আশাবরি( পর্ব ৫৬) just love

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

আশা প্রায় মিনিট এক অসংবদ্ধ নিশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকে অবশেষে বলা শুরু করল,

- আসলে, কিছুদিন আগে আমি একটা কঠিন সত্য জানতে পারি।

কথাটা পরিষ্কার অভিনবের কানে এলো না। দূর থেকে একজন পরিচিত কলিগ অভিনবের নাম ধরে ডাকলে আশার কথাটা চাপা পড়ে গেল। অভিনব, চড়া গলায় ‘আসছি’ বলে গলা খাট করে বলল,

- আশাবরি, স্যরি ডাকছে। এক কাজ করো, আজ সন্ধ্যায় তুমি বাড়িতে চলে এসো। মা'র সঙ্গেও দেখা করে গেলে। তোমার কী কথা তাও বলে গেলে। এখন তো আসতে কোনো আপত্তি নেই রাইট?

পূর্ণ উদ্যম নিয়েও কথাটা বলতে না পেরে আশা শুকনো ঢোক গিলে মুখ ভোঁতা করে রিনরিনে গলায় বলল,

- আচ্ছা।

- ওকে, সি ইউ।

আশা কানের ওপর থেকে ফোনটা কোলের কাছে নামিয়ে রেখে দূরে শূন্য দৃষ্টি ছড়িয়ে উন্মনা হয়ে রইল। সেদিন আশার অফ ডে ছিল, তবু জমে যাওয়া উহ্য কাজেরও অভাব ছিল না। কিন্তু কিছুতেই সাইটের কাজগুলোতে একাগ্রতা স্থাপন করা গেল না। সারাটাদিন সে ঘরের একাজ-ওকাজ করেই একাগ্রতার অভাবে চিত্তবিক্ষেপের মধ্য দিয়ে কাটাল। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই সে মাগরিবের নামাজটা পড়ে নিয়ে পরিপাটি হয়ে একটা অটোরিকশায় চড়ে খুলশির দিকে রওনা দিল। আজই গায়ককে সবকিছু বলে একটা সিদ্ধান্ত না শোনা অবধি তার শান্তি নেই! এভাবে দোলায়িতচিত্তে থাকতে থাকতে সে ভীষণভাবে হাঁপিয়ে উঠেছে। ভীষণ।

~~~~~~~~~~~~~

অভিনবের নিজ হাতে করা পুষ্পকাননের ঠিক পশ্চিম কোণে একটা শানবাঁধানো তরুছায়া-ঘন দ্বিমুখী বৈঠকখানা আছে। বৈঠকখানার সুমুখে সূর্যমুখী বাগানে দৃষ্টি পশিয়ে দিলে সেই দৃষ্টি কষ্টেসৃষ্টে একদম গেট অবধি গিয়ে পৌঁছে। অভিনব আজ আগেভাগেই ঘরে ফিরে শেষ বিকেলে হাতে কলম-খাতা নিয়ে এখানটায় এসে বসেছে,—অনেকদিন পর। গীতিকবিতা অর্থাৎ লিরিক রচনার উদ্দেশ্য। তার যত গীতিকবিতা দিয়ে বিভিন্ন সুরকার শ্রোতাপ্রিয় সব সুর তৈরি করেছেন সবগুলো এই জায়গাটায় বসেই তৈরি। কাজেই জায়গাটা তার কাছে শান্তির এবং বিষাদ দূরীকরণের অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে। জনে জনে জুথিকার বিচ্ছেদের অযাচিত কৈফিয়ত দিতে দিতে আজ তার মনের নিরাকার পাত্র বিষাদের বিষে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তবুও তা কাছ থেকে দেখেও বুঝার উপায় নেই৷ অভিনবের যত দুঃখ সব অন্তর্দেশেই গুঞ্জন তুলে বারবা। বাইরে তার ছটা একরতিও পড়ে না। বিকেলে নিভৃত সময়টা কাটানোর পর মনের অবসাদ কিছুটা দূরীভূত হলে আকাশ থেকে পাতলা অন্ধকারের জাল নেমে আসে। গনগনে সূর্যটা মেঘের গায়ে গায়ে সিঁদুর রাঙিয়ে ওই টিলা পাহাড়টার অন্তরালে অস্তাচলগামী হয়। পুরো নগরে আলোর ফোয়ারা নামে, বাড়ির ভেতরে-বাইরের লাইটগুলোও আগে-পরে করে একে একে জ্বলে ওঠে। বাগানের দিকেও দু-তিনটা সুতীব্র রঙিন আলো জ্বলে ওঠে। অভিনব খাতাটা গুটিয়ে একপাশে রেখে ডানে-বামে ঘুরে কটির গ্রন্থি ফুটিয়ে পা তুলে হেলান দিয়ে বসে, — সূর্যমুখী বাগানে দৃষ্টি প্রসারিত করে তাকিয়ে আশাবরির অপেক্ষা করে। দারোয়ানকে বলা আছে আশাবরি এলে তাকে যেন এদিকটায় নিয়ে আসা হয়। ঠিক ঠিক একটু পর আলেয়ার মতো আচমকা আশাবরির দেখা মিলে। সন্ধ্যার মায়াময় আবছায়ায় লতানো গুল্মলতা ছাওয়া সুঁড়িপথ ধরে থেমে থেমে মুখে হিসহিস শব্দ করে সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে উপস্থিত হয় সে। এসেই সে হাতের ব্যাগটা বৈঠকখানার ওপর রেখে মুখের নিকাব খুলতে প্রবৃত্ত হয়ে সহজ গলায় বলার চেষ্টা করে,

- দেরি হয়ে গেল। আপনি বুঝি নামাজ পড়েননি?

