মনুষ্যত্ব চর্চা

3 37
Avatar for Hossain
4 years ago

মানুষের ইতিহাস অনেক পুরনো। হাজার হাজার বছরের পথ পেরিয়ে আজকের অবস্থানে মানুষ। মানুষের এ পথ পরিক্রমা নিয়ে দু’ধরনের ভাষ্য রয়েছে।

একটি হচ্ছে, আদিম অসভ্য মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। অন্যটি হল ধর্মীয় ব্যাখ্যা। বিজ্ঞান বা ধর্ম যেটাই গ্রহণ করি না কেন; বর্তমানে ধর্ম ও বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষ যে কোনো বিবেচনায় সুসভ্য। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কে কতটুকু সত্যিকারের মানুষ!

এ নিবন্ধটি ল্যাপটপে টাইপ করছি। যে ল্যাপটপে লিখছি, তা দুটো বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ল্যাপটপ হিসেবে তখনই উপযোগী হবে; যখন তার দৃশ্যমান কাঠামোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা সাদৃশ্যপূর্ণ হবে।

একটা ল্যাপটপের দৃশ্যমান অংশের নাম হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর অদৃশ্য নির্দেশনা হচ্ছে সফটওয়্যার। অর্থাৎ ল্যাপটপের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার- এ দুটোর মধ্যে সমন্বয় না হলে এটাকে ল্যাপটপ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতাম না। সফটওয়্যার সঠিকভাবে কাজ না করলে হয়তো একসময় এটা ফেলে দেব, যেমন অতীতেও ফেলেছি।

মানুষের সঙ্গে কম্পিউটারের রয়েছে অনেক মিল। মানুষের রয়েছে সুন্দরতম অবয়ব, যা অনেকটা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মতো। অন্যদিকে মানুষের রয়েছে চিন্তাশক্তি। যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিতে মানুষ তার ভালোমন্দের জ্ঞান দিয়ে করণীয় বা বর্জনীয় ঠিক করে নেয়। মানুষের এ অদৃশ্য চিন্তাশক্তি হচ্ছে কম্পিউটারের সফটওয়্যারের মতো।

বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে পরিচিত একটি পরীক্ষার নাম হচ্ছে ‘লবণ টেস্ট’। পরীক্ষাগারে লবণকে শুকনো ও ভেজা টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুকনো টেস্টে সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পর বলা হয়, লবণটি প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

তারপর তাকে এসিডের মধ্যে দ্রবীভূত করে ভেজা টেস্টে চূড়ান্ত শর্ত পূরণ করতে হয়। দুটো শর্ত পূরণের পরই তাকে সোডিয়াম কিংবা অন্য কোনো লবণ হিসেবে রসায়নের ছাত্ররা স্বীকৃতি দেন।

যদিও একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে হলে দুটো পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা; তবুও মানুষের সৌভাগ্য যে, প্রাথমিক শর্ত পূরণ করলেই আমরা মানুষ হিসেবে ধরে নেই। একজন মানুষের প্রথম পরীক্ষা হচ্ছে তার আকৃতিগত। দ্বিতীয় পরীক্ষা হচ্ছে তার মনুষ্যত্বের।

অবিকল কম্পিউটারের মতো মানবিক গুণ বা মনুষ্যত্ব সঠিক মাত্রায় না থাকলে চেহারা মানুষের মতো হলেও কাজ উল্টাপাল্টা হয়; যেভাবে কম্পিউটারে ভুল সফটওয়্যার বা ভাইরাসযুক্ত সফটওয়্যার থাকলে সঠিকভাবে কম্পিউটার কাজ করে না। মানুষের প্রাথমিক শর্ত অর্থাৎ তার আকৃতিগত পরীক্ষা সবাই করতে পারে। কিন্তু সফটওয়্যার বা মনুষ্যত্বের পরীক্ষাটা অনেক জটিল।

বাইরের কেউ দ্বিতীয় পরীক্ষা করার চেয়ে প্রতিদিন সবাই নিজ নিজ মনুষ্যত্বের পরীক্ষাটা নিজের কাছে দিলে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়বে। সচেতনভাবে এসব বর্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে মানবিক গুণের বিকাশ হবে নিঃসন্দেহে।

আমরা সবাই জানি, মানুষকে মানুষ হতে হয় নিরন্তর চেষ্টার মধ্য দিয়ে। কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্য কিংবা নিজের মনুষ্যত্ব মাপার জন্য কী কী মানদণ্ড ব্যবহার করতে হবে, তা অনেকেই সচেতনভাবে চিন্তা করি না।

আসুন, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে দুটো পরীক্ষা করি। প্রথমেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছু সময় দেখেন। সত্যি বলতে কী, নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাবেন।

আপনি কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যে বয়সের নর-নারীই হোন না কেন, আপনার নিজের অবয়ব আপনাকে মুগ্ধ করবে। চোখ, কান, নাক, মুখ, মাথা সবই সঠিক অবস্থানে সঠিকভাবে দেখতে পাবেন। অন্য আরও দশজন মানুষের মতো আপনাকে মানুষই দেখবেন।

এবার আয়নার সামনে থেকে সরে চোখ বন্ধ করে আপনার বিবেককে মনের আয়নায় মেলে ধরে কিছু প্রশ্ন করতে থাকুন এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর মনের আয়নায় দেখতে থাকুন-

১. ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, দেশ ও জাতির ভিন্নতা সত্ত্বেও পৃথিবীর সব মানুষের অধিকারের প্রতি আপনার সম্মান আছে কিনা। আপনি নিজে যে অধিকারগুলো ভোগ করতে চান, সেগুলো অন্যের থাকুক। তা যদি না চেয়ে থাকেন, তাহলে ধরে নেন আপনার সংশোধন প্রয়োজন।

২. আপনার বন্ধু কিংবা শত্রু যে কোনো মানুষের ভালো অর্জনে দুঃখ পান কিনা? যদি অন্যের অর্জনে আপনি ব্যথিত হন, তাহলে আপনার মনুষ্যত্বের ঘাটতি রয়েছে।

৩. মজলুমের কষ্ট আপনাকে ব্যথিত করে কিনা, জালিমের বিরুদ্ধে আপনার মন দৃঢ় অবস্থান নেয় কিনা। যদি আপনি ব্যথিত না হন, জালিমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে মন সায় না দেয়, তাহলে নিশ্চিত হোন আপনার সমস্যা অনেক জটিল।

৪. আপনার প্রতিপক্ষ কিংবা আপনার শত্রুকে কেউ অন্যায্য ও অন্যায়ভাবে আঘাত করলে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে যদি আপনার মন খুশি হয়, তাহলে আপনার মনের চিকিৎসা জরুরি।

৫. আপনার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার কারণে আপনার প্রতিবেশীরা সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকলে আপনি ধরে নিতে পারেন, আপনার মানবিক গুণের ওপর হিংস্র পাশবিকতা জয় লাভ করেছে। মানুষ হতে হলে আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

৬. আপনার চারপাশের মানুষের কষ্ট লাঘবে সদিচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা আছে কিনা? যদি না থাকে তাহলে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন।

এভাবে দৈনন্দিন কাজের হিসাবও নিতে পারেন। যেমন- আজকে কারও উপকার করতে পেরেছেন কিনা; কারও ক্ষতির কারণ হননি নাই বা চিন্তা করেননি। মজলুমের কান্না আপনাকে ব্যথিত করেছে কিনা; কোনো জালিমকে সাহায্য করেননি- এসব প্রশ্নের উত্তর যদি মনের আয়নায় হ্যাঁ হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে ঘুমান। আর যদি কিছুটা গরমিল পান, তাহলে আগামীকাল থেকেই সংশোধনের শপথ নিয়ে ঘুমান।

সবশেষে সবার জন্য একটি কুইজ। যদি আপনার সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্য ছলে-বলে-কৌশলে কিংবা জোর-জবরদস্তি করে অর্থ উপার্জন করে ঘরে নিয়ে আসে, তাহলে আপনি কি খুশি হবেন? দুঃখজনক হলেও সত্য, কেউ কেউ খুশি না হলেও অনেকেই হবেন! কারণ অনেকেই গর্ব করে গল্প করেন- আমার ছেলে যা বেতন পায় তা একদম খরচ না করলেও চলে। উপরি টাকায় চলে যায়!

আরও একটু সামনে এগোলে মোটামুটি সবাই ধরা খেয়ে যাবেন। ধরুন, আপনার পছন্দের দল বা নেতা-নেত্রী ছলে-বলে-কৌশলে জোর-জবরদস্তি, খুন-গুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেল বা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করল, এতে কি আপনি খুশি? বাংলাদেশের হাতে গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় শতভাগ মানুষ এ প্রশ্নের উত্তরে আমতা-আমতা করবে।

মুখে যত যুক্তিই দেন না কেন, বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাস বলে- একেক সময় একেক দলের মানুষ স্ব-স্ব দলের এসব কুকর্মে আনন্দিত ছিলেন, আনন্দিত আছেন!

এ প্রশ্নের উত্তর মনুষ্যত্বের পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা, আপনারা নিজ দায়িত্বে বিবেচনা করতে পারেন। তবে অন্য উত্তরগুলো নিয়ে আমরা ভাবতে পারি এবং অনবরত নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারি।

নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে গেলে নতুন বছরে নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কার করতে কারও কষ্ট হবে না। অন্তত কারও উপকার করা না গেলেও, কারও ক্ষতির কারণ হব না- এটাই হোক আমাদের নতুন বছরের শপথ।

2
$ 0.05
$ 0.05 from @GreenOasis
Sponsors of Hossain
empty
empty
empty
Avatar for Hossain
4 years ago

Comments

সত্যিকার অর্থে বাস্তবতা এমনি।আমরা অনেক সময় এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পরি যা কারোও সাথে বলা যায় না।আমরা যাই করি নিমত্তের ভেতরে করবো।তখন সবকিছুই সহনীয় হয়ে উঠবে।

$ 0.00
4 years ago

মনুষ্যত্ব ছাড়া কেউই জীবনে সুন্দর ভাবে বেচে উটতে পারে না।মনুষ্যত্ব মানুষের জীবনের খুব বড় একটা অধ্যায়।যার ভিতরে মনুষ্যত্ব নেই সে কখনো নিজেকে মানুষ বলে দাবী করতে পার না।

$ 0.00
User's avatar Ahb
4 years ago

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা আর্টিকেল লিখেছো।আরোও ভালো কিছু আশা করছি।

$ 0.00
4 years ago