ঘুম ভাঙা ভোর থেকে শুরু করে ঘুম না আসা রাতের ঘোর পর্যন্ত জীবন ও জগতের অনিবার্য প্রয়োজন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্য যার মাধ্যমে অনায়াসে আমাদের আয়ত্তে আসে, তাকেই এক কথায় বলতে পারি বিজ্ঞান৷
বিচিত্র বিশ্বের বিস্ময়কর বার্তাবাহী, মানুষের দেহ ও মনের সামগ্রিক পূর্ণতা দানকারী, জীবন ও জড়জগতের রহস্যরাজ্য সমুদঘাটকারী বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সুন্দরতম বিকাশের সর্ব্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে আজ সম্পূর্ন সক্ষম। বিজ্ঞান তাই আজ আমাদের কাছে অনিবার্য আশীর্বাদ স্বরূপ ঠিকই কিন্তু তবু পাশাপাশি অস্তিত্ব চেতনার অস্তিমূলেই হেনে চলছে অবিশ্বাস্য আক্রমণ, নিত্যদিন চলছে ধ্বংস আর মৃত্যুর মহামরণযজ্ঞের প্রচন্ড প্রমত্ত প্রস্তুতি। মানুষের মাঝে তাই এ প্রশ্ন আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে - বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ??
★ বিজ্ঞানের "বিষ্ময়কর আবিষ্কার "
প্রাচীনকালে, বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতে এক ক্রীড়নক। গুহাবাসী সেই পশুসদৃশ মানুষ যখন প্রথম পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তারপর যেখানেই বাধার সসম্মুখীন হয়েছে, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, মানুষ ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। মানব সমাজের যেদিকেই দৃষ্টিপাত করা যায়, শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিজ্ঞানের শক্তিতে মানুষ জল, স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে, মানুষের সংকট নিবারণের ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। বিদ্যুৎ, আণবিক শক্তি, কম্পিউটার প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর আবিষ্কার।
★ বিজ্ঞানের "প্রভাব "
বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আজ নানাবিধ যন্ত্র আবিষ্কার করে কাজে লাগিয়ে জয় করেছে নিত্যদিনের সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনন্য অধিকার। গতানুগতি অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অলস ও বিশৃঙ্খল মনোবৃত্তির বদলে বিজ্ঞান আজ তাকে করে তুলেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী শক্তিতে তীক্ষ্ণতর, কর্মকুশলী, নিয়মনিষ্ঠ, নিরলস, ও সুশৃঙ্খল। তার গতি আজ অক্লান্ত ও অবাধ, দুর্বার, দুর্জয়। সেই শক্তিই আজ তাকে দিয়েছে নতুনভাবে স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার সবচেয়ে সুন্দর ও সার্থক।
মানুষের আরাম আয়েশ ও সার্বিক সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য নিত্যনতুন অবদানের আজ অন্ত নেই। আলো, পাখা, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ, ফ্রিজ, হিটার, প্রেসার-কুকার থেকে শুরু করে টিভি, টেপরেকর্ডার, ভিসিআর, সিনেমা, ক্যাসেট প্রভৃতি সাজসরঞ্জাম উন্নতর পোশাক ও প্রসাধনী তাকে আজ সমৃদ্ধির চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। সক্ষম হয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই পাহাড়-পর্বত কেটে উড়িয়ে নিজের মনমতরুপে তাকে ব্যবহার করতে। সক্ষম হয়েছে মরুভূমিকে সমৃদ্ধ করে আবাদ করার মতো যোগ্যতা। মানুষের পৃথিবীকে সরল ও সুন্দর সহাস্য ও স্বর্গস্বরুপ করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের অবদান তাই অতুলনীয়। সে অর্থে বিজ্ঞান "আশীর্বাদ "ঠিকই।
★ বিজ্ঞানের "অভিশাপ "
দৈনন্দিন জীবনকে সুখী ও সুন্দরতম করে তুলতে বিচিত্র বিজ্ঞানের অবদানের একদিকে যেমন শেষ নেই, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এই বিজ্ঞানই মানুষের জীবনের আশা আনন্দ, সুখ-সমৃদ্ধিকে নসাৎ করতেও কিছু কম করেনি। স্বয়ংক্রিয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র মানুষের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করার পরপরই অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। দ্রুত শিল্পায়ন, যন্ত্রশিল্প -কারখানা ইত্যাদি আজ বিশ্বপরিবেশকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দিকে। নষ্ট করে দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বিজ্ঞানের বদৌলতে উদ্ভাবিত মারণাস্ত্র মহাযজ্ঞ মানুষকে আজ তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই সংশায়কুল করে তুলেছে। রকমারী মারণাস্ত্র, মহাজাগতিক রশ্মির সাহায্যে আরও উন্নতর ধ্বংসাত্মক অস্র উৎপাদন ও পরীক্ষা প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন বিচিত্র যুদ্ধের শক্তিশালী সাজসরঞ্জাম ও মদমত্ত আধিপত্যবাদের হুমকি সুস্থ মানুষের সুখ সমৃদ্ধি নসাৎ করে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের শক্তিতে বলীয়ান স্বার্থবাদীরা পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে অশিক্ষায় ও অত্যাচারে জর্জরিত করে মারছে। সরল সাধারণ মানুষের মন ও পরিবেশকে বিজ্ঞান আজ করে তুলেছে জটিল, কুটিল, অতৃপ্ত, সন্দেহপরায়ণ, স্বার্থান্ধ ও যান্ত্রিক। মানুষের ন্যায়-নীতি, শুভবুদ্ধি, সাম্য স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আজ বলদর্পীদে বিজ্ঞানের সহায়তায় সম্পুর্নভাবে অস্বীকৃত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ আজ বিজ্ঞানকে ভাবতে শুরু করছে অনিবার্য অভিশাপ বলে। তাই কবি এক কাব্যিক ছন্দে আহবান করেছেন~
"মাটি থেকে কবর উৎপাট এক সঙ্গে সবচেয়ে লম্বা দেবদারু,
যেখানে তার শিকড় ছিল আগে সেই গর্তে ফেলব ছুঁড়ে আমাদের সব অস্র।"
সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, প্রচন্ড শক্তিশালী বিজ্ঞান নিজে নিজেই আশীর্বাদ বা অভিশাপ কোন কিছু নয়। আসলে তার মূল সমস্যা হচ্ছে তার ব্যবহারকারীকে সচেতন সঙ্গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে যে আণবিক বোমা মুহূর্তের মধ্যে নাগাসাকি, হিরোশিমাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে তুলেছিল, সেই আণবিক শক্তির সাহায্যেই আজ রেডিও আইসোটোপের দ্বারা মৃত্যমুখী মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধিত হচ্ছে-দুরারোগ্য ব্যাধির কবল থেকে মানুষ আজ মুক্তি পাচ্ছে। তাই বিজ্ঞানের ব্যবহারের দিকেই বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার।
যে আগুন মানুষের সেবা করে, সে আগুনই আবার মুহূর্তের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। এর জন্য দোষ তো আগুনের নয়, দোষ তার ব্যবহারকারীর। ঠিক তেমনি বিজ্ঞানকে অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে কল্যাণের কাজে তাকে ঠিকমতো লাগালে সে সত্যি সত্যিই হয়ে উঠবে আকাংকিত "আশীর্বাদ", "অভিশাপ" নয়।
বিঃদ্রঃ ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে Unsplash থেকে।
...and you will also help the author collect more tips.