আমি ভিনদেশী নই
Part: 1,2
হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে কেপে উঠলো প্লেনটা। রাজা বাইরে তাকালো। প্লেন রানওয়েতে ছুটতে শুরু করেছে। সে সাথে রাজার ভেতরটা বেশ খচ খচ করছে। মনে হচ্ছে, সে যেন কিছু একটা ফেলে যাচ্ছে। কিন্তু কি ফেলে যাচ্ছে! হ্যাঁ..... সে তার হৃদয় ফেলে দিয়ে যাচ্ছে তার ঠাম্মির(নানি) কাছে। তার স্বপ্নের শহর কলকাতার কাছে। বারবার শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। কয়েক ঘণ্টার পর সে বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু, একটুও আনন্দ বোধ করছে না। জীবন আসলে নদীর মতন বয়ে যায়, ফুলের মতন ফুটে না।
সাদা ফুলহাতা জামা কোনুই পর্যন্ত গোটানো, তার উপর বেশ মোটা একটা সাদা জ্যাকেট। পায়ে ফুল কটনের একটা স্যুট। মাথার চুলগুলো বেশ বড় এবং এলোমেলো। চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা। প্লেনের বাকি যাত্রীরা হৈ-হুল্লোড় করলেও, রাজা চুপচাপ বসে রয়েছে। সে, কারুর সাথে বিন্দুমাত্রও পরিচয় হওয়ার চেষ্টা করছে না। শুধু কি আজ, তা নয়, আজ আঠারো বছর প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে পরিচয় তো দূরের কথা, সামান্য কথা বলেনি। এমনকি,ওর বেস্ট ফ্রেন্ড মানে, আকাশ আর অভি ওর এমন আচরণে বিন্দুমাত্র রাগ বা অভিমান করে না।কারণ, ওরা জানে রাজা ছোটবেলার অতিথি ওকে ভীতু, লাজুক করে দিয়েছে। শুধু কি, এখানেই শেষ, তা মোটেও নয়। সদ্য এক বছরের রিলেশন শিপের জরানো রানীর সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। যদিও, রানী এমন একটা শান্তশিষ্ট বয়ফ্রেন্ড পেয়ে বেশ খুশি।
তবে, সবাই খুশি হলেও রাজার ঠাম্মি মোটেও খুশি নন। উনার মতে,
"18 বছর বয়সেও, যে ছেলে নিজের মান সম্মান নিজে রক্ষা করতে পারেনা সেটা, ওর গুণ নয় দুর্বলতা"।
তিনি, রাজাকে নিজের চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসেন। তবে,নাতির এই ভীতু, শান্তশিষ্ট, দুর্বলতা নিয়ে, তিনি খুবই চিন্তিত।
তাইতো ঠাম্মির কথা রাখতে রাজা আজ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। যাত্রীদের কোলাহলের মধ্যে রাজা একটু বিরক্ত বোধ করলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গিয়ে বুঝলো ওর শেষ সম্বল টুকু ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এয়ারপোর্টে, রানীকে ফোনটা দিয়ে বাথরুমে গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে আর নিতে মনে নেই। বেচারা রাজা, একদিকে ঠাম্মি- রানী কে ছেড়ে তিন বছর চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইলটাও ফেলে দিয়ে এলো।
তবে,রাজাকে বাংলাদেশে অনেক মানুষকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ইন্ডিয়ায় এত বড় বড় কলেজ থাকতে, সে কেন বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে এল! রাজা কি তবে কোনো গরিব পরিবারের ছেলে! বিদেশে পড়াশোনা করবে, তা বাংলাদেশে হলেও হবে। তা কিন্তু মোটেও নয়। তার বাবার,যা টাকা আছে তাতে তার সাত পুরুষ বসে আরামে খেতে পারবে। তবে কি জন্য তার বাংলাদেশে আসা! প্রতিটা রূপকথার পিছনে, একজন আদর্শ লেখক এর হাত থাকে। তেমনি রাজার বাংলাদেশের আসার একটা কারন ছিল।
ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পর সে ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করলো। সময় তখন বিকেল পাঁচটা। যদিও ওটা ইন্ডিয়ার টাইম অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশ সময় কত, সে অনুমান করতে পারলো না। বাইরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। তার হাত-পা কেঁপে উঠছে। নগরের বাইরে গেলেই বোঝা যায় পৌষ মাসে শীতের দাপটা কত থাকে। ঠাম্মির কথা মত, বাসে করে সুসং পরগনা চলে আসে। সুসং পরগনা এসে সমস্যায় পড়ে। এতক্ষণ, সমস্ত রাস্তার ঠিকঠাক মিললেও, সুসং পরগনা পর থেকে আর মিলল না। এই 15 বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে গ্রাম শহর,আর শহর নগরে পরিণত হয়েছে। তাইতো, আগে যে রাস্তায় গাড়ি গুলো যেত এখন আর যায় না। আগন্তুক রাজা, নতুন দেশে এসে মহা বিপদে পড়লো। কোন ট্যাক্সি ওর বাড়ির কাছে যেতে চাইল না। অনেকগুলো, ট্যাক্সিচালককে রিকুয়েস্ট করার পর, শেষমেষ একটি ট্যাক্সি যেতে রাজি হলো। যদিও, পুরোটা তিনি আবার যাবেন না। মেন রাস্তায় রাজাকে,ছেড়ে দিবেন তারপরে তাকে গ্রামের রাস্তা ধরে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হবে। সে,আর কোনো উপায় না দেখে ট্যাক্সিতে উঠে পরলো। কথায় আছে না, 'নেই মামার চেয়ে,কানা মামা ভাল'।
মসৃণ রাস্তা দিয়ে ট্যাক্সি দ্রুত ছুটতে লাগলো। সেই সাথে শীতকালে ঠান্ডা কনকনে বাতাস তার কান ধাঁধিয়েএ দিল। তার চোখ যেদিকে যায় সে দিকে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। ছোট্ট এক শুরু রাস্তার মধ্যে দিয়ে ট্যাক্সিটা ছুটছে। ট্যাক্সিটা সাথে সাথে তাল মিলিয়ে দু'পাশের গাছগুলোও দৌড়াচ্ছে।শীতের সন্ধ্যায় মাঠ-ঘাট দিগন্ত কুয়াশায় হালকা ওড়নায় ঢাকা।কুয়াশা ও শিশির ভেজা ঘাস গুলো হি হি করে উত্তরের হিমেল বাতাসে কাঁপছে। সর্বত্র বিরাজ করছে শীতের জড়তা, কুয়াশাচ্ছন্ বিষন্নতা।শীতের সন্ধ্যা হতে না হতে কৃষকের কুঠির দ্বারে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় কৃষক ও কৃষক বধু আরাম করে বিছানায় বসে রয়েছে। দূরে সর্ষে হলুদ ফুলের সতরভা প্রজাপতি রঙের বাহার দাঁড়িয়েছে। রাস্তার ধারে বাড়ি গুলো থেকে গাঁদা,ডালিয়া, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা সুগন্ধি ভেসে আসছে। কৌতুহলী রাজা, কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও গাড়ির কাচটি সরিয়ে দিয়ে, প্রাকৃতিক দৃশ্য অনুভব করতে লাগলো। এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য সে, তার জীবনে প্রথমবার দেখছে। আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপী বঙ্গভূমি, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সুন্দর এই বাংলা।সন্ধ্যার কুয়াশায় অস্পষ্টতা দূরের ছোট ছোট পাহাড় বা টিলা গুলি, চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এমন দৃশ্য দেখে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন মনে পরল,
"যেন একরাশ ধোঁয়াটে মেঘ যেন
কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে
আসলে ওটা মেঘ নয় গারো
পাহাড়"।
সোনার বাংলার, প্রাকৃতিক রূপ দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেল তা টের করতে পারলো না। এখানে পৌঁছেও সমস্যা, তার যেন পিছু ছাড়লো না। সেই ঘড়ির দেখল। তখন রাত 8:00। রাত আটটার মধ্যে প্রায় সমস্ত দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। এটা দেখে, সে মোটেও চিন্তা করলো না। এটা শহর নয়, যে রাত বারোটা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকবে। এটা গ্রাম, এখানে রাত তাড়াতাড়ি নামে তার উপর শীতকাল। শহরের, রাতটা অনেক দেরিতে নামে, তাও আবার অল্প সময়ের জন্য।
আগন্তুক, অচেনা মুখ রাজাকে দেখে একটিমাত্র দোকানদার, তার দোকানটি বন্ধ করতে গিয়ে থামলেন।
- আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া।
তার কাছে এই শব্দটি অচেনা নয়। তবুও, সে ঠিকঠাক উচ্চারণের ভয়ে নিজের ধর্মের সালাম জানালো।
-নমস্কার আঙ্কেল।
-দেখে তো অচেনা মনে হচ্ছে! তা কোথায় যাওয়া হবে?
সে এই সুযোগ ছাড়তে চাইলেও না। এই আঙ্কেল একমাত্র পারে, তার বাড়ির পথ দেখিয়ে দিতে।
- সোনালী পুরে, সুনয়না দেবীর বাড়িতে। আপনি কি,আমাকে উনার বাড়ির রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে পারবেন!
কথাটি শুনে, লোকটি চমকে উঠলো। একটু হালকা স্বরে বললেন,
- কিন্তু...... আমি যতোটুকু জানি সুনয়না দেবী আজ থেকে 18 বছর আগে মারা গেছেন। তারপরই, উনার স্বামী,ছেলে সবাই ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন। এখানে তো কেউ থাকেনা।
- হ্যাঁ জানি......., আমি উনারই হতভাগা ছেলে। যাকে জন্ম দিতে গিয়ে, নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
- দুঃখিত, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমাকে রাস্তাটা দেখান। অনেক রাত হলোতো, আমাকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে।
-কিন্তু এত রাতে, তুমি একা বাড়ি কি করে যাবে! বাড়ির দেখাশোনা যিনি করেন তিনি নিশ্চয়ই, এতক্ষণে উনার বাড়ি ফিরে গেছেন। তুমি বরং আমার বাড়িতে চলো। কাল সকালে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসব।
- না, তা কি করে হয়! আন্টিকে বলে দেওয়া হয়েছে আমি আজই আসবো। উনিতো, আবার আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন।
- তাহলে, আর কি! ডান দিকে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও।
- হ্যাঁ যাবো, থ্যাংকস।
কিছুটা যাওয়ার পর, লোকটি আবার পিছনে ডাকলো,
-ভাইয়া।
- জি বলেন।
-তোমার কাছে মোবাইল আছে তো!
-না আসলে ভুলে ফেলে এসেছি।
-তাহলে, অন্ধকারে কি করে বাড়ি ফিরবেন?
-কোনরকম চলে যাব।
-না, রাস্তাটা খুব ভয়ঙ্কর। তুমি বরং আমার টর্চ লাইটটা নিয়ে যাও।
-তাহলে আপনি কি করে বাড়ি ফিরবেন?
-আমিতো মেন রাস্তা দিয়ে যাব। তাছাড়া আমি ওই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি। আমার কোন অসুবিধা হবেনা।
-ওকে, থ্যাংকস। চিন্তা করবেন না, আমি এখানে তিন বছর থাকবো,আপনার টর্চ ঠিক পেয়ে যাবেন।
তিন বছর কথাটি শুনে লোকটি একটু ঘাবড়ে গেলেন। তারপর তিনি বললেন,
-তিন বছর, তুমি এখানে কি করবে?
-কেন? পড়াশুনা করব।
কথাটি শুনে লোকটি খিলখিল করে হেসে উঠলেন
রাজা যেন কোন এক হাসির কথা বলল। রাজা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
-এতে হাসার কি আছে!
-হাসবো না, তোমার দেশে এত বড় বড় কলেজ থাকতে, তুমি শেষ পর্যন্ত কিনা থার্ড ওয়াল্ড কান্ট্রি বাংলাদেশ পড়াশোনা করতে এসেছ।
রাজাও উনার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন,
-নিজেরা যদি নিজের দেশকে ঘৃণা করো, তাহলে বিদেশীরা করবে না কেন?
-কিন্তু.... কথাগুলো তো সত্যি!
-কোনটাই সত্যি নয়।
Part 2
চারিদিকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা। দূরে বা কাছে কি আছে, তার দেখার উপায় নেই। টচ লাইট টা জালিয়ে দ্রুত পায়ে, সে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া, তার শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। চারিদিকে নিস্তব্ধ তার মাঝে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দু-চারটি বাদুড় চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। সে এদিকে ওদিকে দেখল, কোথাও বাড়ি আছে কিনা! লোকটির কথা মত,সে যদি উনার বাড়িতে চলে যেতেন তাহলে এমন বিপদ আসতো না। সে শহরে আলোকউজ্জ্বল ময় পথে বড় হয়েছে। গ্রামে এমন বিকট অন্ধকার তার শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ভূতের ভয় যে, তার মধ্যে নেই সেটা বলা ভুল। সে ভূতকে ভীষণ ভয় পায়। এমন সব অদ্ভুত কথা ভাবছে। হঠাৎ, তারসামনে কেউ একটা হ্যারিকেনের ছোটো আলো নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। সেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। এমন ভূতের গল্প সে গল্পের বইতে কম পড়েনি। কিন্তু বুঝতে পারেনি, একদিন তাকে সত্যি সত্যি ভূতের মুখোমুখি হতে হবে।
-আরে রাজা ভাই! তুমি এখানে!
বিপরীতমুখী নারী কন্ঠ শুনে, রাজা একটু ইতস্তত বোধ করলেও, ওর মন থেকে ভয় টা কেটে যায়। এই বিদেশে থাকে একমাত্র উনার বাড়ি, যিনি দেখাশোনা করেন তিনি ছাড়া, আর তাকে কেউ চেনে না। নিশ্চয়ই ওর যেতে দেরী হচ্ছে দেখে, আন্টি এগিয়ে এসেছেন। তবুও না চেনার ভান করে সে বলল,
-হ্যাঁ.... কিন্তু আমিতো, আপনাকে চিনতে পারলাম না।
-আমি আরাধ্যা, ভুলে গেছো দেখছি!
আরাধ্যার নামটা তার কাছে নতুন নয়। সেই যখন বাংলাদেশে ছিল, তার প্রতিবেশী ছিল আরাধ্যা। বয়সে রাজা চাইতে 5 বছরের বড় হলেও সম্পর্ক ছিল বেশ মধুর। যদিও রাজার এসব কিছুই মনে নেই। কারণ তখন সে অনেক ছোট ছিল। আরাধ্যার সাথে, তারা লাস্ট যখন দেখা হয় তখন তার বয়স ছিল তিন বছর।আরাধ্যার সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছ সবকটাই ওর ঠাম্মির কাছ থেকে।
-না, ভুলব কেন! তোমার, আমাকে চিনতে অসুবিধা হলো না।
আরাধ্যা কথাটি এড়িয়ে গেল। সে বলল,
-তুমি এত রাতে কোথায় যাবে?
-আমিতো বাড়ি ফিরব। আমাকে একটু পৌঁছে দেবে।
-কিন্তু, এত রাতে কি করে যাবে?
-কেন? তোমার বাড়িওতো ওইখানে, তুমিও তো নিশ্চয়ই যাবে!
-হ্যাঁ, 15 বছর আগে আমার বাড়ি ওইখানে ছিল। কিন্তু আমরা এখন এখানে থাকি।
কি উত্তর দিবে রাজা তা বুঝতে পারছেনা। তাও বলল,
-ওওওও
-হ্যাঁ, তুমি বরং আজ রাতে আমাদের বাড়িতে থেকে যাও। কাল সকালে চলে যাবে।
ভীতু রাজা আর না বলল না। একবার না বলে সে..........
-আচ্ছা চলো।
তারপর, আরাধ্যার পিছনে পিছনে, সে গল্প করতে করতে চলল। তার ঠাম্মি কেমন আছি? পড়াশুনা কেমন হচ্ছে, কলকাতা শহর কেমন? এই নিয়ে তারা গল্প করতে লাগলো।
সবকিছু ঠিক থাকলেও, মনে হল আরাধ্যার চোখটা ওর নিজের নয়। চোখটা স্বাভাবিক মানুষের নয়। ভিশন লাল,যেন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র।
ঘরে পৌছেই আরাধ্যা বলল,
-নে হাত মুখ ধুয়ে আয়! আমি ভাত বাড়ছি, অনেক দূর থেকে এসেছিস খিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
রাজা বাধ্য ছেলের মতো কোনো রকম প্রশ্ন না করে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। সে সত্যি ভীষণ ক্লান্ত। সারাদিন কম ধকল যায়নি, তার উপর দিয়ে। খেতে বসে রাজা তার কাকু কাকিমা কে না দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল,
-দিদিভাই, কাকু কাকিমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
আরাধ্যা ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
-বাবা-মা, মামার বাড়ি গেছে। বাড়িতে আমি একা।
কথা শুনে ভাতটা রাজার গলায় লেগে গেল। একটু জল খিয়ে বলল,
-এখানে তো আসে পাশে কোন বাড়ী নেই। তোমার ভয় লাগছে না?
-না, আমি ভয় পাই না। তুমি রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
-হ্যাঁ, তুমি ঘুমাবেনা?
-হ্যাঁ ঘুমাবো, তুমিতো খেয়ে নিলে। আমি খাই দিলে ঘুমাবো, আরাধ্যা হাসতে হাসতে বলল।
রাজাও আরাধ্যা দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে, আর সাত-পাচ না ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম সে জানেনা।
রাজা নিশ্চিন্তভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আরাধ্যা প্রথমে রাজার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর নিজের গলায় একটি লকেট বের করে হাতে নেয়।তা দিয়ে রাজার একটি হাতের কনুই থেকে শুরু করে কব্জি অব্দি সোজাসুজি বরাবর টান দেয় আরাধ্যা। রাজার কোন নড়াচড়া নেই। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস আছে তার। গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। আরাধ্যার নাক ডুবিয়ে তার গন্ধ নেওয়া শুরু করে। রাজা মারা যাচ্ছে,কিছুক্ষণ পর পা দুটি এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করার পরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। আর আরাধ্যা খুব নিখুঁত ও যত্ন সহকারে রাজার গায়ের চামড়া ছড়াচ্ছে আর খাছে সাথে মুখে অট্টহাসি।তারপর আরাধ্যা, রাজার পেটের ভেতর হাত ভরে হৃদপিণ্ডটা বের করে আনল। রাজা পুরো নিস্তেজ।কিছুক্ষণ পর ফারজানার ডাকে রাজা একটা আর্তনাদ করে জেগে উঠে।
-রাজা ভাই! রাজা ভাই! কি হয়েছে তোমার?
রাজা ধড়পড় উঠে হাপাতে লাগলো। এমন ঠান্ডার মধ্যেও, সে পুরো ঘেমে গেছে। হাপাতে হাপাতে বলল,
-না, কিছু না।
-রাজা ভাই, কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছো বুঝি!
রাজা অনেকক্ষণ চুপচাপ। বেশ খানিকক্ষণ পর সে নিচুস্বরে বলল,
- হ্যাঁ,
-তুমি ভীষণ ক্লান্ত, তার উপর নতুন জায়গা তাই একটু ভয় পেয়েছো। আমি তোমার কাছে বসে আছি।ঘুমিয়ে পড়ো।
তারপর, আরাধ্যা রাজার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে, একটা সুরেলা কন্ঠে গান ধরল। আরাধ্যা, রাজার নিজের দিদি নয়। তবুও, কখনো রাজাকে নিজের ভাই না, এটা কোনদিন ভাবেনি। দিদির স্নেহ পেয়ে রাজার চোখে আবার ঘুম জড়িয়ে আসে। কিন্তু, এবারও তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিল না। ভোর চারটা হতে না হতেই আরাধ্যা ডাক দিল,
-রাজা ভাই! রাজা ভাই! উঠে পড়ো, ভোর হয়ে গেছে।
চোখে একরাশ ঘুম নিয়ে রাজা উঠে পড়ল। সে
আরাধ্যা দিকে তাকিয়ে বলল,
-কই ভোর হয়েছে! এখনো তো অন্ধকার আছে।
-আসলে, এটাতো গ্রাম। সকালে সবাই যদি জানতে পেরে যায়, আমরা দুজন বাড়িতে কেউ নেই তাও একই সঙ্গে রাত কাটিয়েছি, তাহলে ওরা অনেক কথা শোনাবে।
-হুম, দিদিভাই, আমি বুঝতে পারছি।
-তাহলে আসছি।
আরাধ্যাকে বিদায় জানিয়ে রাজা অন্ধকার পথে আবার বেরিয়ে পরলো। শীতকাল, ভোর চারটায় ও অনেক অন্ধকার। কোন দিকে যাবে, কি করবে কোন উপায় না পেয়ে, সে একটা গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
দেখতে দেখতে, পুবআকাশে লালা আভায় ভরে গেল। রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে একটি রৌদ্রদীপ্ত দিনকে উপহারস্বরুপ শ্যামা ধরিত্রীর হাতে তুলে দেয় যে সে উসা তপনের দ্রুতি, অরুণ রমণী।
ঊষার আবির্ভাবে রাত্রি বিদায় নেয়।শ্রমিকেরা কাজে বেরিয়ে যায়। ছোট ছোট বাচ্চারা বাড়িতে বসে পড়ায় মনোযোগী হলো। পাখিরা খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেল গান করতে করতে। নতুন দেশে প্রথম সূর্যের আলো, রাজার ফর্সা গালে চকচক করে উঠলো। সূর্যের তাপে,তার ঘুম ভাঙলো। তবুও সে উঠলো না। অপেক্ষা করতে লাগল, কেউ যদি ওই রাস্তা দিয়ে যায়। নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করবে। কিন্তু 'সেগুড়ে বালি'কেউ এলোনা। কোন উপায় না দেখে, সে আবার হাঁটতে শুরু করল। বেশ খানিকটা হেঁটে যাওয়ার পর, সে আবার বিপদে পড়লো। তিন দিকে রাস্তা, কোন দিকে, তার বাড়ির রাস্তা সে বুঝতে পারল না। এবার খানিকটা হলেও সে বিরক্ত বোধ করলো। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ভাবছে এটা যেন এক নতুন পৃথিবী।
এদিকে ফারজানা সদ্য সাইকেল চালানো শিখেছে। বলতে গেলে এই রাস্তায় ফারজানাই দৈনিক পথচারী। প্রতিদিন ওই একমাত্র এই রাস্তা দিয়ে কলেজ যায় আবার আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালাচ্ছে সে। হঠাৎ রাজাকে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ফারজানা চিৎকার করতে লাগলো'সরে যান, সরে যান'। রাজা সরতে না সরতে ফারজানার সাইকেল রাজাকে ধাক্কা মারলো। রাজা কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে, ফারজানা দিকে তাকালো। মেয়েটির পোশাক-আশাক দেখে বোঝা যায়। সে নিশ্চয়ই মুসলিম। মেয়েটি পড়ে যাওয়ায় তার মাথার হিজাব টা সরে গেছে। তাই মুখটা বেশ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে রাজা, ফারজানার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে দেখে রাজার চোখে রীতিমতো কপালে উঠে গেছে। এত সুন্দর মানুষ হয়!
-কি ভাইয়া! এত ভূত দেখার মত তাকিয়ে আছেন কেন!
-আমি নারী, পরী নই......
-আপনি পরীদের থেকেও অনেক সুন্দর।
কথাটি রাজার মুখ থেকে যেন আপনা আপনি বেরিয়ে এলো। এমন প্রশংসা সে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে করেনি। প্রথম দেখাতে এমন সুনামক পিয়ে ফারজানা একটু খুশি হলো। সে, নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়ল।
-আপনার কোথাও লাগে নি তো?
-না ,একটু পায়ে.....
-তাহলে উঠে পড়ুন।রাস্তায় পড়ে থাকবেন না।তাতে আমার খারাপ লাগবে।
রাজা একটু লজ্জা বোধ করল। মেয়েটি আবার বলল,
-আমি নতুন সাইকেল চালানো শিখেছি।তাই.….....
রাজা মেয়েটির কথায় কান দিলো না। তার কাছে এটাই সুযোগ, এই মেয়েটি তাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি কি না,তা একবার দেখার চেষ্টা করল। সে কোন কথা না ভেবে মেয়েটিকে বলল,
-আচ্ছা, আপনি কি সোনালীপুরে, সুনয়না দেবী বাড়ি চেনেন?
-হ্যাঁ চিনি, কিন্তু ওই বাড়িতে তো কেউ থাকেনা।
-জানি, আমি উনারই ছেলে।
ফারজানা হা হা করে হেসে উঠলো। তার হাসির কারণ রাজা বুঝতে পারলাম না।
-ভাইয়া, আপনি সোনালী পুরের যাওয়ার রাস্তা জানেন না ওটা বলুন, মিছামিছি একজন ভদ্রমহিলাকে আপনার মা বানাচ্ছেন কেন?
-মিথ্যা বলছি না, উনি সত্যিই আমার মা।
-আপনি কি আমাকে পাগল ভাবেন। সুনয়না দেবী মারা যাওয়ার পর উনার স্বামী, ছেলে সবাই ইন্ডিয়ায় থাকে। তারা এত সকালে নিশ্চয়ই উড়ে আসবে না। নিশ্চয়ই অনেকটা সময় লাগবে।
কথাগুলো শুনে রাজার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো।নিজের দেশে এসে প্রথমে ওকে নিজের মা টা আসল না নকল,সেটার পরিচয় দিতে হচ্ছে। রাজার চোখের জল দেখে সে বলল,
-আপনি কাঁদছেন কেন?
রাজার নিজের গলা থেকে একটা লকেট বের করে খুলে ফেলল, তার ভেতর তার মা-বাবার সাথে, তার ছোটবেলার ছবি।
-এই দেখুন। আমার মা সুনয়না দেবীর সাথে আমি।
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে বললেন,
-তাহলে আপনি সত্যিই ভিনদেশী?
-না আমি ভিনদেশী নই। বাংলাদেশই আমার জন্ম।
-ওওও। কিন্তু এত সকালে আপনি এখানে কি করে এলেন? ঢাকা থেকে আসতে তো ন্যূনতম একটা সময় লাগবে।
-হ্যাঁ আমি কাল বিকালে এসেছি।
- তাহলে সারারাত কি এই মাঠে বসে ছিলেন?
-না, আরাধ্যার বাড়িতে ছিলাম।
আরাধ্যার নামটা শোনার সাথে সাথে ফারজানার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। এক লাভে সে রাজার থেকে অনেক দূরে চলে গেল। তারপর বেশ অনেকক্ষণ নীরবতা। ফারজানা আবার কাছে এসে বলল,
-আপনি, আমার হাতে চিমটি কাটুন তো।
রাজা কাছে, আর কোন উপায় নেই তাই বাধ্য হয়ে ওর হাতে চিমটি কাটলো।
-লাগছে, মানে আমি বেঁচে আছি।
-হ্যাঁ, বেঁচে থাকবেন না কেন?
না, আমি ভেবেছিলাম অ্যাক্সিডেন্টের পর আমরা দুজনই মারা গেছি।
-পাগল নাকি! ওইটুকু এক্সিডেন্টে কেউ মারা যায়।
ফারজানা কোন কথা না বলে, রাজারহাতে চিমটি কাটলো। সাথে সাথে রাজা আঁতকে উঠলো।
-কি করছেন লাগছে তো।
-লাগছে মানে তুমিও বেঁচে আছো।
-আচ্ছা পাজি মেয়ে তো তুমি। বলছি না আমরা দুজনই বেঁচে আছি।
-হ্যাঁ, বেঁচে আছি তো আরাধ্যা কোথা থেকে আসছে।
-কেন,আরাধ্যা কি করলো?
- কারণ আরাধ্যা আজ থেকে দু বছর আগে মারা গেছে। আর ওখানে কোনো বাড়ি নেই যেটা আছে সেটা অনেক পুরনো।
ফারজানাকে কি মনে হয় গল্পের নায়িকা না অন্য কেউ প্লিজ কমেন্ট করে জানাবেন।
Part 3 coming soon
0
15
It is very charming story. Thank you writer. Your article is very enjoyable. This post is amazing. Thanks