হামিদ সাহেব তার ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।কিন্তু তিনি কারো সাথে কোন কথা বলছেন না।
হঠাত হামিদ সাহেবকে কোথাও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।বড় মেয়ে হামিদা বাবাকে খুঁজছে এদিক সেদিক। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।হামিদা ছাদের উপর উঠলো বাবাকে খুঁজতে। পানির ট্যাংকটা সিঁড়িঘরের ঠিক উপরে রাখা।হামিদা দেখলো তার বাবা পানির ট্যাংকের পাশে বসে আছেন। হামিদা পেছন দিয়ে দেখছে বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাদের দেখা সবচেয়ে প্রিয় একা কিছুর নাম আকাশ। এই বিশাল একলা আকাশও ভীষণ একলা ভাবেই থাকে। কি অদ্ভুত সে! মেঘেরা ছোটাছুটি করে তার আশেপাশে কিন্তু কেউ তাকে ছুঁয়ে দেয় না।
একলা মানুষেরা আকাশের পানে চেয়ে নিজেকে সঁপে দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ অশ্রু ঝরায় না। মানুষগুলোর অশ্রু শুকিয়ে গেলে তাঁরা আকাশের গায়ে নিজের আলপনা আঁকে।এই আলপনায় মিশে থাকে যাবতীয় হাহাকার।
আজ হামিদ সাহেবের পঞ্চম মেয়ের বিয়ে। ভদ্রলোকের কন্যার সংখ্যাই পাঁচ। আজ অন্যর বিয়ে। অন্যর ভালোনাম অনন্যা। অন্যকে এই বাড়িতে অন্য ডাকেন শুধু তার বাবা। অন্য যখন স্কুলে পড়তো তখন বেশ আপত্তি জানাতো। বাবা, এটা কেমন ডাকা? আমার নাম অনন্যা, নাসরিন জাহান অনন্যা। তুমি আমাকে হয় নাসরিন ডাকো, না হয় জাহান ডাকো। এটা কেমন ডাক ? অন্য? আমার বন্ধুরা যখন দেখেই তখন বলে এই দেখ্য অন্যের বাবা এসেছে! কি বিশ্রী লাগে বাবা। হামিদ সাহেব শুধু হাসতেন আর বলতেন বিশ্রী লাগুক না!
মেয়েটা কি মায়াবী আর সরল মনের হয়েছে। হামিদ সাহেব তারপরও মেয়েকে ডেকে বলতেন, অন্য। আর নিজে খিলখিলিয়ে হাসতেন। অন্য একটা বয়সের পর বুঝতে পারে তার বাবা তাকে অন্য না ডাকলে তার ভালো লাগে না । যেমন বাবা মাঝেমধ্যে অনন্যা বলে ডাক দিলে অন্য খুব চিন্তিত হয়ে উঠে। বাবার কিছু হলো নাকি!
আমাদের বাবা মায়েরা যখন বুড়ো হতে থাকেন তখন তাদের একদিনের অসুস্থতাও আমাদের বেশ ভাবিয়ে তোলে। এই বুঝি হারিয়ে গেলেন!
সিঁড়ি ঘরের উপরে উঠার লোহার সিঁড়ি বেয়ে হামিদা তার বাবার পাশে গিয়ে বসল। হামিদা দেখলো তার বাবার চোখে জল।হামিদাকে দেখে বাবা ফুপিয়ে কান্না শুরু করে দিলো। বৃদ্ধ একজন মানুষকে কাঁদতে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্যের একটি। আর নিজের বাবার কান্নার দৃশ্য পৃথিবীর সবচেয়ে করুনতম দৃশ্য।
হামিদা কখনো বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি।কিংবা বাবার এত কাছেও কখনো যায় নি। হামিদ সাহেব ছিলেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার। একদম কড়া হেডমাস্টার বলতে যাকে বুঝায় তিনি ছিলেন তা। এই বাড়িতে অন্য ব্যাতীত আর কেউ হামিদ সাহেবের সামনে খুব বেশি আসে না । আর অন্য সেই ছোটবেলা থেকেই বাবার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতো। অন্য যখন স্কুলে পড়তো রোজ বাবার অফিসে একবার ঢুঁ মারতো। আর অন্যকে দেখলেই হামিদ সাহেব দশ টাকার একটা কচকচা নোট মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিতেন। অন্য বলতো, বাবা তুমি প্রতিদিন নতুন দশ টাকার নোট কোথায় পাও? হামিদ সাহেব মজা করে বলতেন আমার টাকার গাছ আছে।হা হা হা। অন্যও তখন হাসতে হাসতে বের হয়ে যেত।
হামিদ সাহেব বেতন পেলেই ব্যাংক থেকে ১০ টাকার একটা নতুন নোটের বান্ডেল নিয়ে আসতেন। অন্য যখন ক্লাস নাইনে উঠবে, তখন হামিদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এখন থেকে অন্যকে ২০ টাকা করে দিবেন । বিশ টাকার নোটটা উনার বেশ প্রিয়। হামিদ সাহেবের বাবা ছিলেন পাট চাষী। ২০ টাকার নোটে ৪ জন পাট চাষী পাট ধোলাই করছে এমন দেখা যায়। আহ! পাট। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। হামিদ সাহেবের স্বপ্ন ছিল তিনি রিটায়ারমেন্টের পর কোন একটা পাটকলে চাকুরী নিবেন। দরকার হলে ফ্রিতে করবেন। পাটের সাথে হামিদ সাহেবের বাবা মিশে আছেন। অন্যকে ২০ টাকার নোট দেয়া শুরু করার পর উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রতিদিন ৫ মিনিট করে পাটের গল্প বলবেন। জানিস মা, তোর দাদা সোনালি আঁশের চাষ করতো!
