অন্তর্মুখী (Introvert) মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
অন্তর্মুখীদের নিয়ে নানারকম ভুল বোঝাবোঝি রয়েছে।
একজন মানুষ আর পাঁচজনের মাঝে লজ্জা পাচ্ছে বলেই তাকে যেমন আমরা অন্তর্মুখী বলতে পারি না, তেমনি একজন শান্ত ও একা থাকতে পছন্দ করে এর মানে তাকে হতাশ ও বিধ্বস্ত বলতে পারি না।
অন্তর্মুখীরা কোনো এলিয়েন নয়, তারা আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ মানুষ।
চলুন অন্তর্মুখীদের সম্পর্কে আরও জানি :
১। অন্তর্মুখী ৪ ধরণের।
গবেষক জোনাথন চিকের মতে কেবল এক ধরণের অন্তর্মুখী হওয়া অসম্ভব। মোট চার ধরণের অন্তর্মুখী রয়েছে।
সামাজিক : আমরা সাধারণভাবে যাদেরকে অন্তর্মুখী হিসেবে ধরি এরাই হল মূলত সামাজিক অন্তর্মুখী। এরা দশ জনের দল থেকে দুজনের দল বা একদম একাকী কাজ করাকে বেশি পছন্দ করে। অনেকগুলো অপরিচিত মুখের সাথে পার্টিতে যাওয়ার বদলে এরা বাড়িতে একটা বই বা কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতে বা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করে। এটি লাজুকতা থেকে আলাদা কেননা এরা যে একাকিত্ব খুঁঁজে তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ থাকে না।
চিন্তাশীল : এধরনের ব্যক্তিরা নিজের চিন্তা ও অনুভূতির উপর খুব নজর রাখে। দারুণ কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতার সাথে এরা প্রায় দিবা-স্বপ্নশীল (daydreamer) হয়ে থাকে।
উদ্বিগ্ন : এরা একা থাকার জন্য সময় খুঁজে বেড়ায়, কেননা তারা প্রায় বিব্রতকর এবং আত্ম-সচেতন বোধ করে। নতুন লোকের আশেপাশে গেলে এরা যন্ত্রণাদায়ক লাজুকতা অনুভব করে। যখন একা থাকে তখনও এদের উদ্বেগ পিছু ছাড়ে না কেননা এরা কী হয়েছে বা কী ভুল হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একেবারে পচিয়ে ফেলে।
সংযত : এরা ধীর গতির হয় এবং কিছু বলা ও করার আগে ভাবতে পছন্দ করে। এরা চাপা স্বভাবের হয়ে থাকে। যেকোনো কিছু হতে দেয়ার আগে তারা সময় নেয়, কারণ তারা কোনো রকম প্ররোচনাকে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়াতে প্রভাব ফেলতে দেয় না।
২। অন্তর্মুখীরা নতুন কোনো তথ্যের প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়, কিন্তু এরা ফলাফল অনুধাবনের ক্ষেত্রে ধীর গতির হয়।
৩। অন্তর্মুখীরা ছোটখাটো আলাপকে ভয় পায়। তারা গভীর এবং অর্থবহ কথোপকথনকে বেশী পছন্দ করে।
৪। অন্তর্মুখীদের একা থাকার জন্য বেশি সময় প্রয়োজন হয়।
কার্ল জং ছিলেন প্রথম মনোবিজ্ঞানী যিনি "ইন্ট্রোট্রোভার্সন" এবং "এক্সট্রোভার্সন" শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
৫। অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখীরা তাদের স্নায়ুতন্ত্রের আলাদা আলাদা দিক ব্যবহার করে।
স্নায়ুতন্ত্রের দুটি দিক রয়েছে : সিমপ্যাথেটিক (সহানুভূতিশীল) এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক।
সিমপ্যাথেটিক দিকটা সক্রিয়, সাহসী এবং অনুসন্ধানী হয়। অন্যদিকে প্যারাসিমপ্যাথেটিক দিক বিশ্রাম, আরাম এবং গভীর ভাবে ভাবতে পছন্দ করে। অন্তর্মুখীরা প্যারাসিমপ্যাথেটিক দিকটাকে বেশী প্রশ্রয় দেয়।
৬। অন্তর্মুখীদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে গ্রে মেটার অনেক বেশী থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তত্ত্বগত চিন্তার জন্য দায়ী।
৭। আমাদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন অন্তর্মুখী।
৮। একা থাকতে পছন্দ করাটাই অন্তর্মুখীতার মূল বৈশিষ্ট্য নয়। একটি সমৃদ্ধ অন্তর্জগত (rich inner world) এবং একা সময় কাটানো উপভোগ করার জন্য একজনের বুদ্ধি এবং কল্পনার প্রয়োজন, কেবল অন্তর্মুখীতা নয়।
৯। অন্তর্মুখীরা অন্যের জুতোতে নিজেকে ভালোমত মানিয়ে নিতে পারে।
এরা অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারে এবং দরকারের সময় ঠিক হাজির হয়ে যায়। আপনি যদি এমন একজনকে খুঁজে নিতে পারেন তবে খুব সম্ভবত সেই হবে আপনার বেষ্ট কেয়ারটেকার।
১০। অন্তর্মুখীরা কাজের মাঝে কোনও ব্যাঘাত পছন্দ করে না।
কিছু অন্তর্মুখীরা খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বা মাঝ রাত অবধি জেগে থাকে - কোনও বাধা ছাড়াই কাজ করবে বলে।
একজন অন্তর্মুখীর স্বাস্থ্যকর কিছু বৈশিষ্ট্য :
সমৃদ্ধ অন্তর্জগত
প্রাণবন্ত কল্পনাশক্তি
কখনও বিরক্ত হয় না
কদাচিৎ একাকীত্ববোধ করে
গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা
নিজেদেরকে জানে
অন্যদের শান্ত হতে সহায়তা করে
সহানুভূতিশীল
স্বাধীন
১১। অন্তর্মুখীরা বহির্মুখী হতে পারে না।
যদি আপনার বাচ্চার মধ্যে অন্তর্মুখী হওয়ার লক্ষণ দেখা যায় এবং আপনি মনে করেন যে আপনি এটা বা ওটা করে তার স্বভাব পরিবর্তন করে তাকে বহির্মুখী বানাতে পারবেন তবে জেনে রাখুন - আপনি পারবেন না।
কেননা অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী হওয়া আমাদের ডিএনএ এর উপর নির্ভর করে এবং আমরা আমাদের ডিএনএ পরিবর্তন করতে পারি না (অন্ততপক্ষে এখনও পর্যন্ত)।
দয়া করে আপনার অন্তর্মুখী বাচ্চাকে জোর করে বহির্মুখী বানাতে যাবেন না। অন্তর্মুখীতা কখনোই খারাপ কিছু নয়, তাদেরকে বরং উৎসাহিত করুন, ভালো ভালো সামাজিক স্কিল শেখান।
১২। অন্তর্মুখীরা বহির্মুখীদের থেকে বেশী সতর্ক হয়। তারা খুব হিসেব-নিকেষ করে তবেই ঝুঁকি নেয়।
১৩। অন্তর্মুখীরা লজ্জাশীল নয় (সবাই নয়)।
আমরা প্রায়শই ভাবতে ভুল করি যে একজন মানুষ শান্ত, তার মানে সে লজ্জাশীল। কিন্তু আসলে তা নয়, তারা প্রকৃতিগতভাবে অমনই।
১৪। অন্তর্মুখীরা ভালো শ্রোতা হয়।
১৫। অন্তর্মুখীরা সারাক্ষণ একা থাকতে চায় না। খুব ঘনিষ্ঠদের সাথে তারাও দিনের কিছুটা সময় কাটাতে চায়।
১৬। অন্তর্মুখীদের বহির্মুখী হওয়ার ভান করাটা তাদের কর্মক্ষমতার উপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।
১৭। অন্তর্মুখীরা 'আউট অফ দ্যা বক্স' চিন্তা করে।
অন্তর্মুখীরা সমাজের রীতিনীতি মেনে চলার ধার ধারে না। তারা তাদের নিজস্ব নিয়ম বানিয়ে নিতেই পছন্দ করে। একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তির মন উদ্ভাবনী ধারণা বিকাশের একটি উর্বর ক্ষেত্র।
মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভ ওজনিয়াক বা বিল গেটসকে মনে পড়ে?
১৮। তারা দীর্ঘ সময় ধরে মনোনিবেশ করতে সক্ষম।
১৯। অন্তর্মুখীরাও মজা করে।
অন্তর্মুখীরা বহির্মুখীদের মতো পার্টি-ফার্টি পছন্দ করে না ঠিক, কিন্তু তারাও মজা করতে চায়।
২০। অন্তর্মুখীরা বহির্মুখীদের দ্বারা ইমপ্রেসড হয় না।
এটি সম্ভবত অন্তর্মুখী সম্পর্কে সবচেয়ে মজাদার ঘটনা!
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ আমির ইরেজের ২০১৪ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে অন্তর্মুখীরা তাদের বহির্মুখী প্রতিপক্ষকে সুনজরে দেখার সম্ভাবনা খুব কম।
অন্তর্মুখীরা বহির্মুখীদের পাওনা ক্রেডিট তো দিতেই চায় না, আরও বহির্মুখীদের খুব একটা পছন্দ করেনা।
কারণ?
অন্তর্মুখীরা খুব বেশি সংবেদনশীল উদ্দীপনা উপভোগ করে না। অনর্গল কথাবার্তা এবং সামাজিকতা (যেগুলো বহির্মুখীদের বড় শক্তি) তাদের বিরক্ত করে।
অ্যাগারোফোবিয়া (প্যানিক ডিসঅর্ডার) হচ্ছে এক ধরণের উদ্বিগ্নতাজনিত ডিসঅর্ডার, যার ফলে একজন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে নিজের জন্য অনিরাপদ ভাবে যেন সেখান থেকে তার নিস্তার নেই।
২১। অন্তর্মুখীরা অ্যাগারোফোবিক নয়।
অন্তর্মুখীরা শান্ত থাকে এবং একা থাকাটা উপভোগ করে এর অর্থ এই নয় যে তারা অগ্রোফোবিয়ায় ভুগছে। কিছু ব্যক্তি একইসাথে অন্তর্মুখী এবং অ্যাগ্রোফোবিক হতে পারে, কিন্তু একটা হলেই যে অন্যটা হবে এমন নয়।
২২। অন্তর্মুখীরা অভদ্র নয়।
যখন আপনি কোনো অন্তর্মুখীর সাথে সাক্ষাত করেন তখন তাকে শান্ত এবং চুপচাপ দেখতে পারেন এবং সে কী যে ভাবছে তা বোঝা মুশকিল। ফলে অন্যরা তাকে অভদ্র ভাবতে পারে।
কিন্তু এটাকে অভদ্রতা ভাবার পরিবর্তে, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে একজন অন্তর্মুখী আপনার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার আগে সে আপনাকে আরও ভালভাবে জানতে চায়।
২৩। নিজেকে খুঁজে পেতে অন্তর্মুখীদের একটু বেশী সময় প্রয়োজন হয়। তার অর্থ এই নয় যে তারা ক্ষুব্ধ বা হতাশ।
২৪। অন্তর্মুখীদের আত্ম-সম্মান কম নয়।
অন্তর্মুখী সম্পর্কে আরেকটি সাধারণ ভুল ধারণা হ'ল তারা শান্ত এবং সংযত থাকার কারণ তাদের আত্ম-সম্মান কম বা আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। কিন্তু এটা ঠিক নয়।
২৫। অন্তর্মুখীরা হতাশ নয় এবং তাদের মেরামত করারও দরকার নেই।
সাধারণত অন্তর্মুখীদের এমনভাবে দেখা হয় যেন তাদের হাতুড়ী মেরে মেরামত করা দরকার। একজন লজ্জা পাচ্ছে এর মানে এই নয় যে সে অন্তর্মুখী। একজন অন্তর্মুখীকে ভেঙেচুরে নতুন করে বহির্মুখী বানানোর কোনো দরকার নেই।
তারা যেমন আছে তেমনই সেরা।
They are awesome!
Thanks for sharing this. Please like comment and subscribe my article