রেডি হয়ে বাইরে বেরুতে যাবো, বউ বললো কোথায় যাবে?
আমি বললাম, বইমেলায় একটা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে যাবো, বিশাল একজন সেলিব্রিটির বই বের হচ্ছে, আমাকে থাকার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেছে!
বউ তাচ্ছিল্য করে বললো, বাহ! আজকাল দেখছি তুমি নিজেও বড় মাপের সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছো,তোমাকেও সেলিব্রিটিরা আমন্ত্রণ জানায়! হাউ ফানি, জরিনার নানি! ওগো, যাওয়ার আগে আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে যাও!!
উপহাস করছো? আফসোস! আমার মতো গুনীজনকে চিনতে পারলে না,যেদিন সত্যি সত্যি বড়ো মাপের সেলিব্রিটি হয়ে যাবো, সেদিন বুঝবে আমি কী চিজ। লাইন দিয়েও আমার অটোগ্রাফ পাবে না, অবশ্য তোমার মতো থার্ডক্লাশ আদমিকে অটোগ্রাফ দিবো কিনা সেইটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে! সেলিব্রিটি লোকজন আমাকে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়, এইটা কী সোজা কথা?
কত হাতি ঘোড়া গেল তল, হানিফ ওয়াহিদ কয় কত জল! আচ্ছা ঠিক আছে, তখন দেখা যাবে, এখন বাজারে দৌড় দাও,বাসায় কাঁচা বাজার কিছুই নাই, ফ্রীজ একেবারে ফকফকা! বাজার আনলে তারপর রান্না করতে হবে।
ছিঃ! মূর্খ মহিলার মতো কথা বলবে না, কই যাচ্ছি সেলিব্রিটির বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে,আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিবে, তা না, কাঁচা বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছে! তোমাদের মতো বউদের কারনেই স্বামী বেচারাদের কোন উন্নতি হলো না! আমি এর তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি!!
যতোই তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাও, বাজার না আনলে দুপুরের খাবার বন্ধ। বাজার করে দিয়ে তারপর যাও। তুমি কি প্রধান অতিথি? তাহলে তো দেরি করে গেলেও সমস্যা নাই। প্রধান অতিথিকে যে কোন অনুষ্ঠানে দেরি করে যেতে হয়,এটাই নিয়ম!!
খাবার বন্ধের হুমকি দিয়ে তুমি আমাকে সাহিত্য চর্চা থেকে আঁটকে রাখতে পারবে না। আমার মতো মানুষ পৃথিবীতে আসে, জ্ঞানার্জনের জন্য, বউয়ের হুকুম পালনের জন্য নয়! চললাম।
জি জাঁহাপনা! তবে দুপুরের খাবার বন্ধ, এইটা যেন মনে থাকে!
আমি নতুন জামাকাপড় পরে দামী সেন্ট মেখে নাকেমুখে সামান্য কিছু খেয়ে দৌড় শুরু করলাম। সেলিব্রিটির অনুষ্ঠান বলে কথা! বউয়ের কথায় পাত্তা দিলে চলবে?
গতবছর বইমেলার ঘটনা।
বিটিভিতে বহু বছর আগে "জানা অজানা" নামে একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন যে ভদ্রলোক, তার নামটা ছিল বোধ হয় আনিসুজ্জামান। উনি একজন নামকরা কবি। এখন তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় চাকরি করেন।বাতিঘর থেকে তার একটা কবিতার বই বের হয়েছে।
উনার সাথে কথা বলার সময় ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়। উনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। দেখে চিনতে পারলেন। কথায় কথায় জানলাম, আগামী কাল সকালে উনার একটা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে মুক্ত মঞ্চে। আমি উপস্থিত হলে উনি ভীষণ খুশি হবেন। তিনি আমার লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়েন। ফিরে আসার সময় তিনি তার একটা কার্ড দিয়ে দিলেন।
ফেসবুকে উনার লেখা আমি দেখেছি। দুই-চার লাইন লিখেন,এতেই বহু লাইক কমেন্ট পড়ে যায়।বেশির ভাগ লেখা বানী নির্ভর। উনার বেশির ভাগ ভক্ত মেয়েরা।
পরের দিন সকালেও তিনি আমাকে নক করলেন উপস্থিত হওয়ার জন্য।
বউয়ের হুমকিধামকি উপেক্ষা করে, ধুলাবালি সহ্য করে, গাড়ির প্যা পো হর্ন শুনতে শুনতে, অসহ্য জ্যামে আঁটকে পড়ে ঘামে ভেজা শার্ট নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম। ততক্ষণে অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
ভদ্রলোক নারী বেষ্টিত হয়ে আছেন। নারী ভক্তদের সাথে গল্প করছেন, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমাকে দেখে একটা শুকনো হাসি দিয়ে আবার নারী ভক্তদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি হ্যাবলা কান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, আমার মতো আরও কিছু আবুল দাঁড়িয়ে থেকে মজা দেখছে!
নারী ভক্তদের সাথে উনার কথা শেষ হচ্ছে না,আমি অপেক্ষা করছি, উনার সাথে একটু সৌজন্য দেখিয়ে চলে আসবো। নারীদেরকে এমন সুন্দর করে তিনি আপু আপু করছেন, যেন তিনি পাঁচ বছরের বালক, আপুদের ছাড়া তিনি অসহায় এবং আপুরা না থাকলে উনি বইমেলা থেকে হারিয়ে যেতে পারেন! অথচ উনার মাথায় বিশাল একটা টাক!!
একজন সুন্দরী মহিলা লেখক সাহেবকে বললেন, ভাইয়া,আমাদেরকে চা খাওয়াতে হবে।
লেখক সাহেব নিশ্চয়ই আপু,নিশ্চয়ই আপু, বলতে বলতে চললেন চা খাওয়াতে। আমরা হাঁদারাম গাধা হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম!!
ফিরে আসার সময় দেখলাম লেখক সাহেব চা খাচ্ছেন আর খোশগল্প করছেন। আমাকে দেখে বললেন, ভাইজান, চা খাবেন?
রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, জি না ভাই, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বউ আমাকে আদর করে দুধ চা খাইয়ে তারপর আদা চা খাইয়ে দিয়েছে!
এসেছেন যখন একটা বই কিনে নিয়ে যাবেন।
একজন সুন্দরী মহিলা একটা বই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়! ভাইয়া তো বই কিনতেই এসেছেন!
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধও উপেক্ষা করা যায় কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের অনুরোধ ফেলা যায় না। আমি মানিব্যাগ বের করে দুইশো চল্লিশ টাকা সুন্দরী মহিলার হাতে ধরিয়ে দিলাম!!
লেখক সাহেব উঠে এসে বইয়ের অটোগ্রাফে লিখলেন, হানিফ ওয়াহিদ সাহেব আমার পছন্দের এবং প্রিয় একজন মানুষ। আমি উনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি!
আমি মনে মনে বললাম, হারামজাদা, তুই তো মোটেই ভালমানুষ নস। কীভাবে মানুষের সাথে ব্যবহার করতে হয় তা শিখিস নি! আমি তোর অমঙ্গল কামনা করি!!
খুলে দেখি কবিতার বই! আমি আমার সারাজীবনে একটাও কবিতার বই কিনিনি। কেননা আমি কবিতা বুঝি না। বোমা মারলেও আমার পেট থেকে একটা কবিতা বের হবে না। একজন একটা কবিতার বই আমাকে উপহার দিয়েছিল, আমি পড়ে দেখিনি। লেখক হচ্ছেন, আমাদের জাতীয় কাকু হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ। ক্ষমতায় থাকতে কাকুর কবিতা লেখার শখ হয়েছিল। কিন্তু বিদিশার কারনে কাকু দিশা হারিয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন!!
রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, আমি থাকি কেরানীগঞ্জ। কেরানীগঞ্জ থেকে পোস্তগোলা আসতে সিএনজি ভাড়া লেগেছে একশো টাকা। পোস্তগোলা থেকে বইমেলা আসতে সিএনজি ভাড়া লেগেছে আড়াইশ টাকা। মোট হলো সাড়ে তিনশো। ফিরে যেতেও লাগবে সাড়ে তিনশো। বই কিনলাম দুই,শো চল্লিশ টাকা দিয়ে। হাজার টাকা খসে গেল। লাভ কী হলো? এরচেয়ে ব্লকবাস্টারে গিয়ে একটা মুভি দেখলে কাজ হতো।
অবশ্য লাভ একটা হয়েছে, দুপুরে না খেয়ে থাকতে হতে পারে! সেই সাথে বউয়ের গালি তো ফ্রী থাকছেই!!
সেদিনই কানে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি, সবসময় সেলিব্রিটি লোকজন থেকে আড়াইশো মাইল দূরে থাকবো!!