চারুলতা শেষ পর্ব

0 12
Avatar for Nipa1234
3 years ago

চারুলতা

শেষ পর্ব

তরু কিছু না বলে কেবল মুখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে। ও কেন কাঁদছে নিজেও জানে না। চারু চিঠিটা সাবধানে ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে রেখে দেয়। তারপরে চোখ মুছে বিছা্না থেকে নেমে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে। দায়িত্বের কাছে অনুভূতিরা রোজই হার মানে।

চারু ড্রয়িং রুমে রাজীবের পাশে এসে বসে। "আবার স্লিপ প্যারালাইসিস?"

"হুমম।"

"পানি খাবে?"

"না।"

চারু আর কিছু বললো না, শুধু চুপচাপ রাজীবের হাতটা ধরে বসে রইলো। রাজীব দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে উঠে বসলো বিছানায়। "অফিসের কাজ নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে রওনা দিই আমরা?"

"আচ্ছা, তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি নাশতা দিতে বলি। আর সব গুছিয়ে নিই।"

চারু উঠে গেলো রাজীবের হাত ছেড়ে। এতোক্ষণ ও রাজীবের হাত ধরে বসে ছিলো, রাজীব খেয়ালও করে নি হয়তো। "চারু?"

"হ্যাঁ বলো?"

"তুমি কি থাকতে চাও? তাহলে তুমি আর তৃণা কদিন থেকে যাও। আমাকে ফোন দিলে আমি পরে এসে তোমাদের নিয়ে যাব।"

"না থাক, তোমার অফিস ফেলে আবার আসতে হবে আমাদের জন্য। আমরাও আজই চলে যাবো।"

"কোনো সমস্যা হবে না আমার। তুমি চাও কিনা বলো জাস্ট। আমি বাকি সব সামলে নেবো।"

চারু ভীষণ অবাক হলো। রাজীবের এই স্বভাবের সাথে পরিচিত নয়। গত সাড়ে চার বছরে রাজীব কখনো চারুর জন্য আলাদা করে ভেবেছে বলে চারুর মনে পড়ে না। হুট করে মানুষটা এমন বদলে গেলো কেন?

"তুমি ঠিক আছো রাজীব?"

"হ্যাঁ একদম। সামান্য মাথাব্যাথা করছে। সেটা বাদে সবই ঠিক আছে।"

"না মানে তুমি কখনো আমার জন্য এভাবে কেয়ার করো নি, তাই অবাক হচ্ছি।"

"কেয়ার না করাটাই মেনে নিয়েছো এখন আমার স্বভাব হিসেবে?"

চারু কিছু না বলে ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

রাজীব একা একা বসে রইলো কিছুক্ষণ। চারুর বলা শেষ কথাটা মাথায় পেন্ডুলামের মতো ঝুলে আছে। "না মানে তুমি কখনো আমার জন্য এভাবে কেয়ার করো নি, তাই অবাক হচ্ছি।" কথাটা অবাক করে দেয়ার মতো একটা সত্যি কথা। রাজীব সবসময় নিজেকে একজন দায়িত্ববান স্বামী হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু কিছু জিনিস দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। এই যে চারু এসে ওর হাত ধরে বসে ছিলো, এটা কি চারুর দায়িত্ব ছিলো? ও যদি দায়িত্বের বাইরে গিয়েও রাজীবের জন্য কেয়ার করতে পারে, রাজীবও কি নিজের জায়গায় সেই কাজটা করতে পারে না চারুর জন্য? রাজীব বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

চারু রুমে এসে ব্যাগ গোছানো শুরু করলো। দুইদিন থাকার জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে এলেও কিছুই বের করতে হয়নি বলা যায়। তৃণার কাপড় বের করতে হয়েছে কিছু। সেগুলিই গুছিয়ে নিচ্ছে চারু। এর মাঝেই খালেদা এসে ঢুকলেন। "আজই চলে যাবি তাহলে?"

