করোনাকালে বাস্তব জীবন

1 11
Avatar for MonzurAhmed
3 years ago

বাড়ির উপার্জনকারী নিঃসঙ্গ শেরপাদের বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে।

গত কয়েক মাসে আমি বেশ কয়েকজন পরিচিতের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।

সবার তিনটি জায়গায় মিল:

১. এরা সবাই বয়সে আমার ছোটো কিংবা পিঠাপিঠি, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স।

২. সবাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।

৩. সবাই অকস্মাৎ মারা গেছে হৃদরোগে, কিন্তু এরা কেউ হৃদরোগী ছিলেন না। এদের করোনা রিপোর্টও ছিল নেগেটিভ।

প্রতিটি মৃত্যুই আমার বুকে তিরের মতো বিঁধেছে।

আমি অনেক চিন্তা করেছি, সুস্থ, সবল মানুষ, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করতেন, হাঁটতেন এমন কী শখ করে কেউ কেউ ফুটবল খেলতেন, এরা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবেন কেন?

নিজের মতো করে যে উত্তর আমি পেয়েছি তা হলো, করোনার কারণে অপ্রত্যাশিত আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তাঁরা মারা গেছেন।

এরা সবাই বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালো চাকুরি করতেন। স্বচ্ছল ছিলেন। ভালো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতেন, বাচ্চারা ভালো স্কুলে পড়ে। কিন্তু করোনা সব ওলট-পালট করে দিয়েছে।

কেউ চাকুরি হারিয়েছেন, কারো বেতন বন্ধ, কারো তা কমে গেছে। এরা সবাই এ আকস্মিক আর্থিক পতনে ভীষণ বিপদে পড়ে গেছেন। একটি জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত কেউ হঠাৎ আর্থিক বিপর্যয়ে পড়লে শরীর ও মনে তীব্র প্রভাব ফেলে।

এদের আয় কমে গেছে, কিন্তু খরচ কমেনি। তাই সবাই ছিলেন দিশেহারা। কেউ কেউ আবার চিন্তা করবে বলে পরিবারকে এ বিপর্যয়ের কথা বলেননি। পুরো চাপ একা নিয়েছেন। খাবার টেবিলে হেসেছেন, সে হাসির পেছনে যে রক্তবর্ণ বেদনা লুকিয়ে আছে তা কাউকে বুঝতে দেননি। শেষ পর্যন্ত এ চাপ সইতে পারেননি। ফলাফল- হার্ট অ্য্যাটাক এবং মৃত্যু।

এ মৃত্যুগুলো যে কী ভয়াবহ কষ্টের তা বলার দরকার নেই।

আমি এধরনের একটি মৃত্যুও দেখতে চাই না। তাই আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কিছু পরামর্শ দিতে চাই, যদিও তা 'উদ্ভট' বা 'অসম্ভব' মনে হতে পারে।

১. দয়া করে পরিবারের সাথে সমস্যা শেয়ার করুন। তাঁরা আজ বা কাল ব্যাপারটা জানবেনই। তাই গোপন না করে তাঁদের নিয়েই পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।

২. প্রয়োজনে নাটকীয়ভাবে জীবনযাত্রা নামিয়ে আনুন। মিডল ক্লাসের প্রচলিত 'ইগো'র কারণে আমরা অযথা অনেক খরচ বাড়িয়েছি। সেগুলো চাইলে বাদ দেয়া যায়। কম দামের বাড়িতে শিফট করুন। গাড়ি বিক্রি করে দিন। অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিন। কে কী বললো সেদিকে পাত্তা দিবেন না, এখন টিকে থাকাটাই মুখ্য।

৩. বাচ্চাদের স্কুল খরচ খুব বেশি হলে তাও বদলে ফেলুন। আমাদের মনে রাখা উচিত, স্কুলকে খ্যাতিমান করে শিক্ষার্থীরা, স্কুল কোনো শিক্ষার্থীকে খ্যাতিমান করে না। স্কুলের পরিচয়ে ছাত্রছাত্রীদের আখেরে কোনো লাভ হয় না। কাজ হয় তার রেজাল্টে। সেটা যেকোনো ধরনের স্কুল থেকেই করা যায়। এই যে প্রতি বছর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস বের হয়, এদের বেশির ভাগ সাধারণ স্কুল কলেজে পড়েছে। নামকরা প্রতিষ্ঠানে নয়।

৪. সময়টা খুব খারাপ। তাই কোনো সমস্যা না থাকলেও মাঝে মাঝে ইসিজি করিয়ে ডাক্তারের সাথে আলাপ করুন।

৫. সমস্যা ভাই-বোনের সাথে আলাপ করুন। পরিবারের যে ভাই বা বোন বিপদে পড়েছেন, তাঁকে অন্যরা আগলে রাখুন। টাকা গেলে টাকা আসবে। ভাই-বোন গেলে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এই কঠিন সময়ে সবাই এক ছাতার নিচে আশ্রয় নিন। একজনের উষ্ণতা দিয়ে আরেকজনকে রক্ষা করুন।

৬. এ দুঃসময়ে যৌথ পরিবারে ফিরে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পরিবারের সবার সম্মিলিত আয় যদি সবার কাজে লাগানো যায় তাহলে সবাই উপকৃত হবেন। একা তো অনেক থাকলাম, এবার না হয় একটু কম্প্রোমাইজ করে সবাই মিলে থাকি। স্থায়ী বেদনাকে আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে এটা অনেক ভালো। মনে রাখবেন, যে মেষ শাবক পালছুট হয়, সে-ই বাঘের কবলে পড়ে। আমার এ আইডিয়া অনেকের কাছে 'অসম্ভব' মনে হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি, বর্তমান দুর্যোগ কাটানোর সবচে বড়ো ওষুধ এটাই। আমরা ভাইবোনরা প্রয়োজনে এরকম কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। যদিও এখন পর্যন্ত আমরা সবাই ভালো আছি।

৭. দয়া করে সমস্যার কথা বন্ধুদের বলুন। আর যেসব বন্ধুরা ভালো আছেন, তাঁরা বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে আগলে রাখুন। প্রয়োজনে তাঁর জন্য 'বেইল আউট' প্ল্যান করুন। সবাই হাত লাগালে বিপন্ন বন্ধুটির জন্য ছোটোখাট সম্মানজনক একটি ব্যাবসা দাঁড় করিয়ে দেওয়া মোটেও অসম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় আমরা এটা করে দেখেছি, সফলও হয়েছি।

৮. মধ্যবিত্তের যে ইগোর কথা বলছিলাম, তা একদম বাদ দেন। পৃথিবীর সবচে খারাপ তিন অক্ষরের শব্দ হলো 'EGO'.

এটা বাদ দিয়ে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ান। যেমন, ছাত্র জীবনে যিনি টিউশনি করতেন, তিনি প্রয়োজনে লকডাউনের পর তাতে ফিরে যান। প্রয়োজনে টিউশনিতে ফিরে যেতে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা করবো না। যাদের বাড়িতে জায়গা আছে, তাঁরা কৃষি থেকে আয়ের ব্যবস্থা করুন। পুকুর থাকলে মাছ চাষ করুন, হাঁস-মুরগি পালন করুন। এগুলো নিজেকেই করতে হবে এমন কথা নেই। লোক লাগিয়েও করা যায়। বাড়ির মহিলারা সেলাই কাজ, হোম মেইড ফুড এধরণের ছোটো ছোটো উদ্যোগ নিন।অনলাইন/অফলাইনে বিক্রি করুন। সততাকে পুঁজি করলে ক্রেতার অভাব হবে না।

এখন যুদ্ধকাল, আমাদের আগের কয়েক প্রজন্ম এমন ভয়াবহ আর্থিক দুরবস্থায় পড়েনি, পরের প্রজন্মও সম্ভবত পড়বে না। এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে যেটা জানি, যার যেটা আছে তাই আঁকড়ে ধরতে হবে। এখন ফালতু ইগোর সময় নয়।

০৯. বিগত কয়েক বছর পুনর্মিলনী/ রি-ইউনিয়নের বন্যা আমরা দেখেছি। লাখ লাখ টাকা এসব অনুষ্ঠানে খরচ হয়েছে।

এসব অ্যালামনাই এখন প্রত্যেক সদস্যের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারেন। নয়তো এসব মিলনমেলা/প্রাণের বন্ধন একটি

লোক দেখানো ফালতু ব্যাপার ছিল তাই প্রমাণিত হবে। ( আমি সব সময় বলতাম, এতো টাকা শুধু খাওয়া দাওয়া আর নাচ-গানের পেছনে খরচ না করে কিছু জমান, একটা 'ফান্ড' তৈরি করেন, বিপদ যে কোনো সময় আসতে পারে, তখন কাজে লাগবে। নাউ ইট'স রেইনিং অ্যান্ড উই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি আমব্রেলা! অথচ টাকাটা হাতে রাখলে আমরা বন্ধুদের বিপদে কাজে লাগাতে পারতাম। হয়তো বাথরুমে দড়াম করে পড়ে গিয়ে তাজা বন্ধুটি লাশে পরিণত হতো না।)

১০. সবশেষে বলি, বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য হচ্ছেন নিঃসঙ্গ শেরপা। তাঁকে একাই লড়াই করতে হয়। এ একাকী যোদ্ধাকে বাড়ির সবাই স্বস্তি দিন, যত্ন করুন, মায়ায় ডুবিয়ে রাখুন।

9
$ 0.19
$ 0.19 from @TheRandomRewarder
Sponsors of MonzurAhmed
empty
empty
empty
Avatar for MonzurAhmed
3 years ago

Comments

Onak valo likhachan apni ai corona sadaron manusar jonno khub voyogkor karon tara na pare cikitsa koraite takar jonno.na pare test koraite

$ 0.00
3 years ago