অন্যের যখন জন্ম হয় হামিদ সাহেবের বয়স তখন ৫৫। এই নিয়ে তখন নানান জনের নানান কথা শুনতে হয়েছিল তাকে।চার চারটা মেয়ের বাপ হয়েও বুড়া বয়সে ব্যাটার খায়েশ জাগসে। হামিদ সাহেব কিছু বলতেন না।
কাকতালীয় ভাবে একই দিনে হামিদ সাহেবের মেয়ে হাবিবাও প্রথমবারের মত মা হয়। হাবিবা আর হাবিবার মায়ের একইদিনে বাচ্চা হয়।হাবিবা হামিদ সাহেবের মেঝো মেয়ে। হাবিবা গর্ভবতী হওয়ার পর একবার বাবার বাড়ি আসে। তখন জানতে পারে তার মাও গর্ভবতী। এই নিয়ে মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে ব্যাপক আপত্তি জানায়। স্পষ্ট করে বললে মায়ের কাছে। হামিদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা কথা বলবে এত বড় কলিজা তার মেয়েদের নাই।
হাবিবার স্বামী তখন অনেকদিন আসে নি শ্বশুর বাড়িতে।একদিন হামিদ সাহেবের সাথে রাস্তায় দেখা হাবিবার স্বামীর।
হামিদ সাহেব বললেন,বাবাজি কি রাগ নাকি আমাদের উপর?
জামাই উত্তর দিলো, না আব্বা।এমনিই ব্যস্ততার জন্য আসা হয় না।
হামিদ সাহেব একটু হাসলেন। তারপর বললেন, আমার একটা ছেলে নাই জানো? তোমরাই আমার ছেলে। আমার মেয়েগুলোকে তো এক এক করে বিদায় করে দিচ্ছি। আমরা বুড়া-বুড়ি একলাই থাকতে হবে। এরপর গায়ে হাত দিয়ে বললেন, হাবিবাকে নিয়ে বেড়াতে এসো। ভালো লাগবে। তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না।
একথা বলেই হামিদ সাহেব হাঁটা শুরু করলেন।হাবিবার স্বামী কিছু বলার আগেই একটা রিকশায় করে চলে গেলেন হামিদ সাহেব। ঠিক সেদিন বিকালে হাবিবার স্বামী হাবিবাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এরপর থেকে আর কেউ এই নিয়ে টু শব্দটিও করে নি।
মহাধুমধামে এখন সেই অন্যকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন হামিদ সাহেব।যার উপর দিয়ে অন্যর জন্মের সময় সবচেয়ে বেশি ঝড় বয়ে গিয়েছিল সেই মানূষটি ছাড়া এখন সবাই আছে। অন্যর জন্মের ১০ বছরের মাথায় অন্যর মা মারা যান। সবগুলো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যখন হামিদ সাহেব স্ত্রী আর ছোট মেয়ে অন্যকে নিয়ে বসবাস করছিলেন ঠিক তখনই অন্যর মা চলে যান না ফেরার দেশে।
গত ১৫ বছর হামিদ সাহেবের পাশে বটবৃক্ষ হয়ে ছিল মেয়ে অনন্যা। প্রথমে কিছুদিন অন্যর বড়বোনরা প্রতি সপ্তাহে একবার আসলেও এরপর মাসে একবার আসতো ।হামিদ সাহেবের এই নিয়ে কোন আফসোস নাই। তিনি জানেন মেয়েদেরও সংসার আছে। এদিকে অন্যকে অনেক দ্রুত বড় হয়ে যেতে হয়েছিল। বাবাকে দেখে রাখা, নিজের পড়াশোনা। সবকিছু খুব সুন্দর ভাবে করতো অন্য।
নারী যখন কন্যা, বোন কিংবা স্ত্রী তখনই সে এমন মাতৃরুপ নিয়ে হাজির হয়। নারীর মাতৃরুপের মত এত সুন্দর আর স্নিগ্ধ কিছু সম্ভবত এই পৃথিবীতে পাঠাননি সৃষ্টিকর্তা।
'বাবা'
'কিরে মা।'
'অন্যর জন্য খারাপ লাগছে?'
হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন এর আগেই হামিদা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। হামিদা সম্ভবত এই প্রথম বাবাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। বাবাকে কখনো জড়িয়ে না ধরা সন্তানরা কখনোই এই অনুভূতি বুঝবে না।
হামিদ সাহেব বলা শুরু করলেন-
তোর মনে আছে অন্য যখন হয়েছে তখন তোরা খুব আপত্তি জানিয়েছিলি। হাবিবার জামাই আমাদের বাড়িতে আসা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর আমি একদিন বলাতে আসলো আর দেখলাম তোরা সব মেনে নিলি। মনে আছে তোর?
হামিদা উত্তর দিলো, হ্যাঁ বাবা। মনে আছে।
হামিদ সাহেব বললেন, দেখ তো । তোর মা যে আমাকে একলা ফেলে চলে গেল অন্য না থাকলে আমার কি হতো?
হামিদা বলল, বাবা, এখন এসব বলো না । চলো, নিচে গিয়ে অন্যকে ওর স্বামীর হাতে তুলে দাও। এমন তো না ও চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে।
হামিদ সাহেব হাসলেন আর বললেন, তোদের মত ব্যস্ত হয়ে যাবে তো।
......................."