#তুমি_আছো_হৃদয়ে 💙
পর্ব-১
"এইচএসসি পাশ করেছে,যথেষ্ট পড়াশোনা হয়েছে।এবার বিয়ে থা দিয়ে বিদায় করো।পরের মেয়ের পিছে এতো টাকা খরচা করার মানে হয়না বাপু।"
কথাটি আমার দাদির।দাদি কথাগুলো বাবাকে বলছিলো আমাকে উদ্দেশ্য করে।
আজকে আমার এইচএসসি রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে।গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি অথচ তারা আমাকে আর পড়াতে চাইছেন না। বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় করতে চায়।আমি তাদের কাছে আপদ।আপদ কেনই বা হবোনা।তাদের সাথে তো আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।আমি তাদের কাছে আশ্রিতা।
ঘটনা তবে খোলেই বলি।আমার যখন ৬ বছর বয়স তখন আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়।ডিভোর্সের কারণ আমার বাবা অন্য মহিলার সাথে জড়িয়ে পরেন।তাকে বিয়ে করার জন্য আমার মাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।মাও মেনে নেন।যে লোক তার স্ত্রীকে রেখে অন্য মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে তার সাথে থাকার কোনো মানেই হয়না।তাই মাও ডিভোর্স নিতে রাজি হয়ে যায়।
মায়ের ডিভোর্সের পর আমি মায়ের সাথে মামা বাড়িতেই ছিলাম।আমার মামা খুভ ভালো মানুষ। মামিও অত্যন্ত ভালো।তারা আমাদের সাদরেই গ্রহণ করেন।মা চাকরির চেষ্টা করছিলো তখনই মামা মায়ের বিয়ের কথা বলেন।মা আবার বিয়ের কথা শুনতেই রেগে যায়।কিন্তু মামা হাল ছাড়ে না।তিনি মাকে বুঝান মেয়ে এখনো ছোট।জীবনের অনেকটা সময় পরে আছে।এভাবে একা আমাকে মানুষ করতে পারবেনা।আমার ও একজন বাবা প্রয়োজন আর মায়ের একজন সংগী।সারাজীবন আমাদের পাশে তো আর মামারা থাকতে পারবেনা।আমাদের শক্ত গাছ প্রয়োজন যে কিনা আমাদের মা-মেয়ে কে সকল ঝড় ঝাপটা থেকে রক্ষা করবেন।
কিন্তু মা আমাকে রেখে বিয়ে করবেন না সাফ জানিয়ে দিলেন।আমাকে রেখে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভাবতে পারবেন না।যদি কেউ আমাকে সহ মাকে বিয়ে করতে রাজি হোন তবেই তিনি বিয়ের কথা ভেবে দেখবেন নয়তো নয়।
পরের সপ্তাহেই মামা মায়ের জন্য বিয়ের সমন্ধ নিয়ে এলেন।ভদ্রলোকের বিয়ের দুবছরের মাথায় স্ত্রী মারা যান তারপর আর বিয়ে করেন নি।৩বছর একা আছেন।ভদ্রলোকের বয়স ৩৩বছর, সুদর্শন,শিক্ষিত আর ভালো পরিবারের।ওনাদের নিজেদের ব্যবসা আছে।অবস্থা সম্পন্ন পরিবার।তাই মামা মায়ের জন্য এ সমন্ধ নিয়ে এলেন।আনার মা যথেষ্ট সুন্দরী,যথেষ্ট বললেও ভুল হবে অতিরিক্ত সুন্দরী, পড়াশোনা জানা মেয়ে তাই তাদের চট করেই পছন্দ হয়ে গেলো।মাকে নেওয়ার জন্য তারা পাগল হয়ে উঠলেন।কিন্তু মা তাদের সামনে শর্ত জোরে দিলেন।তিনি তখনই বিয়ের জন্য রাজি হবেন যদি আমাকে সহ ওনারা মাকে গ্রহণ করে।এই শর্তে তারা যেন ঝিমিয়ে পড়লেন।
আমার মায়ের হবু বর আমাকে একবার দেখতে চাইলেন।মা ওনাকে নিয়ে আমার কাছে আসলেন।আমি বারান্দায় বসে পুতুল পুতুল খেলছি।
তিনি এসে আমার পাশে বসলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে হিহি করে হেসে দিয়ে বললাম,
--তুমি তাহলে আমার নতুন বাবা?
তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
--হ্যা মা।আমিই তোমার নতুন বাবা।
মা অবাক চোখে ওনার দিকে তাকালেন।
তিনি মায়ের বিস্ময় কাটানোর জন্য বললেন,এমন ফুলের মতো মেয়ের বাবা হওয়া কয়জনের ভাগ্যে থাকে বলুন তো?আমি এই ফুলের বাবা হতে চাই।আপনি কি আমাকে সে সুযোগ দিবেন??
আমার নতুন বাবার পরিবারের বেশ অসম্মতি থাকলেও তিনি মাকেই বিয়ে করবেন বলে সাফ জানিয়ে দিলেন।তাই তারাও না পেরে রাজি হয়ে গেলেন।এভাবেই আমার এই পরিবারে আসা।দীর্ঘ ১২বছর যাবৎ পরিবারে আছি।কারো কাছে পরিবারের একজন কারো কাছে আশ্রিতা।
"মা,আমি ফুলকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইনা,বাচ্চা মেয়ে আরেকটু বড় হোক তারপর ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিবো।"
বাবা দাদিকে এ কথা বলে আমাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
আমার নাম ফুল নয়।তবে সেদিন আমাকে দেখার পর বাবা আমাকে ফুল বলেই ডাকেন।এ বাড়ির সবাই আমাকে তানহা বলেই জানেন।মাও আমাকে ফুল বলেই ডাকা শুরু করেন।মায়ের মতে এই নামটাই আমার সাথে যায়।আমি নাকি ফুলের মতোই সুন্দর।তাই এ নাম নিয়ে আমার ও কোনো আপত্তি নেই।নামটা আমারও যথেষ্ট ভালো লেগেছে।আমার আসল নাম তাইয়্যেবা তাসনীম তানহা।মা আর বাবাই আমাকে ফুল বলে ডাকে বাকি সবাই তানহা।
--ফুল তুই মায়ের কথায় কিছু মনে করিস না মা।আমি তোকে ভার্সিটি ভর্তি করে দিবো।
বাবা আমায় বললেন।
আমি মাথা নাড়ালাম।
--এখন দেখ তোর জন্য কি এনেছি?বলেই বাবা একটা প্যাকেট আমার হাতে দিলেন।প্যাকেট খোলে দেখলাম আমার পছন্দের সব চকলেট।
আমি হেসে দিলাম।
বাবা আমার অনেক ভালো মানুষ। আমার প্রতি তার ভালোবাসা দেখলে বুঝাই যায়না তিনি আমার আসল বাবা নয়।আমার নিজের বাবাও আমাকে কখনো এতটা ভালোবাসেনি,তিনি আমায় যতটা ভালোবেসেছেন।
আমি চকলেট বের করে মুখে দিবো তখনই শুনতে পেলাম,
--আপুনি তুই একাই খাবি?আমাকে দিবি না?
পিছনে ঘুরে দেখি তুহিন দাঁড়িয়ে আছে।
তুহিন আমার ছোট্ট ভাই।ওর বয়স ১০বছর।ও আমাকে খুব ভালোবাসে।যদিও এই বাড়ির মানুষ প্রতিনিয়ত ওর কানে বিষ ঢালে আমি ওর আপন বোন নই আমাকে যেন এতো ভালো না বাসে কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দেয়না।এক মায়ের পেটের ভাইবোন বাবা আলাদা তাতে কি।উল্টো দিন দিন আমার প্রতি ওর ভালোবাসা বেড়ে চলেছে।
আমি ফিক করে হেসে ওর মুখে চকলেট পুরে দিলাম।দুই ভাইবোন মিলে চকলেট খাচ্ছি।
চকলেট খাওয়া বাদ দিয়ে কিছু মনে পরার ভংগীতে বললো, আপুনি তুই বস আমি আসছি।দৌড়ে কোথায় চলে গেলো।
তারপর আবার পাখির মতো উড়ে চলে এলো।
একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
--আপুনি এটা তোর জন্য।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি এটা?
ও বললো, সারপ্রাইজ।
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে প্যাকেট খুলতে লাগলাম।আমি প্যাকেট খুলে এক জোরা ঝুমকো দেখতে পেলাম।কি সুন্দর ঝুমকো।
ও খুশি খুশি মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমি ওর গাল টেনে বললাম,
--তুহিন তুই তো দেখছি বড় হয়ে গেছিস।আপুর জন্য ঝুমকো কিনে এনেছিস।
তুহিন কোতুহল নিয়ে বললো,
--আগে বল কেমন হয়েছে,?
--অনেক সুন্দর।আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
তুহিন বলল,
তুই এতো ভালো রেজাল্ট করেছিস তাই ভাবলাম তোকে কোনো গিফট দেওয়া যাক।আর তখনই মনে হলো তুই তো ঝুমকো অনেক পছন্দ করিস।তাই মার্কেটে ঘুরে অনেক দেখে তোর জন্য নিয়ে এসেছি।
আমার চোখে পানি এসে পরেছে।
ভাই আমার চোখে পানি দেখে বললো, আপুনি তুই কি এখন কাদতে বসবি?তোর মতো ডেমরা মেয়েকে কাদতে দেখলে লোকে কি বলবে শুনি?
-হিহি,,কই কাদছি।
তুহিন ও হেসে দিলো।
তখনই নিচ থেকে চেচামেচি শুনতে পেলাম।আমি খুব ভালোই বুঝতে পারছি চেচামেচিটা আমাকে নিয়েই হচ্ছে।এ বাড়িতে ৮০% চেচামেচি আমাকে ঘিরেই হয়।
আমি আর তুহিন পা টিপে টিপে নিচে গেলাম।
নিচে মিটিং বসেছে।বাবা-মা,দাদি,বড় চাচা,চাচি মিলে মিটিং করছে।
দাদি বলে উঠলো,
--পরের মেয়েকে নিয়ে তোর এই আহ্লাদি পনা আমার একদম সহ্য হচ্ছেনা।
কাকি বলছে,
--জামিল,দুদিন পর যদি এই মেয়ে আমাদের মুখে চুনকালি মেখে কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায় তখন সমাজে মুখ দেখাতে পারবে?
বাবা বললেন,
--কি বলছেন ভাবি?ফুল এমন মেয়েই না।আমার মেয়েকে নিয়ে এসব বলবেন না।
-তোমার মেয়ে?এই মেয়েকে নিয়ে তোমার এতো আদিখ্যেতা কেন?আমার মেয়ে আমার মেয়ে করে একদিন এই মেয়ের জন্য নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে।এই বলে দিলাম দেখে নিও।
বড় কাকা বললেন,আহ!সালমা চুপ থাকো তো।আমাকে কথা বলতে দেও।
জামিল,আমি জানি তুই তানহাকে নিজের মেয়ে মানিস,ওকে অনেক ভালোবাসিস।দেখ আমরা কেউ ওর খারাপ চাই না।এখনকার সময় কাল ভালো না।কখন কি থেকে কি হয়ে যায় বলা তো যায়না।যতটুকু পড়াশোনা করেছে সংসার করার জন্য যথেষ্ট।ও তোর আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছেনা।তারপরও যদি পড়তে চায় বিয়ের পর পড়বে।কত মেয়েই তো বিয়ের পর পড়াশোনা করছে।
আমি শুধু চাই মান সম্মানের সাথে ও শ্বশুর বাড়ি যাক।ভালো থাকুক।
তাহমিনা(আমার মা)তুমি কি বলো?
এতো ক্ষন নির্বিকার মাথা নিচু করে বসে ছিলেন মা।মাথা তুলে বললেন,আমি আর কি বললো,আপনারা যা ভালো মনে করেন।
এই বাড়িতে মায়ের সব ব্যাপারে সব কিছু বলার অধিকার থাকলেও আমার ব্যাপারে কিছু বলার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার তার নেই।আমাকে নিয়ে যখন কথা হয় তখন তিনি নিরব দর্শক হয়ে শুনে যান।আমাকে যখন দাদি বা কাকি বকাঝকা করেন তখন মা চুপ করে থাকেন কোনো প্রতিবাদ করেন না।
মা আমার ভীতু,তবে জবার দিতে নয়,,আমাকে হারাতে ভয় পায়।মায়ের ধারণা মা যদি আমাকে নিয়ে কথা বলেন তবে আমাকে আর এখানে থাকতে দিবেনা।আর মা না পারবেন এই সংসার ছাড়তে আর না পারবেন আমাকে ছাড়তে।তাই আমাকে আকড়ে ধরে রেখেছে কোনো ভাবে।যতবার উনারা আমাকে বকাবকি করেন মা নিরবে চোখের জল ফেলেন।আমি অনেক বার দেখেছি মাকে কাদতে।
আমি ভালো রেজাল্ট করায় বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে ভালো কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করবেন আর এখানেই যত বিপত্তি বাধলো।পরের বাড়ির মেয়ের জন্য এতো টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয়না।যদিও এই পরিবারের আমার মতো ১০টা মেয়েকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়িয়ে,খাইয়ে মানুষ করার এবিলিটি আছে।কিন্তু ওই যে আমি পরের বাড়ির মেয়ে,,,।
আমি শাড়ি পড়ে সেজেগুজে পা ঝুলিয়ে বসে আছি বিছানায়।আজ আমাকে দেখতে আসবে।সেটা মায়ের সিদ্ধান্তে।তবে আমার সিক্স সেন্স বলছে এসব শুধু শুধু হচ্ছে।মা বলে গেছে আমি যেন এখানেই চুপটি করে বসে থাকি।তাই বসে আছি।
নিজেকে আয়নায় দেখতে ইচ্ছে করছে।তাই বেড থেকে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।ওমা আমি নিজেকে দেখে নিজেই হা।মা সবুজ কালার শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে।হালকা মেকাপ,কাজল,
হালকা লিপষ্টিক।সাথে অলংকার।নিজেকে দেখে নিজেই ক্রাশ খাচ্ছিলাম কিন্তু সেটা আর দীর্ঘস্থায়ী হলোনা।
কোথা থেকে রায়হান রাহাত এসে হাজির।আমাকে দেখে ভেংচি মেরে বললো,
--ওই ফক্কনি এভাবে সং সেজে বসে আছিস কেন?শাড়ি খোল,মেকাপ ধুয়ে ফেল।নয়তো রাস্তার ওপাশের পচা ডোবায় নিয়ে তোকে চুবানি দেবো।যে ছেলে দেখে এলাম মাগো মা।ওই ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেবোনা।বুঝলি।
আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,বুঝলাম এবার যা।
রাহাত কটমট করতে করতে বললো, যাচ্ছি,,শাকচুন্নী।
আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই বেরিয়ে গেলো।আমি আবার আয়না দেখায় মন দিলাম।
এ হচ্ছে আমার সতিন।আমার জানে দুশমন রাহাত।বড় চাচার ছেলে।আমার আরেক শুভাকাঙ্ক্ষী।ও আমার একমাত্র বন্ধু থুরি শত্রু।ওকে আমি দিনে-রাতে দশবার কেটে পিচপিচ করি।ওই একমাত্র ব্যক্তি যার উপর আমি আমার সব রাগ ঢালতে পারি।ইচ্ছে মতো বকতে পারি।সবকিছু শেয়ার করতে পারি।আমরা এক ক্লাশে পড়ি।ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি।একি স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছি।বেচারা পড়াশোনায় মনোযোগী নয়।তাই টেনেটুনে অনেক চেষ্টায় A-পেয়েছে।বড় কাকিমার এখানেই সমস্যা যেখানে আমি গোল্ডেন পেয়েছি সেখানে ওর এমন রেজাল্ট কেন হবে।তাই আমাকে বিদায় করার প্ল্যান।যাইহোক এখন দেখার বিষয় প্ল্যান কতটুকু সাক্সেস হয়।
চলবে....
(নতুন গল্প নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম।যারা হারিকেন দিয়ে নায়ক খোজে পাননি তাদের বলছি খুব শীঘ্রই ওই হিটলারকে পেয়ে যাবেন।)