাগ
(গল্পটি উৎসর্গ করা হলো ‘ভুল আসামি’ হয়ে ২৬টি মামলায় প্রায় ৩ বছর কারাগারে থাকা পাটকল শ্রমিক জাহালমকে।)