চারুলতা

0 16
Avatar for Nipa1234
3 years ago

তরু বেরিয়ে যায় রুম থেকে। চারু হেসে ফেলে, আজ যেন চারু ছোট আর তরু ওর বড়বোন। কি সুন্দর সব গুছিয়ে রাখছে, দায়িত্ব পালন করছে। ওরও তো বিয়ের বয়স হয়ে গেলো। একটা ভালো ছেলে দেখে তরুকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে বাবা মা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। একটা মেয়েকে যত্ন করে বড় করতেই কত বাবা মা হিমশিম খেয়ে যান। সেখানে চারুর বাবা মা দুই মেয়েকে পরম যত্নে বড় করেছেন। অভাব ছিলো, কিন্তু তা বুঝতে দেননি কোনোদিন। তরুর নিষেধ উপেক্ষা করে চারু খাটে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। স্মৃতিগুলি আবার বেরিয়ে এলো বাক্স ভেঙে, পাঁচ বছর চলে গেছে।

চারু ল্যাপটপে কাজ করছিলো। পরশু প্রেজেন্টেশন আছে একটা। গ্রুপের লিডার চারু, তাই প্রেজেন্টেশন ফাইলটা ওকেই রেডি করতে হয়। সবগুলি স্লাইড গুছিয়ে সেভ করতে যাবে, এমন সময় পাওয়ারপয়েন্টটা ক্র‍্যাশ করলো। চারু কয়েক সেকেন্ড থম মেরে বসে রইলো। প্রায় দুই ঘন্টার পরিশ্রম! রাগে ওর চুল চিঁড়তে ইচ্ছা হচ্ছে। নতুন একটা ল্যাপটপের জন্য আজই বলতে হবে বাবাকে। হঠাৎই দরজায় টোকা পড়লো।

- চারু?

- বাবা, এসো এসো।

- তুই কি ব্যস্ত নাকি? পরে আসব?

- আরেহ না বাবা। বসো।

- তুই তো ভালোই গুছিয়ে রাখিস রুম।

- অগোছালো রুম আমার পছন্দ না বাবা।

- তোর মায়েরও। আমি আবার উল্টো। অগোছালো থাকতে খুব পছন্দ করি।

- জানি বাবা। একবার একসপ্তাহের জন্য তোমাকে একা রেখে আমরা নানুবাড়ি গিয়েছিলাম। যা অবস্থা করে রেখেছিলে!

- ওটা কিছুটা ইচ্ছা করে করা। তোর মাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য। তাকে আবার বলিস না যেন এটা।

- আচ্ছা যাও বলবো না।

- চারু, তোর সাথে দরকারি একটা কথা ছিলো।

- কি কথা বাবা?

- তুই তো সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে ফেললি। বিয়ের ব্যাপারে কি একটু ভেবে দেখবি?

- পড়াশোনা শেষ করতে দেবে না?

- আমি তো চেয়েছিলাম তুই গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলে তারপর তোর বিয়ের কথা ভাববো। কিন্তু তুই তো দেখিস আশেপাশের মানুষ কি বলছে, কি করছে। দুশ্চিন্তা হয় ভীষণ। পড়াশোনাটা তো বিয়ের পরেও করতে পারবি, তাই না?

চারু বলার মতো কিছু পাচ্ছিলো না। "তুই একটু সময় নে, ভেবে দ্যাখ।" রায়হান সাহেব আস্তে আস্তে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। চারু চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়। ওর মাথাটা মনেহয় হুট করে খালি হয়ে গেছে। বিয়ের ব্যাপারে চারু তেমন কিছু ভাবেইনি। কত স্বপ্ন ছিলো! কিছুই হবে না। চারুর হঠাৎ মনে পড়লো, বাবাকে ল্যাপটপের কথা বলা হয়নি। পরক্ষণেই মনে হলো, আর দরকার নেই। প্রেজেন্টেশন আর জমা দিতে হবে না।

চার দিন কেটে গেলো। এই চারদিন চারু বাসার বাইরে পা দেয়নি। শুধু ভেবেছে। বাবার অবস্থা ও জানে। এই এলাকার মানুষের মেন্টালিটি ও জানে। একা একা তো আর মানুষের মেন্টালিটি বদলানো যাবে না। কিন্তু যদি যেতো? যদি চারু একাই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতো সবার বিরুদ্ধে? এসব হাবিজাবি ভাবছিলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হুট করে শিউলি গাছটার দিকে চোখ গেলো। অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে শিউলি গাছটার পাশে মাথা নিচু করে। চারু আজ প্রথমবার খুব ইচ্ছে করতে লাগলো অরণ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, কথা বলতে। আচ্ছা কি কথা বলবে চারু? "অরণ্য, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? আমার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? আমাকে নিয়ে দুরে কোথাও চলে যাবে, প্লিজ? যেখানে কোনো মানুষ থাকবে না, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারবো প্রাণভরে। এখানে দমবদ্ধ লাগে আমার।"

চারু নিজের ছেলেমানুষী চিন্তার ধরণ দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। অতটা সাহস থাকলে তো হয়েই যেতো। দুশ্চিন্তার কিছুই ছিলো না। কিন্তু চারু ভীতু। অরণ্যের ভালোবাসা গ্রহণ করার সাহস ওর নেই।

অরণ্য পরের দিনও এসে দাঁড়িয়ে রইলো। চারু নামলো না। এর পরের দিনও নামলো না। ছেলেটা রোজ সকাল থেকে বিকাল অবধি দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হতাশ হয়ে ফিরে যায়। অরণ্যর মুখে হতাশা মানায় না। কিন্তু চারুর কি করার আছে? চতুর্থ দিনে চারু নেমে এলো। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। অরণ্য আজও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হাতের মুঠোয় চিঠিটা দেখা যাচ্ছে।

- অরণ্য, আমার...

- বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি জানি।

- কিভাবে জানো? আর জানোই যখন, কেন আসো? কেন দাঁড়িয়ে থাকো? কিসের অপেক্ষায়?

- অপেক্ষায় না, প্রতীক্ষায়। তোমার প্রতীক্ষায়।

অরণ্য প্রথমবার চোখ তুলে তাকালো চারুর দিকে। চারু অবাক হলো, অরণ্যর চোখগুলি কি প্রচন্ড সুন্দর! একবার দেখেই প্রেমে পড়তে বাধ্য এমন সুন্দর চোখ। কোনো ছেলের চোখ এতো সুন্দর হতে পারে চারুর ধারণাই ছিলো না।

- অরণ্য, তোমাকে আমি যতটা চিনি, তুমি ছেলেমানুষ না। তুমি তো এখনো পড়াই শেষ করতে পারো নি। তুমি কি পারবে এই সবকিছু থামিয়ে দিতে? পারবে সবাইকে অস্বীকার করে আমাকে বিয়ে করতে? বলো পারবে?

- না। পারবো না। সে ইচ্ছা নিয়ে আমি আসিও নি। আমি শুধু চিঠিটা দিতে এসেছি। তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি। আমি জানি আমি চাইলেও আর তোমাকে চিঠি লিখতে পারবো না। অধিকারের কাঠগড়া আমি ভয় পাই।

অরণ্য চিঠিটা বাড়িয়ে দিলো চারুর দিকে। চারু চিঠিটা নিতে গিয়ে খেয়াল করলো ওর হাত কাঁপছে। কেন? ও কি অরণ্যকে ভালোবাসে? না। এমন তো না। অরণ্যর সাথে ওর ফোনে কথা হয়না। রোজ রোজ অভিসার হয়না, আড্ডা হয় না। পার্কের বেঞ্চে কিংবা গাছের নিচের নির্জনতায় স্মৃতি জমে না। তাহলে কেন চারুর এতো যন্ত্রণা হচ্ছে? চারু চিঠিটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে উপরে উঠে এলো। বারান্দায় এসে দেখলো অরণ্য হেঁটে চলে যাচ্ছে৷ এলাকার মোড় অবধি ওর নীল টিশার্টটা দেখা গেলো। চারু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চোখের নদীর পাড় ছাপিয়ে ফোঁটায় ফোটায় পানি নামতে থাকলো। চারুর বোধহয় সেদিকে হুঁশ নেই, কারণ ওর মাঝে চোখ মোছার কোনো তাগিদ স্পষ্ট হলো না।

"এ্যাই চারু, তুই কাঁদছিস নাকি?" চারু স্মৃতি ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলো। তরু দাঁড়িয়ে আছে ঝাড়ু আর বেলচা নিয়ে। চারু তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে গেলো শাড়ির আঁচলে। তরু বেলচা ঝাড়ু রেখে চারুর পাশে এসে বসলো, তারপর জড়িয়ে ধরলো বড়বোনকে। চারুর চোখ আবার ভিজে গেলো। কিন্তু কিছু বললো না ও। শুধু তরুকে জড়িয়ে ধরলো চুপচাপ।