"হ্যাঁ মা। রাজীব অবশ্য বলেছিলো আমাকে আর তৃণাকে থেকে যেতে। ও পরে এসে নিয়ে যাবে আমাদের। আমিই না করেছি।"

"তাহলে আমি নাশতা দিই তোদের। তাও আজ থেকে যেতে পারতিস।"

বিছানা থেকে তরু বলে উঠে বললো, "থাক মা, জোর কোরো না। এখন তো ও শুধু এইবাড়ির মেয়ে না, আরেক বাড়ির বউ। ওর দায়িত্ব আছে কিছু।" খালেদা কিছু না বলে বের হয়ে গেলেন। চারু বিছানার কোনায় এসে বসলো। "কথাগুলি কি তুই অভিমান করে বলেছিস?"

"অভিমানের কি আছে চারু? এটা তো সত্যি। বিয়ের পর সব মেয়েই বদলে যায়। ওখানে তুই ভালো নেই, তবু তুই দায়িত্বের খাতিরে নিজের ভালো থাকাটা বিসর্জন দিয়ে দিবি।"

"তোর বিয়ে হলে তুই কি একই কাজ করবি না?"

"জানি না রে। আমার এখন ভীষণ ভয় হয়। যদি বিয়ের পর আমার জীবনটাও তোর মতোই হয়ে যায়?"

"হবে না, দেখে নিস। তুই আমার চেয়ে সুন্দর জীবন পাবি।"

"কিন্তু আমি যার সাথে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম..."

"তরু, আমরা যেমন জীবন চাই, তেমন জীবন পাই না। এটাই জীবনের অমোঘ সত্য। তুই জানতে চেয়েছিলি, আমি কিসের সাথে মানিয়ে নিয়েছি। আমি এই সত্যের সাথে মানিয়ে নিয়েছি। বিশ্বাস করে নিয়েছি, আমার ভাগ্যটা এমনই। সেটা মেনেই বেঁচে আছি, আর প্রতীক্ষা করছি, একদিন হয়তো সব বদলে যাবে। অরণ্য অসাধারণ একটা মানুষ। হয়তো তুই আমি ওর জন্য খুব সাধারণ, তাই আল্লাহ আমাদের কারো ভাগ্যেই ওর নাম লেখেন নি।"

আকাশে সাঁঝের রং ছেয়েছে। রাজীবের অফিসের গাড়িটা দাঁড় করানো আছে বিল্ডিং থেকে একটু সামনে। বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে আছে চারু, তরু, খালেদা আর রায়হান সাহেব।

তৃণা ঘুমিয়ে পড়েছে, রাজীব ওকে নিয়ে গাড়ির ব্যাকসিটে শুইয়ে দিলো। রায়হান সাহেব সেদিকে তাকিয়ে চারুকে বললেন, "তুই শিওর তুই রাজীবের সাথে ফিরে যাবি?"

"হ্যাঁ বাবা। ওর সাথেই তো আমার সংসার, ওর বাড়িই এখন আমার বাড়ি। এই বাড়ি এখন আর আমার নেই।"

চারু নিচু হয়ে বাবার পা স্পর্শ করলো। তারপর মায়ের পা ধরে সালাম করলো। খালেদা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। "আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।"

"মা হয়ে মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইছো?"

"আমি যদি তোর বাবাকে জোর না করতাম, আজ হয়তো তোকে এভাবে বিদায় দিতে হতো না।"

"এর চেয়ে খারাপও হতে পারতো। যা পেয়েছি তাই নিয়ে ভালো থাকতে চেষ্টা করছি, তোমার মতো। তুমি বাবার আর নিজের যত্ন নিও মা। আর তরু, তুই দেখবি মা কোনো অনিয়ম করে কিনা। তুই ইন চার্জ।"

"আচ্ছা? আর আমার খেয়াল কে রাখবে?"

"পাত্র দেখি?"

