আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কীভাবে লাভ করে?

4 17
Avatar for JosiKhan
4 years ago

ভারতে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর দ্বাদশ আসর। আইপিএল মানেই যে অর্থের ছড়াছড়ি, এমন বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যেন টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় নিলাম অনুষ্ঠানে। কোটি কোটি রুপিতে তারা দলে ভেড়ায় একেকজন তারকা ক্রিকেটারকে। এমনকি নিতান্তই অখ্যাত, অপরিচিত ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার জন্যও অনেক সময় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা ব্যয় করে, তা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠে সাধারণ ক্রিকেট সমর্থকদের। পাশাপাশি একটি প্রশ্নও কমবেশি সবার মনের কোণেই উঁকি দিয়ে যায়: ক্রিকেটারদের পেছনে এত অর্থ কীভাবে খরচ করে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো? এত এত অর্থ খরচের পর আদৌ কি তাদের হাতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? কীসের আশায় তারা প্রতিবছর আইপিএলকে কেন্দ্র করে এতটা মেতে ওঠে?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সবকিছুতে লাভ-ক্ষতির হিসাব দেখার কী-ই বা প্রয়োজন! ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবাসে, তাই তারা আইপিএলে দল কেনে, আর সব কাজ বাদ দিয়ে আইপিএল নিয়েই কয়েকটা মাস ব্যস্ত থাকে। কিন্তু না, প্রকৃত বাস্তবতা মোটেই সেরকম না। আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই বিশাল বড় ব্যবসায়ী। ক্রিকেট নয়, ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতিই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আইপিএল থেকে লাভ না হলে, খামোখা তারা একে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। আইপিএল তাদের জন্য দারুণ অর্থকরী ও লাভজনক বলেই, বছরের বড় একটা সময় তারা খুশিমনে আইপিএলের পেছনে ব্যয় করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো দল মাঠের খেলায় একদমই সুবিধা করতে না পারলেও, সেসব ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক মোটেই হতাশ হয়ে পড়ে না, বরং পরের বছর ঠিকই আবার নতুন উদ্যমে দল গোছানো শুরু করে দেয়।

এখন চলুন পাঠক, জেনে নিই আইপিলে অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভের উৎস কী, কেনই বা আইপিএলকে কেন্দ্র করে তাদের এত মাতামাতি।

মিডিয়া স্বত্ত্ব

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। প্রাথমিকভাবে এই অর্থ বিসিসিআই গ্রহণ করে, এবং তারপর তারা প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট হারে তাদের ভাগের অর্থ বুঝিয়ে দেয়।

এক্ষেত্রে কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি কয়টি ম্যাচ খেলেছে, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলেছে, অর্থাৎ কাদের ম্যাচে বেশি দর্শক হয়েছে, এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, রাউন্ড রবিন লিগ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ যে অর্থ পায়, তার তুলনায় প্লে অফ খেলা দলগুলো বেশি অর্থ পায়। আর সবচেয়ে বেশি অর্থ পায় ফাইনালে খেলা দুটি দল। এছাড়া সম্প্রচারকারী চ্যানেল যদি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা তাদের নির্দিষ্ট এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করতে চায়, সে বাবদও ওই ফ্র্যাঞ্চাইজি মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে।

মিডিয়া সত্ত্ব থেকেই প্রতিটি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ৬০-৭০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হলো ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কয়েকটি ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, এবং নিজেদের জার্সি ও টিম কিটে সেসব ব্র্যান্ডের লোগো প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপন করে থাকে। এমনকি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের হোম গ্রাউন্ডের বাউন্ডারির বাইরে কোনো ব্র্যান্ডের লোগোসমৃদ্ধ ব্যারিকেড লাগিয়েও অর্থ পেয়ে থাকে।

এছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে চুক্তি মোতাবেক, ব্র্যান্ডগুলো চাইলে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে কোনো বিশেষ ইভেন্টের আয়োজনও করতে পারে। এছাড়া অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়রাই তাদের প্রধান স্পন্সর ব্র্যান্ডের টিভি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে থাকে। এগুলোর মাধ্যমেও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সরশিপ থেকেই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ২০-৩০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

টিকিট বিক্রি

ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের হোম ম্যাচের জন্য টিকিট বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ পেয়ে থাকে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরাই মূলত হোম ম্যাচের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের সামান্য অংশ স্পন্সর এবং বিসিসিআইকে দেয়া হয়, আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অর্থই চলে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পকেটে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা তাদের ইচ্ছামতো টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে বটে, তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়: তাদের হোম গ্রাউন্ডের দর্শক ধারণক্ষমতা, তাদের দলের জনপ্রিয়তা, ঐ শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি। এছাড়া টিকিটের দাম যেন এত বেশি হয়ে না যায় যে তা আগ্রহী দর্শকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়।

আইপিএল কর্তৃপক্ষ চায়, যেকোনো ভাবেই হোক, গ্যালারির একটি আসনও যেন ফাঁকা না থাকে, এবং টিভিতে বসে খেলা দেখা দর্শকদের যেন মনে হয় এবারের আসর খুবই হিট হয়েছে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে, ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা অনেক সময় টিকিট বাবদ ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেও বাধ্য হয়, যাতে খুব বেশি আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও দর্শক স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখে।

টিকিট বিক্রি থেকে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মোট লাভের ১০ শতাংশের মতো উঠে আসে।

প্রাইজ মানি

প্রাইজ মানি বাবদও অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল চেন্নাই সুপার কিংস প্রাইজ মানি হিসেবে পেয়েছিল মোট ২০ কোটি রুপি। এই অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ কোটি রুপি দলের পুরো স্কোয়াড ও কোচিং স্টাফদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, আর ১০ কোটি রুপি পেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক। এছাড়া রানার্স-আপ দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ পেয়েছিল ১২.৫ কোটি রুপি। প্লে-অফ খেলা বাকি দুই দলও বেশ ভালো প্রাইজ মানি পেয়েছিল।

মার্চেন্ডাইজ বিক্রি

ক্লাব ফুটবলে মার্চেন্ডাইজ বিক্রয়ী একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মোট লাভের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। সে তুলনায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। তাদের মোট লাভের মাত্র ৫ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না, ক্লাব ফুটবল চলে প্রায় সারা বছর ধরে, সে তুলনায় আইপিএলের উন্মাদনা থাকে বছরে মাস দুয়েক। তাই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মার্চেন্ডাইজ বিক্রি বাবদ এর চেয়ে বেশি লাভ করা কঠিনই বটে। তারপরও, প্রতি বছরই মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ বাড়ছে। আইপিএল তো সবে ১২ বছরে পা দিল। আজ থেকে আরো পাঁচ বা দশ বছর পর হয়তো মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই মার্চেন্ডাইজ হিসেবে তাদের মূল জার্সির রেপ্লিকা, টুপি, ঘড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। এই খাতে অদূর ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিসিসিআই সেন্ট্রাল পুল

বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ অর্থ তো পায়ই, এর পাশাপাশি তারা আইপিএলের অফিসিয়াল স্পন্সরশিপ ও পার্টনারশিপ বাবদও অর্থ পেয়ে থাকে। বিসিসিআইয়ের সেন্ট্রাল পুল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ অর্থ লাভ করবে, তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো লিগ টেবিলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অবস্থান।

স্টল ভাড়া

প্রতিটি ম্যাচ চলাকালীনই দর্শকরা যাতে খাবার ও পানীয় কিনতে পারে, সেজন্য স্টেডিয়ামের ভেতর স্টল বসে। কিন্তু এসব স্টল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা নিজেরা চালায় না। তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে স্টল ভাড়া দেয়, এবং তার বিনিময়ে তারা অর্থ পায়। সাধারণত তৃতীয় পক্ষের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর চুক্তি প্রতি ম্যাচ করে বর্ধিত করা হয়, এবং এ খাতে প্রতিটি স্টল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ নিয়ে থাকে।

প্লেয়ার ট্রেডিং

প্রতি বছর আইপিএলের আগে একটি নিলাম অনুষ্ঠান হয়। তবে এর আগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মতো করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রান্সফার উইন্ডোও খোলা হয়। এই সময়ের মধ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় অদল-বদল করতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি একজন খুব বড় তারকা খেলোয়াড়ের বদলে নিজেদের দলে একজন সাধারণ বা গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় নিচ্ছে, এবং সেই সাথে তারা মোটা অংকের অর্থ 'ক্ষতিপূরণ' হিসেবেও পেয়ে যাচ্ছে।

নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা

স্পন্সরদের বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, সেই সাথে আইপিএল কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালানোরও খুব বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই খুব বড় ব্যবসায়ী, ফলে তাদের অসংখ্য ছোট-বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনার মাধ্যমে তারা তাদের সেসব ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের মুফতে প্রচারণাও কিন্তু চালাতে পারছেন।

শেষ কথা

এতক্ষণ তো বলা হলো আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কীভাবে লাভ করে থাকে। কিন্তু আপনাদের আগ্রহ নিশ্চয়ই এখনো মেটেনি? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, প্রতি বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ লাভ করে থাকে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ মৌসুমে আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কমপক্ষে ৭৫ কোটি রুপি করে লাভ করেছে। আর কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি নাকি ১০০ থেকে ১২৫ কোটি রুপি পর্যন্তও লাভ করেছে।

5
$ 0.00
Avatar for JosiKhan
4 years ago

Comments

You gathered some interesting points what was unknown to me. From your article i come to know that. Best wishes for ipl 2020

$ 0.00
4 years ago

অনেক সুন্দর হয়েছে ভাই

$ 0.00
4 years ago

It's wonderful i love it ❤️

$ 0.00
4 years ago