আশা বিলক্ষণ জানে শুক্রবার ছাড়া তিনি নামাজ-কালামের ধারেকাছে থাকেন না। তবু গায়ককে কোনো বিষয়ে গিট্টুতে ফেলতে পারলে তার মনের ভেতর খুশির লহর বয়ে যায়!

আশার কথাটার জবাবে অভিনব লজ্জিত হেসে নিজের দোষ লুকানো উদ্দেশ্যে বলল,

- তুমি সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ, রূপে-গুণে অনন্য। শুধু মাথায় ঘিলু একটু কম।

কথাটা নতুন নয়। শুধু ধরণটা নতুন। আশাবরি সেদিকে না গিয়ে আজকের আলোচ্য বিষয়ের ভবিতব্য বিবর্ণ-টলট্টল পরিস্থিতির কথা ভেবে মুহূর্তেই সারামুখে অন্ধকার নামিয়ে গায়কের পাশাপাশি অল্প দূরত্বে রেখে বসল। আশার মতিগতি অভিনব তখনো খেয়াল করেনি। আশাবরি চুপ দেখে সে ঠাট্টার ছলে বলল,

- একটা জিনিস খেয়াল করলাম। সবাইকে তোমার ওই বোকাসোকা বদনখানি না দেখালেও আমার সামনে এসে ঠিকই নিকাব খুলে ফেল। ব্যাপারটা কী? আমি কি জ্বিন-টিন যেন কাছে ঘেঁষলেই উত্তাপ পাও? গরম লাগে...

আশাবরি কিছু একটা বলতে মুখ খুলেও নিশ্বাস ছেড়ে চুপ করে যায়,কিছুই ভালো লাগে না তার।

এবার অভিনব আশার নীরবতাকে পুঁজি করে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তার দৃষ্টির ভীরুতা, শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্বাভাবিকতা, উত্তরোত্তর আঁটুবাঁটু, আর স্থৈর্য দেখে ভেতরকার চলমান অস্থিরতা অনুমান করতে দের হয় না ওয়াকিফ অভিনবের। সে স্বর নিচু করে বলে,

- তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে আশাবরি!

একটু থমকে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে বলল

—সকালে তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে! কী এমন বিষয় যে তুমি এতো ঘাবড়ে গেছ?

আশা একপলক ভীত চাহনি নিপতিত করে গায়কের ওপর। এরপর মূল কথার মুখবন্ধ স্বরূপ বলে,

- গায়ক, সেদিন জুথিকা আমার ঘরে এসেছিল। অনেকক্ষণ কথা হয় আমাদের। আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। হয়তো ও শুধরে যাবে।

-তুমি নিশ্চয় ক্ষমা করে দিয়েছ। কেন জানি না আমি সবাইকে ক্ষমা করলেও ওকে ক্ষমা করতে পারিনি। হয় ও ক্ষমার অযোগ্য, নয়তো আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি!

- ও আপনাকে ব্লাকম্যাজিক করেছিল। আর কালোজাদুর কারণেই আপনি শেষপর্যন্ত উনার সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন। বলে আশা একটু সসংকোচে ভঙ্গিতে করে তাকিয়ে বলে,

আমি যতদূর জানি আপনি ওকে—

অকস্মাৎ অভিনব আশার কথার মাঝখানেই একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলে,

- উঁহু ওসব কিছুই না। আধুনিক কালের মেয়ে হয়ে তুমি এসবে বিশ্বাস করছ?ও তো পাগল হয়ে গেছে। যা নয় তা বলছে। কান দিও না।

বলে মুখ-চোখ ঘুরিয়ে বসে অভিনব। আশাবরির সঙ্গে এ প্রসঙ্গ আলোচনা মোটেও সুখপ্রদ নয়। তবু তার কাছে এর কোনো যুক্তিযুক্ত সংজ্ঞা নেই যে,কেন এবং কীসের ভিত্তিতে সে জুথিকার সঙ্গে পরিণয়াব্ধ হতে সম্মতি দিয়েছিল? শুধুমাত্র পরিবারের চাপের অভিমানে? নাকি জুথিকা এসে নিজের এবং পরের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে এমনটাই বরাতের লিখন ছিল? জুথিকার সঙ্গে তার অসংখ্য অগণিত মিউজিক ভিডিয়ো, টিভি সাক্ষাৎকার, লাইভ, মজার মুহূর্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্ষার দিনের মাঠেঘাটের ব্যাঙের ছাতার মতো ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। উপরন্তু, প্রায় একযুগের স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে বিস্মৃত করাও কি এতোই সহজ হবে? উইপোকা যেমন নীরবে-নৈঃশব্দে কাঠকে খেয়ে ঘুণে পরিণত করে তেমনি সর্বত্র নমুনা ছড়িয়ে থাকা জুথিকার অতীত কি তাকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাবে না?

- না সত্যি। আশাবরি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, আপনি বিশ্বাস না করতে পারেন। কিন্তু এমনটা হয়। আর এটা অনেক খারাপ। আমি নিজ চোখে...

- থামো তো। ভাবনার মাঝপথে বাগড়া দেওয়ায় কিছুটা বিরক্ত হয় অভিনব, তোমার এসব আজগুবি কথা না-হয় বিশ্বাস করেই নিলাম। কিন্তু তাতে কী আসে যায় এখন?—

একটু দম নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলে,

ওসব শেষ হয়ে গেছে আশাবরি। আমি অতীত ঘেঁটে দুর্গন্ধ ছাড়াতে চাই না। আমি বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে চাই৷ আমার দুর্গন্ধময় অতীতকে কি তুমি তোমার সুবাসে ভুলিয়ে দিতে পারবে না?—

একটু চুপ করে নিজেকে সংযত করে অভিনব,

-মা'র সঙ্গে দেখা করো। কখন কোথায় কীভাবে কী করতে হবে সব তোমায় জানিয়ে দিবে। বুঝেছ?