"না না দরকার নেই। আমি খেয়াল রাখবো সবার। কোনো সমস্যা নেই।"

খালেদা আর চারু দুজনই হেসে ফেললো তরুর কথায়।

রায়হান সাহেব রাজীবের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাজীব তৃণাকে গাড়িতে রেখে রায়হান সাহেবের পা ধরে সালাম করলো। রায়হান সাহেব তার কাঁপা কাঁপা দুই হাত দিয়ে রাজীবের হাতটা চেপে ধরলেন। "বাবা রাজীব, আমার কোনো ছেলে নেই। মেয়ে দুটোকে বড় আদরে বড় করেছি। কখনো একটুখানি বিপদ কিংবা কষ্টের আঁচ লাগতে দিই নি ওদের গায়ে। কিন্তু চারু এখন আমার মেয়ে না শুধু, ও তোমার স্ত্রী। ওকে তুমি কষ্ট দিও না। বাবা হয়ের মেয়ের কষ্টটা দেখতে পারি না। তোমারও তো মেয়ে আছে, তারও একদিন বিয়ে দেবে। নিজের মেয়েকে যেমন দেখতে চাও, আমার মেয়েটাকেও সেভাবে রাখার চেষ্টা কোরো একটু।"

"এভাবে বলবেন না আব্বা। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো চারুকে ভালো রাখার। আপনাকে কথা দিয়ে যাচ্ছি আমি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।

চারু, এসো।"

চারু গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। রাজীব গাড়ির বাইরে থেকে বললো, "আরও ভেতরে গিয়ে বসো চারু। আমি বসবো এইপাশে।"

"তুমি না সামনে বসবে?"

"আমি তোমার পাশে বসবো।"

চারু কথা না বাড়িয়ে রাজীবকে বসার জায়গা করে দিলো পেছনের সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করলো। রায়হান সাহেব , খালেদা, তরু গাড়িটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন, গলির মুখে সেটা অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া অবধি।

তরু বাসায় ঢুকে গোসল করলো আরেকবার। আজকের দিনটা এতো ঝামেলার যাবে ধারণায় ছিলো না। ফিজিক্যালি আর মেন্টালি পুরোপুরি বিধ্বস্ত তরু। গোসল সেরে বেরিয়ে চুল মুছছিলো, হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দটা কানে আসে। টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে এগিয়ে যায় ও। অরণ্যর হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা ফুটে আছে কলিং স্ক্রিনে। ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও। রিং হতে হতে কেটে যায় কলটা। তরু ভাবতে থাকে। আবার কল আসে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কলটা রিসিভ করে ও।

"হ্যালো।"

#

সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে একটুখানি লাল রং রয়ে গেছে এখনো। চারু সেই রঙের দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রইলো। চোখে পানি জমে যাচ্ছে হঠাৎ, গলা ধরে আসছে।। "মন খারাপ?" চারু মুখে কোনো উত্তর দিলো না রাজীবের প্রশ্নে। শুধু উপরে নিচে মাথা নাড়লো। রাজীব খানিক দ্বিধা নিয়ে আলতো করে নিজের হাতটা রাখলো চারুর কোলে রাখা হাতের উপর। চারু একটু কেঁপে উঠলো। চোখের পানি আর চোখে জমে থাকতে চাইলো না। চারু জীবনে প্রথমবার রাজীবের কাঁধে মাথা রাখলো। এতোক্ষণ এক প্রচন্ড অনিশ্চয়তায় বসে ছিলো। ভয় হচ্ছিলো, এই বুঝি রাজীব আবার আগের মানুষ হয়ে যাবে, এমন কিছু বলে বসবে যা চারুর সহ্য হবে না। কিন্তু রাজীব কিছুই বললো না, বরং চারুর মাথা রাখার জন্য কাঁধ পেতে দিলো। চারুর মনে হলো, আজ সে সব পেয়েছে। জীবনের হারানোর তালিকাটা এই হঠাৎ বদলে যাওয়া রাজীবের ভালোবাসার কাছে হার মেনে গেছে।

কে যেন বলেছিলো,

"জীবন যেখানে থেমে যায়, স্বপ্ন সেখানে শুরু হয়।

স্বপ্ন যেখানে থেমে যায়, জীবন সেখানে শুরু হয়।"

(যবনিকা)

- সাজ্জাদুল আরেফিন

ষষ্ঠ পর্বঃ facebook.com/groups/bdofficials/permalink/862917207847110/

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments