পর্ব :- ০৩
লেখিকা :- #তাসনিয়া_আলী 🍁
আমার মেয়ের নামটা তার দাদীমা রেখেছিলেন( সুবাইতা বিনতে রাজীব) ডাকনাম জাইমা। আমি অনেক স্পৃহা সহকারে অত্যাধুনিক নাম রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আম্মার ভালোবাসার কাছে আমি নত স্বীকার করে আমার মেয়ের নাম নিজের মতো রাখতে পারিনি।
তার লাশের পাশে সুবাইতাকে কোলে নিয়ে বসে সেইদিনের কথা আমার অনবরত মনে হচ্ছে । পুরো পাথর হয়ে গেছি আমি, এই মানুষটাকে এতটা দিন আগলে রেখেছি কিন্তু তার শেষ সময় আমি পাশে থাকতে পারলাম না। এই মানুষটাকে প্রথম থেকেই আমি বেশি ভালবাসতাম । সে নিজেও আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, নিজেকে খুব বেশি অসহায় লাগছে। তার লাশের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো তিনি অভিমানি ভঙ্গীতে আমার দিকে তার সেই তিক্ত কথা গুলো বলছেন,
" ছোটো বৌমা গো, তুমি আজকে ছিলে না কেন? তুমি থাকলে আমার বাথরুমডা অমন পিচ্ছিল হতো না, আর আমি পরে মরতাম ও না।"
আমার স্বামীকে কেউ সান্তনা দিতে পারছেন না । রক্তিম কাঁদছে না, কিন্তু সে পাথর হয়ে গেছে। মাথায় হাত চেপে মায়ের লাশের সামনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাড়িতে আমার অন্য ভাসুর, জা, ননদরা কান্নায় ভেঙে লুটিয়ে পরেছেন। লাশ বাড়ি থেকে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমার বড়ো ভাসুর চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
" মারে, তুমি এইভাবে চলে গেলে। তুমি আমার কাছে থাকলে কোনোদিনও এত নির্মম মৃত্যু পেতে হতো না তোমার। তোমার আদরের শিক্ষিত বউয়ের ঘরে দুটো ভাতের যে বড়ো দাম, সেইটাই তুমি বুঝলে না। চলে গেলে আমাদের ছেড়ে। "
•
মরা বাড়িতে শোক পালনের থেকে আমাকে নিয়ে কুরুচি পূর্ণ বক্তব্যের আসরটা বেশি ভালো জমলো। পৃথক কিছু আসরে কিছু সময় চিৎকার করে কান্নাকাটি করার পর শোকাহত মানুষটির মুখ থেকে অনর্গল আমার সংসারে আমার শাশুরির অবস্থানের গল্প রচিত হতে থাকলো, এবং সান্তনা প্রদানকারী ব্যক্তিরা তিলের তাল রূপটি অন্তরে ধারণ করে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগলেন ।
•
আমার পাশে আমার অসহায় মা সুবাইতাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। আমি নামায আদায় করে আমার শাশুরির আত্মার মাগফেরাত কামনা করে উঠে দেখি মা আমার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।
- কী হলো আম্মু? এইভাবে কী দেখছো?
- মারে, এই বাড়িতে তোর অবস্থান খুব নড়বড়ে। আমি মা, আমাকেও কোনোদিন কিছু বলিসনি। আজকে মানুষ আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কথা বললো। আমার তো তোর মা, তোকে আমি চিনি । আমি কিভাবে সহ্য করলাম সেইটা আমি জানি। আর এতকিছু সহ্য করে তুমি কিভাবে এইখানে পরে আছিস? আমার সাথে চল। জামাই থাকেনা এইখানে, তুমি এদের সাথে একা কিভাবে জীবন কাটাবি? আমার কাছে চল, না হয় মানুষের বাড়িতে কাজ করে হলেও তোর কোন অভাব রাখবো না। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে এইভাবে দেখতে পারবো না। হাতে ধরে তোকে আমি বলি দিয়ে দিছি, আটকাতে পারিনি কোনো কিছুর মূল্যেও ।
- মা আমি অনেক সুখী। আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। তার পর্যাপ্ত যত্নে আমি এইখানে অনেক ভালো আছি। আমার শাশুড়িও অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আর যাদের কথা শুনে তুমি কষ্ট পাচ্ছো তারা দুদিনের অতিথি। তাদেরকে আমার পরিবারের অভ্যন্তরীণ সদস্য আমি মনে করি না যে তাদের কথা গায়ে লাগিয়ে আমি রক্তিমের হাত ছেড়ে দিবো। আর সব থেকে বড়ো কথা রক্তিম মা ছাড়া পুরো অচল। ওর এই দুনিয়াতে আমি ছাড়া আপন আর কেউ নেই, আর থাকলেও না। আমি এতবড়ো অমানবিক হতে পারবো না ওর সাথে। আমাকে ওর দরকার, আমার পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করতে হবে তাকে । তুমি আমার জন্য দোয়া করো আমি যেনো শক্ত হাতে সব কিছু আয়ত্ত করতে পারি ।
.
.
মা ওইদিন অনেক কান্নাকাটি করছিলেন, এই বাড়িতে আমার অবস্থান দেখে তিনি নিজেই হতভম্ব। কিন্তু মায়ের এত উদ্ধিগ্ন হওয়াতে আমি কিছুই মনে করিনি। আমার সংসারে ভাঙনের আভাস দেখা দিতেই পারে, সেইটা আমাকেও প্রতিহত করতে হবে। এমনটাই ভেবে প্রবল মনোবল চাঙ্গা করে নেমে পড়লাম এক নতুন ধরনের জীবন যুদ্ধে। আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম, এইখানে রক্তিমের উপস্থিতিও আমি পাবো না। তেমনটাই হলো, রক্তিম মনে হলো এক দমকা হাওয়াতে পুরোপুরি ভেঙে লুটিয়ে পড়লো। সে মুখে কিছু না বললেও আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম, মায়ের চলে যাওয়াতে সেও মোটামুটি ভাবে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছে। অন্য দশজন যেমন বিষয়টা ধারণ করেছে, রক্তিমের ও মনে হচ্ছে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য অনেকটাই আমার অন্যায় আবদার জড়িত। চোখের নিমেষেই আমার তার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের থেকে শুধু জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণ স্বামী স্ত্রীতে পরিণত হলো। কিছুদিন বাদেই মা হারানো শোক বুকে চেপেই রক্তিম তার কর্মস্থলে ফিরে গেলো। আমি থেকে গেলাম শশুরবাড়ি নামক এই অন্ধকার পুরীতে একা আমার মেয়েকে নিয়ে, প্রচন্ড একা। এই সময়টাতেই আমি পুরোপুরি ভাবে আমার অস্তিত্বের অবনতির কথাটা উপলব্ধি করতে পারছিলাম। আসলে একটা মেয়ের জন্য শশুর বাড়ির ধাক্কা সামলানো যে খুব সহজ বিষয় না সেইটা উপলব্ধি করতে আমার খুব অল্প সময় লেগেছিল। জীবন যুদ্ধে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে অনেক কিছু আমাকে হারাতে হলো। লেখাপড়ার বিষয়ে ওইদিন পর থেকে আমি আর কখনও ভেবেও দেখিনি।
"যেইখানে টিকে থাকাটাই অস্বাভাবিক, সেইখানে নিজের সত্তার বিকাশ ঘটানোর ইচ্ছাটা নেহাত দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। "
সময় যেতে থাকলো, বাড়িতে সবার পরিবেশ সাবলীল। যে যার মতো নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলো। মা হারানো শোকটাও সবাই কাটিয়ে উঠলো। আমি আমার সুবাইতাকে নিয়ে রয়ে গেলাম একা এই বাড়ির প্রান্তে। আসলে মা হওয়ার একটা সুবিধা আছে, বয়সে আমি যতই ছোটো মা হইনা কেনো, আমার বাচ্চার মুখের দিকে তাকালে রাজ্যের প্রতিটা জিনিস আমার কাছে তুচ্ছ লাগতো।
কিসের দুঃখ? কিসের কষ্ট? কিসের না পাওয়া অভিযোগ? আমি একজন মা। আমার সামনে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট সুখময় নিষ্পাপ হাসির ভান্ডার আছে। আমার কোনোই দুঃখ নেই, তাকে আগলে রেখেই আমি হাজার বছর অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারবো। তেমনটাই দিন চলছে, আমি পুরো একা আমার ভাগে পাওয়া দুটি ঘরের মধ্যে আমার ছোট্ট সোনাকে নিয়ে। মাসে মাসে আমার ব্যাবহৃত মোবাইল নাম্বারে টাকা চলে আসে। খাওয়া-পড়াতে কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। গায়ে বল ছিল, মোটা ভাত মোটা কাপড়ে দিন চলে যাচ্ছিলো। আম্মা মারা যাওয়ার পর রক্তিম টানা ৪ মাস বাড়ি ফিরলো না। ফোনে কল দিয়ে শুধু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে, বাবুর কথা শুনে সেইটাও খুব অল্প সময়ের জন্য। এইভাবে অতিবাহিত হচ্ছিলো আমার জীবন। বাড়িতে কেউ আমার সাথে তেমন কথা বলে না, কিন্তু সুযোগ পেলে কথা শোনাতে কেউ ছাড় দেননা। পাড়া প্রতিবেশী এসেও আমাকে নিয়ে কথা তোলে, হাসাহাসি করে। আমার সেই আগের সমস্যাটা আবার আমাকে মানসিক অশান্তি দেই। দূরের কথা শোনার শক্তি একটু বেশিই আমার মধ্যে কাজ করে। নিজের উপর প্রচুর রাগ হয়, কেনো আমি এতটা স্পষ্ট মানুষের খারাপ কথা গুলো শুনতে পাই? এমন কথা জিজ্ঞেস করে সারাক্ষণ আমার মন। কিন্তু দিনে দিনে এগুলো আমার দৈনন্দিন সঙ্গীতে পরিণত হলো।
দিন কাটতে লাগলো, আমার মেয়ের বয়স ৫ মাস তখন। হঠাৎ একদিন ভোর রাতে আমার মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। আমি মাত্র নামায শেষ করে উঠে এসে ফোন ধরলাম। ঐপাশ থেকে অচেনা এক কণ্ঠে বলে উঠলো,
" আসসালাময়ালাইকুম, আপনি কি মিসেস রক্তিম বলছেন ? "
" ওয়ালাইকুম্যাসালাম! জি আমি বলছি। আপনি কে বলছেন? "
" আমি স্যারের সহকর্মী বলছি, মনোয়ার হোসেন । আসলে ম্যাডাম আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি। "
কথাটা শুনেই আমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করতে লাগলো । আমি একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
" জি বলুন। কী বলতে চান? "
' ম্যাম, আসলে রক্তিম স্যার গতকাল রাতে মোটর সাইকেল অ্যাকসিডেন্টে করেছেন । আপনি অনুগ্রহ করে আজকের মধ্যেই এইখানে চলে আসার চেষ্টা করুন। স্যারকে আমরা হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি। আপনি দ্রুত আসার চেষ্টা করুন, আর এই নাম্বারে যোগাযোগ করলেই সমস্যা হবে না । "
আমি তাৎক্ষণিক নিজের ভেতর থেকে হারিয়ে গেলাম । ফোনটা রেখেই দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম বড়ো ভাসুরের ঘরের বারান্দায়। আমার চিল্লাচিল্লিতে তাদের সকলের ঘুম ভেংগে গেল। সবকিছু শুনে তারা আমাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। তারপর কিছু সময় পর আমাকে নিয়ে রওনা হলো আমার বড়ো ভাসুর এবং ননদের ছেলে। সাথে আমার মেয়ের খাবারের দ্রব্য এবং ওর প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী নিয়ে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে । সেইদিনই আমার জীবনের প্রথম ঢাকা যাত্রা ছিল। আগে হাজারো ইচ্ছা থাকলেও কখনো ঢাকা যাওয়া হইনি আমার, এই প্রথম পাড়ি জমাচ্ছি। কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। আমার স্বামীর বিপদে, আমার স্বামীর রক্ষাত্রে আমি প্রথম ঢাকা শহরে পদার্পণ করলাম।
সিএনজি মেডিকেল এরিয়াতে ঢুকতেই আমার চোখে খুব স্পষ্ট ভাবে পড়লো, ( ঢাকা মেডিকেল ) । অনেক বড়ো সাইন বোর্ড এই লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি । হঠাৎ আমার ভাসুর বললেন,
" দ্রুত নামো। আমরা চলে এসেছি, এইখানেই ওরা ঠিকানা দিয়েছে। ওই লোকের নাম্বারটা দাও।"
আমি দ্রুততার সাথে নাম্বার বের করে দিলাম। আমার ভাসুর সেই লোকটিকে ফোন দিলেন এবং অবশেষে আমরা রক্তিমের সামনে উপস্থিত হলাম। আসলে জীবনটা কখনোই সিনেমাটিক হয় না। হ্যাঁ, সেইটাই ঠিক। আমার জীবন কখনোই সিনেমাটিক হবে না সেইটাও ১০০ ভাগ সত্য। আমার প্রত্যাশিত মানুষটি শুয়ে আছে মেডিকেলের তিন তলার সিড়ির নিচে। তাকে ওইখানে দেখে আমার ভাসুর বলে উঠলেন,
" একটা ওয়ার্ড এও কি জায়গা হলোনা ওর জন্য? কিসের ব্যবস্থা করেছেন আপনারা কালকে থেকে? "
" ভাই আপনি রেগে যাবেন না । এই জায়গাটায় ভালো ওনার জন্য। কেবিন পাওয়া দুষ্কর, ওয়াডের যা অবস্থা, তার থেকে এইটাই নিরাপদ। তবুও আমরা চেষ্টা করছি আজ কালকের মধ্যে কেবিনের ব্যবস্থা করার জন্য। "
তারা কথোপকথন অব্যহত রাখলো, আমি অপলকে চেয়ে আছি রক্তিমের অসাড় দেহের দিকে। পুরো শরীর সাদা গজে আবৃত থাকলেও তাকে চিনতে আমার একটুও কষ্ট হলো না। হ্যাঁ, সেই মানুষটি। এইতো সংসারের টাকা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে তাকে একটি আংটি উপহার দিয়েছিলাম আমি, সেইটা তার হাতে আছে। তার চোখের কোণের ছোট্ট তিলটি ও আমার চোখে পড়লো। কিন্তু ঠোঁটটা খুব বেশি বিধঘুটে লাগছে। ছোপ ছোপ রক্তের চিহ্ন এঁকে আছে। তাকে দেখে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার সুবাইতাকে কোলে নিয়েই তার দিকে অগ্রসর হলাম, প্রবল কান্নায় ভেংগে গিয়ে। পাশে থাকা এক নার্স অনেক খারাপ ব্যবহার করে আমাদেরকে সেইখান থেকে সরিয়ে দিলো। তার যথাযথ বিশ্রামের প্রয়োজন। অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। লোকজনের ভিড় কম হলেই ভালো হবে। ছন্নছাড়া ভাবে সেইখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো আমাকে। পাশের করিডোরে এক বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলাম। তখনও আমি কান্না করছি, আর মধ্যে আমার মেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় কান্না করতে লাগলো, তাকে আমার খাওয়ানোর দরকার কিন্তু আমি কখনোই তাকে মানুষের মধ্যে খাওয়াতে অভ্যস্ত নই। আমাকে এমন অবস্থায় দেখে একজন মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে নিয়ে তার স্বামীর কেবিনে জায়গা করে দিলেন। সেইখানেই কোণায় বসে আমি আমার মেয়েকে দুধ খাওয়ালাম ।
ঢাকাতে আমাদের স্থান হলো রক্তিমের এক ফুফাতো ভাইয়ের বাড়িতে। আমি সারাদিন রক্তিমের কাছেই থাকতাম, ওর দেখাশোনা করতাম। আমরা তিন দিনের মধ্যে একটি কেবিন ও পেয়ে গেলাম । বাবু অনেক বেশি ছোটো ছিল বলে রাতে ওই বাসায় গিয়ে ঘুমাইতাম আমি। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ঢাকা শহর আসলেই নিষ্ঠুর সমাজের বোঝা। এইখানে একবেলা ভাতেরও অনেক মূল্য, মানুষের দুই কথা, মুখের মলিনতা, অপ্রস্তুত ভাবে বাইরের মানুষকে গ্রহণ করা এইটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। তারপরও যদি সেইটা অসুস্থ রুগীর সাথে সম্পৃক্ততা অর্জন করে তাহলে বিষয়টা আরো বেশি তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু কী যায় আসে, এইসব সহ্য করা করা ছাড়া উপায়হীন। তারা যেটুকু করবে ততটুকুই সাদরে গ্রহনের প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।
আস্তে আস্তে রক্তিম অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেলো। কিন্তু পায়ে দুই ভাঙ্গা দেওয়াতে সে স্বাভাবিক হাঁটা চলার ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলো। সেইটাও কোনো বিষয় না, সে যে আমার বাবার মতো আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে পরকালে পাড়ি জলামো না এইটাই অনেক বড় বিষয়। হ্যাঁ, এইটাই আমার আর আমার মেয়ের জন্য অনেক কিছু। এক মাস পর তাকে নিয়ে আমরা রক্তিমের মেসে ফিরলাম।সেইখানে একটি ফ্ল্যাটে তারা চারজন থাকতো, রক্তিমের ঘরে দুইজন থাকতো। আমি যাওয়াতে ওই ঘরটি আমাদেরকে দিয়ে দেওয়া হলো। যে ক'দিন আমি থাকবো আমরা এই ঘরেই থাকবো কারণ তাকে ওই অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না জেনে আমাকে রেখে আমার ভাসুর আর ননদের ছেলে গ্রামে ফিরে গেলো । আমি থেকে গেলাম রক্তিমের দেখাশোনা করার জন্য। অচেনা অজানা নিষ্ঠুর শহরের কোলে একা বিস্ফারিত হৃদয়ে।
রক্তিম যতটা সুস্থতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, তত মনে হতে লাগলো আমি সেই আগের মানুষটিকে খুঁজে পাচ্ছি। অনেক উৎফুল্ল লাগতো তাকে, তাকে যখন আমি ড্রেসিং করাতাম, খুব আগ্রহ নিয়ে সে আমার ব্যস্ত চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতো। আমার চোখে ধরা পড়লেই সে খুব রসিকতার সাথে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতো। আমার তখন খারাপ লাগতো না, আমি রান্না করার সময় খুব যত্নের সঙ্গে আমার মেয়েকে সে আগলে রাখতো, যতটুকু পারতো।আমার কাছে সব থেকে ভালো লাগলো সুবাইতার সাথে রক্তিম যখন খুনসুটি করতো, আমার মনে অফুরন্ত ফুল ছড়িয়ে পড়তো।
সাবাইতাকে কোলে নিয়েই সব সময় সে বলতো,
" আমার মা তুমি, আমার মা নেই তো কী হলো, মায়ের পুরো চেহারা ঢেলে দিয়েছে আল্লাহ, আমার সুবাইতার মধ্যে।"
কথাটা শুনেই আমার আত্মতৃপ্তি ঘটতো এইটা ভেবে যে কিছুটা হলেও রক্তিম মা হারানো শোক টা কাটিয়ে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম এক মাস যেভাবে আমি রক্তিমের সাথে আমার জীবনের সব থেকে সুখময় দিন গুলো অতিবাহিত করেছিলাম, এই বিপদের সম্মুখীন হয়ে তার কাছাকাছি এসে আমি ধীরে ধীরে ঠিক সেই অনুভূতি গুলোই উন্মোচন করতে লাগলাম । হ্যাঁ, খুব খুশি লাগতো। আমি জানি এইটা আমার প্রাপ্য না, আমাকে ছেড়ে যেতে হবে এই স্বর্গ ছেড়ে, এই অগোছালো, অনিশ্চিত, আমার একার মতো গুছিয়ে নেওয়া এই ছোট্ট ঘরটি আমার জন্য না। কিন্তু তারপরও রাতের আঁধারে মনে হতো, আমি যদি এই ছোটো ঘরটি, আমার রক্তিমকে এইভাবে সবসময়ের জন্য আপন করে নিতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। কিন্তু সে তো আমার মতো অভাগার জন্য দিবাস্বপ্ন, কিন্তু মানুষের জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন দিবা স্বপ্ন দেখেও বেঁচে নেই থাকার শক্তি ফিরে পায়। বার বার দিবা স্বপ্ন দেখতে চায়।
.
•আমাদের যাওয়ার পালা, রক্তিম মোটামুটি সুস্থতা লাভ করেছে । কিছুদিন ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটেছে, অফিস করেছে। আমি দিয়ে এসেছি, কিন্তু এখন একাই যেতে পারছে । আমার সাহায্য লাগছে না, ভালোই লাগছে নিজের কাছে। এইটা যেনো আমার জন্য প্রাপ্তির মতো। আমাদের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো, আমার ননদের ছেলে এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে । গাড়ির টিকিটও বুকিং । আগামীকাল সকাল ৮:০০ টাই বাস। আমি রাতে অনেক কিছু রান্না করলাম। যেনো আগামী দুই সপ্তাহ ওর খাবারের কোনো সমস্যা না হয়। বাটি বাটি করে খাবার ফ্রিজিং করলাম। ওকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলাম, বোঝার থেকে সে আমাকে আদর করতে বেশি ব্যস্ত। আমার খুবই ভালো লাগছে তার এই দুষ্টু মিষ্টি কার্যক্রম গুলো, এই দুইমাসে মনে হচ্ছে আমি আমার প্রত্যাশিত রক্তিম কে ফিরে পেয়েছি। কিন্তু ভোরে চলে যাবো ভেবেই বুকের মধ্যে ব্যাথা হতে লাগলো। একটাই প্রশ্ন,
- ও একবার আমাকে বলুক, "নকশী তুমি যেও না, আমি তোমাকে ছাড়া একাকিত্বে ডুবে যাবো। "
কিন্তু সেগুলো আমার কল্পনা ছাড়া কিছুই হবে না । বললে ঐকদিনে সে একবারের জন্য হলেও বলতো।
সকাল ৭:০০ বাজে। খুব দ্রুততার সাথে আমি রেডি হচ্ছিলাম। বাবু হঠাৎ ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদতে লাগলো। আমি ব্যস্ততার মাঝে দ্রুত তাকে খাওয়াতে লাগলাম । কিছুক্ষন বাদে রক্তিম আসলো,
" দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখন একটা খাওয়ানোর সময় হলো নাকি? "
তার কথায় আমি হঠাৎ প্রচুর রেগে গেলাম,
" তাহলে কি আমাকে মরতে বলছো? আমারও তো জীবন তাইনা? তোমাদের জন্য সেইটাকে তো বিসর্জন দিয়েই দিছি, এখন এই বিসর্জনের মধ্যেও কী ডবল বিসর্জন দিতে হবে? "
" এই পাগলী? কী বলো এইসব? আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করছি। দেরি করে লাভ আছে? নীরব কতক্ষন ওয়েইট করবে? এইজন্য বললাম। "
আমি কিছুটা অভিমানি ভঙ্গীতে অশ্রুসিক্ত নয়নে উঠে গেলাম। ওইঘরে গিয়ে দেখি নীরব বসে আছে, আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। আমি উত্তর দিয়েই তাকে বললাম আর একটু দেরি করতে, আমি পাঁচ মিনিটেই বের হচ্ছি। আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে সে আমাকে বলল,
-"আপনি কোথায় যাবেন মামী? আমি যাবো। আমি বসে আছি আপনার কী কী লাগবে আরো একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলে ভালো হতো। মামা বলছে আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। "
-" মানে? "
হঠাৎ রক্তিম এসে বললো, তোমার কী কী নিয়ে আসতে হবে সেইটা শুনছে ও । এখন এই মুহূর্তে ছোটো বাচ্চা নিয়ে তুমি সবটা গুছিয়ে আসতে পারবে না । তাই ওকে একাই পাঠাচ্ছি আমি একা, এক্সট্রা কিছু লাগলে ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দাও।
নীরবকে সব বুঝিয়ে বিদায় দিয়ে আমি নিষ্ফলকে রক্তিমের শান্ত স্বাভাবিক চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো,
-" এত অবাক হওয়ার কী আছে নকশী? পরিবার পরিজন নিয়ে একসাথে থাকাটাই তো সার্থকতা। খুব কিছুদিনের জন্য নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তোমার সাথে অন্যায় করে ফেলেছি পাখি। সেই তোমার অপূর্ণতা বুঝতে আমার কিছুটা সময় ঠিকই লাগলো কিন্তু অনেকটা ভুক্তভুগী হতে হলো, তাতেও আমার আক্ষেপ নেই নকশী। আর কথা না বাড়িয়ে চলো নতুন করে সংসার শুরু করি, তুমি আমি আমার মা আর আমাদের ছোট্ট সংসার। "
আমি দৌড়ে গিয়ে বরাবরের মতোই তার বুকের বা পাশে গিয়ে স্থান গ্রহণ করলাম । আমি অঝোরে আঁখি বর্ষণে ব্যস্ত, আমার নিজেকে থামাতে ইচ্ছা করছে না । এইবার সে আমার মাথাটা উপরে দিকে কিছুটা উঠিয়ে বললো,
" কান্নাকাটি করার সময় নেই নকশী । সময় কিন্তু অনেক কম, এই পঙ্গু স্বামীর পিছে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছো, এইবার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হও, এইবার পরীক্ষা দিতে পারনি তো কী হয়েছে? সামনের বারের জন্য তৈরি হতে হবে, খুব কঠোর ভাবে তৈরি করো নিজেকে নকশী, আমি তোমাকে উন্নয়নের সর্বস্তরে দেখতে চাই। অনেক বড় হতে হবে তোমাকে । অনেক কিছু অর্জন করতে হবে তোমাকে।
• রক্তিমের গলাটা ধরে আসছিল কথা গুলো বলার সময়। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা গুলো শুনছিলাম, হয়তো হৃদয়ে ধরন করছিলাম। আমার হৃদয় থেকে অনায়াসেই দুঃখ গুলো নিংড়ে যাচ্ছিলো। অনেক বেশি ঋণী হয়ে গেলাম তার প্রতি, অনেক বেশি, সব কিছুর উর্ধে। সে আমার চোখ মুছে দিয়ে বললো,
" This is not the right time to cry . We have a lot of work to left, let's do it together, better half . "
চলবে.....???
পূর্ববর্তী অংশ :- https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/840165820122249/
বি. দ্র:- সবার নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমি নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছি গল্প দিতে। আমার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান প্লাস আমি মানসিক ভাবেও কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলাম, যার কারণে কিছুটা কষ্ট দিয়ে দিয়েছি আপনাদেরকে। পুরো বিষয়টা ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমার জন্য দোয়া করবেন । ধন্যবাদ সবাইকে 🍁