রিকশায় উঠে বসেছে। কড়া রোদে শঙ্খের মতো সাদা কাশবন যেমন ঝলমল করে, ঠিক তেমনি ঝলমল করছে সাদা শাড়ি পড়া এই তরুণী। আর কিছুক্ষণ বাদেই প্রশান্তির এক গভীর স্রোত বয়ে যাবে তার ওপর দিয়ে। প্রণয়কে না দেখে কাটানো এক একটা মুহূর্ত যেন অসস্তিকর।
তাদের প্রথম দেখাটা ছিল প্রচণ্ড অদ্ভুত! প্রণয়ের বাবা অনিমার মায়ের অফিসের কলিগ। সেই সুবাদে কোনো এক ঈদের দুপুরে তাদের বাড়িতে দাওয়াতে যায় অনিমারা। ছেলেটাকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল অতি সাধারণ। সাধারণের মতো হাঁটাচলা, সাধারণের মতো কথাবার্তা। নিজেকে অতিচালাক মনে করা ওই ছেলেটির প্রতি আর যাইহোক, প্রেম জন্মায়নি অনিমার মনে।
বাড়িটা সেদিন গিজগিজ করছিল প্রণয়দের আত্মীয়দের ভীড়ে।
পরিবেশটাকে হাসিখুশি রাখার উদ্দেশ্যেই প্রণয় উঁচু গলায় বলে উঠলো, “আমি কি আপনাদেরকে একটু হাসাতে পারি?”
বয়স্ক ধরনের এক লোক বলে উঠেলন, “অবশ্যই! অবশ্যই!”
প্রণয় উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো, “স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ চলছে, ডিভোর্স হবে হবে এমন একটা অবস্থা। এখন সমস্যা হলো তাদের ছেলেটা কার কাছে থাকবে? স্ত্রী কোর্টে বলল, মেলর্ড! আমি দশ মাস দশ দিন কষ্ট সহ্য করে ছেলেটাকে পৃথিবীতে এনেছি, তাই ও আমার কাছে থাকবে। অন্যদিকে স্বামী শান্তভাবে বলল, আপনিই বলুন মেলর্ড, এটিএম মেশিনে টাকা জমা রেখেছি আমি। তাহলে টাকাটা কার? আমার না এটিএম মেশিনের।”
কয়েকজন বয়স্ক লোক অবুঝের মতো হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসেনি অনিমা, অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের দিকে। একটা পর্যায়ে মনে হলো, শুধুমাত্র তাকিয়ে থেকে কাজ হবে না। ছেলেটাকে শিক্ষা দিতে হবে, কঠিন এক শিক্ষা!
অনিমা প্রণয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “কী বললেন? আরেকবার বলুন!”
প্রণয় কিছুটা ভড়কে গিয়ে বলল, “কেন? আপনি শুনতে পাননি?”
“পেয়েছি, তবে হজম করতে পারিনি। এই আপনার মতো মানুষের কারণেই মেয়েরা আজ যথাযথ সন্মান পায় না। এতই যখন শখ, তখন টাকা নিজের কাছে রাখলেই হয়। এটিএম মেশিনে জমা রাখার প্রয়োজন কী?”
“দেখুন আপনি ভুল ভাবছেন। এটা শুধুমাত্র একটা জোক ছিল।”
“কই আমার কাছে তো জোক বলে মনে হয়নি। আপনি হাসতে হাসতে গোটা নারীসমাজকে অপমান করেছেন।”
“আমি কাউকে অপমান করিনি। আর তাছাড়া জোকটা তো আমি বানাইনি।”
“জোকটা আপনার না, তবুও এতগুলো মানুষের সামনে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন। এর অর্থ কি এই নয়, যে আপনি মেয়েদেরকে অপমান করাটা সমর্থন করেন?”
এই ছেলের সঙ্গে আর কথা বাড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। অনিমা রাগী ভঙ্গিতে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ধরেই নিয়েছিল, বাজে মানসিকতার ওই ছেলেটার সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না। তবে দেখাটা হয়েই গেল।
সেদিন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরীতে বই ঘাটাঘাটিতে মহাব্যস্ত অনিমা, চারপাশের তাকানোর বিন্দুমাত্র সময় নেই। তবুও মনের অজ্ঞাতে চোখ পড়েই গেল, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রণয়ের দিকে। অনিমার চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটা শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এল তার দিকে।
“ভালো আছেন?”
অনিমা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “হুঁ।”
“আপনাকে স্যরি না বলা পর্যন্ত, ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
“স্যরি বলতে হবে না। ওই ছোট্ট একটা শব্দ বললে তো আর আপনার মানসিকতা বদলাচ্ছে না!”
প্রণয় এবার গলার স্বর কিছুটা কঠিন করে বলল, “শুনুন! শুধু শুধু আমার মানসিকতার ওপর দোষ চাপাবেন না। ওই জোকটা আমি বানাইনি। আপনার বোন, তৃণা না তৃধা কী যেন নাম?”
“তৃষা?”
“হ্যাঁ, তৃষা! ওই তৃষাই আমাকে জোকটা শিখিয়ে দিয়েছিল।”
“কেন?”
“আপনাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুকনো গলায় প্রণয় বলল, “আসি হ্যাঁ?”
অনিমার জবাবের অপেক্ষা না করেই গড়গড় করে হেঁটে চলে গেল প্রণয়। যন্ত্রণায় পড়ল অনিমা। একটা কাজ করতে গেলেই বারবার মনে হয়, শুধু শুধু এতগুলো কথা শুনতে হলো মানুষটাকে। অসংখ্য রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় অনিমা। শুধুমাত্র একটি প্রহরের অপেক্ষায়, প্রণয়ের সঙ্গে তৃতীয়বার দেখা হওয়ার প্রহর।
শুধু তৃতীয়ই নয় - চতুর্থ,পঞ্চম,ষষ্ঠ,b প্রত্যেকবারই দেখা হয়ে গেছে কাকতালীয়ভাবে। পুরোপুরি কাকতালীয় বললে ভুল হবে, একদিন তো অনিমা নিজেই দাঁড়িয়ে ছিল প্রণয়দের বাড়ির বাইরে। উদ্দেশ্য, ছেলেটা বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র চমকে ওঠা। উৎফুল্ল গলায় বলা, “আরে আপনি? ভালো আছেন?”
রিকশা থেকে নেমে অনিমা লক্ষ করল, স্যার মাথা নিচু করে সিগারেট টানছেন। প্রণয়ের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে বুক ধুকপুক করে উঠলো অনিমার।
“প্রণয়?”
অনিমাকে দেখে অকারণেই আতকে উঠে প্রণয় বলল, “অনিমা! এসে গেছ?”
“দেরি করলাম না-কি?”
“না, না! আমিই তাড়াতাড়ি এসেছি।”
“তোমার গ্রামের সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। তুমি কেমন আছ?”
“ভালো আর থাকি কী করে? তোমাকে না দেখে কখনো কাটিয়েছি এতগুলো দিন? দেখো, তোমার দেওয়া শাড়িটা পড়েছি!”
“বাহ্, সুন্দর লাগছে।”
অনিমা লক্ষ করল প্রণয় একটু পরপরই ঘামছে, চিন্তায় তার গলা শুকিয়ে আসছে।
“তোমার কী হয়েছে প্রণয়?”
“কিছু হয়নি তো!”
“আমাকে মিথ্যা বলছো? তুমি খুব ভালো করেই জানো আমাকে মিথ্যা বলে কোনো লাভ হয় না। কী হয়েছে?”
“কিভাবে যে বলবো...”
“স্বাভাবিকভাবেই বলবে!”
“আচ্ছা অনিমা, আমাদের সম্পর্কের কত দিন হয়ে গেল?”
“তিন বছরের বেশি তো হবেই। কেন?”
“এই তিন বছরে আমরা কতটা বদলে গেছি তাই না?”
“তো?”
“তোমার কি কখনো মনে হয়নি আমরা একে অপরের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা?”
“কী?”
প্রণয় শান্তভাবে বলল, “আমাদের চিন্তাভাবনা এক ধরনের না, পছন্দ এক ধরনের না। তুমি পাহাড় পছন্দ করো, আমি
সমুদ্র। ছুটির দিনে তুমি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ কোরো আর আমি ঘরে থাকতে।”
“শুরু থেকেই তো জানো আমরা একে অপরের থেকে একটু আলাদা। কিন্তু সেটা জরুরী নয়, জরুরী হলো আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। তাই না?”
“অনিমা আমার মনে হচ্ছে না যে এ বিষয়টা জরুরী না। এখনের জন্য ঠিক আছে কিন্তু ভবিষ্যতে? তুমি পারবে এমন একটা মানুষের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে যে কি-না তোমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা?”
“তুমি পারবে?”
“এখানে আমার কথা আসছে কেন?”
“তাহলে আমার কথাও আসছে কেন?”
“কারণ আমার মনে হয়, আমি তোমার জন্যে পারফেক্ট নই।”
“হঠাৎই?”
“হঠাৎই না অনিমা। অনেক দিন ধরে ভাবছি ব্যাপারটা নিয়ে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আরও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো।”
“করতেই পারি। কিন্তু আমার তোমাকেই লাগবে। বুঝেছ?”
“অনিমা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আমার কাছে এই সম্পর্কটাকে ভিত্তিহীন বলে মনে হচ্ছে। সম্পর্কটার কোনো ভবিষ্যত নেই। আর তাছাড়া এই মুহূর্তে আমার কাজেও মন দেওয়া উচিত।”
“শুধুমাত্র কাজে মনোযোগ দেওয়ার জন্য আমাকে ছাড়তে চাইছো?”
প্রণয় বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ।”
অনিমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। যে প্রণয়কে নিয়ে সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে এতদিন, সেই প্রণয়ের কাছেই আজ এ সম্পর্ক ভিত্তিহীন?
“বেশ। আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করবো না, কোনো জোরাজুরিও করবো না। শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখবে?”
“কী?”
“একটা সত্যি কথা বলবে প্লিজ? আমি খুব ভালো করে জানি কাজে মনোযোগ দেওয়ার জন্যে তিন বছরের সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার মতো মানুষ তুমি নও। আসল কারণটা কী?”
প্রণয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই। সত্যিটা হলো, আমি একজনকে পছন্দ করি। মাসখানেক হলো আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ। তোমাকে বলতে চেয়েছি অনেকবার। কিন্তু...”
অনিমা স্তম্ভিত হয়ে বলল, “তাকে কি আমি চিনি?”
“ফারজানা।”
অনিমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। পালিয়ে যাওয়াটাই উচিত। তবুও অনিমা দাঁড়িয়ে রইলো, যদি প্রণয় বলে, “অনিমা ভয় পেও না তো, মজা করছিলাম!” - সেই আশায়।
তবে প্রণয় তা বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অনিমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে।
অনিমার এর পরের দিনগুলো কেটে গেলো বিষন্নতায়। লেখাপড়া করতে গেলে প্রণয়ের কথা মনে পড়ে, মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করতে গেলেও পড়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে গেলে তো সবথেকে বেশি পড়ে। প্রণয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া ওই আনন্দের মুহূর্তগুলো সারাজীবন শুধু স্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে, ভাবতেই যেন কেমন লাগে।
অনিমা নিজেকে একেবারে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে। বাইরে বের হলেই একেকজনের একেক রকম প্রশ্ন! সেদিন তার বান্ধবী মেঘলা এসেছিল। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করেছে, “প্রণয়কে দেখলাম আজ ফারজানার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে। তুই কিছু বলছিস না কেন?”। এদিকে আবার কাল রাতে অনিমার মা সুলতানা বেগম আন্তরিক গলায় বলে উঠলেন, “মা রে, গ্র্যাজুয়েশনের পর ভালো একটা দিন দেখে তোর আর প্রণয়ের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলি। এতদিনের চেনাজানা তোদের। তাছাড়া প্রণয়ের বাবা জুয়েল ভাই, কতো স্নেহ করেন তোকে। তোর কোনো আপত্তি নেই তো মা?”। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই অনিমার কাছে।
মেয়ের কষ্ট মায়ের চোখে ঠিকই হানা দিয়েছে। সুলতানা বেগম বহুবার লক্ষ করেছেন, দরজা বন্ধ করতে অনিমাকে কাঁদতে। অচেনা এই কান্নার কারণ জিজ্ঞেসও করতে চেয়েছেন বহুবার, কিন্তু পারেননি। জিজ্ঞাস করা মানেই মেয়েটাকে লজ্জা দেওয়া। কী দরকার! কয়েকটা দিন এভাবে চলুক, পরে এমনিতেই সব আগের মতো হয়ে যাবে।
দিন চলে যায়, কিন্তু অনিমা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে না। অদৃশ্য এক শক্তি ঘিরে রেখেছে তাকে।
মেয়ের এই অবস্থায় কোনো মা-ই পারেন না হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। তীব্র এই কষ্ট থেকে মেয়েকে মুক্ত করার জন্যে এক মেন্টাল কাউন্সিলরের খোঁজ করলেন সুলতানা বেগম। যে অনিমার কষ্ট পুরোপুরিভাবে কমিয়ে দিতে না পারলেও সমস্যার সমাধান করতে পারবে, আগের মতো স্বাভাবিক করে তুলতে পারবে।
কাউন্সিলিং নেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আপত্তি করলো না অনিমা। সত্যি কথা বলতে কী, মেয়েটা নিজেও চায় এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে।
কাউন্সিলর মহিলার নাম নওশাদ, বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। চেম্বারের চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে থাকার ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না অনিমার।
নওশাদ স্বাভাবিক গলায় বললেন, “আপনিই তাহলে অনিমা?”
অনিমা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
“যতদূর শুনেছি, আপনি না-কি প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন?”
“হুঁ।”
“তা কী নাম ছিল আপনার বন্ধুর?”
“প্রণয়।”
“বাহ্! নামের মধ্যেই তো একটা প্রেম প্রেম ব্যাপার! আপনার মতো বয়সে আমারও এক বন্ধু ছিল, আজিজুল। নাম শুনলেই যেন মনে হয় সরকারি ব্যাংকের কর্মচারী।”
“আপনি এভাবে বলছেন কেন? একটা মানুষকে তার নাম নিয়ে অপমান করা মোটেই উচিত নয়।”
“মিস অনিমা, আপনার বোধ হয় জোক বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। তাই না?”
অনিমা চুপ করে রইলো।
“তা এই প্রণয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয় কীভাবে?”
“এভাবেই। ও একটা জোক বলেছিল, আমি বুঝতে পারিনি। না বুঝেই অযথা রাগ দেখিয়েছি।”
“কী সর্বনাশ! দেখেছেন আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি!”
অনিমা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“আচ্ছা, সম্পর্কে ফাটল ধরলো কী করে?”
“আমরাই ক্লাসমেট ফারজানা। আমার কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিয়ে গেছে। একদিন হঠাৎ আমাকে ডেকে প্রণয় বলল, আমাদের এই সম্পর্ক না-কি ভিত্তিহীন।”
“তা ভিত্তিহীন সম্পর্কটা কতদিনের?”
“তিন বছর।”
“তিন বছর! সময়টা কিন্তু অল্প না। আপনার কি মনে হয়, একজন মানুষকে পুরোপুরিভাবে চেনার জন্যে সময়টুকু যথেষ্ট?”
“হুঁ।”
“তার মানে আপনি প্রণয়কে চিনতে পেরেছিলেন। তাহলে কখনো বুঝতে পারেননি কেন, যে একদিন সে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।”
অনিমা বিরক্ত গলায় বলল, “আপনি এসব প্রশ্ন আমাকে করছেন কেন? আপনার আজ আমার সমস্যাগুলোকে কমানো, বাড়িয়ে দেওয়া নয়।”
“তাইতো! দেখেছেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা এবার বলুন, ভালোবেসেছিলেন তাকে?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”
“প্রণয় আপনাকে বেসেছিল?”
“জানি না। মানে, ও কখনো আমাকে আই লাভ ইউ জাতীয় কথাবার্তা বলেনি। তবে ওর চোখে ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলাম।”
নওশাদ চুপ করে রইলেন।
“জানেন প্রণয় যদি আমার কাছে এসে বলতো, অনিমা আমাকে খুশি করার জন্য আগুনে ঝাঁপ দাও। বিশ্বাস করুন আমি হাসিমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কিন্তু ও কী করলো? আমার বেঁচে থাকাটা কঠিন করে দিয়ে চলে গেল। প্রণয়কে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
নওশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা যখন কোনো কিছু মুখস্ত করি, কিংবা কোনো বিশেষ বা সাধারণ ঘটনা আমাদের সঙ্গে ঘটে - তখন সেগুলো আমাদের মস্তিকে জমা থাকে। স্মৃতি কখনো আমাদের মস্তিক থেকে মুছে যেতে পারে না বা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। এখন আপনি বলতে পারেন, পরীক্ষার হলে তাহলে কেন মুখস্ত করা পড়াটা আমরা ভুলে যাই? পরীক্ষার হলে আসল মস্তিষ্ক এক ধরনের অসস্তিকর অবস্থায় থাকে, ভোঁতা এক দুশ্চিন্তা কাজ করে সেখানে। তাই মস্তিষ্ক আমাদের পড়া মনে করিয়ে দিতে পারে না। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আপনি যখন একটা মানুষকে মন থেকে ভালোবাসেন, তখন তাকে কোনোভাবেই সেখান থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। হ্যাঁ হয়তো ভালোবাসার পরিমাণ বাড়তে-কমতে পারে, কিন্তু তা কোনোদিনও ফুরিয়ে যাবে না। আজ আপনার বন্ধু অন্য একজনকে নিয়ে খুশি, তবে আপনার জন্যে তার ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। আমি নিশ্চিত, এখনও তার মনের কোনো এক ছোট্ট কোণায় আপনি বেঁচে আছেন। আমাদের মন আবার ওই কোণায় পড়ে থাকা ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে পারে না। মনের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে যার জন্যে ভালোবাসা, তাকেই প্রাধান্য দেয়।”
অনিমা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ্, আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।”
“কী করবো বলুন, এটাই আমার পেশা। আচ্ছা এখন আসল কথায় আসি, আপনি কী জানেন পৃথিবীর জনসংখ্যা কত?”
“সাত বিলিয়ন?”
“সাত বিলিয়ন, সাত’শ কোটি! এতগুলো মানুষ, তাদের এত এত আনন্দ, দুঃখ, রাগ, হিংসা, ভালোবাসা। একজনের সঙ্গে আরেকজনের জীবনের কোনো মিল নেই। সিনেমার পরিচালকেরা যদি একেকজনের জীবনী নিয়ে সিনেমা বানানোর প্রকল্প হাতে নেন, তবে পৃথিবীতে নতুন সাত’শ কোটি গল্পের সিনেমা আসবে। কিন্তু না! সেই একই গল্পকে নতুন নাম দিয়ে, নতুন রূপ দিয়ে বারবার সিনেমা বানাতে হবে। একজন সাধারণ মানুষের জীবনী নিয়ে সিনেমা বানানোটা অপ্রচলিত, তাই কেউ বানায় না। ঠিক তেমনি অনেক দিনের সম্পর্ক ভেঙে গেলে কষ্ট পাওয়াটা প্রচলিত। তাই সবাই কষ্ট পায়, আপনিও পাচ্ছেন।”
“তাহলে কী আমার আনন্দ করা উচিত?”
“না, তবে কষ্ট পাওয়াও উচিত নয়। আপনার বয়স এখন অনেক কম, কোনো পরিচালক যদি আপনার জীবনী নিয়ে সিনেমা বানাতে চায় তাহলে তাকে কমপক্ষে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই বছরগুলোতে অনেকগুলো ঘটনা আপনার সঙ্গে ঘটবে, প্রচুর মানুষ আসবে আপনর জীবনে।”
“আসুক, তবে আমি প্রণয় বাদে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।”
“ভালবাসাবাসি নিতান্তই মনের ব্যাপার। মন যে কখন চুপিসারে একটা মানুষকে ভালোবেসে ফেলবে, টেরও পাবেন না। তবুও যদি কাউকে ভালোবাসতে না পারেন, তাহলে প্রণয়ের মনের ছোট্ট একটা কোণে এখনো আপনার বসবাস এই ভেবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবেন।
অনিমা কিছুটা হেসে বলল, “থ্যাংক য়্যু!”
“ভালো লাগছে এখন?”
“অনেক!”
“এখনও কি মনে হচ্ছে, প্রণয়কে ছেড়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব?”
অনিমা হাসতে হাসতে না-সূচক মাথা নাড়ল।
Great story