আশার বুকটা কাঁপে,থরথর করে,— চৈত্রের অনাবৃষ্টিতে ধূ-ধূ ধূসর প্রান্তরের মতোন হাহাকার করে। বেপথুমান ঠোঁটজোড়া তিরতির করে নড়ে কীসের যেন আকণ্ঠ অতৃপ্ততায়। আশার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,সে পারবে। পারবে। কিন্তু বলতে পারছে না। একটাই শুধু প্রতিবন্ধকতা! তার অনাকাঙ্ক্ষিত জন্ম!

অভিনব আনকো রঙিন আলোয় দেখতে পেল আশার ঘন আঁখিপল্লব চপচপ করে ভিজে উঠেছে। সুখশ্রু ভেবে সে কিছুটা আকুল আর আফসোসের সঙ্গে বলে ওঠল,

- ওকি আবার— চোখে কেন পানি?

আশা নিজেই তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল,

- গায়ক আমি আপনাকে আরো কিছু বলতে চাই৷

অভিনব এবার কিছুটা সপ্রশ্ন-সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আশা কণ্ঠে অস্বাভাবিক দৃঢ়তা এনে বলে,

- জুথিকা আপনাকে ঠকিয়েছে, কিন্তু আমি আপনাকে সত্যটা বলছি যাতে আপনি পরে না ভাবেন আমি আপনাকে ঠকিয়েছি। আপনারও সুখে থাকার অধিকার আছে,আমারো আছে৷

অভিনব ঠান্ডা পাথুরে কণ্ঠে বলে,

- কী সত্য আশাবরি? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।

আশা চোখ নামায়, মুখ নিচু করে। চোখের পাতা বেয়ে টপটপ করে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়ায় কোলে। এরপর—এরপর ফাটা বাঁশের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,

- আমি,—আমি কামজ।

অভিনবের ভুরু জোড়া দু'দিকে প্রসারিত হয়ে চোখদ্বয় বিস্ফারিত হয় ধীরে ধীরে। মুখ ঈষৎ হাঁ! বুকের ভেতরটা অদৃশ্য কিছু হারানো বেদনায় ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সে কিছু সময় নতমুখী আশার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ক্ষীণ করে রক্তচক্ষু নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলার মতো করে বলে,

- অর্থাৎ!

আশাবরি তড়িতাহতের মতো আবার ঈষৎ কেঁপে উঠে। তবুও সে দমবন্ধ করে অসাড় জিহ্বা সচল করে বলে,

- অর্থাৎ... অর্থাৎ...অর্থাৎ... আমার কোনো পিতৃপরিচয় নেই৷ সভ্য ভাষায় যাকে বলে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান আর অসভ্য ভাষায়...

কথাটা শেষ না করেই নিজেকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণ করে ভেঙে পড়া রোধ করে আশা। ক্ষান্ত বর্ষণের পর মৃদু সমীরণে যেভাবে পাতা থেকে বৃষ্টিফোঁটা ঝরে পড়ে তেমনিভাবে আশার চোখের পক্ষ্ম বেয়ে জল গড়াতে লাগল।

- এটাই বলার ছিল। অনেকদিন ধরে বলতে চাইছি৷ কিন্তু পারিনি৷ আজ আমি দায়মুক্ত হলাম। এখন আপনি আমাকে মেনে না নিলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।

অভিনব যেন মূক হয়ে যায়! একমুহূর্তের জন্য তার মনে হলো,আশাবরি মিথ্যা বলছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার দৃষ্টির ছায়াছন্নতা, অশ্রু,কণ্ঠের অস্বাভাবিক ভঙ্গি তাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করল! সে ধীরে ধীরে নতমুখী নিঃশব্দে রোরুদ্যমান আশার উপর থেকে চোখ সরিয়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়-পাত্র ভর্তি হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আশাবরিও উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ পাওয়া আঘাতটা অভিনব তৎক্ষনাৎ সামলে উঠতে পারে না। বাকপটু অভিনব যেন নিজের সব কথার আঁটুনি নিমিষেই ভুলে যায়। ভুলে যায় এই মুহূর্তে তার কী বলা উচিত,কী করা উচিত। তার চোখ দিয়ে কেবল আগ্নেয়গিরির লাভা বুদবুদ করে উদগীরণ হয়! আহ্! এতোদিন পর ঠিক এই সময়ে সত্যটা জানানোর কী দরকার ছিল আশাবরি?— একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশাকে পেছনে রেখে উদ্ভ্রান্ত পা বাড়ায় অভি৷ আশাবরি চাপা সুরে কেঁদে দিয়ে গায়কের হাতটা জাপটে ধরে, হাঁসফাঁস করতে করতে ভেজা কণ্ঠে বলে,

- গায়ক, এমন করবেন না, কিছু তো বলে যান!

অভিনব শুকনো মুখে,তীব্র দৃষ্টিতে আশার অতর্কিত ধরা হাতের ওপর আড় চোখ রাখে। আশা লজ্জা নয়,সংকোচ নয়,অপমান নয়—কেমন অন্যরকম একটা অনুভূতি নিয়ে চট করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মনে হয়,সে অপবিত্র, গায়ককে সে ছুঁয়ে দিয়েছে। এজন্যই এমন কটাক্ষপাত! সে যে কামজাত!

- বাসায় ফিরে যাও আশা।

গনগনে কণ্ঠে কথাটা বলেই অভিনব আর দাঁড়ায় না। দ্রুতলয়ে বাগানের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ভেতর দিয়ে হেঁটে আশার চোখের আড়াল হয়ে যায়। আশা! এই প্রথম গায়ক তাকে আশা বলে সম্মোধন করল। অন্য সবার মতোন! তিনি তো কখনোই ‘আশাবরি’ ভিন্ন ডাকতেন না। তাহলে সব বুঝি এভাবেই শেষ? সমাপ্ত? গায়ক কেন এভাবে তাকে অগ্রাহ্য করে চলে গেল? ভাবতে ভাবতে মুখে পাগলামির হাসির ঢেউ তুলে ভূতগ্রস্তের মতো উল্টোদিকে হেঁটে বেরিয়ে আসে আশা। বৈঠকখানার মধ্যখানে একসঙ্গে পড়ে রয় গায়কের লেখা গীতিকবিতার ওপর আশাবরির লাখে দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী কালো নিকাবটি। মানুষ স্মৃতি দাফন করে,বস্তু স্মৃতি বহন করে।

সেদিন রাতে খাবার টেবিলে অভিনবের উপস্থিতিতে বিয়ে নিয়ে আলোচনা পাড়লেন আলী সাহেব। তিনি লাল ফ্রেমের চশমার ফাঁকে সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে এনে রসিয়ে রসিয়ে বললেন,

- এখন কীভাবে কী হচ্ছে? নির্বাচনের আরো প্রায় তিনমাস বাকী। অভিনব সাহেব যদি কোনোরকমে এমপি হয়ে যায় তাহলেই হয়েছে আর কি! তাঁকে আর পায় কে? তাই বলি কি,বিয়েটা আগেভাগেই হয়ে গেলে ভালো হয় না?

অভিনব নিরুত্তর নতমুখে খেয়েই চলেছে। কোনো বিকার লক্ষ করা গেল না। যেন সে কথাটা শুনেইনি। ইহিতা ভাইয়ের দিকে একপলক দৃষ্টিপাত করে বলল,

- হুঁ, তোমাকে তো পাওয়া যায় না বাবা। এসব কথা আগেই হয়ে গেছে। নির্বাচনের আগেই বিয়ে হবে। তবে সেটা কীভাবে হবে তা ভাইয়ের ওপর নির্ভর করছে৷

আলী সাহেব মাথা নেড়ে মতামত দেন,

- লোকে যে নানান কথা বলবে তাতে সন্দেহ নেই। আমি বলি কি ওর যেহেতু কেউ নেই। সমর্পণ করারও কেউ নেই। তাই আমরা কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে বিয়ে পরিয়েই তুলে আনি। এরপর নাহয়...

অভিনব খাওয়াটা দ্রুত সাঙ্গ করে হাঁটুর পেছন দিকে চেয়ার ঠেলে সশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে তীর্যকভাবে বলল,

- মনে হচ্ছে বিয়েটা তোমাদের কারোর! আগবাড়িয়ে কিছু না করলে খুশি হব। কখন কী করতে হবে আমি জানাব।

বলেই বেসিনে হাত ধুয়ে হনহনিয়ে চলে গেল অভিনব। সবাই সেকেন্ড কয়েক মুখচাওয়াচাওয়ি করল। জেসমিন আক্তার চোখেমুখে অসন্তুষ্টি সঞ্চার করে ইহিতার উদ্দেশ্য বললেন,

- কী হয়েছে ওর? আবার কার সঙ্গে ঝামেলা করে রগ চটিয়ে বসে আছে!

আলী সাহেব বললেন,

- নিশ্চয়ই আশার সঙ্গে! ওর না আজ আসার কথা? এসেছিল?

ইহিতা বাবার সন্দেহকে অপরূপ মুখভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়ে ধ্রুবত্বের সঙ্গে বলল,

- আরে নাহ। আশাবরির সঙ্গে হবে ঝগড়া? মাথা খারাপ? ভাইয়াকে ও দেবতার মতো ভক্তি করে। যা বলে তাতেই হ্যাঁ। আর ও ঝগড়া করার মতো মেয়ে? জিহ্বা খসে যাবে তবু ওই মুখ দিয়ে কটু কথা বের হবে? এখানে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে...

এভাবে মতানৈক্য চলতেই থাকল। কিন্তু সঠিক কারণের হদিস কেউই পেল না।

সেই রাতটা অভিনব এমন সংকটময় মুহূর্তে নিজের উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ, নিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে ভেবে সারা হয়ে নির্ঘুমভাবে অতিবাহিত করল। রাতভর সে না দেখেও যেন দিব্যি অনুভব করল,মেয়েটি এই একলা নির্বান্ধব ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে নিজের ধরাধামে অভিশপ্ত আগমনকেই দোষারোপ করতে করতে চোখের পানি ফেলছে। একদিকে জুথিকার বিচ্ছেদের বিষয়ে চারিদিক থেকে নানাবিধ শ্লেষোক্তি শোনার পর আশার কথা ভেবে যখন সে একটুখানি স্বস্তি কুড়চ্ছিল তখনই সেই আশাবরির এমন কঠিন সত্য এসে তাকে আঘাত করল! সত্যের সময়-জ্ঞান নেই। কেন সে সবসময় অসময়ে আসে?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

দিন দুই পর গুজরান হলো। এরমধ্যেই আশাবরি স্বাভাবিক হয়ে কাজে যেতে শুরু করল। সেদিন ফেরার পথে সে একটুও চোখের পানি ফেলেনি বটে,কিন্তু তার নিভৃত খুপরি ঘরে এসে তার ভঙ্গুর আত্মনিয়ন্ত্রণ আর বাগ মানেনি। সুদীর্ঘ সময় ধরে পুঞ্জীভূত হাহাকার আর চাপা কষ্টে তার সমগ্র হৃদয়জমিন যেন দীর্ণ-বিদীর্ণ, খানখান হয়ে যাচ্ছিল। সে কেঁদেছে। ভারী বর্ষণে বাঁধ টুটে গিয়ে যেভাবে সশব্দ-অশ্রু দিকবিদিকে ছড়িয়ে দেয় আশাও সেভাবে কেঁদেছিল। তার অর্ধেক কান্না ছিল চিরতরে গায়কের সংস্রব হারানোর বেদনায়,আর অর্ধেক কান্না ছিল নিজের পিতৃপরিচয়হীন জীবনটার জন্য। কিন্তু পরেরদিন হতেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের চিরকেলে ভগ্ন বরাতের লীলাখেলাকে সসম্মানে মেনে নিয়েই দিনাতিপাত শুরু করল। মনে মনে সে বদ্ধপরিকর হলো,এই জীবনে আর গায়কের মুখোমুখি হবে না এবং খুব শীঘ্রই এই স্মৃতিভরা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে অচেনা অজানা কোনো শহরের উদ্দেশ্য পাড়ি জমাবে। গত কয়েকমাসে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিএসসিতে ভর্তির জন্য যে টাকাগুলো জমানো হয়েছে সেগুলো দিয়ে দিব্যি ছ'মাস কেটে যাবে। এই ছ'মাসে সেই অজানা শহরে গলিঘুঁজি চষে বেড়িয়ে একটা চাকরি-বাকরি ঠিকই বাগিয়ে নেওয়া যাবে। নিজের যোগ্যতার ওপর অগাধ বিশ্বাস আশাবরির। সে সুন্দরী তথা কর্মতৎপর এবং যেকোনো কাজ সহজেই হাত করে নিতে পারে বলে অবমূল্যায়ন তার হবে না,এই বিশ্বাস তার আছে। যোগ্যতা-বলে চাকরি না পেলে কী? এই জাত শক্ত গতর তো আছেই! আচ্ছামতো খাটিয়ে নেওয়া যাবে।

কিন্তু আরো দুইদিন পেরোনোর পর আশার অফিসের বড় সাহেব অর্থাৎ কোম্পানির মূল মালিক যিনি,তিনি সকল প্রকৌশলীদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে তিনি সংক্ষেপে যা বললেন তা হলো, তার প্রভাবশালী শ্বশুর মুন্সিগঞ্জের একটি শহরে সিটি কমপ্লেক্স স্থাপন করবেন। কাজেই কাজটা পেয়েছেন তিনি। এখন সেখানের কনস্ট্রাকশন সেক্টরের জন্য ঝানু একটি দল পাঠানো হবে তাদের সঙ্গে স্বয়ং তিনিও তদারকিতে থাকবেন।

কেউ কেউ স্বেচ্ছায় রাজি হলেন। কাজে পটু হলেও আশাবরি মুখচোরা। সে এককোনায় বসে যাওয়া উচিত হবে কি-না তা চিন্তা করে মাথার কেশ পাকাতে লাগল। একসময় তার দিকে লক্ষ করে সিনিয়র প্রকৌশলী মোমিন বললেন, আশাবরিকে নেওয়া যায়। আই থিংক... সি ইজ বেস্ট!

বড় সাহেবের বয়স অল্প। বাবার কোম্পানি এখন নিজের। তবুও বয়সের ভার বুঝাতে তিনি একটা গোল চশমা পরেন। তিনি আশার দিকে অদ্ভুত কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

- ওঃ বেস্ট? ওয়েল। তোমাকেও সিলেক্ট করা হলো।

এরপর যা ঘটার খুব তাড়াতাড়িই ঘটে গেল। আশাবরি কাউকেই কিছু না জানিয়ে প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপাতি পোঁটলাপুটলি বেঁধে ভগ্নচিত্তে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্য রওনা দিল। এমনকি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা তারিনকেও সে কিছু জানাল না পাছে সে তার প্রস্থানের খবর রাষ্ট্র করে দেয়!

এবার একটু পেছনের ঘটনা বলা যাক। সেদিন সারারাত বিরতিহীন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ করার পর পুরো ব্যাপারটা অভিনব নিজের মনের মধ্যে সাজাল। নিজেকে আশার অবস্থানে রেখে গোটা বিষয়টার আদ্যপান্ত চিন্তা করল গভীরভাবে। আশবারির মা পাগল ছিল। আজকাল পাগলের মা হবার গা গুলানো খবর অহরহ শোনা যায়। আশাবরির মা-ও নিশ্চিয় সেরকম কোনো লিপ্সার স্বীকার হয়েছিল এবং এতেই আশাবরির অনাকাঙ্ক্ষিত জন্ম হয়! কিন্তু তাই বলে আশাবরি কেন এতে দোষী হবে? কেন সে লজ্জায় মরমে মরে যাবে নিজের পরিচয় বলতে গিয়ে! একজন পুরুষের একটা শুক্রাণুর মূল্য কি দশমাস গর্ভধারণের চেয়েও মূল্যবান? না,এমন তো নয়! সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত হাজারো শিশু-কিশোর আজও বেঁচে আছে। তাদের কি উচ্চ স্বপ্ন নেই? তাদের কি অন্য সবার মতো সমান অধিকার নেই? বাবা-মায়ের দোষে কিংবা শুধু এক নরপশুর দোষে তারা কেন আজন্ম দুঃখ ভোগ করবে? তারাও তো সৃষ্টিকর্তার তৈরি মানুষ। জন্মের পিছনে তো তাদের তো হাত নেই। শেষ রাতের উদাম ছাদের কাকজ্যোৎস্নায় বসে অভিনব মনের আদালতে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করল। নিজেকে সে বুঝাল,আশাবরির স্বীকারোক্তিতে সে বিচলিত কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত নয়৷ আশাবরি ফুলের মতো নিষ্পাপ। জন্মের কলুষতা তাকে তিলমাত্র স্পর্শ করেনি। তাহলে? একবুক অনুশোচনা নিয়ে অভিনব আশাবরির নাম্বারে মেসেজ লিখল,

“আশাবরি, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটে গেল যে... কাল একবার এসো।”

দুর্ভাগ্যবশত সেই মেসেজ আশাবরি পড়তে পারল না। তার সস্তা দামের মুঠোফোনে বাংলা লেখা সাপোর্ট হয় না। অভিনবের লেখাগুলো গোটাকতক রহস্যজনক বর্গাকার বাক্সের মতো উঠে এলো আশার ফোনের স্ক্রিনে। এরপর দুইদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন আশাবরির কোনো রা নেই,তখন অভিনব আবারো মেসেজ লিখল,

“ আশাবরি,আমি জানি তুমি আমার আচরণে আহত হয়েছ। কিন্তু এতোটা অভিমান কারারও কিছু হয়নি! আজ রাতেই তুমি আসবে। নইলে...”

