“তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো। এটা শুধু একটা কথা না। একটা কমিটমেন্ট। তুমি এই কমিটমেন্টটা কিভাবে করলে আমার সাথে যেখানে তুমি আমার বড়বোনের জন্য আবেগ পুষে রেখেছো? তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই কি আমার সাথে আছো নাকি আমার মাঝে চারুর ছায়া দেখো বলে?”
“তোমাকে ভালো লেগেছিলো তোমার মাঝে চারুর ছায়া দেখেছিলাম বলেই কিন্তু...”
“ তাহলে এনাফ অরণ্য। আর কিছু বোলো না। আমাকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
তরু আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। হন হন করে হেঁটে চললো আইসক্রিমের দোকানটার দিকে। অরণ্য পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গাতেই। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ তরুর চলে যাওয়ার দিকে। কিন্তু তরু একবার ফিরেও তাকালো না অরণ্যর দিকে। অরণ্যর প্রতি ওর অভিমান হচ্ছে না। রাগ হচ্ছেনা। কষ্টও হচ্ছে না। কিন্তু একটা অপমানের ছাপ পড়ে গেছে ওর ভালোবাসায়। ধীরে ধীরে সেই ভালোবাসা বদলে যাচ্ছে বিতৃষ্ণায়। এই বিতৃষ্ণাটা কি শুধুই অরণ্যর প্রতি? নাকি খানিকটা চারুর প্রতিও আছে?\
তরু কাঁচের দরজাটা ঠেলে দোকানে ঢুকেই চমকে উঠলো ভয়ঙ্করভাবে। তৃণাকে যে চেয়ারটায় বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো, সেটায় এখন এখন মোটা মতন এক লোক বসে আছে। তরুর হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেলো। আশেপাশে তাকাতে লাগলো ও, হয়তো অন্য টেবিলে গিয়ে বসেছে। কিন্তু তৃণা নেই কোথাও। তরুর অস্থির লাগছে খুব। ওর মনে হচ্ছে সব ঝামেলা একসাথে হাজির হয়েছে ওর জীবনে। দোকানের সেই স্টাফকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানা গেলো না। তরুর চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। দোকান থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে। তৃণা ততক্ষণে বাসার গেটে পৌছে গেছে।
তৃণা আইসক্রিম শেষ করে চুপচাপ বসে রইলো দোকানটায়। সময় কাটছে না। খালামনি পাঁচমিনিটের কথা বলে বের হয়ে গেলো, এখনো আসে নি। তৃণার ইচ্ছা করছিলো আরেকটা আইসক্রিম খেতে। কিন্তু খালামনি বকতে পারে এই ভেবে চিন্তাটা বাদ দিল। কিন্তু একা একা বসে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগছে। এরচেয়ে বাসায় চলে যাওয়া যায়। একা একা চলে যেতে পারলে সবাই অনেক অবাক হবে। খুশিও হবে। ভাববে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তৃণা চুপচাপ চেয়ার থেকে নেমে এলো। দোকানে কাস্টমার ঢোকার জন্য দরজা খুলতেই তৃণা সবার চোখের আড়ালে বেরিয়ে গেলো দোকানটা থেকে। দোকানের স্টাফরা কাস্টমার সামলাতে ব্যস্ত।
একা একা বেরিয়ে আসার পর তৃণা যে পথে এসেছিল খালামনির সাথে সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। এই রাস্তা দিয়েই ওদের গাড়িটা ঢুকেছিলো। তৃণার অনেক কিছু মনে থাকে খুব ভালোমতো। এই রাস্তায় একটা ছোট দোকান আছে। কেমন নোংরা। সেই দোকানের সামনেই ওর নানাবাড়ি। তৃণা গুটি গুটি পায়ে নানাবাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। ওরা যেখানে থাকে সেখানে অনেক মানুষ। সবাই তৃণাকে চেনে। তৃণাকে সবাই পছন্দ করে। অনেকে কোলেও নেয়। কিন্তু নানাবাড়িতে আসার পর থেকে কেউ তৃণাকে কোলে নেয় নি। আম্মু বলে বড় হয়ে গেলে কেউ কোলে নেয় না। ও কি বড় হয়ে গেছে?
কেকের দোকানের আশেপাশের দোকানগুলিতে তরু জিজ্ঞাসা করতে থাকে ফ্রক পরা একটা তিন বছরের বাচ্চাকে কেউ হেঁটে যেতে দেখেছে কিনা। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। তরুর মাথা কাজ করছে না। বাসায় গিয়ে কি বলবে? ওরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলো ভীড়ের মধ্যে? তরু কিছুই ঠিকমত ভাবতে পারছে না। হঠাৎ ওর ফোন বাজতে শুরু করে। মা ফোন দিচ্ছে। নিশ্চয়ই দেরি হচ্ছে কেন সেটা জানতে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু তরু ফোন ধরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আম্মু ফোন দিতেই থাকবে না ধরলে। দ্বিতীয় কলটা রিসিভ করলো তরু। কাঁপা গলায় বললো,"হ্যালো?"
"কিরে তরু তুই কোথায়? তৃণা বাসায় চলে এসেছে একা একা, বলছে তুই নাকি কি কিনতে গেছিস।"
"আরে মা লেবু কিনতে গিয়েছিলাম ওকে আইসক্রিম খেতে বসিয়ে দিয়ে। লেবুওয়ালাকে পাচ্ছিলাম না তাই দেরি হয়ে যাচ্ছিলো। এসে দেখি ও নেই। আমি এদিকে খোঁজাখুঁজি করে অস্থির।"
"তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।"
তৃণা আবার মন খারাপ করে বাবার পাশে এসে বসেছে। সে যা ভেবে এসেছিল তার কিছুই হয়নি। সে বাসায় এসে বলেছে খালামনির আসতে দেরি হচ্ছিলো বলে সে একা একা বাসায় চলে এসেছে। কিন্তু সবাই খুশী হওয়ার বদলে যেন বিরক্ত হলো। মা সরাসরি এসে একটা চড় বসিয়ে দিলো গালে। আচ্ছা ওর কি দোষ? ওর তো একা একা বসে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। বকা দিতে পারত। নানা নানুর সামনে থাপ্পড় না মারলেই পারত। বাবা যে মাঝে মাঝে মাকে মারে বোধহয় এজন্যই। তৃণার এখন মনে হচ্ছে বাবা যা করে ঠিকই করে। ঠিক তখনই তরু এসে ঢোকে বাসায়।
#
- কোথায় গিয়েছিলি তুই তরু?
- মাকে তো তখন বললামই, লেবু কিনতে গিয়েছিলাম।
- তুই মিথ্যা বলছিস।
- না। আমি মিথ্যা বলতে যাবো কেন সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে? শুধু শুধু সন্দেহ করছিস আমাকে।
- তুই মিথ্যা বললে বুঝতে পারি। কোথায় গিয়েছিলি বল?
- সব বুঝিস তুই তাই না? অরণ্য তোকে ভালোবাসতো সেটাও নিশ্চয়ই বুঝেছিলি?
- অরণ্যর কথা তুই কিভাবে জানলি?
- ওর সাথে আমার তিন বছরের প্রেম। আজ তৃণাকে রেখে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন বললো। কেন করলি এমনটা তুই?
- অরণ্য এখন কি করে?
- আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে একটা চাকরি করে। টিউশনি করায়, বিসিএস দেবে।
- এখন যদি তুই চাস, বাসায় সবাইকে অরণ্যর কথা জানাতে পারিস। এর কারণ ওর একটা পজিশন আছে। কিন্তু তুই কি চাইলেই তোর একটা বেকার ক্লাসমেটকে বাবার সামনে নিয়ে এসে বলতে পারবি যে তুই তাকে বিয়ে করতে চাস?
তরু চুপ করে রইলো। "আমি অরণ্যকে বলেছিলাম, ওর কি আমাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কিনা। ওর পায়ের নিচে মাটি ছিলো না। তাই আমি রাজীবের সংসারে গিয়েছিলাম।"
"সেখানে গিয়ে খারাপ কি আছিস? সবই তো দিচ্ছে। একটা মেয়েও আছে। সুন্দর সংসার।"
"বাইরে থেকে সবই সুন্দর গোছানো মনে হয়।"
"কি বলতে চাচ্ছিস তুই? কোনো সমস্যা চলছে তোর আর দুলাভাইয়ের?"
চারু কিছু বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তরু সেই দীর্ঘশ্বাসের অর্থ খুঁজতে থাকে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।
- বিয়ের পর তোর কখনো অরণ্যর সাথে কথা হয়েছিলো কখনো?
- নাহ। তবে গতবছর ফিরে যাবার পথে গাড়ির ভেতর থেকে দেখেছিলাম ওকে। বদলায়নি একদম। আগের মতো উষ্কখুস্ক চুল, ভাঁজ পড়া টিশার্ট, রঙচটা জিনস। একটু গুছিয়ে রাখতে পারিস না ছেলেটাকে?
- আরে কত বলি! একবার বললাম, তোমার মেসে যাব আমি। এমনভাবে তাকালো আমার দিকে যেন দুটো কিডনি চেয়ে বসেছি।
- গিয়েছিলি এরপরে?
- গিয়েছিলাম, না বলে। কি এক গোয়ালঘর বানিয়ে রেখেছে। আমি গুছিয়ে রেখে এসেছি খানিকটা।
- তুইও তো দেখি সংসারী হয়ে যাচ্ছিস।
- বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তো, অথবা তোর সুবাতাস লেগেছে গায়ে। মা শুনলে খুশি হয়ে যাবে।
- মা কি ভাবে তুই সংসারী না?
- আরে আমি ঘুম থেকেই উঠি সকাল সাড়ে আটটায়। বিছানা না গুছিয়ে চলে যাই ট্রেন ধরতে। সংসারী ভাবার কোনো কারণ আছে?
- তাও একটা কথা। আচ্ছা আমি মাকে বলে দেবো যে তার ছোট মেয়ে সংসারী হয়েছে। পাত্র দেখো। আচ্ছা পাত্র তো তুই খুঁজে ফেলেছিস।
- আমমম... আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপু।
- কি বুঝতে পারছিস না?
- আমি অরণ্যকে আদৌ বিয়ে করতে চাই কিনা।
- মানে কি বলতে চাইছিস?
- আজ ও একটা কথা বলেছে। আমি ওকে অরণ্য জেনেই ভালোবেসেছিলাম। সেও আমাকে ভালোবেসেছে, তবে তরুলতা ভেবে নয়। চারুলতা ভেবে। আমার মাঝে তোর ছায়া দেখে ও আমার প্রেমে পড়েছিলো। একটা ছায়া হয়ে ওর সাথে জীবন কাটাবো কি করে? যদি কখনো খুব বেশি আলো এসে পড়ে, আমি হারিয়ে যাবো।
- অতীত খুব গুরুত্বপূর্ন তরু। কিন্তু আমরা কখনো ভাবি না, কেন গুরুত্বপূর্ণ। অতীত কখনো সময় তৈরী করে না। সময় আমরা তৈরী করি। অতীত আমাদের তৈরী করে। আমরা আজ যা, তা অতীতের অসংখ্য ঘটনার ফলাফল।
- তুই কি বলতে চাচ্ছিস আপু?
- অতীতে অরণ্য তোকে কেন ভালোবেসেছে সেটা তুই জেনেছিস, কিন্তু জানতে চেয়েছিস ও এখন তোকে কেন ভালোবাসে? ভবিষ্যতে ও যদি তোকে ভালোবাসে, কেন ভালোবাসবে? তুই তরু, ঠিক এই কারণে যদি ও তোকে ভালো না বাসতে পারে, তাহলে এই ভালোবাসা অর্থহীন।
- হয়তো ও এখন আমাকে তরু ভেবেই ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার শিকড় কি? একটা অবাস্তব ভিত্তির উপর ভালোবাসাটা কতদিন টিকে থাকবে? তার চেয়ে এক কাজ কর, তুই দুলাভাইকে ডিভোর্স দিয়ে অরণ্যকে বিয়ে করে ফ্যাল।
- তৃণার কথা ভুলে যাচ্ছিস। আর আমি মানিয়ে নিয়েছি এই জীবনে।
- কিসের সাথে?
- সবকিছুর সাথে।
- তুই কিন্তু আমাকে...
- মা খেতে ডাকছে। চল চল। এমনিও অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ।
তরু আর কিছু না বলে উঠে যায়। চারু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রাজীবের টপিকটা এ্যাভয়েড করা গেছে।
চারুলতা
চতুর্থ পর্ব
সাজ্জাদুল আরেফিন
তৃতীয় পর্বঃ https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/860016304803867/