#আমি_রোদেলা
#পর্ব_২১
পরের দিন খালামনি আমি কলেজ থেকে ফেরার সময় গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন । আমি রিকশা থেকে নামার পর ছেলেটিকে ডাকলেন , ছেলেটি প্রথমে আসতে চাইলে না , যখন খালামনি বললেন আমি তোমাকে কিছু করবো না । আমি শুধু তোমার সাথে কথা বলতে চাই । তখন ছেলেটি খালামনির সামনে এসে সালাম দিলো । আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খালামনি বাসায় চলে যেতে বললেন । খালামনি ছেলেটিকে কি বলে ছিল জানি না । সেদিনের পর আর কখনই ছেলেটিকে দেখিনি ।
ওই ঘটনার পর থেকে সব সময় ছেলেদের থেকে দ্রুত বজায় রেখেই চলেছি । কিন্তু তুহিন সাহেবের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিলো যা আমি এড়িয়ে যেতে পারি নি । উনার সাথে কাটানো সময়গুলোকে খুব মিস করতে লাগলাম । খুব ইচ্ছে করে ফোন করে কথা বলি , কিন্তু খালামনির কথা মনে হলেই চুপ করে যাই ।
তুহিন ভেবে পেলোনা রোদেলার কি হয়েছে ? মেসেজের উত্তর ও দিচ্ছে না , বেশ কয়দিন অপেক্ষা করার পর রোদেলার মোবাইলে কল দিলো । না কল ও যাচ্ছে না । মেয়েটি কি আবার ও কোন বিপদে পরলো না তো ? তুহিন ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বোধ করতে লাগলো । মাকে জিগ্যেস করেছিলো রোদেলার সাথে কথা হয়েছে কি না । মা জানিয়েছেন অনেক দিন কথা হয় নি । মাকে দিয়ে ফোন করিয়েছিল তুহিনের , ওর ফোন না ধরলে ও আম্মুর ফোন ঠিকই ধরেছিল । তুহিন মায়ের কাছ জানতে চাইলো রোদেলা কেমন আছে ? মা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন ভাল । বেশি কিছু জানতে সাহস পায়নি তুহিন , যদি আম্মু কিছু সন্দেহ করে বসে । আর যদি জানতে চায় তুহিন কেন রোদেলার ব্যাপারে এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে ? তখন ও মাকে কি জবাব দেবে ।
তুহিন কিছুতেই বুঝতে পারছে না রোদেলা যদি ঠিকই থাকে , তাহলে ওর সাথে কিছু না বলেই কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো । মেয়েটার প্রতি একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল এই অল্প সময়ে , আর কিছু বলে উঠার আগেই রোদেলা এভাবে সম্পর্কটা শেষ করে দিলো ? এই ব্যাপারটা তুহিনকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল । এখন কি করা দরকার ভেবে পেলোনা না তুহিন । একবার ভাবলো রোদেলার মুখোমুখি হয়ে জিগ্যেস করবে ও এমন করলো কেন ? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো ওর নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে । কিছুটা সময় দেয়া উচিত ওকে আর নিজেকে বুঝার জন্য ও কিছুটা সময় চাই । রোদেলাকে কি সত্যিই সে ভালোবাসে ? নাকি নীলার চলে যাবার পর ওর মাঝে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ আর জন্যই কি সে রোদেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে । তুহিন দ্বিধায় পরে গেল । ঠিক করলো ব্যাপারটা সময়ের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো । সময় বলে দিবে সেটা মোহ ছিলো না ভালোবাসা ছিল । যদি ভালোবাসা হয় ও নিজে গিয়ে রোদেলাকে বলবে , রোদেলা আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
আজ দুপুরে আমার ইন্টারভিউ এর জন্য মেসেজ এসেছে চাঁদপুরের একটি বেসরকারি স্কুল থেকে । মেসেজটা পেয়ে এতো খুশি হোলাম যে আম্মু আর খালামণিকে বলার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম । ঠিক করলাম আম্মু অফিস থেকে আসলে দুজনকে একসাথে বলবো । মিষ্টিকে আমার রুমে আসতে দেখে জানতে চাইলাম ।
- মিষ্টি খালামনি কি করে ?
- খালাম্মা আইছে , বড় খালাম্মারে খালাম্মার রুমে ঢুকতে দেইখা আইলাম ।
- আম্মু এসেছে ?
- হ , খালাম্মা আইছে মনে হয় মেজাজ খারাপ ।
- তুই কি করে বুঝলি আম্মুর মেজাজ খারাপ ?
- আইয়াই বড় খালাম্মারে কইলো বুবু রুমে এসো তোমার সাথে কথা আছে । আর খালাম্মা মুখ আন্ধার কইরা রাখছে ।
- আচ্ছা হয়েছে তুই এখন তোর কাজ কর গিয়ে ।
রাজিয়াকে এই অসময়ে আসতে দেখে মিনু বেগম খুব অবাক হলেন । বোনকে জিগ্যেস করলেন,
- রাজিয়া কি হয়েছে ?
-বুবু তুমি একটু রুমে এসো আমার ভালো লাগছে না , রোদেলা কই ?
- একটু আগে খেয়ে ওর রুমে গেলো ,কেন ডাকবো ও কে ?
- না ।
রাজিয়ার রুমে ঢুকেই মিনু জানতে চাইলেন ,
-কি হয়েছে শরীর খারাপ লাগছে ?
- হুম , তুমি একটু আমার পাশে বসো ।
- তুই এমন করছিস কেন ? বাহিরের কাপড় আগে পাল্টে নিয়ে ফ্রেস হ , দেখবি ভালো লাগছে ।
- কাপড় পরে পাল্টানো যাবে , তুমি আমার কথা
শুনো ।
- আচ্ছা বল কি বলবি ?
- বুবু তোমারও কি মনে হয় আমি রোদেলার মা হয়ে উঠতে পারি নি ?
- কি হয়েছে তোর ? এতো বছর পর এই প্রশ্ন করছিস কেন ?
- যা জিগ্যেস করেছি আজ তুমি তার সত্যি উত্তর
দিবে ।
-তোকে আমি মিথ্যা বলতে যাবো কেন ?
- হ্যা আমি সব সময় ওর ব্যাপারে কঠোর ছিলাম , আমি চাইনি আমার মেয়ে , আমি জীবনে যে ভুল গুলো করেছি সে সেই গুলো করুক ।
- সেটা কোন মা ই চাইবে না তার মেয়ে ভুল করে কষ্ট করুক ।
- তুমি জানো আমি মা বাবার কথা নাশুনে রফিক কে নিজের পছন্দে বিয়ে করে ছিলাম । প্রতিটা মেয়ের ই স্বপ্ন থাকে স্বামীর সাথে সুখে , নিশ্চিনতে সংসার করার । অথচ ওকে যখন বিয়ে করি দুজনে কাছে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা এই টাকায় মধ্যে মাথা গুজার ঠাঁই আর সংসার চালানো যে কতটা কঠিন ছিল সেটা আমি জানি । এমন ও দিন গেছে আধা কেজি চাল ছাড়া ঘরে কিছু ছিলো না নুন আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে অফিস করতে হয়েছে । আজ আমি ঐ দিনের জন্য অভিযোগ করছি না , আমার কাছে তখন রফিকের ভালোবাসাই সব কিছু ছিল । কিন্তু এমন কষ্টকর দিন জেনো আমার মেয়ের দেখতে না হয় আমি সে চেষ্টা সব সময় করেছি ।
- সেটা তো আমি জানি , আজ কেন তুই পুরনো কথা নিয়ে বসেছিস ।
- আমি যখনই মেয়েটার উপর রাগ করেছি সেদিন আমার কোন কিছুই ভালো লাগতো না । নিজে নিজে কষ্ট পেতাম কিন্তু ওকে সেটা বুঝতে দেয়নি । ওকে আঘাত করে আমি নিজে কেঁদে বুক বসিয়েছি সেটা আমি জানি । ও একটু আঘাত পেলে আমার মনে হতো সেটা আমার নিজের গায়ে লেগেছে ।
- মা তো এমনই হয় ।
- আমি আমার মেয়েটাকে সব আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছি , কেউ জেনো ওকে বলতে না পারে যে ও আমাদের পালিত মেয়ে । তুমি জানো আমি ওর মেঝ ফুপুর সাথে আজ ও কথা বলি না । কারণ রোদেলার যখন তিন বছর , ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রফিক কে ওর বোন বলেছিলো , পালিত মেয়ের জন্য এত টাকাপয়সা খরচ করার কি দরকার ? শুধু শুধু পয়সা নষ্ট যেদিন জানতে পারবে দেখবি ঠিকই তোদের ছেড়ে চলে যাবে , পর কোন দিনই আপন হয়না । নিজের রক্ত নিজেরই থাকে । কথাটা শুনে আমার খুব রাগ হয়েছিলো সেদিনের পর থেকে আমি ওকে সবার কাছ থেকে আলাদা রেখেছি । কথাটা শুনে আমি যে কষ্টটা পেয়েছি আমার মেয়ে জেনো সে কষ্ট না পায় ।
- কিন্তু তুই আজ এগুলো বলছিস কেন ? সেগুলোতে অতীত হয়ে গিয়েছে রোদেলা বড় হয়েছে । আর ও তো জানে সব , ও তো তোকে ছেড়ে যায় নি । তাহলে ...
- আমি মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই , সেটা কি আমার অন্যায় বুবু ?
- অন্যায় হতে যাবে কেন ? সব বাবা মায়ের ই স্বপ্ন মেয়েকে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দেয়া ।
- এলিনা আর আকরাম ভাই যখন অফিসে রিয়ার বিয়ের দাওয়াত দিতে এলো ,তখন কথায় কথায় রোদেলার কথা উঠলো । আকরাম ভাই জানতে চাইলো ওর বিয়ের কথা কি ভাবছি । বললাম মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে তো দিতেই হবে , তোমাদের কাছে ভালো পাত্র থাকলে বলো । এলিনা নিজ থেকেই বললো যে ওর ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছে । ঘরেই যখন মেয়ে রয়েছে বাহিরে কেন আর খুঁজতে যাবো । আকরাম ভাই বললো তাহলে তো ভালো কথা বিয়েতেই সবাই যখন আসবে , ছেলে মেয়ের দেখা করুক । ওদের যদি পছন্দ হয় তাহলে না হয় কথা আগানো যাবে । আমি ও ওদের কথায় রাজি হয়ে গেলাম ।
- তো এখন কি হয়েছে ? আয়াতের কি রোদেলাকে পছন্দ করে নি ?
- আজ এলিনা ফোন দিয়েছিলো , ফোনদিয়ে বলে আমি নাকি ওর সাথে প্রতারণা করেছি । আজকাল নাকি কেউই ডিভোর্সি বাপ মার মেয়েকে ঘরের বউ করতে চায় না তার পর ও সে রাজি হয়েছিল রোদেলাকে ছেলের বউ বানাতে । কিন্তু আমি কেন ওকে বললাম না , যে রোদেলা আমার মেয়ে না । যে মেয়ের বাপ মায়ের ঠিক নেই তাকে কিছুতেই সে ছেলের বউ করবে না ।
- না করলে নেই আমাদের মেয়ে তো আর ভেসে যাচ্ছে না ।
- বুবু ওখানে থেমে গেলো ও আমার কষ্ট লাগতো না । ও কি বলেছে জানো । কথাটা বলেই রাজিয়া সুলতানা কান্না করে দিলেন ।
- যা বলার তো বলেই দিয়েছে আর কি বাকি আছে বলার । তুই কান্না করছিস কেন আর ওর কথা শুনতে গেলি কেন ?
- ও বলেছে আমি নাকি আমার মেয়েকে ওর ছেলের পিছু লাগিয়েছি । ওর ছেলে নাকি বলেছে রোদেলাকে ছাড়া ও কাউকে বিয়ে করবে না । আমার মেয়ে নাকি ওর ছেলের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে ।
- আমাদের মেয়ে ওর ছেলের কাছে বিয়েই দিবো না । ব্যাস সব চুকে গেল , তুই কেন ওদের কথা শুনে কান্না করে নিজের শরীর খারাপ করছিস । এবার তুই শান্ত হ রোদেলা তোর সন্তান ,তুই ওর মা এটাই সত্য ,আর এটাই রোদেলার একমাত্র পরিচয় ।
- তাহলে ও কেন বললো আমার মেয়ের কোন জন্ম পরিচয় নেই ? আমার মেয়ে নাকি জারজ সন্তান ।
কথা গুলো বলতে বলতেই রাজিয়া সুলতানা জ্ঞান হারালেন ।
- রোদেলা , রোদেলা এদিক আয় তোর আম্মু কেমন জেনো করছে । মিনু বেগম চিৎকার করে রোদেলাকে ডাকতে লাগলেন ।
মিষ্টি চলে যাবার পর আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আম্মুকে বলার জন্য যে আমাকে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে ডেকেছে । আম্মুর রুমের দরজার সামনে আসতেই শুনতে পেলাম আম্মু খালামনির সাথে আমাকে নিয়ে কথা বলছেন । দরজায় দাঁড়িয়ে এভাবে বড়দের কথা শোনা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু আমি কিছুতেই ওখান থেকে সরে আসতে পারছিলাম না । আম্মু আর খালামনির সব কথা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম আম্মুর জন্য খুব কষ্ট হতে লাগলো । আমি কান্না আটকে রাখতে পারছি না । আমার ভেতর জমে থাকা অনেক প্রশ্নের জবাব আজ জানতে পারলাম ।এখানে না দাঁড়ালে হয়তো ওগুলো অজানাই থেকে যেতো । আমার আয়াতের উপর খুব রাগ হতে লাগলো , আমার মনে হচ্ছিলো ছুটে গিয়ে এলিনা আন্টিকে বলি । তোমাকে কে অধিকার দিয়েছে আমার মাকে এভাবে অপমান করার । রাজিয়া সুলতানা ই আমার মা , আমার আর কোন পরিচয়ের দরকার নেই ।
খালামনির চিৎকারে আমি দরজা ঠেলে রুমে
ঢুকলাম । আম্মু খাটে কাত হয়ে শুয়ে আছে । আম্মুকে ওই অবস্থায় দেখে আমি কি করবো ভেবে পেলাম না । আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে খালামনির কাছে জানতে চাইলাম ।
- আম্মুর কি হয়েছে ? আম্মু কথা বলছে না কেন ?
- তুই তোর আম্মুর কাছে বোস । মুখে পানির ছিটা দে । আমি ডাক্তার কে ফোন দিচ্ছি ।
চলবে .........
✍️ রেহানা হক রেনু
গত পর্বের লিংক -২০
https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/859277114877786/