পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে ‘মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭) আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কাবা শরিফের নির্মাণের উদ্দেশ্য ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোকপাত করেছেন। এই ঘরটি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইবাদতের ঘর যা বরকত ও সব কল্যাণের আধার এবং সারা বিশ্বের জন্য হেদায়েতের দিশারি। আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলবী (র.) স্বীয় কিতাব তাফসিরে মারেফুল কোরআনে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন যে, নভমণ্ডল, ভূমণ্ডল, চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি সৃষ্টি করার আগে মহান রাব্বুল আলামিন কাবার জমিন সৃষ্টি করেছেন। পরে কাবার নিচ থেকে জমিনকে বিস্তৃত করে সারা পৃথিবী সৃষ্টি করেন।
এক কথায় সবার আগে কাবা শরিফ নির্মাণের প্রায় দুই হাজার বছর পর আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন। তাকে সব ফেরেশতাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন। কেন শ্রেষ্ঠত্ব দান করে সৃষ্টি করলেন? এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক বলেন, আমি কেন আদমকে বা তার সন্তানদের সৃষ্টি করেছি, তার নিগূঢ় তথ্য আমি ছাড়া কেউ জানে না। তিনি হজরত আদম (আ.)কে সব ফেরেশতার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন কাবা নির্মাণের মৌলিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। বায়হাকি শরিফে একটি হাদিস এসেছে, হজরত রসুলে আরাবি (সা.) বলেন, হজরত আদম ও বিবি হাওয়ার পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের কাবা সংস্কারের নির্দেশ দেন। সংস্কার হয়ে গেলে তাদের কাবা গৃহ তওয়াফ করার নির্দেশ দেন। ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়, আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)কে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি সর্বপ্রথম মানব এবং এই গৃহটি সর্বপ্রথম গৃহ— যা মানব জাতির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পরবর্তীতে কালের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন সময় তার পুনর্নির্মাণের বিষয় পরিলক্ষিত হয়। তাফসিরে জালালাইনের বর্ণনা মতে, তখন থেকে নিয়ে পরবর্তীতে প্রায় দশবার পবিত্র কাবা শরিফকে নির্মাণ করা হয়। যেমন— হজরত আদম (আ.)-এর দৌহিত্র হজরত শীশ (আ.) কাবাতুল্লাহর নির্মাণ কাজ করেন। তারপর হজরত নূহ (আ.) এই বরকতপূর্ণ কাজে নিজেকে শরিক করেন। পরিবর্তীতে হজরত জিবরাঈল (আ.)-এর নেগরানিতে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)কে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণরূপে নির্মাণ কাজ করেন। মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারীদের কাবা শরিফ তওয়াফ করার আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে বনু আমালেকা ও জুরহাম সম্প্রদায়ের লোকেরা এই বরকতপূর্ণ কাজে যোগদান করেন। পরবর্তীতে এই নির্মাণ কাজে হাত দেন রসুল (সা.)-এর দাদামহ কুসাই বিন কিলাব। এরপর উক্ত কাজ করে ধন্য হন কুরাইশরা এবং এই বরকতপূর্ণ কাজে স্বয়ং নবী করিম (সা.)ও যুক্ত হন। প্রিয় পাঠক, পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে যুগে যুগে কেন নবীগণ এবং অন্যান্য মানুষ কাবা শরিফ নির্মাণের মতো এই বরকতপূর্ণ কাজে নিজেদের শরিক করেন? বিষয়টি আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। তা বোঝার জন্য পবিত্র কোরআন অনুধাবন করলেই সহজে বুঝে আসে। মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে সূরা জারিয়ার ৫৬-৫৭নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য জোগাবে।’ আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে মানব ও জিন জাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য আলোচিত হয়েছে। আগে পবিত্র কাবাতুল্লাহ নির্মাণের উদ্দেশ্য আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববাসী যতদিন পর্যন্ত পবিত্র কাবাতুল্লাহর সম্মান করবে, তওয়াফ করবে, কাবাতুল্লাহর দিকে র্িফরে নামাজ আদায় করবে, হজ ও উমরাহ করবে ততদিন পর্যন্ত সারা দুনিয়া টিকে থাকবে। দুনিয়াবাসী রহমত ও বরকত পেতে থাকবে। দুনিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহতায়ালা সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতার কারণ করেছেন’ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা হজরত আতা (র.) এইভাবে করেছেন যে, কাবাঘর সারা বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ। যতদিন এর দিকে মুখ করে মানুষ নামাজ পড়বে ও হজ করবে ততদিন দুনিয়াটা টিকে থাকবে। প্রিয় পাঠক, একটু চিন্তা করুন, কাবাতুল্লাহ নির্মাণের উদ্দেশ্য ও মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এক। আর তা হলো এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করা। ইবাদত বলতে আমরা কি বুঝি? প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে যে একেবারে ইসলাম সম্পর্কে কিছুই না জানে বিস্তারিত বলতে না পারলেও অন্তত এতটুকু বলতে পারবে যে, ইবাদত হলো ইমান আনার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে মালের জাকাত দেওয়া। সম্পদ থাকলে জীবনে একবার হজ করা। পবিত্র রমজানে রোজা রাখা। কাবাতুল্লাহ যেমনিভাবে দুনিয়ার খুঁটি অনুরূপভাবে ইবাদতের খুঁটি হলো এই পাঁচটি
আমার জীবনের একটাই প্রবল ইচ্ছা। আর সেটা হচ্ছে হজ্জ করতে যাওয়া আর কাবা ঘর পরিদর্শন করা। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে হজ্জ করার মতো তৌফিক দান করেন।