ফুলদানির ভাঙা টুকরোগুলি দুই বোনের এই নীরব কষ্ট বিনিময়ের দৃশ্য দেখলো।

#

আকাশে মেঘ জমে যাচ্ছে। তৃণার মন খারাপ। বাসার বাইরে কি সুন্দর খেলার জায়গা! ও বাসায় এমন খোলামেলা পরিবেশ পায়না। সারাদিন বাসার ভেতরে থাকতে হয়। আকাশে মেঘ আসার আর সময় পেলো না! তৃণার একটু একটু রাগও হচ্ছে। ও রাজীবের পাশে এসে চুপ করে বসলো। রাজীব ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তৃণা ওর পাশে এসে বসেছে সেদিকে ওর খেয়ালই নেই। তৃণা মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবার চোখে অসুখ। বাবা কিছু নির্দিষ্ট জিনিস ছাড়া কিছু দেখে না। এই যে ফোন দেখছে, কিন্তু তৃণার মন খারাপটা দেখছে না। বাসায় থাকলে শুধু মায়ের দোষ দেখে, মাকে মারে। তখন দরজার পাশে দাঁড়ানো তৃণার ভয়ার্ত মুখ বাবা দেখে না। মায়ের গায়ের কাটাগুলি বাবা দেখে না। বাবা শুধু নিজের অফিসের কাজ দেখে আর মায়ের ভুল দেখে। তৃণা ভয় পায় বাবাকে। কোনো ভুল করলে ও মায়ের জামার ভেতরে গিয়ে লুকায় আর বলে,"আম্মু আমি খারাপ কসসি। বাপিকে বলিও না। আমাকে লাঠি দিবে তোমার মতো।" মা একদম চুপ হয়ে যায়। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে। কেন, সেটা অবশ্য তৃণা বোঝে না।

রায়হান সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন তৃণাকে খুঁজতে খুঁজতে। মেয়েটা বাইরে খেলছিলো, শুধু শুধু জোর করে নিয়ে এলেন। এখন মেয়েটার মুখ দেখে মায়া লাগছে। মেয়েটা একদম চারুর মতো হয়েছে। চারুও চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকে, কাওকে কিচ্ছু বলে না। রায়হান সাহেব ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে চারুর ঘরে ঢুকলেন। তরু বেলচা দিয়ে মেঝে থেকে ভাঙা কাঁচ তুলছিলো তখন। চারু বাবাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো, "ওখানেই দাঁড়াও বাবা। কাঁচের টুকরোগুলি তুলে নিক। এরপরে আসো।" রায়হান সাহেব চারুর কথা শুনেও ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। "এই তরু শোন, কাঁচগুলি ফেলে দিয়ে তৃণাকে নিয়ে ছাদে ঘুরে আয় তো একটু। মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে।" তরু চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। রায়হান সাহেব এসে মেয়ের বেডে বসলেন।

- কিরে, এতদিন পর এলি। কেমন লাগছে?

- গেস্ট গেস্ট ফিল হচ্ছে বাবা।

- তোরা তো এখন গেস্টই।

- বিয়ের পর তো সব মেয়েই বাপের বাড়িতে গেস্ট হয়ে যায়।

- তুই নিজেকে পর ভাবলে কি করে হবে?

- আমি তো পরই বাবা। কেউই তো আপন করে নিলো না। দেখো মেয়েটাও মন খারাপ করে তার বাবার পাশে গিয়ে বসে। জানে তার বাবা কাজে ডুবলে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না। তাও বাবার কাছেই যায় ও।

- তুই কি তোর মায়ের কাছে যেতি?

- না। কিন্তু এখন মা হওয়ার পর বুঝি, মায়েরা সন্তানের জন্য কি অনুভূতি পুষে রাখে।

- তোর মা কিন্তু আসলেই তোদের ভালোবাসে...আমার চেয়েও বেশি।

- আমরা যাদের কাছে ভালোবাসা আশা করি, তারা আমাদের মূল্যায়নই করে না।

- এটা... সত্যি কথা বলেছিস। তুই হুট করে অনেক বড় হয়ে গেছিস।

- পরিস্থিতি আর দায়িত্ব মানুষের বয়স বদলে দেয়, বাবা।

- তুই ভালো আছিস তো মা?

- ভালো থাকতে যা যা লাগে সবই তো আছে আমার, খারাপ থাকার কোনো কারণ তো নেই। তাই না বাবা?

চারুলতা

দ্বিতীয় পর্ব

সাজ্জাদুল আরেফিন

প্রথম পর্ব- www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/857467278392103/

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments