আব্বার সাথে একদিন"

2 17
Avatar for Nipa1234
3 years ago

তখন সবে হাইস্কুলে উঠেছি। আব্বা চাকরীর সুবাদে ঢাকায় থাকেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘর সবসময়ই সরগরম থাকে। সপ্তাহে ছয় দিন রিক্সা করে অতদূর স্কুলে যাওয়া আসা করে করে শুক্রবারে আলস্য পেয়ে বসতো। বিছানাটাকেই মনে হতো প্রিয়তম বন্ধু। আর জ্যামিতি, গ্রামার, সমাস নির্নয় এরা সব যেনো একেকটা জাত শত্রু।

তবে যে সপ্তাহন্তে আব্বা বাড়ি থাকতেন। সে শুক্রবারে যেনো ঈদের চাঁদ দেখতাম। তেমনি এক শুক্রবার এসেছিলো আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে।

আব্বা বৃ্হস্পতিবার রাতে বাড়ি আসতেন। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। রাত প্রায় একটা দুটোয় ফটকে এসে ঠক ঠক করে ধাক্কানো শুরু করেছেন। এসেই আমাদের জাগিয়ে ঘুমচোখে বিছানায় বসিয়ে, কাগজের ঠোঙা থেকে আনার, কমলা কিংবা আঙুর দিয়ে বললেন, "যত খাবি ফল, তত পাবি বল, বুঝলি আলো?"

আমরা চার ভাই বোন মিলে শরীরের বল বাড়ানোর চেয়েও চোখের বল দিগুণ বাড়িয়ে আব্বার কান্ড কারখানা দেখছি। এরপর আব্বা জাদুর ব্যাগ থেকে একের পর এক বের করলেন, ছোট বোনের জন্যে আনা রঙিন ফ্রক, ভাইদের জন্য খেলনা গাড়ি, উড়োজাহাজ আর আমার জন্য সুন্দর মলাটের লেখার ডায়েরী এবং সুগন্ধি কালির দামী কলম।

মাঝ রাতে আমাদের হইচইয়ে আম্মা বিরক্ত হয়ে আব্বাকে বললেন, " কেন এত টাকা খরচ করো বলোতো? দু'দিন পরই সব নষ্ট করে ফেলবে"।

আব্বা হেসে বললেন, " ওরা তো আমাদের মতো ছেলেবেলা পায়নি। বৌছি ডাংগুলি খেলার সুযোগ পায়নি। যতটুকুন পেয়েছে তাও কিভাবে কেড়ে নেই বলো?"

আমি এক ফাঁকে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। নতুন ডায়েরীর প্রথম পাতায় কালো অক্ষরে লিখলাম, " আজ বৃ্হস্পতিবার, রাত একটা বেজে তেইশ মিনিট। আব্বা বাড়ি এসেছেন"।

পরের দিন অনেক বেলা করে ঘুম ভেঙেছে । স্কুল ছুটি বলে আম্মাও আজ আর ঘুম ভাঙাতে আসেনি। গড়িমসি করে উঠে দেখি ঘড়িতে আটটা বাজে। সকাল আটটা মানে তো অনেক বেলা। মুখ ধুঁয়ে রান্নাঘরে আম্মার পাশে গিয়ে বসলাম, আম্মা খুন্তি দিয়ে প্লেটে গরম ফুলকো রুটি দিয়ে বললেন, " বাটিতে আলু ভাজি আছে, নিয়ে নে।"

বুঝে নিলাম আম্মার ব্যাস্ততা আজ বহুগুণে বেশি। তার ওপর ভোর থেকেই কার্তিকের শীত নামানো বৃষ্টি। তাই দেখে আব্বা বললেন ঝরঝরে সাদা পোলাও খাবেন। সাথে নারকেল দিয়ে ডিমের কোর্মা।

রুটি বেলে শেষ করে ততক্ষনে রেশমা আপা পেঁয়াজ আলু কাঁটতে বসে গিয়েছেন। আমি নিজে ফটাফট খেয়ে ছোট ভাইয়ের মুখে রুটি ছিড়ে দিতে দিতেই শুনলাম। আব্বা ভাইয়াকে নারকেল ছিলতে বলছেন।

এই অনাত্মীয় ভাইয়ার বাড়ি বরিশাল। জন্ম থেকেই উনাকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি। গরুর গোয়ালের কাজ করেন, খড় কাটেন, পানিতে গরুর খৈল ভুষি ভেজান আর বিড়িতে টান দিতে দিতে বলেন,

" কেমুন আছো মনু? ভালা?"

অথচ ভিন্ন জেলায় স্বজনবিহীন উনি সত্যিই ভালো আছেন কিনা। কখনো জানতে চাইনি।

ভাইয়া নারকেল ছিলে কুরিয়ে দিলে, রেশমা আপা বসে গেলেন শীল নোড়া নিয়ে। মসৃন করে নারকেল বেটে নিয়ে যখন উনি বাটিতে রাখলেন। মনে হলো আম্মার মুখে দেয়ার লাল কৌটোর ভ্যানিশিং ক্রীম। সাদা থকথকে কিন্তু কী মোলায়েম।

নাস্তা শেষে আমরা ভাই বোনেরা ছুটলাম মোরগ ধরতে। আব্বা ঝাল ঝাল করে আলু দিয়ে মোরগের গোস্ত বড় ভালোবাসেন। কিন্তু রেশমা আপা তো খোপ থেকে সকাল সকাল সব মুরগী উঠোনে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন এই বৃষ্টির মাঝে সে দুরন্ত মোরগ খুঁজে আনা কি চাট্টিখানি কথা।

বৃষ্টিটা ধরে এলে রেশমা আপা উঠোনে নামলেন। আর আমরা ভাই বোনেরা সব উনার পিছু পিছু। বৃষ্টিতে ভিজে ঘরের পেছন দিকে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো মোরগ বেচারা। রেশমা আপা বাঁশের ঝাফোইন ফেলে সহজেই সেটাকে পাঁকড়াও করে ফেললেন । এ যাত্রায় আব্বার ভাগ্য সু প্রসন্ন।

ছোট মামা এগিয়ে এসে পশ্চিমমুখি হয়ে মোরগ জবেহ দিতে দিতে বললেন "আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর" আমরা কৌতুহলী হয়ে চোখ বড় বড় করে সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে দেখছি।

মামা চোখ কটমট করে ধমকে বললেন, " আজকে কি ঈদ? নাকি এখানে সিনেমা হয়, যা সব কয়টা পড়তে বোস।"

গাল ফুলিয়ে টেবিলে এসে বই খুলে, শব্দ করে পড়তে আরম্ভ করেছি,

" বাংলাদেশের প্রধানত তিন প্রকারের ধান পাওয়া যায়। আউশ, আমন এবং বোরো"

আমার ঘরের পাশেই রান্নাঘর হওয়াতে, ভুর ভুর করে পোলাও চালের ঘ্রান নাকে এসে ধাক্কা দিলো। কেরোসিনের স্টোভ কিংবা ইলেক্ট্রিক হীটার ছেড়ে এখন কাস্ট আয়রনের দুই মুখের গ্যাসের চুলা বসেছে রান্নাঘরে। সেই নীল উজ্বল রঙের আগুনে ভরপুর তাপ। সেই তাপে বাতাসে সুবাস যেনো দ্রুতগামী হয়েছে আরো।

আমি ছোট মামাকে জিজ্ঞেস করলাম। মামা, " পোলাওয়ের চাল কোন জাতের ধান?"

মামা অনেক্ষন সময় নিয়ে ভেবে বললেন, "সম্ভবত আতপ চাল"

কিন্তু সেকথা তো বইতে লেখা নেই। তাহলে কি মামা সঠিক উত্তর জানে না? নাকি বইয়ের লেখায় ভুল?

একমনে উত্তর হাতড়ে ফিরছি। এর মাঝেই আজান হলো পাড়ার মসজিদে। রেশমা আপা এসে হাঁক দিয়ে গেলেন। "আলো, গোসলে যাও,দেরি হইলে আম্মা রাগাইবো কিন্তু"

গোসলে গিয়ে দেখি ছোটভাই সারা গায়ে সাবান মেখে ফেনা দিয়ে দাঁড়ি গোঁফ বানিয়েছে। আম্মা তাই কয়েক ঘা মেরেছে ওকে। চিৎকার করে কেঁদেকেটে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। আর বড়জন আব্বার পেছন পেছন পাঞ্জাবী টুপি পরে মসজিদের দিকে হাঁটা দিয়েছে। আজ তো জুম্মাবার।

গোসল সেরে আমি ছোটবোনের চুল আঁচড়ে দিলাম। রেশমা আপার ততক্ষনে ঘর ঝাড়পোছ করা শেষ। আম্মা গোসল সেরে টেবিলে খাবার সাজানোয় ব্যাস্ত। আব্বাও ফিরেছেন জুম্মার নামাজ পড়ে। আব্বার পাঞ্জাবীর আতরের ঘ্রান পোলায়ের সাথে যেনো মিশে একাকার।

আম্মা সবার পাত বাড়েন। আঁচলের নিচে ঢাকা আম্মার ভেজা চুল কপালে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় বার বার। আমি অদ্ভুত মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ দরজায় অচেনা গলা পেয়ে রেশমা আপা ছুটে যান, কে যেন বলে উঠেন, " আম্মাগো কয়ডা চাইল দিবেন"।

বয়োবৃদ্ধ একজন জীর্ন শরীরে দুটো চাল ভিক্ষে চাইতে এসেছেন। আম্মা চোখ ইশারায় রেশমা আপাকে রান্নাঘরে পাঠান। সবাই তখন টকটকে লাল মরিচ বাটায় রান্না করা মোরগের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে গোগ্রাসে গিলছি। ছোট দুইভাই প্রতিবারের মতই ঝগড়া বাঁধিয়ে, দিয়েছে কার প্লেটের ডিম আকারে বেশি বড় সেই নিয়ে।

আম্মা বড় একটা থালা এনে তাতে সব কিছু সুন্দর করে বেড়ে দিলেন। আব্বা বাটি থেকে চামচে করে উঠিয়ে দিলেন মোরগের আস্ত একটা রান। আম্মা বলে উঠলেন, "তুমি খাও, আরেকটা দিতেছি"

আব্বা বলতেন, "ওইটা তুমি খাবে"। আম্মা কিছু বলতেন না। মৃদু হাসতেন।

আমি খাওয়া শেষ করে হাত ধুঁয়ে এসে দেখতাম, সে অচেনা লোক খাবার শেষ করে এঁটো প্লেট ধুঁয়ে সে পানি সুড়ুৎ করে টেনে টেনে খাচ্ছেন। আমার কৌতুহল উনি বুঝে গিয়ে বললেন, "এটুক হইলো গিয়া বরকত "।

তারপর উনি দুহাত জড়ো করে মোনাজাতে ধরে বলেন,

" শোকর আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ মেহেরবান "

দেখলাম রেশমা আপার দুচোখ ভর্তি জল। আমি আপার আঁচল টেনে বললাম, "এ্যাই আপা, কাঁদো কেনো?"

আপা বললেন, " উনারে দেখে আমার আব্বার কথা মনে পড়ছে, আব্বাও এইভাবে খাওয়া শেষে বলতো, শোকর আলহামদুলিল্লাহ "।

আমি জানি রেশমা আপার আব্বা বেঁচে নেই। গতবছর মারা গিয়েছেন।

আচমকা কি মনে করে, ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে আব্বার পাশে দাড়ালাম। আব্বা শেষ পাতে পায়েশ আঙুলের ডগায় নিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছেন।

আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে, "আব্বা আর দু'টো দিন থাকুন। আমাদের ছুটির দিনের আনন্দটুকু থাকুক"।

কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারিনা। আব্বা আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, " কি হইছে রে আলো"।

আমি উত্তরে শুধু দুদিকে মাথা নেড়ে বলি, "কিছুনা আব্বা"।

রেশমা আপা বলতো, " বড় মানুষের কষ্টও বড় হয়। মন পুড়ে ছাই হলেও চোখে জল গড়ায় না।"

তবে কি আমিও আর সবার মতো বড় হয়ে যাচ্ছি?

বড় হওয়া মানে কি,

চোখে জল নেই অথচ বুক জুড়ে পুরো হিমালয় দাঁড়িয়ে।

"আব্বার সাথে একদিন"

লেখা : Noor Helen

২৩/১০/২০২০

2
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments

So lucky girl you are

$ 0.00
3 years ago

Khub valo akta oviggota. Sokolar amn sujog hoi na tr babr satha amn somoi katanor

$ 0.00
3 years ago