আশাবরি

0 10
Avatar for Nipa1234
3 years ago

আশাবরি

পর্বঃ৫৯

লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

চল্লিশবার কান ধরে ওঠবস শেষে আশাবরি নাক ফুলিয়ে ফুলিয়ে অপমানের উচ্ছ্বসিত কান্না রোধ করে না পেরে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। অভিনব প্রথমে ওর কান্না দেখতে না পেয়ে দাবড়ে বলে ওঠল,

- ও কি? বসে পড়লে কেন? চল্লিশ হলো। সংশোধন পর্ব বাকি আছে যে! শুরু কর।

আশাবরির চোখে পাতা হয়ে কচুপাতার মতো একফোঁটা জল গড়াল অতি সন্তর্পণে। ধমকেও আশার বিকার নেই দেখে অভিনব এবার আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিষয়টা খানিক আঁচ করল। সে ঝুঁকে মেঝেতে ঠেস দিয়ে থাকা আশার হাতটা ধরে তাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। আশা এবার যেন আরো ফুলে ফুলে কাঁদল। তার দৃষ্টি স্থবির হয়ে, নিচের দিকে নিবদ্ধ। চাপা-কান্না আর অভিমানে নিটোল ঠোঁটজোড়া স্ফুরিত! উপর্যুপরি ওঠবস করাতে কটিদেশ হতে সারা নিম্নাঙ্গে ব্যথারা দানা বাধল বিধায় আশা ভালো করে ওজন ছেড়ে দাঁড়ালে পারল না। অভিনব আশার দু-হাত নিজের কাঁধে বিছিয়ে দিয়ে নিম্নমুখী আশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

- কাঁদছ?

- না

- হ্যাঁ কাঁদছ।

আশা গায়কের কাঁধ থেকে দু-হাত ধীরেসুস্থে আলগা করে পায়ের ভর ঈষৎ মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে অনুরাগ-বিজড়িত কণ্ঠে বলল,

- আপনি সবসময় আমার সঙ্গে এমন করেন৷

আশার অনুযোগের মুখে অভিনব ফিক করে হেসে উঠে বলল,

- আচ্ছা, তাই? যাইহোক,বসো। চোখ মুছো। - জুথিকার ব্যাপারে ভেবো না। আমি ওর সঙ্গে দেখা করব। আমি নিষেধ করলে ওর মুখ খোলার সাহস হবে না। আর যদি খুলেও আধপাগল থেকে পুরো পাগল বানিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দেব।

আশাবরি যারপরনাই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে দুই করতলে মুখ ডলে ঈষৎ ভাঙা কণ্ঠে বলল,

- আপনি ওর সঙ্গে দেখা করবেন?

বলেই একটু যেন তীক্ষ্ণ হয় ভেজা চোখদ্বয়। জানালা গলে ফুড়ুৎ করে একদমকা বাতাস এসে আশাবরির মুখের পাশে ঝুলে পড়া কুন্তলে ফুৎকার দিয়ে যায়। যৎসামান্য সরে যাওয়া ওড়নাটা আবারো মাথার ওপর টেনে দেয় আশা; ভুজঙ্গ শিশুর মতোন অবাধ্য তড়বড়ে কেশপাশ গুঁজে দেয় গুলফাম কানটার অন্তরালে। অভিনব ঘরের কোণায় স্ট্যান্ডে বসানো একটা চকচকে গিটার নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

- হু,কেন? আবার জড়িয়ে ধরবে মনে করে ভয় পাচ্ছ?

আশার চোখের তারাজোড়া একমুহূর্তের জন্য তড়িদগর্ভের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল। আজন্ম প্রসাধনের ছোঁয়া না পাওয়া শুকনো ওষ্ঠপুট কী দারুণভাবে বসন্তের নবপল্লবের মতো ডিগডিগ করে কেঁপে উঠে! সত্য সত্যই যে তার অবচেতন মন-মস্তিষ্ক এমনটাই ভেবেছে! আবার দেখা হলে ওই পাগল জুথিকা কাছাকাছি না চলে আসে, অযাচিত ঢলাঢলি না শুরু করে! পাগল-ছাগলের বিশ্বাস আছে না-কি! কিন্তু গায়ক কীভাবে তা আন্দাজ করল?

- যাইহোক, গিটারটার তার ঠিক করতে করতে অনুষঙ্গের পাতা উল্টায় অভিনব,তুমি গান গাইতে পার?

আশাবরি মাথা নেড়ে জানায়,সে পারে না।

- শিখবে? তোমার কণ্ঠ কিন্তু ভারী মিষ্টি আর পরিষ্কার।

আশাবরি দিব্যচক্ষে দেখল, গায়ক তাকে গান শেখাচ্ছে আর একটা রাগ ভুল হতেই তার হৃষ্টপুষ্ট পেশিতে দুড়দাড় করে বেতের বাড়ি পড়ছে। সে উচ্চস্বরে ক্রন্দন জুড়ে অনুনয়-বিনয় করছে ছুটি দেওয়ার জন্য।

- কোনো দরকার নেই,একটু জোর গলাতেই বলে আশা,পরক্ষণেই গলা নিচু করে সংশোধন করে,না মানে ইচ্ছে নেই আর কি।

- থাকবে কী করে? অভিনবের কণ্ঠে হালকা শ্লেষ, আমি যে বিষয়টা দুই বছর পড়ে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছি। তুমি সেটাই পড়েছ। সামনে আরো পড়বে। ওটা নিয়েই থাকো।

একটু থেমে আবার যোগ করে,

তবে তুমি নিজের ইচ্ছে মতো গান প্র্যাকটিস করো। বিশেষ দিনে আমি তোমার কণ্ঠে গান শুনতে চাইব।

অকস্মাৎ ঝি’র হেঁড়েকন্ঠে ছন্দপতন হয়।

- ভাইজান।নাশতা করতে ডাকে আপনাগো।

আশাবরি ঝি’র পিছুপিছু আগে আগে বেরিয়ে গিয়ে বাঁচে। অভিনব আসে একটু পরে।

সন্ধ্যাটা আশাবরি সবার সঙ্গে এটা-ওটা কাটিয়ে দেয়। নিচতলায় গায়কের ঘরে তার দলবল এসে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। গান-টান বানায় বোধহয়! সেদিকেও ভুলেও পদ বাড়ানোর চেষ্টা করে না আশা। সবার সঙ্গে ভালোমন্দ আলাপচারিতার পাশাপাশি আশাবরি ভাবে আর ভাবে। গায়কের সঙ্গে তার বিয়েটা আসলেই হচ্ছে? ছোট বড় নির্বিশেষে সবার আকারে-ইঙ্গিতের গৃঢ় ব্যঞ্জনা তো তাই বলছে! কিন্তু, কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এটি? কোথায় আকাশের জ্বলজ্বলে তারা আর কোথায় এঁদো জমিনের নাড়া! বাস্তবিক জ্ঞান যাদের নেই তারা ‘পারফেক্ট’ বলে আঙ্গুলি-দ্যোতনা দেখিয়ে দিচ্ছে সহাস্যে বদনে। আর যাদের আছে তারা ছেলের দিকে তাকিয়ে কিংবা যুক্তির খাতিরে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আদপেই কি দামী মধুতে আর সহজলভ্য জল একাকার হবে কখনো?... হবে হয়তো। তবে সেখানে নিঃসীম ভালোবাসার উত্তপ্ত বুদ্বুদের দরকার। সেই বুদবুদ কি তার আছ? বা কখনো হবে? কে জানে! এসব মনে হলে ভালো লাগে না তার। দুনিয়া উলটপালট হয়ে যাক গায়ক তার পাশেই থাকুক এটাই সে চাই মনেপ্রাণে। এটা কি ভালোবাসা না স্বার্থপরের মতো নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তা আশাবরি জানে না।

আচ্ছা,কী হবে বিয়ের পর? আমৃত্যু এ বাড়িতেই থাকবে সে? গায়কের সঙ্গে? অহর্নিশ? রাতেও? পাশাপাশি? এমনটাই তো আবহমানকাল ধরে সমগ্র বিশ্বে চলে আসছে... এটাই তো প্রকৃতির অপরিবর্তিত স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম! ভাবতে গেলেই একটা অজানা ভয় আর আড়ষ্টতায় আশাবরি জান যেন কণ্ঠনালিতে এসে ঠেকে। কেমন যেন অদ্ভুত ভোতা আর বোবা অনুভূতি আশাকে চারিদিক থেকে বূহ্য করে নেয়! সে কী চেয়েছিল আর কী হচ্ছে! সে চেয়েছিল চিরটাকাল একাকী নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দিতে। অথচ... কী এক নামহীন, তারাভ্র, অচেনা মায়ার বাহুডোরে আটকে গেল সে!

রাতের খাবারে সবাই উপস্থিত হয়। বিশেষত আশাবরির জন্য নিজ হাতে হরেকরকম পদের খাবার রান্না করেছিলেন জেসমিন আক্তার। মেয়েটা অনেকদিন পর ভালোমন্দ খাবে এই ছিল ভাবনা। তিনি বেছে বেছে আশাবরি পছন্দ করে এমন খাবারগুলোই বিভিন্ন পন্থায় সংগ্রহ করে রান্না করেছেন। মলা আর শিং মাছ খেতে পছন্দ করে সে। মুখ ফুটে কখনো না বললে একদিন দাওয়াতের সময় খাবারের তৃপ্ততা দেখেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। তার জন্যই গ্রামে খবর দিয়ে পুকুরে হাত জাল ফেলে তরতাজা মাছ আনা হয়েছে। জেসমিন আক্তার দেখলেন, আজও মেয়েটা বড় প্রীত মনে মলা মাছ দিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে পুরছে একের পর এক। দেখে দেখে বড় ভালো লাগে তার। আজকালকার মেয়েটা কত রকমের ঢং করে যে খাবার খায়! অথচ এই মেয়েটাকে দ্যাখো!কী অতি সাধারণ অথচ খেদহীন তার মুখাবয়ব, চালচলন, অঙ্গভঙ্গি, বাচনভঙ্গি এমনকি খাওয়ার ভঙ্গিটাও কী বিমল আর সাচ্চা! অথচ এর ওপরই কি-না বারবার বিপদ চড়ে!

সবাইকে খেতে দিয়ে তিনিও পাতে বসে গোটাকতক লোকমা মুখে দিয়ে কথা পাড়লেন,

- সব তো সমাধান হলো। এবার আর অপেক্ষা কেন?

দুলু আর তার আম্মাও আজ এখানে উপস্থিত। দুলু ফোঁড়ন কাটল,

- মামার ঘরছাড়া কন্যা আবার কবে ঘর ছাড়বেই সেই অপেক্ষাই করছি বোধহয়!

অভিনব ভাবল, সর্বনাশ। এই পাজিটা কী করে জানল সে আশাকে সে এই নামে ডাকে! সে তো খুব সাবধানে এবং প্রায় হাতগোনা কয়েকবার এই নামে ডেকেছে! কিন্তু একটু হাসাহাসি পর্ব শেষে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় গুরুভারে দুলুর হাস্যস্পদ কৌতুক চাপা পড়ে গেল। আলী সাহেব খাবার মুখে আমোদিত কণ্ঠে বললেন,

- খারাপ কই? স্যার থেকে শ্বশুর হবার প্রসেসটা আমি ভালোই উপভোগ করছি।

জেসমিন আক্তার সরু চোখে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করলেন,

- উপভোগ করার বয়েস আর নেই। একটু শক্ত থাকতে নাতিনাতনি কোলে নেবার ইচ্ছে কি নেই? বলি,মেয়েটাকে বিয়ে দিই,তা করবে না। আইবুড়ো করে রেখে দেবে।

- খবরদার আমার মেয়েকে খেদানোর চেষ্টা করো না।

ইহিতাই কেবল কোনো কথা বলে না। সে মেঘ-গম্ভীর মুখে মৃদু চালে ভাতের গ্রাস মুখে দেয়।

অভিনব বাবা-মায়ের বাগ্বিতণ্ডা শুনে আর নিশ্চুপভাবে সবার মুখদর্শন করে খেয়ে চলে। বোনের অস্বাভাবিক নিরুদ্যম ভাবভঙ্গি দেখে সে বুঝতে পারে,কিছু একটা হয়েছে তার। এমন সময়ে অন্তত দু'টো কথা বলবে না কিংবা নিজের মতামত উপস্থাপন করবে না এমন অচঞ্চল সে নয়।

দুলুর আম্মা বলে ওঠে,

- মা যেটা বলছে। আশা একটা কঠিন সিচুয়েশন পার করে এসেছে৷ এখন আমি মনে করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা যদি হয় তাহলে ও সবকিছু ভুলে সামনে এগোতে পারবে।

মা সায় দেয়,

- ঠিক বলেছ মা। একলা ও বাড়িতে থাকলে সে ভেঙে পড়বে। তাছাড়া ওর চাকরি-বাকরিও নেই। খুঁজার মতো মানসিক ইচ্ছেও নিশ্চয় এখন নেই। সবমিলিয়ে...

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে মা অকস্মাৎ একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরেকটা কথা পাড়ে,

- আচ্ছা সবাই বললে তো হবে না। আশা কী চায় সেটাও তো দেখতে হবে? আশা? তোমার কি কোনো আপত্তি আছে? দ্যাখো কিন্তু! তোমার ওপরেই সব। পরে কিন্তু বলো না যে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছি!

বলেই ঠোঁটে একসুতো হাসির আবির রাঙালেন তিনি৷ সবার নজর এখন আশার উপর। আশার লাজুকলতার ন্যায় নুইয়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে সবার মুখে একটা চাপা হাসির বদ্ধ তরঙ্গ খেলছে। সেই তরঙ্গের ওপরকার সূর্যচ্ছটা যেন আশার মুখের ওপর গিয়ে পড়ছে।

আশা খাওয়া বন্ধ করে আনত মস্তকে বাসনের মধ্যখানের ঝোল মাখানো ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে মিনমিন করে বলল,

- আপনারা যা ভালো মনে করেন।

কথাটা বলেই যেন সে বেঁচে গেল। এতক্ষণ তার বুকের বাঁ পাশস্থ হৃৎপিণ্ডটা কেন যেন মুচড়ে ধরে উদ্যতমুষ্টি করে ছিল! বলামাত্রই তাকে নিষ্কৃতি দিল! সে মরতে মরতে বেঁচে গেল!

মা'র মুখে তখনো হাসিটা ঝুলছে,

- বেশ, বিয়েতে তুমি মত দিচ্ছ তো?

আশাবরি ধুকপুক ধুকপুক দুন্দুভি বাজাতে থাকা বুকে খুবই সাবধানে একপলক চোখ তুলে পরক্ষণেই নামিয়ে নিয়ে বুঝা যায় না এমনভাবে বিনয়াবনত মাথা দুলাল।

জেসমিন আক্তারের মুখে বর্ষার চেরিফুলের মতোন একটা প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল। হাসির ছটার তাঁর দুচোখ কোনার প্রসারিত বার্ধক্যের বলিরেখাগুলো এতে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি খুশি হয়ে কথাবার্তা এগোতে লাগলেন। যেন এখনি না বললে সবকিছু ফসকে যাবে।

- আচ্ছা আচ্ছা। একটা কথা। একটু দম নেন তিনি, অভিনব চাইছে কাছের আত্মীয়দের ডেকে বিয়েটা যাতে সাধাসিধে ভাবে হয়। কেননা,—বুঝতেই পারছ? পরে অবশ্য অনুষ্ঠান করে সবাইকে নেমন্তন্ন করা হবে। তুমি এটা নিয়ে মন খারাপ করবে না তো?

আশাবরি এবারো একইভাবে মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে-দ্যোতনায় বুঝিয়ে দিল, বাহ্যিক চাকচিক্য তার কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। যত কম লোক জানল ততই তার লজ্জার দাঁড়িপাল্লা হালকা হলো। কাছের মানুষ আরো কাছে আসবে এতো লোক দেখানোর কী?

- দ্যাখো কী লক্ষ্মী মেয়ে। অভি- তোমার তো প্রতিদিনই ব্যস্ততা...

জেসমিন আক্তারের কথার মধ্যিখানে আলী সাহেব টিপ্পনী কাটলেন,

- ছেলের কি বিয়ে করার সময় হবে?

অভিনব মাথা তুলে নিরাশা-বিরক্ত মিশ্রিত একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বাবার দিকে।

- আহা তুমি চুপ কর। ওর মেজাজটা গরম করে দিও না!

অভিনব বাবার দিকে আরেক পলক একই দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলল,

- সামনের শুক্রবার তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই।

তার কণ্ঠে বাবার প্রতি ক্রোধের গনগনে আঁচ স্ফুটিত হয়। হাজার হোক, বাবা-ছেলেয় যে আদায়-কাঁচকলা তা তো কেউ ভুলেনি আজ অবধি।

মা একটু নীরবে হিসেব করে উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন,

- আজই তো রবিবার, এরপর কি—

অভিনব বিরক্তি-নিঃসৃত রনরনে কণ্ঠে বললশ

- এমনিতেই আশাবরির পেছনে অনেক সময় গেছে। প্রচারণা, মিছিল-মিটিং, সমাবেশ, কত কাজ বাকি এখনো। তোমরা ওর কী বুঝবে!

ছেলের এই বাবার সঙ্গে লটখট করাটা আর গেল না। বাপটাও আছে তেমন! সুযোগ পেলেই ছেলের সঙ্গে ঠোকাঠুকি না করলেই কি নয়? তিনি একদলা বিষদৃষ্টি স্বামীর দিকে নিক্ষেপ করে পরক্ষণেই শান্ত-ভীতভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

- বেশ, তবে শুক্রবারই। কাল থেকেই সব প্রস্ততি শুরু। তোমার বন্ধুদের জানিয়ে দিও। বাকিটা আমি দেখছি।

সভাভঙ্গ হলো। আশাবরির মনটা খাঁচায় বন্দি পাখির মতোন কেবল পালাই পালাই করছিল। অনিচ্ছা সত্বেও সে জোরপূর্বক অনুমতি নিয়ে সেদিন রাতেই বাসায় ফিরে গেল। সারাটাপথ সে কেমন একটা ভালোলাগা আর হৃৎ-খচখচানি ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। বৈকালীন ওই বাসন্তী রঙিন প্রজাপতির মতো এধার-ওধার ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে হলো তার। কখনো আবার বুক ঠেলে কান্নার রুদ্ধ ঢেউ উঠল। কান্না এলো। কাঁদল সে। কান্নার জলের মধ্যেও যেন হৃদয় সরোবর জুড়ে অস্পষ্ট এক খুশির নীলোৎপল ভাসে! কেন এই হ্যাঁচড়প্যাঁচড় তা আশা জানে না। মনের এই অনভিপ্রেত আঁকুপাঁকুর সংজ্ঞা সত্যিই আশাবরির জানা নেই।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল অভিনব। ইহিতা হন্তদন্ত হয়ে তেড়েফুঁড়ে ঘরে ঢুকে ভাইয়ের সুমুখে দাঁড়ালো কঠিন মুখে। অভিনব কাল থেকেই তার মতিগতির অস্বাভাবিকতা লক্ষ করে আসছিল, সে গায়ে পাতলা কালো টিশার্টটা গলিয়ে রুক্ষভাবে শুধাল,

- কী হয়েছে?

ইহিতা নিজের মুঠোবন্দি মোবাইলটা ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল বিনাবাক্যে।

- কী?

বলে অভিনব মাথা উঁচিয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। পলে পলে একটি ফেইক একাউন্ট থেকে পাঠানো মেসেজগুলো পড়তে পড়তে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো,দাঁতে দাঁত লেগে কটকট শব্দ উঠল,চোখ হয়ে উঠল বিতৃষ্ণাপূর্ণ।

- এটা জুথিকা।

বলে একটা নিশ্বাস চেপে ফোনটা পুরশ্চ ফিরিয়ে দিল অভিনব।

ইহিতা নিজের ফর্সা মুখটা অমানিশার মতো কালো করে বলল,

- তুমি কি জানতে যে আশা...

- হু জানতাম। অভিনব অতিমাত্রায় নির্লিপ্ত, তবে এটার সত্যতা নেই কোনো। আশাবরি আমাকে বলেছিল ওর মা মারা যাওয়ার সময় একটা কথাই বলেছিল যে ওর বাবা আছে। এটার ব্যাখ্যা কী? দিনের অর্ধেক সময়ই আশার মা সজ্ঞানে থাকতো।

- ভাইয়া তুমি কিছু যাচাই না করেই আমাদের ঘরে...

- ইহিতা, চেঞ্জ ইউর মাইন্ড।—

অভিনবের গলার স্বর তেতে উঠে।

-সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আমি চাইব না পাগল-ছাগলের কথা শুনে তুমি এটা নিয়ে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করো। তোমার জেনে রাখা উচিত, আমারো বোধ-বুদ্ধি আছে।এবং আমি কারো কথা ভেবে চলি না। না নিজের পরিবারের না বাইরের তথাকথিত সমাজের৷ আমি অবশ্যই সবকিছু যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,নাহলে তোমার কেন মনে হলো হাজার হাজার উত্তম প্রস্তাব ঠেলে আমি আশাকেই বেছে নিলাম? নিশ্চয় বিবেচনা করেই তো! — আর কিছু বলার না থাকলে আসতে পার এবার। আমি বেরোব'খন।

বলে আর কোনো উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে নিজেই দ্রুতলয়ে প্রস্থান করল অভিনব। ইহিতা দ্বিধান্বিত মনে পুরো ঘরময় বিরতিহীন পায়চারি করল মিনিট পনেরো। ভাবল আকাশকুসুম,ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত। ভাইয়ের মুখের ওপর সে বলতে পারল না, তুমি আশাকে প্রাণপণে চাও বলেই তো এখন নানান যুক্তিতর্ক উঠে আসছে! এখন যদি পরিবার থেকেই এমন একজনকে ঠিক করতো তাহলে কি তুমি মেনে নিতে? কিন্তু বলার সেই সাহস ইহিতার নেই। তথাপি ভাইয়ের কথাগুলোও যে মোটেও ফেলনা নয় তা থেকে থেকে একটু হলেও অনুধাবন করতে পারল সে। ঠিকই তো! সবকিছু ঠিকঠাক হবার পর এমন একজনের কথা ধরে সে পুতুল নাচের মতো নাচতে যে কখনোই চাইবে না তার ভাইয়ের পাশে অন্যকেউ দাঁড়াক। সুতরাং ভাইয়ের সিদ্ধান্তই ঠিক ভেবে নিজেকে নিরস্ত করল ইহিতা৷ তবুও যেন মনের খচখচানিটা পুরোপুরি তিরোহিত হতে চাইল না।

একদিনের মধ্যেই বিয়ের যোগাড়যন্ত্র শুরু হলো পুরোদমে। আলোচনা সাপেক্ষে ঠিক করা হলো নিয়মানুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত্রে গায়ে হলুদ এবং শুক্রবার জুমার নামাজের পরই হবে আক্দ। সেদিনই ঘরোয়াভাবে নিকটাত্মীয়দের উপস্থিতিতে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে বউ উঠিয়ে আনা হবে। বিয়েকে সামনে রেখে অত্যন্ত জোরদার কেনাকাটা শুরু হলো। ঘরে সারে সারে নব্য ক্রয়কৃত জিনিসপত্রের রাশি জমল। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের ছোট করে নিমন্ত্রণ জানানো হলো। অভিনব এসবের কিছুতেই নেই৷ কথায় আছে,যার বিয়ে তার খবর নেই পাড়াপড়শির ঘুম নেই। বিয়ে তার, অথচ তার কোনো রা বিকার নেই। অন্যদিনে অভিনবের বিয়ে শুনে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যেম অতর্কিত বোমা বিস্ফোরণ হলো। এক আত্মীয় অন্য আত্মীয়কে দূরালাপনিতে যোগাযোগ করল,‘ হ্যাঁ রে,শুনেছিস! অভির নাকি বিয়ে। মাত্র দাওয়াত দিল। মেয়ের নাকি বাড়িঘর মা বাবা নাই,অনাথ’

‘কী বলো,একদম কেউ নাই?’....

শুনে কেউ বলল, এমনি হবে,গানটান করে কিনা,মিডিয়ায় কাজ করে যারা এমনি তো হয়!

আবার অধিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা মেকি মন খারাপের ভান করে বলে,‘ছেলেটার কপাল পোড়া, ভালো চরিত্র, অথচ বউটা সব উলটপালট করে দিল। বিয়ে-থা না করে কী করবে? নিজের দিকও তো দেখতে হয়’

থুড়থুড়ে বৃদ্ধ যারা তারা দাওয়াত পেয়ে অভিযোগ করে,সব ভাল,কিন্তু ছেলেটার কী এমন বয়স হলো জেসমিন? একটু দেখেশুনে বিয়ে দেওয়া যেতো না? কোত্থেকে একটা... যাহোক, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দেখি শুক্রবার পর্যন্ত সয় কি-না!

মোটের ওপর আত্মীয়স্বজনদের মাঝে একটা চাপা কানাঘুঁষা তপ্ত-ভ্যাপসা বাতাসের মতো বারবার ঘুরাফেরা করতে লাগল। ফলশ্রুতিতে দেখা যাদের দাওয়াত দেওয়ার কোনো আলামতই ছিল না তারাই গায়ে পড়ে হালকা অপমানের উদ্দেশ্যে কৌতূহলী হয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করল,

- শুনলাম ছেলের নাকি বিয়ে?

জেসমিন আক্তার অপ্রস্তুত হয়ে কপট হেসে কৈফিয়ত দেন,

- আপনাদেরকেই কল দিতে যাচ্ছিলাম এখন। হুট করে ঠিক হলো কি-না তাই সবাইকে কার্ড পৌঁছে দেওয়াটা হচ্ছে না।

কল রেখে তিনি ফুঁসতে ফুঁসতে আওড়ান,‘উহঃ নির্লজ্জ সব!’

এরিমধ্যে আরেকদফা ভিন্ন কাণ্ড ঘটল। জেসমিন আক্তার চাইলেন, গ্রাম থেকে আশার কোনো নির্ভরযোগ্য আত্মীয় এসে আশাকে সমর্পণ করে যাক। যেভাবেই হোক, তারা আশাকে ছোট থেকে লালন-পালন তো করেছে!

আশা জানাল এমন একজনই আছে,মনির ভাই। যদিও তার সঙ্গে সেই শেষ যোগাযোগ হয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু এটা সত্য যে সে আশাকে ছোট থেকেই সে নিজের বোনের নজরে দেখে এসেছে। মা'র জন্য প্রকাশ্যে না পারলেও আড়ালে আবড়ালে তাকে অনেককিছুই তাকে দিতো ঠিক যেমনটা রাইসাকে দিতো।

কিন্তু মায়ের প্রস্তাব অভিনব নাকচ করে দিয়ে বলল,

- নো, নেভার! ওই লোকের সঙ্গে আমার একবার তর্ক হয়েছিল ফোনে৷ আশাবরি তখন তার ভাই জহিরের হাতে বন্দি। সে ছিল ইন্ডিয়ায়।... নাহ হবে না। লাস্ট দুই বছর কোনো খোঁজ নিয়েছে সে? নেয়নি? তাহলে? কী দরকার?

জেসমিন আক্তার ছেলেকে কিছু বুঝিয়ে বলার আগেই আশাবরি ইতস্তত করে সংকোচ ঝেড়ে অকস্মাৎ মুখ খুলল,

- উনি সবসময় আমাকে ভিন্ন চোখে দেখতেন। আমার মনে হয় উনাকে জানানো উচিত।

বলেই আবারো মাথা নিচু করে চুপ করে গেল সে। এটাই তার মুখফুটে প্রথম মতামত এবং চাওয়া। কাজেই অভিনব কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও অগত্যা সায় দিল।

দিন-দুই এভাবেই বৈবাহিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই গেল। ইহিতা যদিও সব দিকে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত। কিন্তু দিনশেষে ঘরে ফিরে তার মুখ দেখে অভিনব নিমিষেই বুঝে নেয় যে, শুরুতে এই বিয়ে নিয়ে সে যতোটাই উদ্যমী ছিল, এখন ঠিক ততটাই চুপসে পড়েছে। এর ভবিতব্য প্রভাব যে খুব একটা সুখকর নয় এবং এর ছটা যে গোড়া থেকেই ইনিয়েবিনিয়ে আশাবরির উপর গিয়ে তাও সহজ অনুমেয়। এ কারণেই সে দিনকয়েক ধরে আশাবরির গ্রামে গুপ্তচর দ্বারা আঁতিপাঁতি করে ইতিবাচক তথ্য সংগ্রহ করেছে। গায়ে হলুদের আগেরদিন অর্থাৎ বুধবার রাতে অভিনব ইহিতাকে জরুরি তলব দিল। ইহিতা স্টুডিও ঘরে এসে ভাইয়ের কাছে বসল নিঃশব্দে। অভিনব ইজিচেয়ারটা ঘুরিয়ে বোনের দিকে মুখ করে বসল। মিনিট এক নিঃশব্দে কাটল। ঘরজুড়ে ঘরির পেন্ডুলাম দুলার শব্দ আর এসির ভোঁতা যান্ত্রিক শব্দ বাদে আর কোনো শব্দ নেই। ডানপাশে গুটিকয়েক মনিটর জ্বলছে। অভিনব কী যেন ভেবে বলা শুরু করল,

- দ্যাখো ইহিতা৷ তুমি জানো আশাবরির কোনোদিক থেকে কোনোপ্রকার খেদ নেই৷ তুমি যে বিষয়টি নিয়ে ভার হয়ে আছ সে বিষয়টি নিয়ে ও নিজেই হীনমন্যতায় ভোগে। ঠিক এই কারণেই সে চায়নি এই বিয়েটা হোক। আচ্ছা, একটা কথা বলো,আশাকে কি তোমার ঘৃণা হয়?

ইহিতা অপ্রতিভ হয়ে সবেগে মাথা সঞ্চালন করে বলল,

- না না,কী বলছ ভাইয়া!— হঠাৎ শুনেছি তো, তাই...

- যাক্ তুমি তোমার উন্নত মনের পরিচয় দিয়েছ। একটু প্রসন্ন হয়ে বলে অভিনব, আমি খবর নিয়েছি। ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজবের মতো। আশাবরি ওখানকার তৎকালীন বৌদ্ধ জমিদার বংশের মেয়ে। যেহেতু আশাবরির মায়ের শেষ কথা ছিল, আশাবরির বাবা আছে তাই আমার বিশ্বাস জমিদারের বিপুল সম্পত্তি থেকে আশার আর ওর মা'কে বঞ্চিত করার জন্যই এই খেলা চালা হয়েছে। ভবিষ্যতে আশা চাইলে আমি এটা নিয়ে লড়ব।

- ওমাগো, চোখ পাকিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে ইহিতা, এতো কিছু? আশাবরি মেয়ে না রহস্যের বস্তা? ও জানে এসব?

- নিশ্চই জানে। কিন্তু ও তো কেমন জানো। পৃথিবীটাকে সে নিজের মতোই সহজ ও সরল মনে করে। এ বিষয় নিয়ে আমি এতদিন মাথা ঘামাইনি। এখন দেখছি সেটা বেড়ে যাচ্ছে তাহলে অবশ্যই সত্য সামনে আসবে।

কিন্তু তুমি স্বাভাবিক হও। আশার সঙ্গে থাকো। তোমার ফ্রেন্ডদের খবর দাও। আনন্দ করো। টাকাপয়সা কিছু লাগবে?

ইহিতার বুকের ওপর থেকে একটা বিরাট পাথর যেন গড়গড়িয়ে নেমে যায়৷ থেকে থেকে তার চিকন পাতলা ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির লহর ওঠে সারা মুখাবয়বে ছড়িয়ে পড়ে তার তরঙ্গ। সে আবদারে কণ্ঠে বলে ওঠে,

- লাগবে না,কিন্তু শপিং করার সময় একটা ডায়মন্ড রিং দেখেছি। ওটা লাগবে।

- ডায়মন্ড রিং? চোখ বড় করে অভিনব, ফতুর করবে দেখছি।

- এ্যাঁহ, মুখ বাঁকিয়ে দাঁড়ায় ইহিতা।

অভিনব প্রতিশ্রুতি দেয়,

- আচ্ছা, এখন না। আরো কিছুদিন পর। বাইরে থেকে এনে দিব।

- আচ্ছা।

পাতলা লিকলিকে বপুটা দুলিয়ে দুলিয়ে মৃদু শিস দিতে দিতে খুশিমনে বেরিয়ে যায় ইহিতা।

গায়ে হলুদের দিন সমস্ত কাজ থেকে ইস্তফা নিয়ে বাড়ির উত্তর পাশের সুইমিংপুলের নীলাভ পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল অভিনব। পাশে টাপেটোপে আড়ষ্টভাব নিয়ে বসে আশাবরি। অপরিমেয় সংকোচে সে পারতপক্ষে গায়কের মুখোমুখি হয়নি দু'দিন। একটু আগেই আশা বাড়িতে প্রবেশ করতে যেতেই সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা অভিনব তাকে দূর থেকে দেখে কাছে ডেকে নেয়। আশাবরি পাশে এসে বসতেই অভিনব দুঃখিত গলায় বলে,

- জুথিকার কোনো খোঁজ পাইনি। কোথায় আছে কে জানে।

- কী হবে এখন?

আশার কণ্ঠ আর দৃষ্টি উদ্বিগ্ন। অভিনব চোখ সরিয়ে সুদূরের খোলা আকাশে দৃষ্টি বিছিয়ে ওই প্রসঙ্গ এড়ায়,

- বাদ দাও৷ হানিমুনে কোথায় যাবে? পাহাড়ে না সমুদ্রে? তোমার তো পাসপোর্ট ভিসা নেই,দেশে কোথাও যেতে হবে।

নতুন প্রসঙ্গটা শুরুতে আশাবরি বুঝতে না পেরে আওড়ায়,

- হানিমুন... ওঃ, পরক্ষণেই তার মাথায় বাড়ি খায় বিষয়টা। রাঙ্গা হয়ে বলে, আপনার ইচ্ছে।

- তোমার ইচ্ছে নেই কেন?

লজ্জিত আশা এবার নিজেই তিনশো ষাট ডিগ্রি কোনে প্রসঙ্গের কম্পাস ঘুরায়,

- বান্দরবানের বাড়িটার কাজ শুরু হয়েছে?

কিন্তু এতে কাজ হয় না। অভিনব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জোরপূর্বক আগের প্রসঙ্গেই আশার মুখ থুবড়ায়,

- কেন? ওখানেই হানিমুন করার ইচ্ছে নাকি?—চলছে কাজ৷ মাস ছয় লাগবে আরো।

আশাবরি পুনর্বার এই সংকোচ বিজড়িত অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়ানোর চেষ্টা করে,

- বলছি,নির্বাচনে আপনার মার্কা কী হবে? আপনার তো কোনো পোস্টার আসেনি এখনো!

- ‘সিঙ্গারা। মার্কা হয়ে সিঙ্গারা।’ অভিনব বলে ভীষণ নির্বিকারে,যেন এটাই সত্য!

- সত্যি? গভীর বিস্ময় চোখে নিয়ে শুধায় আশা, লোকে তাহলে বলবে, সিঙ্গারা মার্কায় দিলে ভোট খাবার পাবে দেশের লোক? তাহলে তো চাল মার্কা দেওয়া যায়। কারণ আমাদের প্রধান খাবার ভাত।

- নাহ চাল সাইজে ছোট।

- তাও ঠিক। সিঙ্গারাই ভালো।

অভিনব একটু মুখ শক্ত করে ছদ্ম হতাশার সুরে বলে ওঠে,

- ওহ আল্লাহ, তুমি আমার কপালে জুটাইয়াছ এক গাধী,

সে আমার মাথা খায় নিরবধি।

পাতলা অভিমানে আশাবরি চুপ করে যায়। বুঝতে পারে এ তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা।

জানো আশাবরি, হঠাৎ গায়কের সুরটা পাল্টে যায়,কী এক অসহায়ত্বের বীজ বুনে যায় তার কথাগুলো,বলে, মাঝেমাঝে মনে হয় আমি তোমার ওপর অবিচার করেছি। যে দু'টো বছর তোমার পাওয়ার কথা ছিল সেই দু'টো বছর আমি অপাত্রে দান করেছি৷ অথচ এখন সঠিক মানুষটার জন্য সঠিক আয়োজনটা করতে পারছি না।...

আশার ভেতরটা অজানা অপরাধবোধে চিড়বিড়িয়ে ওঠে। সে একটা প্রগাঢ় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতলভাবে বলল,

- বাদ দিন না! আপনিই তো বলেছিলেন অতীত মনে না রাখাই শ্রেয়। তাছাড়া আমার তো কোনো অভিযোগ নেই, আপনি কেন—

কথাটা শেষ না করেই মুখ ঘুরায় আশা। শক্ত মানুষটার মন খারাপি তাকে চিনচিনে যাতনা দেয় এটা তাঁকে কে বুঝাবে?

অভিনবও ফিরতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

- সেটাই,চলো ওঠা যাক। সবাই অপেক্ষা করছে। একটু পরই ডেকোরেশন মেম্বাররা আসবে। টুকটাক কিছু সাজানো-গোছানো হবে।

সন্ধ্যা হতেই আশাবরি বুঝল মুখে যতটা সামান্য বলা হয়েছিল আদপে আয়োজন ততটা সামান্যও নয়! লোকজন যত কম আসবে ভেবেছিল অত কমও নয়! সাধারণের ওপর এতো সুন্দর করে বিয়ের সাজ সাজানো যায় তা তার কল্পনার অতীত ছিল। সারা বাড়িতে ঝাড়বাতি জ্বলছে ঝিকিমিকি করে। অকৃত্রিম ফুলের বাহার চারিদিকে৷ ছাদে নানাবিধ ফুলেল স্টেজ গড়া হয়েছে। সারা সন্ধ্যা একঝাঁক তরুণী আশাকে ঘিরে বসে দুই হাত মেহেদিতে রাঙাল। কদাচিত দু একজন তরুণ প্রেমিক পুরুষ এসে এঘরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। মেয়েরা তাদের উর্ধ্বশ্বাসে বিতাড়িত করে। এরা সবা-ই এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তরুণ তরুণীদের মাঝে কিন্তু আবার জাত্যভিমান নেই। এই বয়সে তারা কার পাশে কাকে কতটা মানিয়েছে সেটাই বিচার করে। কোন বংশীয়, কার পারিবারিক ইতিহাস কত চমকপ্রদ সেসব এদের কাছে উহ্য। আশাকে ঘিরে পুরো খাট ছেয়ে থাকা তরুণীদের মাঝ থেকে চাপা সুরে সেই আভাসই কানে আসে আশার,

‘আগে এসেছিলাম তখন খেয়াল করিনি। গায়ের রং দেখেছিস! দুধে আলতা! মেকআপ না দিলেও চলবে।’

‘আরে চোখ দেখ না। কাজল লাগবে? খোদায় তো কাজল দিয়েই পাঠিয়েছে’

'‘ ওতেই তো অভিনব ভাই আটকেছে’

যেইজন মেহেদি রাঙাচ্ছিল সে সবার হাস্য পরিহাসে যোগ দিয়ে বলল,

- হাতটা একটু শক্ত মনে হচ্ছে!’

- হবে না? সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে কি-না! ইট বালু সিমেন্ট নিয়েই তো যত কারবার! ’

- শক্ত বলেই তো একটা বদমায়েশ মরেছে। তুমি হলে কি পারতে?

নানান কথাবার্তা,হাসিঠাট্টা চলে অনবরত। আশাবরি চোখ অবধি ওড়না টেনে দিয়ে চুপটি করে সব কথা শুনে আর মনে মনে গালি কপচায়,নির্লজ্জ বেহায়া আত্মীয়-স্বজন সব।

রাতে মহা আড়ম্বরের গায়ে হলুদ হয়। থমথমে কঠিন মানুষটা দাড়ি-গোঁফ ভর্তি ভেজা হলুদ নিয়ে আড়চোখে আশার দিকে তাকায়। আশার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। একে তো সবার শ্যোনদৃষ্টি তার ওপর অন্যদিকে অদ্ভুত ফিনফিনে শাড়িটা সামলাতে সামলাতে সে নাজেহাল। আঁটুনি দেখে মনে হচ্ছে এখনি গা থেকে খসে পড়ে চরম বেইজ্জতি হবে! আশার গালেও হলুদ পড়ে। একফাঁকে অভিনব আশার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

- সবাই দেখছে তো, এমন চিড়বিড় করছ কেন? শাড়ির ভেতরে কি বিছা ঢুকেছে?

এতগুলো লোকের মাঝে ভরসা করার মতো একজন মানুষ পেয়ে আশা নির্দ্বিধায় বিমর্ষ-বিপন্ন কণ্ঠে বলে,

- মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাবে। কী করব?

- পাগলামি বন্ধ কর। কিচ্ছু হবে না।

চোখ কটমটিয়ে খ্যাঁচম্যাঁচ করে কথাটা বলেই কেটে পড়ে গায়ক।

গভীর রাত। মধ্যকাশে কাটা কুমড়োর ফালির মতোন একখানা নব্য চাঁদ নক্ষত্রহীন আকাশের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে গাঁক গাঁক করে লোকজন কথা বলছে। ছাদে টাঙানো সামিয়ানার পর্দায় ওই পাহাড় ছাড়া বাতাস এসে পতপত করে ঝাপটা দিচ্ছে। আশার চোখ যখন ঘুমের ভারে অবনত, ঢুলুঢুলু তখন ছাদের স্টেজে পাশাপাশি বসে আশার নিভাঁজ পেটের কাছে সূক্ষ্ম চিমটি কাটে অভিনব,

- গাধী, একদম ঝিমুবে না। ক্যামেরার দিকে তাকাও। কেক কাটা বাকি এখনো!

চিমটি খেয়ে আশা হকচকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে বসে। বিয়ে করা যে এতো দহর কষ্টসাধ্য তা কে জানতো! জীবনে যত ধকলই আসুক,দিনশেষে সব বিস্মৃত হয়ে একটু শান্তিতে ঘুমানো যেত! এখন কি সেটাও বিসর্জিত হতে যাচ্ছে নাকি তা নিয়ে আশা সশঙ্কিত।

গায়ে হলুদের রাতে অনেক কষ্টে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কেক কেটে সবার মুখে তুলে দিল আশা। অভিনবের কাছের বন্ধুরা যারা নিমন্ত্রিত হয়েছিল তারা খোঁচা দিল,

‘এখনও মূল কাজ বাকি ভাবি! ঝিমানো স্বভাব বাদ দিতে হয় যে!’

ছাদের স্টেজে ছোটখাটো অনুষ্ঠানটা শেষ হতেই তাকে আর উপরতলা কি নিচতলা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। পরিত্যক্ত চিলেকোঠায় একটা পাটি আর বালিশ বিছিয়ে অপূর্ণ ঘুমটা তৃপ্তিভরে পরিপূর্ণ করে নিল সে। ঘুমটা ভাঙল একটু বেলা করে, তুলির হাঁকপাঁকে। তার ঝঞ্ঝাটময় কণ্টকাকীর্ণ জীবনে স্বপ্নের মতো সুন্দর আর অতিন্দ্রীয় আচ্ছন্নতায় একটি দিনের সুখময় অন্তে আরো একটি স্বপ্নময় দিনের সূচনা হলো। এই যুগান্তকারী দিন তার জীবন-সারথিকে ভিন্ন মোড়কে প্রত্যাবর্তিত করবে।

সকাল সকাল অভিনব বিছানা ছেড়ে উঠে চারিদিকের কাজকর্মের হাটহদ্দ জেনে নিল৷ একে-ওকে ছোট-বড় কিছু দরকারি ফরমায়েশ দিয়ে ফিরল ঘুরে ঘুরে। কী এক ভীষণ কাজে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত তুলিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

- দেখ তো আশাবরি কোথায় টাল হয়ে পড়ে আছে। ডেকে দাও আর আমার কাছে একটু আসতে বলো।

তুলি আজ্ঞা নিয়ে চলে গেলে অভিনব পেছনের হলঘরের পাশে বাবুর্চিদের শোরগোলপূর্ণ ডিপোর দিকে এগোল। ওদিকটার একটু খোঁজখবর নেওয়া জরুরি। হঠাৎ তার চোখ কাড়ল দূরের একজন বোরকাওয়ালির ক্ষীণ হাতের ইশারায়। অভিনব সকালের কড়া রোদ্দুরে চোখ কুঁচকে তাকাল সেদিকে,পরক্ষণেই আশেপাশে৷ চারিপাশে অবাধ লোকসমাগম,হাঁকাহাঁকি, ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে ধীরে ধীরে। তবে এদিকটা একটি নিরজন আছে। কালেভদ্রে দু'একটা ছেলেপেলের দল দৌড়ে আসে, আবার ফিরে যায় । অভিনব কৌতুহলী হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে রাখতে এগিয়ে গেল সেদিকে। একপর্যায়ে সামনে এসেই বোরকাওয়ালিকে চিনতে পারল অভিনব। জুথিকা! তার অবিবর্জিত দুঃস্বপ্ন। সে চারদিকে আশু সতর্ক দৃষ্টির জাল বিছিয়ে দিয়ে চাপা উত্তেজিত স্বরে বলল,

- তুমি এখানে কী করছ জুথিকা!—এসো আর সাথে। সবকিছুর হিসাব দিবে তুমি।

বলেই খপ করে বোরকাওয়ালির হাতটা চেপে ধরে টেনেহিঁচড়ে পাছদুয়ার দিয়ে অন্দরে প্রবেশ করে গোপন পথে নিজের ঘরে চলে আসে সে।

- কী চাও তুমি?

আপাদমস্তক বোরকাবৃত জুথিকে জোর ধাক্কায় ঘরে পশিয়ে আস্ফালন করে অভিনব। জুথিকা অবিচল ভঙ্গিতে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ থেকে হিজাব উন্মুক্ত করে বলে,

- তোমার বিয়ে আর আমি আসব না?তা কী করে হয়?

- অনেক সহ্য করেছি তোমার বেলাল্লাপনা। এবার তুমি দেখবে আমি কী করতে পারি৷ ইহিতাকে তুমি কী বলেছ? কেন বলেছ?

রাগে চোখেমুখে অন্ধকার দেখে অভিনব। চোখ দিয়ে তার আগুনের ফুলকি টিকরে টিকরে বেরোয়।

জুথিকার চোখে বাসি অশ্রু জমা হয়।

- এমন করো না। কাতরোক্তিটা করেই জুথিকা অভিনবের একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে আসে, আমি শেষবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। শেষবার। আল্লাহর কসম।

-তুমি...অভিনব রোষে ফেটে পড়ে কিছু একটা বলতে যেতেই অকস্মাৎ কটাস করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার পেছন থেকে ঘুম ফোলা ভারী মুখে বেরিয়ে এলো গতকালের সেই শাড়ি পরিহিতা আশাবরি। এই প্রথম আশাবরিকে দেখে ভয়ে অভিনবের হৃৎপিণ্ডটা কেঁপে উঠল। অন্তত আজকের মাহেন্দ্রক্ষণে আশাবরি কোনোপ্রকার স্নায়বিক আঘাত পাক্ এটা তার অন্তরাত্মা মোটেও প্রত্যাশা করেনি।

চলবে...

আগের পর্ব

https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/847374226068075/

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments