#আলো_আধাঁর
লেখা- তোহা কবির
২.
একটু আগে ওর ননদরা ও বাড়ির অন্য মেয়েরা হিয়াকে বাসর ঘরে রেখে গেছে। বলে গেছে ফ্রেস হয়ে নিতে।রাজিবের আসতে অনেক দেরি হবে ও মুরুব্বিদের সাথে কথা বলছে। হিয়া দরজা লাগিয়ে রুমের মাঝে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রুমটাকে পর্যবেক্ষণ করল। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো রুম। রুমের প্রতিটা জিনিসে হালকা বৈদেশিক ভাব লক্ষ করা যায়। রুম এবং বারান্দার মাঝের দেয়ালটা কাচেঁর। নীল পর্দা ঝুলছে তাতে। পর্দা সরিয়ে ভিতর থেকেই বারান্দাটা দেখে নিল হিয়া। বারান্দাটা আরও সুন্দর। খুব বড় এবং অনেক রকম ফুলগাছে ভর্তি। একসাইডে বড় একটা দোলনা। অন্য সাইডে একটা গোল টেবিল ও একজোড়া বেতের চেয়ার। হিয়ার মনে হচ্ছে মানুষটা বেশ সৌখিন। তাছাড়া ও শুনেছে রাজিব এস এস সি দিয়েই বিদেশে পড়াশোনা করতে চলে গেছিল। ফিরেছে এম বি এ শেষ করে একবছর হলো। তাই রুমের সবখানে বিদেশি ছোয়া। বারান্দার দরজা খুলে একবার ভাবলো গিয়ে ভালো করে দেখে আসে পরে কি ভেবে আর ওদিকে না গিয়ে নিজের জিনিসপত্র খোজায় মনোযোগ দিল ও। রুমের এককোণায় ওর লাগেজগুলো রেখে গেছে এ বাড়ির কাজের ছেলেটা। বড় লাগেজটা খুলে সুতির একটা লাল শাড়ি বের করে নিল হিয়া। টয়লেট্রিজের ব্যাগটা নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকল সে। অনেক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল ও। এখন ক্লান্তি ভাবটা অনেকটা কমেছে ওর। আয়নায় নিজেকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল ও। চোখে মোটা করে কাজল দিল হিয়া। হিয়ার চোখটা এমনিতেই অনেক সুন্দর। মোটা করে কাজল দিলে আরো সুন্দর লাগে। ঠোটেঁ গাঢ় করে লাল লিপস্টিক দিল। চুলটা হাত খোপা করে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে বিছানার মাঝে বসে পরল হিয়া। এতেই হিয়াকে অপরুপ লাগছে। মেক আপের প্রয়োজন নেই ওর। ফর্সা মুখে ঠোঁটের নিচের তিলটা এখন বোঝা যাচ্ছে। একটু আগের ভারি মেক আপে এই তিলটা হারিয়ে গেছিলো যদিও এটিই ওর রুপ বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ। বসে বসে অপেক্ষা করছিল ও রাজিবের জন্য কিছুটা নার্ভাসনেস ভালোলাগা ভয় এসব সহ একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ওর ভিতর। এসবের মাঝে হঠাৎ ওর দিয়ার মুখটা মনে পরে গেল। মুখে হাসি রেখে বিদায় দিলেও চোখদুটি ছলছল করছিল ওর। হিয়ারও কান্না পাচ্ছে। না জানি এখন দিয়া কি করছে? হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে সচকিত হলো হিয়া। আজ থেকে ওর নতুন জীবনের শুরু। মানুষটা কেমন হবে? ওর মনের মতো কি? নাকি.....
বেশি কিছু ভাবতে পারলো না হিয়া সম্পর্কের শুরুর মূহুর্তটা দুশ্চিন্তা দিয়ে শুরু করতে চায়না ও। ঘোমটাটা ঠিকঠাক করে আরষ্ট হয়ে বসে রইল হিয়া। ঘোমটার ফাক দিয়ে খুব সাবধানে রাজিবকে লক্ষ করছে ও। দরজা দিয়ে ঢুকে রাজিব ওর দিকে না এসে আলমারির কাছে গেল। আলমারি খুলে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়ল। হিয়া ওভাবেই বসে রইল। প্রায় আধঘন্টা পর বেরিয়ে এল রাজিব। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল হিয়া। রাজিব এবার ওর পাশে এসে হাত দিয়ে ফুল সরিয়ে শুয়ে পরল। ওকে দেখে বলল,
এখনো এভাবে বসে আছেন কেন? টায়ার্ড লাগছে না শুয়ে পরুন। আমার তো খুব ঘুম পাচ্ছে আমি তো ঘুমাচ্ছি।
বলেই আর একমুহুর্ত দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পরল ও। কিছু সময় পর ধীরেধীরে নিজের ঘোমটা সরালো হিয়া। অপলক দৃষ্টিতে রাজিবের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষন। মনের ভিতর থেকে কেউ জানান দিল এই ঘুমন্ত রাজপুত্রটা আজ থেকে ওর। শুধুই ওর। কিন্তু আসলে কি তাই? এক অজানা আশংকা এসে আবারও ঘিরে ধরল ওকে। কিন্তু রাজিবের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত দুশ্চিন্তা আবারও দুর হয়ে গেল ওর। ফর্সা লম্বাটে মুখ,জোড় ভ্রু,বা চোখের পাশে ছোট্ট একটা তিল,চাপ দাঁড়ি সব মিলিয়ে অসাধারণ সুন্দর রাজিব। তবে বাইরের সৌন্দর্যের সাথে কি ভেতর টাও সুন্দর তার। ভাবতে ভাবতেই একবার রুমের রেডিয়াম ঘড়ির দিকে তাকালো হিয়া। ২:১০ মিনিটের জানান দিচ্ছে ওটা। ঘড়ির উপর থেকে চোখ সরিয়ে রাজিবের মুখের দিকে তাকিয়ে ওভাবেই কখন যে ঘুমিয়ে পরল তা টেরই পেলনা হিয়া।
ভাইকে বাসরে ঢুকিয়ে কিছুক্ষন আত্মীয় বন্ধুদের সাথে গল্প করে নিজের রুমে ঢুকল রিয়াদ। সব মিলিয়ে ভিষন ক্লান্ত ও। কোনোরকমে ড্রেস চেন্জ করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই তন্দ্রা এসে ঘিরে ধরল ওকে। বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছাদের সেই পরিটার মুখ। সাথে সাথে সমস্ত ঘুম কর্পূরের মতো উবে গেল। থেকে থেকে ছাদের সমস্ত কিছু ওর কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে থাকলো। ওর প্রচন্ড কৌতুহল হচ্ছে পরিটার সম্পর্কে জানার জন্য। কাল তো আসবেই সে আর ও ওতো যাবে ওর ভাইয়ের সাথে ঐ বাড়িতে। কি করে পরিটার সাথে কথা বলবে এখন সেটাই চিন্তা করছে। পরিটা কি আদৌ ওর সাথে কথা বলবে। ছাদ থেকে নামার পর ও তো কারো সাথে কথা বলেনি। সারাক্ষণ ওর ভাবীর আচলের একটা কোণা ধরে ঘুরছিল মেয়েটা। ওদের আসার সময় আস্তে করে আচল টা ছেড়ে দিয়েছিল ও। ওর ভাবী গিয়ে যখন মেয়েটার কপালে আলতো করে তার ঠোঁট ছুয়িয়েছিল তখন চোখ দুটি ছলছল করে উঠেছিল কেবল এছাড়া একফোটাঁ পানিও চোখ থেকে পরেনি ওর না বলেছে একটাও কথা। মেয়েটা এখন কি করছে? মেয়েটা কি জানে তার কথা ভেবে পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিচ্ছে কেউ? আর রিয়াদ ইবা এত কেন ভাবছে ওর কথা? একবার মাত্র দেখেছে ওকে কথাও হয়নি। তাছাড়া যেভাবে দেখেছে সেভাবে দেখলে যে কারোরই মেয়েটাকে নিয়ে খারাপ ধারণা জন্মাবে। তাহলে ওর কেন এমন ধারণা হচ্ছেনা? কেন মনে হচ্ছে মেয়েটার কথা এত? হয়তো ওর প্রফেশনের কারণে। কিন্তু না তাও না। আগে কখনোই কাউকে দেখে এমন অনুভূতি হয়নি ওর। তবে কি এটাই লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট? শুয়ে শুয়ে এমন নানা কথাই ভাবছিল রিয়াদ। ও কি জানে যার কথা ভেবে ও রাত পার করে দিয়েছে ওর সেই পরি এখন কি করছে? চারিদিকে সিগারেটের ধোয়া দিয়ে এক রহস্যময় ইন্দ্রজালের রচনা করে চলেছে ওর পরি। আর এভাবেই রাতটা শেষ করবে ও।
ঘুম থেকে উঠেই নিজের পাশে ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে চোখ গেল রাজিবের। কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও। লাল সুতির শাড়ি , চোখের কাজল একটু লেপ্টে গেছে, ঠোঁটের লিপস্টিকটা বালিশের ছোয়াঁয় লেপ্টে প্রায় মুছে গেছে আর লম্বা একরাশ কালো চুল বুকের ওপর ছড়িয়ে আছে। সবকিছুই যেন মেয়েটার সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।আর ঠোটেঁর নিচের তিলটা যেনো ওকে টানছে। এত মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল রাজিবের। ও কি করে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিবে? কি দোষ মেয়েটার? এই ঘুমন্ত দুটি চোখে হাজারো সপ্ন নিয়ে মেয়েটা ওর কাছে এসেছে। কি করে নিজের হাতে সেই সপ্ন গুলো ভাঙবে ও। নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছা হচ্ছে ওর। বিয়ের আগে একবার যদি দেখে নিত ওকে। উফ্ কি ভুলটাই না করে ফেলেছে ও। অবশ্য দেখে নিলেই কি বিয়েটা ভাঙা যেতো? কিন্তু এই ভুলের প্রায়াশ্চিত্ত করতে যদি ওকে এই মেয়েটার সাথে সারাজীবন কাটাতে হয়, ওকে দুনিয়ার সমস্ত সুখ এনে দিতে হয় তাহলে তা......
ফোনের রিংটনে চিন্তাটা সম্পূর্ণ করতে পারলনা রাজিব। স্ক্রিনে চিরচেনা একটা নাম দেখে দ্রুত ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল ও। ততক্ষনে হিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ মেলে নিজের বর্তমান অবস্থা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল ওর। অচেনা একটা রুম দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিল হিয়া। তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে তাকালো কিন্তু রাজিবকে দেখতে না পেয়ে একটু লজ্জা পেল। ইস মানুষটা ওর আগেই উঠে পরেছে। বিছানা হাতড়ে নিজের ফোন খোজার চেষ্টা করল। হঠাৎ মনে পরল সেটা ওর হ্যান্ড ব্যাগে রয়েছে। তাই রুমের রেডিয়াম ঘড়ির দিকে তাকালো ও। ৮-৪৫ মিনিট। বেশ বেলা হয়ে গেছে। পাশের ড্রেসারের আয়নায় চোখ পরতেই লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল ও। কি অবস্থা ওর আর এভাবেই মানুষটা দেখেছে ওকে ইস্। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি বের করে বাথরুমে ঢুকে পরল ও। যাবার আগে একবার বারান্দার দিকে তাকালো ও। কাচেঁর দরজা লাগানো। কারো সাথে কথা বলছে রাজিব কিন্তু কাচেঁর দেওয়াল ভেদ করে রুমে সে শব্দ আসছে না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কারো কাছে অনুনয় করছে। কিন্তু কার কাছে। হয়তো কোনো বন্ধু। নিজের মনের আশংকা গুলো নিজের মনেই চেপে বাথরুমে ঢুকে পরল হিয়া।
চলবে........
আগের পর্বের লিংক---
https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/851699378968893/