চারুলতা

0 13
Avatar for Nipa1234
3 years ago

চারুর কথার মধ্যে কিছু একটা ছিলো। রায়হান সাহেব কিছু বললেন না। রাজীবের সাথে কথা বলা দরকার একটু। চারু প্রচন্ড সংসারী মেয়ে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। তাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানা দরকার। রায়হান সাহেব চুপচাপ উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই পায়ের তালুতে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলেন। "উহহ!"

চারু খাট থেকে নেমে এলো তাড়াতাড়ি। বাবাকে ধরে বসিয়ে দিলো খাটে। তারপর উবু হয়ে পায়ের কাছে বসলো। "কাঁচ ঢুকেছে বাবা। ছোট, ব্লিডিং হবে না খুব একটা।" বলতে বলতে চারু সাবধানে কাঁচের টুকরোটা বাইরে বের করে আনলো। ভোঁতা এক টুকরো কাঁচ, ভেতরে ঢুকতে পারেনি। চারু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, "তরু ভুল করে ফেলে গেছে টুকরোটা। খেয়াল করেনি। এখন উঠে দাঁড়াতে পারবে?" রায়হান সাহেব খাট ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। চারু এসে বাবার ডানহাতটা ধরলো শক্ত করে। "ছেড়ে দে। আমি পারবো।" রায়হান সাহেব নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন। পায়ে সামান্য ব্যাথা করছে। সেটা সয়ে যাবে। চারু হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো একপাশে। রায়হান সাহেব বেশ তাড়াহুড়োতেই বেরিয়ে গেলেন চারুর রুম থেকে। তাঁর কপালের সুক্ষ্ণ ভাঁজের মতো এই ব্যাপারটাও চারুর চোখ এড়ালো না।

“রানু, মাংসটা নামিয়ে রাখ।” খালেদা শসা কাটতে বসলেন। পোলাও মাংসের সাথে সালাদ না হলে তো চলে না। তখনই তরু বেলচা হাতে ঢুকলো। “বেলচায় কি রে?”

“ভাঙ্গা কাঁচ। ফুলসানিটা ভেঙ্গে গেছে।”

“নতুন ফুলদানিটা? চারুর রুমে যেটা দিয়েছিলি?”

“হ্যাঁ।”

“ফ্রিজ থেকে লেবু নিয়ে আয় তো দুটো।”

“লেবু নেই। ফ্রিজের দরজার সাথে অর্ধেকটা আছে, ওটা কবেকার তাও মনে নেই।”

“এখন কি করব বল তো? লেবু দেবো না? রানু তুই এক দৌড়ে নিয়ে আয় তো দুটো লেবু।”

“থাক ওকে পাঠিও না মা। আমি তৃণাকে নিয়ে যাই। বাবাও বললো ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে।”

“যা তাহলে। তাড়াতাড়ি আসিস।”

তরু নিজের রুমে ঢুকলো। চুলটা একটু গুছিয়ে নিলো, পার্সটা নিয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ লিখলো, “আমি বের হচ্ছি অরণ্য। তুমি জিইসি মোড়ে দাঁড়াও।” তারপর আয়নায় শেষবারের মতো একবার মুখটা দেখে নিলো। তারপর তৃণাকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

রায়হান সাহেব এসে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসলেন। রাজীব এখনো ফোনেই ব্যস্ত আছে। রায়হান সাহেব কোথেকে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।তার দৃঢ় বিশ্বাস চারুর সাথে রাজীবের কোনো ঝামেলা চলছে। কিন্তু রাজীব ঝামেলা করার মানুষ না। চারুও খুব সংসারী মেয়ে। কিন্তু তবুও কিছু একটা খটকা আছে। সেটা কি রায়হান সাহেব বুঝতে পারছেন না।

"রাজীব, ব্যস্ত নাকি তুমি?"