এই এসএমএসটাও আশার কাছে রহস্যময় হয়ে রইল। সে নিজেও জানতো না তার মোবাইলে বাংলা সাপোর্ট হয় না কিংবা বাংলা ফন্ট সাপোর্ট না হলে কেমন দেখায়! এরপরও যখন আশাবরির কোনো উচ্চবাচ্য নেই তখন অভিনব ক্রোধান্বিত হয়ে সরাসরি ফোন দিল। আশাবরি সাইটে ফোন নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তাও অভিনবের পূর্ববর্তী কাণ্ডের কারণে। কাজেই ফোন রিসিভ হলো না। বিতৃষ্ণা- বিষাদে বাসায় এসে ফোনটা যাচাই করারও ইচ্ছে আশার ছিল না।

গোপনে খবর নিয়ে জানা গেল আশাবরি ঠিকই কর্মক্ষেত্রেসহ সব পূর্বমতো সব জায়গায় নিয়মিত আনাগোনা করছে। শুনে অভিবের জ্বলন্ত ক্রোধের অনলে রঞ্জক পড়ল । একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতোটা বাড়াবাড়ি তার ঠিক পছন্দ হলো না। একটু কিম্ভুত আচরণ না-হয় সে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় করেছে,তাই বলে এভাবে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে বেয়াদবের মতো চুপ করে থাকলেও তো সমস্যা নিরসন হবে না! সে কি ভেবেছে ‘অভিনব’ সেধে পড়ে তার কাছে মাফ চাইবে? থাকুক সে নিজের মতো।

ব্যস দু'জনার মধ্যে মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝিটা দু'জনার অজ্ঞাতেই হয়ে গেল। একদিকে অভিনব ভাবছে আশাবরি বেতমিজ, সে ফোন ধরেনি,এসএমএসের জবাব দেয়নি। দুইবার বাসায় ডাকার পরও আসেনি! অপরদিকে আশাবরি প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ভেতরে ভেতরে পাহাড়সম অভিমান জমাতে লাগল, হলোই-বা সে কামজাত, হলোই-বা পিতৃপরিচয়হীন সমাজের ঘৃণ্যতম একশ্রেণির প্রাণী। তাই বলে কি একটা ফোন দিলেও তাঁর মোবাইল ফোনটা অপবিত্র হয়ে যাবে? কোথায় গেল তাঁর মানবতার ! সে বাঁচল কি মরল একটা খবরও কি নেওয়া যায় না? পাষাণ গায়ক!

এভাবেই নস্যি বিষয় নিয়ে নীরবে মানাভিমানের নিরবধি পাট চলতে লাগল৷ এরমধ্যে আশার আশপাশে ঘুরঘুর করা চ্যালাচামুণ্ডারা ঢাকায় অবস্থান রত অভিনবকে দূরালাপনিতে জানাল,আশাবরি তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়েছিল আর ফেরেনি। বর্তমানে সে সিটি কমপ্লেক্সের কাজে মুন্সিগঞ্জে আছে। বেশ কিছুদিন থাকবে সেখানে।

অভিনব কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে পরক্ষণেই ক্রোধ জাগিয়ে তুলে দ্রুতই মুন্সিগঞ্জে যাওয়ার একটা হেতু খুঁজা শুরু করল। ঘর ছাড়তে যে আশাবরি একেবারে সিদ্ধহস্ত তা এরিমধ্যেই অভিনবের জানা হয়ে গেছে। সুতরাং সেদিন রাতের অপমানকে সম্বল করে মেয়েটা যে আবারো দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার অব্যর্থ পরিকল্পনা এঁটেছে তার হৃদয়ংগম করতে অভিনবের বেগ পেতে হলো না। কাজেই যেকোনো মূল্যে আশাবরিকে তাকেই ফেরাতে হবে। হাতে সময় আছে ঢের। নতুন মুভির প্লেব্যাক গানটার কাজ শেষে ঢাকা থেকে ফেরার পথে তাকে গ্রেফতার করা যাবে। অনেক লাজলজ্জা আর নিজের উচ্চমার্গীয় ছদ্মবেশ দেখান হয়েছে। আশাবরির ত্যাড়া ঘাড় সোজা করে ছিনিয়ে আনতে কোনো অজুহাতের প্রয়োজন নেই। এরপর চুলোয় যাক তার চাকরি৷ যাযাবরের মতোন দেশে দেশে ঘুরে কাজ করতে হয় এমন চাকরির অভিনবের হবু স্ত্রীর প্রয়োজন নেই। সে তো দলে দলে বাচ্চাকাচ্চা সামলাবে আর পড়াশোনা করবে। বিএসসি করবে,এমএসসি করবে৷ প্রয়োজনে বিদেশে... নাহ্, ঝামেলার রাণীকে চোখের আড়াল করা মুশকিল। লাগামহীন ভাবনায় অভিনবের ঠোঁটের কোণে একছটাক মুচকি হাসি জেগে ওঠে ধীরেধীরে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। অভিনবের হাসিটা ভারি দারুণ। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আশাবরি তার সৌম্যদর্শন কটিতে একটা বাচ্চা দোলাচ্ছে আর অন্যহাতে একটা বই ধরে সুর করে পড়ছে। কী নির্মল সেই কল্পিত দৃশ্য! আদৌ কি তার কখনো দেখা হবে এমন দৃশ্য? মিউজিক ডিরেক্টরের ডাকে ধ্যানভঙ্গ হয় অভিনবের। তিনি সকরুণভাবে বলেন,

- দুশ্চিন্তা করবেন না অভিনব ভাই। জুথিকার সঙ্গে যা হয়েছে কপালের লিখন বলে মেনে নেন। এই দেখুন না,আমিও সিঙ্গেল!

অভিনবের হাসি পায় ডিরেক্টরের মাথামুণ্ডুহীন ধারণা শুনে। সে মনে মনে বলল,কয়দিন পর তাক লাগান খবর শুনবে ডিরেক্টর সাহেব!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

সন্ধ্যাকালে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সাইট থেকে ফিরে এসে নিজের কামরায় ঢুকতেই ঝনঝন করে বেয়াড়া সুরে আশাবরির সেলফোনটা বেজে ওঠল। মাথা থেকে হলুদ হার্ড টুপিটা খুলতে যাচ্ছিল আশা। সে পিলাচমকে ওঠে হাত নামিয়ে মোবাইলটা হাতের তালুতে তুলতেই দ্বিতীয়বারের মতো চমকে ওঠল স্ক্রিনে গায়কের নাম্বারটা দেখে। সঙ্গে তার হৃৎপিণ্ডটাও তড়াক করে আপন অবস্থান থেকে নিজের চমকের কথা জানান দিল। পরমুহূর্তেই এক সিন্ধু অভিমানে আশার বুকের খাঁচা দলে একটা ঝড়ো বাতাস গলার কাছে এসে আটকে গেল। মানুষটার এতোদিন পর মনে হলো তার কথা! তবুও স্বয়ং গায়কের ফোন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কিংবা সাহস কোনটিই আশার নেই। সে কান্নার দলা গলাধঃকরণ করে একটু জোর দিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে দিয়ে মিহি কণ্ঠে সালাম দিল। অভিনব সালামের জবাব না দিয়ে রুক্ষভাবে বলল,

- দুই মিনিটের মধ্যে নিচে নামো। ইউর টাইম স্টার্টস নাও!

আশাবরি কিছু বলতে মুখ খোলার আগেই টুট টুট টুট করে লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মোবাইলটা হাতে নিয়েই আশা একদাপটে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল অদূরই গায়কের ঘুসঘুসে কালো গাড়িটি দাঁড়িয়ে। এক লহমায় মনটা তার অদ্ভুত ভাবাবেগে পূর্ণ হয়ে গেল।....

ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে নেমে আশা গাড়িটিকে উদ্দেশ্য করে হাঁটতে হাঁটতে বারবার সময় দেখল দুই মিনিট পেরোল কি না। গাড়ির কাছে ঘেঁষতেই আবছা কালো গ্লাস নেমে গেল যান্ত্রিক শব্দ করে। ড্রাইভিং সিটে গায়কের থমথমে কঠিন অথচ ঈষৎ সুপ্রসন্ন মুখটা মূর্তিমান হলো। আশা কী করবে বুঝতে না পেরে আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় পিটপিট করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

- ভেতরে এসো।

গায়কের মুখে চুইংগাম। মুখের ভেতর সেটি বারকয়েক পিষ্ট করে দৃষ্টিবিনিময় না করেই কথাটা বলল সে। আশার মাথার ভিতর অদ্ভুত রকম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে কয়েক পল ইতস্তত করে ধীরে ধীরে দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটায় ঢুকে বসল জড়োসড়ো হয়ে। অভিনব বলল,

- ক্যাপটা খুল।

আশা বিস্ময়মাথা দৃষ্টি অভিনবের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে অনুজ্ঞা পালন করল। সাইটে কাজ করা আর আর হার্ড সেইফটি ক্যাপ মাথা বসার সুবিধার্থে এবং বেণি রচনার লোকের অভাবে শুধুমাত্র ক্লিপ আটকে বোরকার ভেতরে চুল ছড়িয়ে দিতো আশাবরি। এক্ষণে অকস্মাৎ অভিনব সুমুখে হামলে পড়ে খপ করে আশার গাল টেনে কাছে নিয়ে এসে পরক্ষণেই চুলের গোছায় ধরল। আশা ব্যথায় তীক্ষ্ণস্বরে ককিয়ে উঠল। অভিনব চুলের গোছাটা ভালো করে আয়ত্তে এনে টানটান করে ধরে জেরা করার ঢংয়ে বলল,

- কয়টা মেসেজ দিয়েছি?

- একটাও না। ব্যথায় চোখমুখ সংকুচিত করে বলল আশা।

- একটাও না, না?—কয়টা কল দিয়েছি?

- একটা৷ একটু আগে।

- এর আগে দিইনি?

- পাইনি তো!

- দেখি কেমন ফোন ইউজ করো...

বলেই আশার মুঠোবন্দি মোবাইলটা ফস করে কেড়ে নিয়ে চুলের আকর্ষণ শিথিল করে মেসেজ চ্যাক করল। পরক্ষণেই পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুলের গোছা ছেড়ে দিল অভিনব। হাঁদা মেয়েটা মোবাইল কিনেছে ভিনদেশী কোম্পানির। ইচ্ছে হলো, এক আছাড়েই মোবাইলটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়,কিন্তু মেয়েটার কষ্টে উপার্জিত অর্থে কেনা জিনিস গুড়িয়ে দেবার সে কেউ নয়, ভেবেই নিজেকে নিরস্ত করল সে। নিজেকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণ করে ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া আশার দিকে নরম দৃষ্টিপাত করল অভিনব, মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়েই রইল মিনিট আধেক—এরপর শীতল কণ্ঠে শনৈ শনৈ বলল,

- স্যরি,— তুমি সেদিন যা বলেছিল তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন রাতেই আমি ভুল বুঝতে পেরে মেসেজ দিয়েছিলাম৷ কিন্তু তোমার ফোনে বাংলা ফন্ট নেই।

আশাবরির চোখজোড়া অভিমানের বৃষ্টিতে আদ্র হয়ে এলো। অনেকটা ক্ষণ গাড়ির আবছা আলোয় নীরবতায় কাটল। একসময় আশা অভীক স্বরে বলল,

- গায়ক,আপনি আমার জন্য যা করছেন, আমি কি তার উপযুক্ত?

- কেন তোমার নিজেকে অনুপযুক্ত মনে হচ্ছে? জন্মে নয় কর্মে মানুষের যোগ্যতার প্রমাণ করে। আমি কখনোই তোমার থেকে আর এমন কথা আশা করব না।

আশা অশ্মীভূতের মতো ঠায় বসে চুপ করে রইল। অনেক কথাকুঞ্জ জমে আছে হৃদয়াভ্যন্তরে। জমে আছে হাজারো-বেশুমার জিজ্ঞাসার ঢিবি। কিন্তু কোনো কিছুই যেন গায়কের ইতিবাচক চিন্তার চাইতে বড় নয় এইমুহূর্তে। অভিনব আবার বলল,

— এই চাকরি তুমি আর করবে না। এখন এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়বহুল কাজ করা মানে তোমার ভবিষ্যৎ থেমে থাকা। আজ এখনই তুমি আমার সঙ্গে ফিরে যাবে।

বলতে বলতে অনেকটা উড়ো রোষাবিষ্ট হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল অভিনব। আশাবরি চোখ পাকিয়ে শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠল,

- কী করছেন, সমস্যা হয়ে যাবে। অর্ধেক কাজ—

অভিনব হম্বিতম্বি করে বলল,

- উহু,আসছে কতো কাজের মেয়ে,আমি আর একদিনও তোমাকে এখানে থাকতে দিচ্ছি না। খবরদার, ভুলেও জেদ করার চেষ্টা করো না।

বিপন্ন আশা দেখল নিস্তার নেই,কাজেই তৎক্ষনাৎ মেনে নিয়ে আপসের সুরে বলল,

- আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র সব কামরায়, নিয়ে আসি?

অভিনব গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে তির্যক চোখে আশাবরির আপাদমস্তক দর্শন করে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,

- ওঃ সারাদিন এগুলোই পরে ছিলে না? তাইতো বলি। এতো কটকটে ঘামের দুর্গন্ধ কীসের? উহঃ সারা গাড়ি দেখি... যাও যাও,গোসল করে এসো একেবারে। আমি আধাঘন্টা পর আসছি গাড়িতে গ্যাস ভরে।— আর হ্যাঁ, ভুলেও এই কাপড়গুলো পলিথিন ভরে নিয়ে আসবে না।

আশা লজ্জায় লাল হয়ে হেলমেট আর মুঠোফোনটা কুড়িয়ে নিল দ্রুত। এরপর তড়বড় করে গাড়ি থেকে নেমে বডিং হাউজের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা দিল। উঃ, গায়ক না একটু বেশিবেশিই...। এটা সত্য যে সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কারণে শরীর ঘেমেছে তাই বলে এভাবে অপদস্ত করার কী আছে? কিন্তু চাকরির কী হবে? ধ্যুত, যা হয় হোক। চাকরি গেলে চাকরি মেলে, কিন্তু গায়কের একবার রগ চটে গেলে তা ঠিক করা মুশকিল! ভাবতে ভাবতে আশা জড়িত পদে বহুতল বডিংয়ের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে নিজের কামরায় ঢুকল। কামরায় ঢুকে দরজা লকড্ করতেই ঘরের ঘুটঘুটে আঁধার নিমজ্জিত ঘরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড কর্কশ স্বরে ভেসে এলো।

- কী ব্যাপার আশা? সেই কবে থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি৷

কণ্ঠটা চিনতে পেরে আশার কণ্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এ তাদের বড় সাহেবের গলা, যে তাদের সঙ্গে নিজের শ্বশুরের কমপ্লেক্স তদারকি করতে এসেছিল। কিন্তু তিনি তো পাশের কামরায় রুম নিয়েছিলেন! এলেবেলে,অলক্ষুণে চিন্তা করে আশার মাথার শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল দ্বিগুণ হয়ে গেল। সে কোনোমতে শুকনো ঢোক গিলে বলল,

- আমার কাজ তো শেষ স্যার,আপনি এখানে—

- কাজ তো সবে শুরু আশা। আমি তোমার সঙ্গে ব-ড়-অ-অ-অ একটি ডিল করতে এসেছি।

বলতে বলতে বড় সাহেব অন্ধকারে পা টিপে টিপে আশার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ধাঁ করে আশার ডান হাত চেপে ধরল। অন্যহাত আশার ভয়-ক্লিষ্ট তুলতুলে গালে রেখে সামনে অগ্রসর হলো। নিমিষেই আশার আর্তি হৃৎপিণ্ডে ছলাৎ করে রক্তের সফেন ঢেউ উঠে এলো। সে বিকট এক ভয়ার্ত চিলচিৎকার দিকে বড় সাহেবের জঠর ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতেই তিনি আবারো চুম্বকের মতোন আশার কাছাকাছি এসে বিষাক্ত সাপের মতোন কোমর প্যাঁচিয়ে ধরলেন।

চলবে..

1
$ 0.02
$ 0.02 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments