চারপাশে সব কিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চেনা জগৎটা কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। জানি না হয়তো সব ঠিকই আছে আমিই বদলে যাচ্ছি। আজ দিনটা আমার । কেন এমন মনে হচ্ছে জানি না। সব প্রশ্নের উত্তর জানা উচিৎ না। এটাও না হয় নাইবা জানলাম।
সামনের হোটেলটার নাম রহমত হোটেল । অনেক জীর্ণ । হোটেলের ে- টা উঠে গেছে। তাই দেখাচ্ছে হাটেল । আমি ভিতরে ঢুকলাম। সামনের দিকের একটা টেবিলে বসলাম। আমার পাশে কালো পোশাক পরা তিন জন লোক বসলো। তারা চায়ের কথা বলল। দোকানের পিচ্চি ছেলেটা চার কাপ চা দিয়ে গেল।
আমার সামনে বসা সামান্য গোঁফ ওয়লা লোকটা যাকে হামিদ বলে ডাকছে, আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম
ঃ হামিদ ভাই ভালো আছেন?
ঃ জি ভাই আল্লাহ রাখছে কোন রকম। তো ভাই আপনাকে তো চিনলাম না?
ঃ মিষ্টিতো খাওয়ালেন না ভাই?
ঃ (অবাক হয়ে ) কীসের মিষ্টি ভাই? বুঝলাম না। আপনি কে?
ঃ আজ তো আপনার মেয়ে হবে।
তিন জনই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি উঠে চলে আসলাম । কাউকে চমকে দেয়ার একটা আলাদা মজা আছে।
মাথার উপরে সূর্যটা যেন একটু বেশি খেপেছে। আমি কোন একটা ফুটপাত দিয়ে হাটছি। মানুষ জনের মধ্যে অদ্ভুত ব্যস্ততা । সবাই নিজের মত করে ব্যস্ত। মোবাইল নামক বিভ্রান্তিকর যন্ত্রটা মানুষকে আরও ব্যস্ত করে দিয়েছে। সামনে একটা লাল রঙের প্রাডো দাড়িয়ে আছে। ভেতরে একটা মহিলা বসা। চেহারায় একটা বিরক্তি ভাব। হাতে একটা বিশাল মুঠোফোন। পাশে একটা ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়ে। আমি গাড়ির জানালার পাশে আসলাম।
ঃ আপা তিন দিন কিছু খাই নাই। ৫ টা টাহা দিবেন?
ঃ মাফ কর।
ঃ আপা একটা কথা বলি?
ঃ যা তো। বিরক্ত করিস না।
ঃ আপা আপনার মা হাসপাতালে।
দেখতে যাবেন না?
আমি চলে আসছি। মহিলার ফোন বেজে উঠল। উনি উত্তেজিত গলায় বলছেন,"কখন? কীভাবে? "
আমি হাসছি আর ভাবছি কাউকে চমকে দেয়ার একটা আলাদা মজা আছে।
বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান কিছুটা বেশি । বাতাসের সামান্য ঝাপটা এসে গায়ে লাগছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি মনের অপবিত্রতাকে দূর করে।
আমি এখন একটা ওভার ব্রিজের উপর হাটছি। ওভার ব্রিজ কে মনে হল আলাদা একটা জগৎ। অনেক ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে। একেক জনের ভিক্ষা করার ধরন ও একেক রকম। একজন আবার ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসেছে। চিৎকার করছে ওজন মাপেন, দুই টেকা দুই টেকা । সিড়ির কয়েক ধাপ পরেই দেখা গেল কয়েকজন নিশি কন্যা কে। সিঁড়ি দখল করে কয়েকজন আবার খিলি পান ও বিক্রি করছে। হালকা বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। ভিজতে বড় ভাল লাগছে। রূপার কথা ভীষণ মনে পরছে। জানি ভালো আছে। অনেক খানি ভালো। এখন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তা গুলোকে মনে হচ্ছে এক একটা নদী। প্রকৃতি মনে হয় তার সবটুকু রূপ নিয়ে আজ হাজির। বৃষ্টির সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়।
আমি হেটে চলেছি। সাথে আসছে একটা নেড়ি কুকুর। সে ও আমার সাথে হাটছে। আমি তার সাথে কথোপকথন চালানোর চেষ্টা করলাম।
অনেকটা এরকম.....
ঃ কিরে কেমন আছিস?
ঃ ঘেউ। (যার অর্থ ভালো বা খারাপ দুটাই হতে পারে)
ঃ বৃষ্টি তে ভিজছিস কেন? ঠান্ডা লাগবে তো?
ঃ ঘেউ ঘেউ।
ঃ তোর পরিবার কোথায়?
ঃ ঘেউ। (যার অর্থ যেকোনো কিছু হতে পারে)
ঃ তোর নাম কি?
ঃ ঘেউ। (আমি তার নাম ঘেউ ধরে নিলাম)
ঃ আচ্ছা ঘেউ জানিস,রূপা এখন কি করছে?
ঃ ঘেউ ঘেউ।
ঃ আমি ও জানি না। হা হা হা!!!
আমি এমন ভাবে হাসলাম যেন চমৎকার একটা রসিকতা হয়েছে। ঘেউ কি বুঝল কে জানে। সে ও মনে হয় দুই বার মাথা নাড়াল।জগৎ বড়ই রহস্যময়।
আমি এখন রূপাদের বাড়ির সামনে। রূপাদের বাড়িটা দোতালা।
দোতালার সামনে একটা প্রকাণ্ড বারান্দা আছে। আমি সেই বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগছে। একটু পর রূপা একটা নীল কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় আসলো। আজ সে একটা লাল শাড়ি পরেছে। ভীষন সুন্দর লাগছে তাকে। স্রষ্টা মনে হয় রূপ দিতে তাকে কার্পন্য করেননি। হঠাৎ রূপার চোখ পড়লো আমার দিকে। রূপা কিছু সময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অপলক দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টি যেই দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আমি চলে আসছি। রূপা আমাকে পেছন থেকে ডাকছে,
ঃ এই অভ্র শোন। এই অভ্র....!
আমি পেছন ফিরে তাকালাম না। ভালোবাসার মানুষের খুব কাছে কখনো যেতে নেই।
আমি এখন একটা হাসপাতালের সামনে। আমার সঙ্গি ঘেউ। কেন এখানে আসলাম তা জানি না। হয়তো যিনি সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি চান আমাকে এই সময় এখানে থাকি। সামনে একটা চায়ের স্টল। স্টল থেকে আমি একটা বেনসন ও হেযেস কিনলাম। বেনসন টা জ্বালাতেই দেখি আমার সামনে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মেয়েটি কে চিনতে পারলাম। মেয়েটি দুপুরে প্রাডো গাড়িতে বসে থাকা সেই মেয়েটি। সম্ভবত মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছিল। চোখের কাজল সারা গালে লেপ্টে আছে। এভাবেই তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এই কথাটা কি কেউ তাকে বলেছে?
মেয়েটি গম্ভীর গলায় বলল
ঃ আপনি কে?
ঃ এটা তো বড়ই কঠিন প্রশ্ন। জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ জানতে চেষ্টা করে সে কে? আমি এখনো জানতে চেষ্টা করছি আমি কে?
ঃ আপনি দুপুরে আমার মাকে বলেছিলেন আমার নানু হাসপাতালে। আপনি কি করে জানলেন আমার নানু হাসপাতালে? আপনি কি তাকে চিনেন?
ঃ সকল মানব সম্প্রদায়ই কোন না কোন ভাবে একে অন্যের সাথে যুক্ত। তবে তার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নি।।আমি তাকে চিনি না।
ঃ তাহলে আপনি মাকে এটা বললেন কেন?
সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না। আমি এটার উত্তর দিলাম না।
একটা রহস্যের হাসি হাসলাম। আমি চলে আসছি। মেয়েটি পেছন থেকে বলছেঃ আপনি কি করে জানলেন...?
বলুন না। প্লিজ!!!
আসলেই তো আমি কি করে জানলাম? তা তো জানি না। প্রকৃতি সব রহস্য উন্মোচন করে না। এটাও হয়তো করবে না।
কিন্তু আমি জানি। মেয়েটির নানু আজ রাতে মারা যাবে। তার পরপরই এই হাসপাতালে জন্ম হবে অসম্ভব রূপবতী একটি কন্যা শিশুর। বৃদ্ধ প্রাণ সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে নতুন প্রান কে। মেয়েটির বাবার নাম হামিদ। সে তার মেয়ের নাম রাখবে রূপা...!
আজ আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। জোছনা দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে। আমি হাটছি। আমার সঙ্গি ঘেউ।
আমি গান ধরলাম....
"আসমান ভাইঙ্গা জোছনা নামে
লইয়া সাদা প্রর,
সেই প্ররে ভাইসা যাইব
বন্ধু তোমার অন্তর ঘর.....!"
onek sundor hoise. Aro valo likhun.