"আরে না আব্বা।"

রাজীব ফোন নামিয়ে রাখলো। রায়হান সাহেব বেশ খুশি হলেন জামাইয়ের এই ব্যবহার দেখে।

- আসার পর থেকে তোমার সাথে ভালো করে কথাই হলো না।

- জ্বি আব্বা। আসলে আমি অফিস থেকে ছুটি নেই না তো, তাই সবাই একরকম নির্ভরশীল হয়ে গেছে। আপনি তো বুঝবেন, অনিয়মিত মানুষের উপর কেউ সচরাচর ভরসা করতে চায় না। যা দায়দায়িত্ব সব আমাদের মতো মানুষদের ঘাড়ে এসে পড়ে।

- তা যা বলেছো জামাই। আমিও তো ছুটি নিই না। আজ তোমরা আসবে বলে অফিস যাই নি, তাতেই তুলকালাম অবস্থা বলা যায়।

- আব্বার চাকরি আর কত বছর আছে?

- ৭ বছরের একটু বেশি আছে। কিন্তু বুড়িয়ে গেছি এখনই।

- কে বলেছে? আপনি তো এখনো জোয়ান, আমাদের মতো। যদি বলেন পাত্রী দেখি, আবার বিয়ে করিয়ে দিই।

- তোমার শাশুড়ি আম্মাকে সামলেই পারি না, আবার আরেকটা?

- আম্মাকে আমি সামলাবো। মিয়া বিবি রাজি হলেই হয়।

- না না থাক। আচ্ছা তোমার সাথে একটা কথা ছিলো।

- হ্যাঁ আব্বা বলেন না।

- তোমার আর চারুর মাঝে কি সব ঠিক আছে? কোনো ঝামেলা হচ্ছে কি?

- না কোনো ঝামেলা তো নেই। ও কি কিছু বলেছে?

- না ও কিছু বলে নি। কিন্তু বাবা তো আমি, চিন্তা হয় আরকি ওর জন্য অনেক।

- আমাদের তো সবই ঠিক আছে। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।

- সেটাই হবে। তা তোমরা তো থাকছো দুদিন, তাই না?

- না আব্বা, আমরা আজই ফিরে যাব। আমাকে কাল অফিসে যেতেই হবে। বারবার ফোন দিচ্ছে।

- এতোদিন পর এলে, ভাবলাম দুদিন থেকে যাবে। তৃণাকেও তো আমরা পাই না খুব একটা।

- আমি বুঝতে পারছি আব্বা। কিন্তু অফিস থেকে প্রচুর ঝামেলা করছে। থাকা যাবে না কিছুতেই।

- তাহলে তো আর কিছু করার নেই। আমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখি খাবারের আয়োজন কতদুর হলো।

রায়হান সাহেব সোফা থেকে উঠে এলেন। তার মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেছে। রান্নাঘর থেকে পোলাওর গন্ধ ছড়াচ্ছে। কতদিন পর বাসায় একটা উৎসব উৎসব ভাব এসেছে। কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য।

- খালেদা, রান্না কতদুর হলো?

- মাংস, মাছ আর পোলাও হয়ে গেছে। চিংড়িগুলোও ভাজা হয়ে এসেছে। তরু লেবু আনতে গেছে। ও আসতে আসতে হয়ে যাবে।

- তরু কেন গেল?

- তুমি নাকি ওকে বলেছো তৃণাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে?

- হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আগে কেন বলো নি যে লেবু নেই বাসায়?

- আমরা কেউ লেবু খাই বাসায় যে বলবো?

- তাও আগে থেকে সব ভেবে রাখবে না? সকালটাও তো বসে ছিলাম বারান্দায়। বললেই নিয়ে আসতাম।

- এখন তরু গেছে তো। তুমি এতো কথা বোলো না তো। যাও ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসো। জামাইয়ের সাথে গল্প করো। রানু চিংড়িটা নেড়ে দে তো একটু খুন্তি দিয়ে।

রায়হান সাহেব রান্নাঘরের দরজা থেকে সরে এলেন। কিন্তু ড্রয়িং রুমে গেলেন না। বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারন্দাটায় এসে বসলেন। তাকিয়ে রইলেন বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটার দিকে। চারুর সাথে কি আরেকবার কথা বলবেন তিনি?

#

"তৃণা আইসক্রিম খাবি?"

"আম্মু বকবে না খালামনি?"

"আম্মু জানলে তবেই না বকবে!"

"তাহলে খাবো।"

তরু তৃণাকে নিয়ে একটা আইসক্রিমের দোকানে ঢুকলো। পে ফার্স্ট সিস্টেমে চলে এসেছে এই দোকানটা। তরুর মনে আছে আপু কলেজে ওঠার পরও ওরা দুজন এই দোকানে আসতো। এখনকার মতো কাঁচঢাকা ছিলো না দোকানটা। দুই বোন বাসায় ফেরার সময় এই দোকানে ঢুকে আইসক্রিম নিতো। তারপর টাকা না দিয়ে দৌড় দিতো। দোকানের লোকটা দৌড়ে আসতে আসতে ওরা অনেকদুর চলে যেতো। তরু হঠাৎ স্মৃতিগুলি নিয়ে থমকে গেলো।

"খালামনি, খালামনি..." তৃণা হাত ধরে টান দিলে তরুর সম্বিৎ ফেরে। আইসক্রিম নিয়ে তৃণাকে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে তরু বললো,"তুই এখানে বসে আইসক্রিম খেতে থাক। আমি কিছু জিনিস কিনে নিয়ে আসি বাসার জন্য। কোথাও যাবি না কিন্তু! আমার পাঁচমিনিট লাগবে। আঙ্কেল বাচ্চাটাকে একটু দেখবেন।" বলে তরু বেরিয়ে আসে।

তরু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অরণ্যর নাম্বার খুঁজতে শুরু করে।

- বয়ফ্রেন্ডকে ফোন দিচ্ছো?

- হ্যাঁ দিতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি আর দিতে দিলা কই?

- আমি কি করলাম? দাও তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কল!

- হইসে আর ঢং কইরো না তো। এতোদিন পরে দেখা হইসে কই আমার খোঁজ খবর নিবে তা না, উনি আছেন উনার উল্টাপাল্টা কথা নিয়ে।

- আচ্ছা কেমন আছো?

- রাজরাণীর মতো। দেখে বুঝতে পারছো না কেমন আছি?

- আরে তুমিই তো বললে তোমার খোঁজখবর নিতে!

- খোঁজখবর নেয়া লাগবে না। আপুর মেয়েকে বসিয়ে রেখে এসেছি।

- কোন আপুর মেয়ে?

- আমার একটা বড় বোন আছে বলেছিলাম না?

- বলেছিলে বোধহয়। কিন্তু ডিটেইলস বলো নি কখনো।

- বলি নি? ইচ্ছে করেই বলি নি তাহলে। তোমার প্রেম তো আমার সাথে। আমার বড়বোনের পরিচয় জেনে কি কাজ তোমার?

- আরে বাসায় জানাজানি হলে বড়বোনই তো সাপোর্ট করবে!

- হয়েছে অত ভাবতে হবে না।

- তোমার আপুর নাম কি তোমার সাথে মিলিয়ে রাখা?

- হ্যাঁ। তবে আপুর নামটা সুন্দর। চারু। চারুলতা। আমার নামটা কেমন যেন! শুনলেই লতাপাতা জংলার কথা মাথায় আসে।

- তোমার আপু কোথায় পড়তো?

- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারিতে। ও যখন থার্ড ইয়ারে তখন ওর বিয়ে হয়ে যায়। সাড়ে চার বছর হয়ে গেছে বোধহয়।

- আচ্ছাআআআ…

- এভাবে আচ্ছা বলার কি আছে? তুমি চেনো নাকি?

- হ্যাঁ।

- কিভাবে?

তরু অরণ্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো অরণ্যকে। অরণ্য বুঝতে পারলো ওকে সত্যিটা বলতে হবে।

“আমি চারুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। রাস্তায় দেখেছিলাম, ভালো লেগে গিয়েছিলো। চেয়েছিলাম কিছু হোক। ওকে আমি চিঠি দিতাম মাঝে মাঝে। কখনো উত্তর দিতো না। আমি উত্তর চাইতামও না। ও কখনো কথা বলতো না আমার সাথে। চিঠিগুলি পড়তো কিনা তাও জানি না। শেষ যেদিন আমাদের দেখা হয়, ও বলেছিলো ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি যেন আর না যাই। আমিও তখন থার্ড ইয়ারে। কিছুই করার ছিলো না আমার।”

“এখন যাও? এখন তো চাকরি আছে, এখন গিয়ে চারুকে বলো, তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও।”

“তরু! তুমি কি বলছো এসব?”

চারুলতা

তৃতীয় পর্ব

সাজ্জাদুল আরেফিন

দ্বিতীয় পর্বঃ facebook.com/groups/526513374820830?view=permalink&id=859105034894994

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments