#আমি_রোদেলা
#পর্ব_২৩
- আমার ভালো করতে গিয়ে নিজেদের সম্পর্কটা কে কেন নষ্ট করে ফেললে । আমাকে নিয়েই যখন সমস্যা হচ্ছিল আমাকে কেন দূরে সরিয়ে দিলে না । আমি তো তখন বেশ বড়ই ছিলাম ।
- তোমাকে ছাড়া যে তোমার মা একা হয়ে যেতো । সব দোষ আমার , আমি সবার সুখ না দেখে শুধুমাত্র নিজের সুখ বেছে নিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম আমি বুঝি এবার সুখী হবো । কিন্তু .....
- কিন্তু কি আব্বু ?
- আমি তোমাদের হারিয়ে ফেলেছি , বলতে পারো আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি । এখন মনে হয় সেই এক রুমের বাসায় সুখ ছিল , সুখ ছিল ওই
দারিদ্রতায় । কারণ ওখানে একে অন্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিলো ।
- কেন ? তুমি কি এখন সুখে নেই ?
- মারে সুখ এমন একটা জিনিস যা একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না ।
- কেন আন্টি আর তোমার ছেলে নিয়ে কি তুমি সুখী নও । তুমি তো তোমার নিজের সন্তান চেয়েছিলে এবং তা পেয়েছো ও । তাহলে ?
- তোমাকে আর তোমার মাকে তো হারিয়ে ফেলেছি ।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না চুপ করে রইলাম । মিষ্টি এসে বললো ,
- আফা সব গুছাইয়া দিছি , আফনে আইয়া টিফিন বক্সে ঢুকাইয়া লন ।
মিষ্টির পিছুপিছু রান্না ঘরে গিয়ে খাবারগুলো বক্সে ঢুকিয়ে নিলাম ।
- মিষ্টি তুই খেয়ে নিয়ে অন্তুদের বাসায় চলে যাস । আর শোন যাবার সময় দরজা ঠিক মত লক হয়েছে কি না ভালো করে দেখি নিস ।
- ঠিক আছে আফা ।
- আমি তোকে গিয়ে ফোন দেব । আর শোন ওখান থেকে আবার কোথাও যাসনা । মনে থাকবে তো ।
- জী ,আফা ।
সব গুছিয়ে আমি আব্বুর সাথে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে । গাড়িতে উঠে বসতেই আব্বু জানতে চাইলেন ,
- তোমার কি জেনো প্রশ্ন ছিলো ? জিগ্যেস করলে না তো ?
- আজ না , অন্য কোন দিন জিগ্যেস করবো ।
- ঠিক আছে । তোমার মায়ের সাথে যাই হয়েছে তাতে তোমার কোন দোষ ছিলো না । ওটা আমাদের নিজেদের বোঝাপড়ার অভাবেই হয়েছে । তুমি কিন্তু তখন ও আমার মেয়ে ছিলে এখনো আমার মেয়েই আছো । এই কথাটা সব সময় মনে রাখবে ।
আমি কিছু বললাম না , গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম । হাসপাতালে পৌছেনর পর শুনি আম্মুকে কেবিনে সিফট করা হয়েছে । আমার মেঝ মামা ঢাকা থেকে এসেছেন আর বড় মামা রাতে এসে পৌঁছাবেন । কেবিনে ঢুকে জিনিস পত্র খালামনি কে বুঝিয়ে দিলাম । আব্বু কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলেন । আমি আব্বুকে ভেতরে আসতে বলতেই বললেন ।
- আমি এখানেই থাকি , তোমার আম্মু হয়তো আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে যেতে পারেন । ডাক্তার ওকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে ।
আমি ভেতরে ঢুকে আম্মুর পাশে বসলাম ।
- কিরে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি ?
- হুম । এখন কেমন লাগছে ?
- ভালো , খেয়েছিস কিছু ?
- হুম , আব্বু এসেছে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে ।
- ভেতরে আসতে বল ।
আমি উঠে গিয়ে আব্বুকে ডেকে দিলাম । আব্বু ভেতরে ঢুকতেই আমি আর খালামনি বেরিয়ে এলাম রুম থেকে । বাহিরে করিডোরে দুজন বসলাম ।
- তোর বাবা তোর সাথে বাসায় গিয়েছিলো ?
- হুম ।
- তুই কি তোর বাবার সাথেই এসেছিস ?
- হ্যা , কেন জানতে চাইছো ?
- না , এমনি । তোর বড় মামা এসে তোর মাকে নিয়ে যাবে ।
- জানি ।
- তুই কিভাবে জানিস ?
- মামা না এলেও আম্মু এমনিতে ও যেতো । আম্মুর ভিসা হয়ে গেছে ।
- কই তুই তো আমাকে আগে বলিস নি ।
- কেন তুমি জানতে না । আম্মু আমার বিয়ের জন্য কেন তাড়াহুড়ো করছিলেন তুমি জানো না ?
- রাজিয়া তো আমাকে এমন কিছুই বলে নি ।
- আম্মুর ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়ে হয়ে গেলে উনি নিশ্চিন্তে বাকি সময়টা নানুমনির কাছে কাটিয়ে
দিবেন ।
- হটাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন নিলো রাজিয়া ।
- না নিয়ে কি করবে , একে তো নানুমনি অসুস্থ । আর আমার বিয়ে হয়ে গেলে তো আর আমি আম্মুর সাথে থাকবো না । আম্মু তখন একা হয়ে যাবেন ।
- কিন্তু .....
- কিন্তুর কিছু নেই । বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে । আমি তো আর ছোট নই । একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলে আমার দিব্বি চলে যাবে ।
- তুই তোর মায়ের সাথে যাবি না ।
- না ।
- তোর মা তোকে ছাড়া যাবে ।
- বিয়ে হলে তো রেখে যেতো তাই না ।
- তখন ব্যাপারটা অন্য ছিলো ।
- বাদ দাও , ডাক্তার কি বললো ?
- অনেক গুলো টেস্ট দিয়েছেন । তোর মামা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে । এলে জানা যাবে ।
মামা এসে জানালেন আপাতত সব ঠিক আছে । বাকি টেস্ট গুলোর রিপোর্ট আসলে জানা যাবে কি হয়েছে ।
মামা আমাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন ।
- কি হয়েছিলো রে বুবুর ।
- আমি ঠিক জানি না , খালামনি বলতে পারবে । আমি যখন রুমে গিয়েছি তখন আম্মুর জ্ঞান ছিলো না ।
- কোন কিছু নিয়ে কি দুশ্চিন্তা করছিলো ? দুলাভাইয়ের ব্যাপারে কিছু না তো ?
- আমার মনে হয় না । ডিভোর্সের পর তো আব্বুর সাথে আজই আম্মুর প্রথম দেখা হলো ।
- দুলাভাই এসেছিলো ?
- হ্যা , গতকাল সন্ধ্যা থেকেই তো এখানে আছেন ।
- তোর বাবা মানুষটাকে আমি এখনো বুঝতে পারলাম না । এই লোক তোর মাকে এতো ভালোবাসে তারপরও কেমনে সে এই কাজ করলো বুঝি না ।
আমি কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম ।
- তুই কি জানিস দাদা এসে বুবুকে নিয়ে যাবে ?
- হুম ।
- আমার একটা কাজ আছে আমি একটু যাবো সন্ধ্যায় চলে আসব । আর তোর মার জন্য চিন্তা করার কিছু নাই সব ঠিক হয়ে যাবে ।
আমি আর মামা দুজন কেবিনের বাহিরে বসে কথা বলছিলাম । মামা গেলেন আম্মু কে বলে আসতে । আমি বাহিরে বসে রইলাম । ভাবতে লাগলাম আম্মু চলে যাবার পর কি হবে ? আমার চাকরিতে ইন্টারভিউর আর মাত্র তিনদিন বাকি আছে । আম্মুকে এখন ও বলা হয়নি , ইশ যদি চাকরিটা হয়ে যেতো তাহলে খুব ভালো হতো । কিন্তু আম্মু কি আমাকে এত দূরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে দিবে ? তাও আবার গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলে জন্য । আমি আম্মুকে কি ভাবে বলবো ভাবতে লাগলাম ।
বিকেলে অনেক আত্মীয় স্বজন , আম্মুর অফিসের লোকজন এলেন আম্মুকে দেখতে । তাদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি না । মজার ব্যাপার হলো তারাদের প্রায় সকলেই আমাকে চেনেন । সবার মুখে একই কথা মেয়েতো বড় হয়ে গেছে । ওর বিয়ে কবে খাওয়াবে । আমার মনে হলো ওরা আম্মুকে দেখতে না আমার বিয়ে নিয়েই আলোচনা করতে এসেছে ।
সন্ধ্যার পর আমি মাগরিবের নামাজ মাত্র শেষ করে উঠেছি ঠিক ওই সময় এলো , সাফিন ভাইয়া আর আয়াত । আয়াত কে দেখে তো আমার রাগে গা জ্বলে যেতে লাগলো । এসেই জিগ্যেস করলো ।
- আন্টি কেমন আছেন , শরীরে এখন কি অবস্থা ?
কথাটা শুনে আমার কি হলো জানি না । আমি আয়াতের হাত ধরে বললাম ,
- আমার সাথে আসুন ,আমার কথা আছে আপনার সাথে ।
খালামনি পেছন থেকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন , তার আগেই আমি আয়াত কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম । সন্ধ্যার সময় হাসপাতালের রোগীর আত্মীয় স্বজনের বসার জায়গাটিতে মানুষজন কম থাকে । আমি আয়াতকে ওখানে নিয়ে গেলাম । রাগের সাথেই জানতে চাইলাম ।
- আপনি এখানে কেন এসেছেন ?
- আন্টিকে দেখতে ।
- আপনার কি লজ্জা বোধ বলতে কিছু নেই ?
- কেন বলতো ?
- এতো কিছুর পর কোন মুখে এখানে এলেন ?
- যা হয়েছে তার জন্য আমি সত্যি লজ্জিত ।
- লজ্জিত খুব সহজেই বলে ফেললেন , আমার আম্মুর যদি কিছু হতো আমি কি করতাম আমি নিজে ও জানি না ।
- তুমি শুধু শুধু আমার উপর রাগ করছো ।
- শুধু শুধু ! আমি কি একবারও বলেছি আমি আপনাকে পছন্দ করি ?
- বলো নি , কিন্তু আমার সাথে বিয়েতে তো তোমার অমত ছিলো না ।
- আপনাকে সেটা কে বললো ?
- তাহলে তুমি তোমার মায়ের সাথে বিয়েতে এসেছিল কেন ?
- কেন ? আমি কি আমার কাজিনের বিয়েতে যেতে পারি না ।
- সেখানে আমাদের বিয়ের উদ্দেশ্যে ই দেখা হওয়ার কথা ছিলো ।
- সেটা পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে আগে বিয়েতে যাওয়ার কথা ছিলো ।
- আমার অপরাধ টা কি বলতে পার ?
- আপনি আপনার আম্মুকে কি বলেছে ?
- যা সত্য তাই বলেছি , আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না ।
- আপনি আমার পরিচয় জানেন ?
- আমার জানার দরকার নেই ।
- কেন দরকার নেই ? সেটার জন্যই তো আপনার আম্মা আম্মুকে যা ইচ্ছে তাই বলেছে ।
- সেটা উনাদের দুই বোনের ব্যাপার ।
- আপনার কাছে ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হচ্ছে ? আমার আম্মু মরতে বসেছিলেন বুঝতে পারছেন আপনি ?
- বললাম তো আমি সরি ।
- শুনুন আজকের পর থেকে আমাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ করবেন না ।
- আমার দ্বারা সম্ভব নয় ।
- মানে কি ? আপনার দ্বারা সম্ভব নয় ।
- আমি সত্যি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি ।
- এত কিছুর পরও আপনি বলছেন , আপনি আমাকে ভালোবাসেন ।
- হ্যা , বলছি ।
- আমাকে ভালোবাসার অধিকার আপনার নাই । আপনার মায়ের ভাষায় আমি হলাম গিয়ে জারজ সন্তান । যাদের সমাজে কোন জায়গা নেই ।
- আমি তো তোমাকে সেটা ভাবি না , তুমি রাজিয়া আন্টির মেয়ে, তুমি রোদেলা সেটাই তোমার পরিচয় ।
- দয়া দেখাচ্ছেন ?
- না , দয়া দেখতে যাবো কেন ? আমি তোমাকে ভালোবাসি , আর ভালোবাসায় দয়া হয়না ।
- কিন্তু আমি তো আপনাকে ঘৃণা করি , আপনাকে দেখলেই মনে হচ্ছে আপনার জন্য আমি একটু হলে আম্মুকে হারাতে বসেছিলাম ।
- ব্যাপারটা এতো দূর যাবে আমি ভাবি নি । আমার আম্মুর একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার বিয়ে নিয়ে তার স্বপ্ন অনেক । উনি আমার জন্য সবেচেয়ে ভালো মেয়ে খুঁজতে চেয়েছেন ।
- ভালো কথা ,আমাকে তার পছন্দ হয়নি বলে দিলেই পারতেন । আমার আম্মুকে অপমান করার তো দরকার ছিলো না ।
- এক্ষেত্রে দোষ কিছুটা আমার ছিলো , আমি আম্মুর নিষেধ মানি নি । কারণ প্রথম দেখায় আমি তোমার প্রেমে পরে গিয়েছি । আমি সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাই ।
- আগে হলে অন্য কথা ছিলো এখন তো অসম্ভব ।
- কেন ? আমি যদি আন্টিকে রাজি করাই ।
- আমি কখনো আমার আম্মুর অবাধ্য হয়নি । কিন্তু আপনার ব্যাপারে এবার হবো । কারণ আপনাকে দেখলেই আমার দুটো কথা মাথায় আসবে এক আপনার জন্য আমার আম্মু মরতে বসেছিলেন আর দুই আমি জারজ সন্তান ।
- রোদেলা তুমি আমার আম্মুর সাজা আমাকে দিতে পারো না ।
- আমার কিছুই করার নেই । দয়া করে আর কোন দিন আপনি আমার সামনে আসবেন না । আমি আপনাকে দেখতে চাই না ।
- রোদেলা ।
- প্লিজ ,আমি হাত জোর করছি আপনার কাছে ।
আয়াত আর কিছু না বলেই চলে গেলো , আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না । আমি কোন রকম হেঁটে গিয়ে একটি চেয়ারে বসে পরলাম । আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে , গলা শুকিয়ে আসছে পানি খেতে পারলে ভালো হতো । আমি সামনের চেয়ারে হাত রেখে হাতের উপর মাথা রাখলাম । আমার উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না । কেউ একজন আমার পাশে বসে পানির বোতল আগেই দিলেন । আমি বোতলটির ঢাকনা খুলে এক ঢোকে অনেক খানি পানি খেয়ে নিলাম ।
চলবে ........
✍️রেহানা হক রেনু
গত পর্বের লিংক -২২
https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/861082861363878/