টিউশন বন্ধ! টিউশনকে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার জীবিকা উপার্জনের জন্য একমাত্র অবলম্বন হিশেবে নিয়েছে এমন ছাত্রের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। রানিং স্টুডেন্ট ও সদ্য পাশ করা ছাত্রদের জীবিকার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজ্যের অনিচ্ছা মাথায় থাকা সত্ত্বেও মানুষের বাড়িতে কলিং বেল টেপা।
করোনা ভাইরাস নামক মহামারির তোপে লকডাউন দেওয়ার সময় থেকে আজ অবধি এই বিশাল সংখ্যার উচ্চ শিক্ষিত যুবক যুবতি চরমভাবে আর্থিক সংকটে ভুগছে। না খেয়ে থাকছে। বাড়িওয়ালার ভাড়ার জন্য উপর্যুপরি চাপে বিধ্বস্ত। পেঠকে না খাইয়ে বুঝ দেওয়া যায় কিন্তু বাড়িওয়ালা নামক মধ্যযুগীয় জমিদার শ্রেণীদের বুঝ দেওয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগ টিউশন পেশাদারি ছেলে- মেয়েই মফস্বল এলাকা তথা নিন্ম মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা। সরকারের তাদেরকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, তাদেরকে নিয়ে কারো কথা বলার লেশমাত্র চিন্তা নেই, সামনের সারির সবগুলো মিডিয়াও নিশ্চুপ।
পত্রিকায় পড়েছি ভারতে একজন টিউশন পেশাজীবীর টগববে স্নাতক পাশ যুবক সংসার চালাতে না পেরে আত্মহত্যা নামক মুক্তির পথ বেঁছে নিয়ে চিরস্থায়ী সংসারে পদার্পণ করেছে। সে জগতে তার না আছে করোনার টেনশান না আছে টিউশানের টেনশান। সুযোগ থাকলে তার অনুভূতির কথা সত্যিই সে বলে যেতো। একজন বিখ্যাত লেখকের একটা বই আছে "কেউ শখ করে মরেনা" উচ্চ বিদ্যাপীঠের উচ্চ সার্টিফিকেটধারী বেকার যুবকটি এমনি এমনি মরেনি— মরে গিয়ে দায়িত্বশীলদের একটি শক্ত বার্তা দিয়ে গেছে যে আমাদের কথাটা ভাবুন নয়তো— এ পথের লাইটা একটু দীর্ঘই হবে। যদিও এ লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়াতে কারো কিছু যায় আসেনা।
উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের আত্মসম্মানের পারদ এভারেস্টের চূড়া সমতুল্য! আত্মসম্মানবোধের কারণে কোথাও ত্রানের জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারছেনা।পাছে আবার কর্তাব্যক্তিদের ফটোসুটের ভয়। যে ছেলেটা বা মেয়েটা মাস শেষে টিউশনের ন্যায্য টাকাটা চাইতে গিয়ে লজ্জায় বলতে পারেনা, দেড় মাসের বেতন এক মাসের বেতন হিশেবে পাওয়ার পরে বলে থাকগা! সে কি করে বলবে— এমন দূর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতে আমাদের বেতন চালু রাখুন কিংবা আমাকে কিছু এডভান্স বেতন দিন।
দেশে লকডাউন পড়েছে পঁচিশে মার্চ থেকে অথচ অনেক অভিভাবক সেই মাসের মাইনেটাও বাদুর ঝুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। জগতের সবচেয়ে আনন্দময় বেদনাদায়ক চাকরি বুঝি এই টিউশন করা। এইতো এক বাসায় আপনি এমন সম্মান, মর্যাদা পেলেন, তৃপ্তির পূর্ণ ঢেকুর তুলে বলতে পারবেন —এর চাইতে বুঝি আর মহৎ প্রাপ্তি থাকতে পারেনা। অনুভূতির পারদের মাত্রা অনেকটা এরকম, "সম্মান" পাইলাম আমি ইহাকে পাইলাম। আরেকবাসায় এমন বেদনাদায়ক কিছু ঘটবে, শুধু কপালে হাত মেরে বলবেন হায়! এতোদিন, এত বছর আমি কী করেছি, আমি কী করলাম , কী করে যাচ্ছি?
আমরা গাঁধার খাটুনি খেটে বছরের পর বছর শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের স্বর্ণ প্লাস আর রুপালি এ প্লাস পাইয়ে নিজেকে এবং তাদেরকে তাদের পরিবার সমেত আনন্দ এবং অহকাংরের সমুদ্রে অবগাহন করিয়েছি। তাদের কারো কারো ডায়মন্ড প্লাসের ইতিবৃত্ত কয়েকদিনের মধ্যে ফুলে ফেপে দেশের স্বনামধন্য কোন এক প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয় এই শিরোনামে "আমাদের সোনামনি অমুক এ বছর গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।" যার কৃতিত্বের ভাগিদার হচ্ছে তার মা-বাবা ও ইশকুলের অমুক শিক্ষকের। (ইশকুলের শিক্ষক নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই) অথচ যে গৃহ শিক্ষক অথবা কোচিংয়ের শিক্ষক বছরের পর তার পিছনে খেটেছে, কিছু পারিশ্রমিকের বিনিমিয়ে বিশেষ যত্ন নিয়েছে, তার নামটা ভুল করে প্রিয় শিক্ষক হিশেবে উচ্চরণ করেনা। ঠিক সেই ছাত্র/ছাত্রীটি তাঁর (গৃহ/কোচিং শিক্ষকের) সম্মুখে বসে ঠিকই তাকে দেবতা জ্ঞান করে, হাজার বার বলেছে আপনি আমার ফেবারিট শিক্ষক কথাটি। মনে হয় যেনো পাবলিক প্লেসে এই কথা বলটা লজ্জাজনক কিংবা মহাপাপ! (তবে ব্যতিক্রম অল্পস্বল্প আছে)।
বলতে পারেন কোচিংয়ের স্যারেরা তো শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। ওয়েল, বলতে পারেন! জগতের উন্নত সকল দেশেই এই শিক্ষা বাণিজ্য চলে। আমাদের দেশের দায়িত্বশীলরা কি আমদেরকে এখনো এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা দিতে পেরেছে কিংবা অর্থনীতিক সাম্যের ছিটে ফোটাও কি নিশ্চিত করতে পেরেছে —যে আমরা বলতে পারি যে বাণিজ্য করা কোচিং গুলো একেবারে শীকড় সহ এখনি উপড়ে ফেলা যাবে? বরং কিছু মানুষ নিজেদের ফায়দা লুটে নিলেও লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ছেলেদের সংকটকালীন অস্থায়ী কর্মসংস্থানের যোগান দিচ্ছে এই বাণিজ্যিক কোচিং গুলো। বাণিজ্য করার পাশাপাশি অন্তত কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে এই কোচিং গুলো। তাহলে তাদের কাজ তারা যদি নিষ্ঠার সাথে করতে পারে, আমরা যারা উপকৃত হচ্ছি, তাদেরকে ন্যূনতম স্বীকৃতি দিতে এতো হীনমন্যতা কেনো?
অভিভাবকদের মাইনাসের খাতায় রেখে বলি, আমরা কলিং বেল টেপা পেশাজীবীরা আমাদের ছাত্রদের ভেতরে মানবিকতার সামান্য এই বোধটুকু তৈরি করে দিতে পেরেছি কি? —তারা (যাদের সামর্থ আছে) তাদের অভিভাবকদের বলবে আব্বু, আম্মু এই সংকটময় মূহুর্তে স্যারদের বেতন চালিয়ে যাওয়া উচিত। নয়তো স্যারেরা চলতে পারবেন না। তাদের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক গুলো মানুষের জীবন আর অন্নের যোগান। আমাদের এতো এতো অর্জন তাদের ছাড়া কল্পনাও করা যেতোনা। দিনশেষে এইটুকু ব্যর্থতার দায় আমাদেরকে মাথায় নিতেই হবে। যেটা আগামীর টিউশনজীবীদের জন্য বড় রকমের একটি উচিত শিক্ষা।
বিসিএস নামক কচ্ছপ দৌড় প্রতিযোগিতায় মেতে ছোট খাটো সোনালি সুযোগ মিস করা দুর্ভাগাদের দলটা এখন অনেক বড়। এহেন পরিস্থিতে তাদের নিয়ে ভাবার কারো টাইম নেই। আমার এই অরোন্য রোদনও কোনো দায়িত্বশীলের লৌহ প্রাচীরে নির্মিত বিবেকের কর্ণ দ্বারে মৃদু নাড়া দিবেনা জেনেও মনের কিছু কথা টিউশন পেশাজীবীদের হয়ে বলার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অভিরাম ভালবাসা রইলো এই অবহেলিত পেশাজীবীদের জন্য।
You've written amazing... You highlighted the bitter truth of this pandemic situation.